অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প(৫ম পর্ব) কলমেঃ সু ক ন্যা   দ ত্ত

সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প(৫ম পর্ব)

কলমেঃ সু ক ন্যা   দ ত্ত

 

 

গত পর্বে সোমালিয়ার লোকগল্পের কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। নর খাদক, WereHyena এর বন্যতা, হিংস্রতার পথ পেরিয়ে এবার প্রবেশ করবো সমাজের অভ্যন্তরে। নারী- পুরুষের সামাজিক স্থান, উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক সব নিয়েই সমাজের ভীত গড়ে ওঠে। এবার আসি প্রথম গল্পে

গল্প-১

বুদ্ধির বাটোয়ারাঃ
বুদ্ধির বাটোয়ারা

অনেক আগের কথা। একবার  ভগবান বুদ্ধি সৃষ্টি করলেন। তারপর তিনি সেটা একটা জলাশয়ে ফেলে দিলেন। এরপর  তিনি একজন নারী, একজন পুরুষ কিছু   বন্য পশু  এবং কিছু গৃহপালিত  পশু তৈরি করলেন। তাদের সকলকে ডেকে তিনি  বললেন,
”  বুদ্ধিগুলো  আমি জলে ফেলে দিয়েছি।  আমি চাই তোমরা সকলে সেগুলো  পান করো। তাহলে তোমাদের বুদ্ধি সৃষ্টি হবে।”
প্রথমে বন্য ও গবাদি পশুরা জলের কাছে গেলো কিন্তু তারা জলাশয়ের জল পান করলো না। জলের পাশ দিয়ে হেঁটে অন্যদিকে চলে গেলো। সারিবদ্ধভাবে  একে অপরের   গন্ধ শুকতে শুকতে এগিয়ে  গেলো। মনে করা হয়, এ কারণেই   আজ ও পশুরা বুদ্ধিহীন।  তবে তাদের ঘ্রাণ শক্তি প্রখর। 
এরপর এলো স্ত্রী লোকটি ।   জল খেয়ে সে  ঝড়ের বেগে জলাশয়ের পাশ থেকে   চলে গেলো ।  মনে করা হয়,  মহিলারা বুদ্ধিমতী হলে ও   দ্রুত  সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে সমস্যার সঠিক সমাধান করতে পারে না। 
সবার শেষে এলো পুরুষ।  বুদ্ধির জলাশয়  থেকে জলপানের পর সে তীরে   বসে ধ্যান করতে লাগলো। মনে করা হয়, এই কারণে পুরুষরা  বিবেচনা করে ধীরে স্থিরভাবে  সমস্যার  সমাধান করতে পারে।

গল্প বিশ্লেষণঃ

সোমালিয়ার এই গল্পে  কৌতুকের ছলে   নারী পুরষের লিঙ্গগত বৈষম্য তুলে ধরা হয়েছে। পুরুষ কে নারী অপেক্ষা   বুদ্ধিমান হিসেবে অঙ্কিত করে নারী পুরুষের সামাজিক ভেদাভেদ দেখানো হয়েছে।   এ জাতীয় গল্পের স্রষ্টা সম্ভবত কোনো পুরুষ।  পুরুষ জাতির সামাজিক অবস্থানকে  নারীর তুলনায় দৃঢ় করার মানসিক সূক্ষ্মতার  প্রকাশ ঘটেছে। একবিংশ শতকে এসে ও  এই  ধারণা বাস্তব সমাজে আজ ও  প্রোথিত। 

এবার আসি পরবর্তী গল্পে। 

★গল্প-২
বিবাহ বিচ্ছেদ
বিবাহ বিচ্ছেদ

বহু কাল আগের কথা। একজন  লোক, সুন্দরী একটি মেয়েকে বিয়ে করলো কিন্তু বিয়ের পরদিনই সে তার স্ত্রী কে বিবাহ বিচ্ছেদ দিয়ে দিলো। এই ঘটনার কারণ জানার জন্য  এক মহিলা  প্রতিবেশী মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো,
” তোমার স্বামী তোমায় বিবাহ বিচ্ছেদ দিলো কেন? তোমাদের মধ্যে কী কোনো সমস্যা হয়েছে?”
মেয়েটি উত্তরে বলল,
”  আমি বিন্দু বিসর্গ কিছুই জানি না।গতকাল রাতে আমার স্বামীর  সঙ্গে আমার একটা কথা ও হয়নি। আমি কোনোভাবেই কারণ অনুসন্ধান করতে পারছি না।”
এরপর লোকটিকে ওই একই প্রশ্ন করায় লোকটা উত্তর দিলো,
” আমি পাঁচটা কারণে ওকে বিচ্ছেদ দিয়েছি।
 সে সব বিষয়  অবহেলা করে, সে অপয়া, অমিতব্যয়ী, অধৈর্য্য এবং অল্পেই শাপশাপান্ত করে।”
প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি এক রাতে কীভাবে এসব বুঝতে পারলে?”
লোকটি উত্তরে বলল,
” গত কাল রাতে ঘরে ঢোকার আগে আমি 
ইচ্ছাকৃত জুতো জোড়া বাইরে রেখেছিলাম কিন্তু আমার স্ত্রী সেটা দেখে ও  ঘরের ভিতর আনেনি। তখন আমি বুঝতে পারলাম সে কাজের বিষয়ে  একেবারেই যত্নশীল নয়। কাজকর্মে সে  যথেষ্ট অবহেলা করে। সেদিন রাতে  জুতো চুরি হওয়ায় বুঝতে পারলাম সে ভীষণ   অপয়া। এরপর খাবার তৈরির জন্য উনুনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত   জ্বালানী   কাঠ দেওয়ায় বুঝতে পারলাম আমার স্ত্রী  একেবারেই  সাশ্রয়ী নয়। আগুন জ্বলার  অপেক্ষা না সে  করে বার বার কাঠে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছিলো। এ থেকে অনুমিত , তার  ভিতর ধৈর্যের অভাব রয়েছে।  উনুনে আগুন  না ধরায় সে কাঠের দিকে তাকিয়ে  অভিশাপ দিয়ে বলছিলো,
” আগুন না জ্বললে সব কাঠ বন্যা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।” 
“আমার বুঝতে বাকী রইলো না, সে সামান্যতেই শাপশাপান্ত করে। তাই তাকে ত্যাগ করলাম।” 

গল্পের বিশ্লেষণঃ

 এই গল্পে সমাজে নারীদের  তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ইঙ্গিত রয়েছে। পুরুষ তার নিজস্ব ধারণায় নারীমূর্তি আঁকতে চায়।  “So called  percent ” না হলেই সাংসারিক জীবনে নারী হয়ে ওঠে নিস্প্রয়োজন। বিবাহিত জীবনে ভালোবাসার পরিবর্তে প্রয়োজনীয়তা, কাজের তৎপরতা প্রধান হয়ে ওঠে। ব্যক্তির বদলে  বস্তু হিসেবে নারীর পরিচয় নির্ধারিত হয়।

এবার  তৃতীয় গল্পে

★গল্প-৩
কাকের রঙ কালো হলো
কাকের রং কালো হল

সোমালিয়া দেশে  এক সময় কাক ছিলো ধর্ম গুরু। তার গায়ের রঙ ছিলো ধবধবে সাদা। পক্ষী সমাজে অন্যান্য পাখীরা তার প্রতি বিরক্ত ছিলো। কাক সর্বভূক। একদিন সকল পাখী কাকের কাছে এসে বলল,
” তুমি আমাদের  সমাজের ধর্মগুরু ।  অথচ তুমি এত ভোগী কেন? ফল, মাংস সবেতেই তোমার দখলদারি ঠিক নয়। আমরা সকলেই ক্ষুধার্ত। নিয়ম অনুযায়ী ছোটো পাখিরা মাংস খায়  আর বড়ো পাখিদের বরাদ্দ ফল।  তুমি নিয়ম বর্হিভূত আচরণ করছে।”
এদেশের  দেশের  সংস্কৃতিতে কাক হলো সূর্য দেবতা ওয়াক এর দূত। তাদের বিশ্বাস, কাকের মুখ থেকে সূর্যদেবের বানী নিঃসৃত হয়। সব পাখিরা যখন প্রতিবাদে সামিল তখন কাক ” ওয়াক”  বলে চিৎকার করে ওঠে। অহংকারীর ছল চাতুরী সব সময় খাটে না। কাকের ও সেই দশা হয়। সূর্যদেবেতার অভিশাপে কাক পুড়ে কালো হয়ে যায়।

বিশ্লেষণ

বিভিন্ন পুরান ও উপজাতিগত গল্পে কাকের ভূমিকাকে বাদ দেওয়া যায় না। পুরাণে দেখা যায় দশ মহাবিদ্যার ধূমাবতীর রথের সারথি  কাক। নর্স পুরাণে অডিন এর দুই কাক হলো হুগিন( thought)  ও মুনিন( memory) । এরা সারা পৃথিবী ঘুরে অডিনের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করে। হিন্দু ধর্ম অনুসারে মনে করা হয়, শ্রাদ্ধের সময় মৃত পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে  কাককে খাওয়ানো হয়।   মৃতলোক ও ইহলোকের যোগাযোগকারী হলো কাক।  এই পাখি মনুষ্য জাতির অশ্রুত ধ্বনি গ্রহণে সক্ষম। এমনকি এ ও মনে করা হয়, কাকের ডাক অশুভ ইঙ্গিতবহ। 

★গল্প-৪
ক্যালাবাস শিশু
ক্যালাবাস শিশু

বহুকাল আগে সিন্ডো পাহাড়ের পাদদেশে একজন মহিলা বাস করতো। স্বামীর মৃত্যুর পর একাকী বাস করা মহিলা ছিলো  নিঃসন্তান। সকালে উঠে ঘর পরিস্কার, নদী থেকে জল আনা, মুরগী পালন, জামাকাপড় কাচা, কাঠ কাটা, রান্না এসব করার পর  ক্লান্ত হয়ে যেতো। অসহায় মহিলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলত,
” হে ঈশ্বর, আমায় সকল পরিশ্রম থেকে রক্ষা কর। 
 আমার যে সাহায্য করার কেউ নেই।”
একদিন মহিলা যখন চাষের জমিতে কাজ করছে তখন তার সামনে এসে দাঁড়াল এক দীর্ঘাঙ্গী পুরুষ।  সে মহিলা কে বলল,
” আমি সর্ব মহানের দূত। এই নাও ক্যালাবাসের ( আফ্রিকার একজাতীয় সব্জি, অনেকটা লাউয়ের মতো) বীজ। এগুলো বপন করো। গাছ হলে সেগুলোর যত্ন নিও। তোমার প্রার্থনার জবাব পেয়ে যাবে।”
মহিলা দ্বিধান্বিত হলে ও দূত এর কথা মতো কাজ করলো।  এক সপ্তাহ পর সেই বীজ থেকে গাছ জন্ম নিয়ে লতিয়ে কুঁড়ে ঘরের চাল  স্পর্শ করলো। মহিলাটি  ফলন্ত ক্যালাবাসগুলো  ঘরে এনে ভিতরের আঁশ বের করে ঘরের চালে রোদে  শুকোতে দিলো। কেবল একটি  ক্যালাবাস উনুনের পাশে রেখে দিলো, যাতে আগুনের তাপে  দ্রুত শুকনো হয়ে যায়। পরদিন সিন্ডো ক্ষেতে যাওয়ার পর ওর ঘরে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটলো। এক একটা ক্যালাবাসের হাত, পা, মাথা গজিয়ে কন্যা শিশুর রূপ নিলো। উনুনের পাশের ক্যালাবাস ছোটো একটি ছেলের আকার ধারণ করলো। তবে সে অন্যান্যদের তুলনায় একটু দূর্বল।  সকলে মিলে ঘরের সব কাজ করা শুরু করলো। কাজ শেষে যে যার মতো ক্যালাবাসে পরিণত হলো। সিন্ডো ঘরে ফিরে দেখলো, ঘর দুয়ার ঝকঝক তকতক করছে। সে অবাক হয়ে গেলো কিন্তু কিছুতেই এর রহস্য উদঘাটন করতে পারলো না। পরের দিন সিন্ডো কাজে যাওয়ার নাম করে আড়াল থেকে সব কিছু লক্ষ্য করতে লাগলো।  ক্যালাবাস শিশুরা যখন কাজে ব্যস্ত তখন সিন্ডো আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসলো। ক্যালাবাস শিশুরা লুকোনোর সময় না পেয়ে সিন্ডোর সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। পরদিন  থেকে সকল শিশুরা সিন্ডোর কাজে সাহায্য করতে লাগলো। তবে  ছেলেটির  শারীরিক দূর্বলতার কারণে ততখানি দক্ষ নয়। সিন্ডো মনে মনে রোজ ছেলেটার  বিরক্ত হতে লাগলো। একদিন সে ছেলেটির অক্ষমতা নিয়ে তিরস্কার  বলল। এর ফলে সব ক্যালাবাস শিশুরা রাগ করে পুনরায় ক্যালাবাসের রূপে ফিরে গেলো। সিন্ডো নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার সকলের উদ্দেশ্যে ক্ষমা চাইলো। পুনরায় কন্যা ও পুত্ররা মানুষের রূপে ফিরে আসলো। অতঃপর তারা সকলে সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগলো।

বিশ্লেষণঃ

‌তানজানিয়ার এই গল্পটি ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ।  ক্যালাবাস থেকে শিশুর রূপধারণকে  আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে   টেস্ট টিউব বেবি জন্মের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। সব কয়টি ক্যালাবাস শিশুর মধ্যে  আগুনের পাশে রাখা ক্যালাবাস ছেলেটির   শারীরিক অক্ষমতাকে বিশ্লেষণ করলে দুটি দিক উঠে আসে। টেস্ট টিউব বেবি জন্মের পদ্ধতিতে কিছু সময় দূর্বল শুক্রানু ও ডিম্বানুর মিলনে শারীরিক প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম হয়।  গল্পে ক্যালাবাসটিকে  অন্য জায়গায় রাখা হয়েছিলো। স্থানান্তরে অন্যান্য শিশুর তুলনায় ছেলেটিকে  অক্ষমভাবে চিত্রিত হয়েছে।  বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় ভ্রুণের বেঠিক  অবস্থানের কারণে অসুস্থ সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করা যায় না। আবার ভেবে দেখুন অন্তঃসত্ত্বাকালে মায়ের অযত্ন, আগুনের তাপের ফলে অসুস্থ সন্তান জন্ম লাভ করে। গল্পে ক্যালাবাস ছেলেটি মাতৃগর্ভে অযত্নকালীন সময়ের  ফলাফল হওয়াও   যুক্তিযুক্ত। আগুনের পাশে রাখা ক্যালাবাস থেকে জন্মলাভ করা ছেলেটি ব্যতীত  প্রত্যেকে কন্যা সন্তান। চিরাচরিতভাবে দেখা যায়, মেয়েরা গৃহকর্মে  ছেলেদের তুলনায়   দক্ষ। মেয়েদের সাথে তাল মিলিয়ে গৃহকর্মে নিপুণ না হওয়ায় পুত্র সন্তানকে দূর্বলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে চিরাচরিত সমাজ ব্যবস্থা উঠে  এসেছে। 

আফ্রিকার পূর্বাংশে যবনিকা পতনের  পর এবার যাবো পশ্চিম অংশে। পূর্ব এবং পশ্চিম দিকের ভৌগোলিক পার্থক্যের সাথে লোকগল্পের পরিবর্তন ধীরে ধীরে উন্মোচিত করবো।

অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্পগুলির আগের পর্ব পড়তে হলে নিচের লিংক ক্লিক করুন

অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প(পর্ব-৪) কলমেঃ সু ক ন্যা দ ত্ত

অলৌকিক আলোক-ধারার লোককথা(পর্ব-৩)–কলমেঃ সু ক ন্যা   দ ত্ত

অলৌকিক আলোকধারার লোককথা(পর্ব-দুই) কলমেঃ সুকন্যা দত্ত

অলৌকিক আলোকের ধারায় লোককথাঃ লিখছেন–সুকন্যা দত্ত

 

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *