রিমা দাসমুন্সী-র একগুচ্ছ কবিতা

রিমা দাসমুন্সী-র একগুচ্ছ কবিতা

কবি পরিচিতি -জন্ম -১৭ই জুন, ১৯৯২
বেহালা (দক্ষিণ কলিকাতা )। তাঁর শৈশব কেটেছে দক্ষিণ কলিকাতাতেই। বর্তমানে ব্যারাকপুর(উত্তর কলিকাতা)-র বাসিন্দা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক। পরে অবশ্য পড়াশুনোর গণ্ডী পেরোতে পেরোতে ‘কবি সম্মেলন’, ‘তত্ত্বমসি’, ‘উড়িধান’, ‘কলেজ স্ট্রীট’, ‘পান্থপিয়াস’, ‘বিকল্প নির্মাণ’ ইত্যাদির মত অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশিত হয়। নেশা -বই পড়া, আঁকা, গান শোনা। আজ বাইফোকালিজম্-র পাতা তাঁরই কিছু কবিতা নিয়ে সেজে উঠল।

ঝরাপাত

যন্ত্রণার আঁচে স্যাকা রুটি
আর দুঃখের আগুনে ভাত
পিঁড়ি পেতে বসে থাকা এক মূর্তিমতী বিষাদ,
যার মুখের প্রতিটি বলিরেখার গল্পই আমার চেনা।
তবুও বিনষ্ট সভ্যতার মাটিচাপা মৌণ ইতিহাস হয়েও তার চোখে এখনও কত স্বপ্ন,
এগিয়ে যাওয়ার…
একলা এগোনোর।
পারবে কি এগোতে সে নাকি ঝরে যাবে বিষন্ন শীতরাতের
ঝরাপাতার মত নিঃশব্দে?

অবাধ্যতার ডাক

অবাধ্য ডাক বুনছে আমার শীতের দিনের সোয়েটার,
মাফলারে পুঞ্জিভূত অভিমান দূরের আকাশ ছুঁলো।
তরঙ্গাবয়ব স্পর্শ অবাধ্য সমুদ্রও ফিরিয়ে দেয়
শৈশব বিজড়িত স্মৃতি।
চুক্তিবদ্ধ পাখি মেঘ ভুলে এঁকে দিয়ে যায় উল্কাবৃষ্টি,
তুফান তোলা জীবন অশ্বখুরে বিষাদ বিস্মৃতিতে এগিয়ে যায় নিজের অজ্ঞাত দোষে
ভালোবাসার জন্য।
যে সকালেও সকাল হয়না,
বাধ্যতামূলক শব্দটি সেখানে সংজ্ঞাহীন এক অধ্যায়।

প্রিয় মানুষ

বিকেলে বন্ধ জানালার মধ্যে দিয়ে আজকাল অসময়ে ধূলোঝড় আসে
রক্তে বেজে ওঠে ব্যঞ্জনধণি
চোখ বুজে থাকি ভয়ে,
ধূলো ঢোকার ভয়ে
যে ভয়ের মধ্যে দেখি মারনোৎসব
মৃত চারাগাছের মধ্যে চেনা মুখের অচেনা মুখোশ
ফ্যানে ঝুলছে, বাক্সভর্তি কাটালাশ, নালাভরা শবদেহ।
যে ঝড়ে কাছের মানুষ বহু দূরে সরে যায়, অপ্রাকৃতিক ধুলিঝড়
তীব্র পর্বত ফাটানো চিৎকার
ভেঙে যাওয়া ঘরের চৌকাঠ
ভুলে গেছে সময় দেখতে,
অসময়ের ঘোলা জল ঢুকেছে ঘরেতে।

গ্রন্থাগার

বিশালাকায় এক লাইব্রেরী
মৃত্যু সেখানে জীবন্ত,
কফিনের মধ্যে এক চিলতে রোদে ছড়ানো শরীর ঘুমিয়ে আছে এখনো উষ্ণ ঠোঁটে
তাঁর ব্ল্যাককফির স্বাদ
শীতের সকালকেও যেন হার মানায়।
পড়ে থাকা প্রাচীন ধূলো স্পর্শ করেছে বহু শতাব্দীর ইতিহাস।
অস্থায়ী এখন সে সব।
সবশেষে জানলাও উত্তর চায়
পড়ন্ত বিকেলের সূর্যাস্তে
ঘনিয়ে আসে রাত্রি,
যে রাত্রি নতুন ভোরের সূর্যোদয়ের গল্প বলে।
বলে, ইচ্ছামৃত্যুও অনেকসময়
আত্মসম্মানের হয়।
লাইব্রেরীর পূর্বদিকের শেলফ-এ বসে একা ভাবি
যুক্তির সত্যতা একদম ঠিক।

প্রতিশ্রুতি

আবার যদি ফিরতে চাই এই বারান্দাতে
রোদ্দুর পাবো তো?
এই বাগানকুঠি ছেড়ে তোমার ঐ মনের ইচ্ছেগাছটি দেবে তো আমায় ছায়া?
পথ অনন্ত, বাগান সীমাহীন
এতগুলো থামবন্ধনী যা অদেখা,
এত ফুল ফল এত আমি -তোমার একগুচ্ছ চোখে অধরা
এত খরগোশ
এ বাগানের পেয়ারা গাছের গর্তের অন্তরালে, পায়রাগুলো খই ওড়ায় এ বাড়ির ছাদে।
মনের গাছের ছাউনি থেকে তুমি জানবে না এসব, জানতেও পারবে না এরা দাঁড়িয়ে শেষবেলাতে,
সবকিছু ছেড়ে দিনরাত একা পথ চলে নতুন পথের খোঁজে।
সেই পথ কি আমায় ছায়া দেবে?

উন্মুক্ত

সন্ধ্যার ফুটপাতে পাশ কেটেছে এক অদ্ভুত পুরুষ,
ঝাপসা কাচের মতো ফুটপাত স্পর্শ করেছে ছোটো শহরের মৃদু হ্যারিকেনের আলোকে,
যে আলো সান্ধ্যবেলার প্রতীক।
কারো শরীর স্পর্শ করার আকর্ষণের চেয়ে আমার দু-হাতের করতলে আবদ্ধ উষ্ণ হৃৎপিন্ডের পৃষ্ঠা উল্টে চেষ্টা করি পড়তে।
স্নানঘরে গিয়েও দেখি
সব মানুষই আসলে সদৃশ।
বিকল্প কল্পনা শুধুই মনে
আমাদের বিরাজমান।
কোনো এক বৃদ্ধাকে দেখে আমার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত আমার নিজের আম্মার কথা মনে পড়ে গেল, মনে পড়ে গেল সেই ‘ঠাকুমার ঝুলি’র রূপকথার গল্প।
যে দীর্ঘ প্রবাহিত নদীতীরে বসে কবিতা লেখা পাতা নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে পিছন থেকে মনে হল,
ভেসে যাচ্ছে সে লেখা অলকানন্দা জলে,
সাথে কি ভাসছে আমার মনও?
পিছন থেকে দেখছি আর মনে হচ্ছে নদী আমাকে প্রশ্ন করছে ‘বিরক্ত হলে বুঝি?’

আবহাওয়া

এক স্কুলবালিকা দু-হাত লম্বা করে আকাশের মেঘকে ধরতে গিয়েও ছুটে গেল সন্ন্যাসীর দিকে,
যেমন করে আঠারো বছর বয়স হাতে তুলে নিয়েছিল পুরাতন বন্দুক।
ব্যক্তিত্বের মুকুরে ধরা পড়ে
কোনো একজনের আলগোছ,
বিকেলের শিশুপাঠ্য বই ভেজে সন্ধ্যার শিশিরে।
সন্ধ্যার নির্জনতায় ভীত
শৈশবের শিশু আম্রমুকুল
দিনশেষের শীতল কফিন থেকেও বেরিয়ে আসে ঈষদ উষ্ণ চা, যে চায়ের স্বাদেও বিষন্নতা,
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি স্পর্শ করতে পারেনা স্কুলবালিকাকে।
জল লেগে আচমকা ফেটে যাওয়া হ্যারিকেনের কাচের মতো চোখ কি খুঁজবে স্কুলবালিকার চোখ?
অজানা স্পর্শে নিজেকে বড্ড
ক্লান্ত বিপন্ন লাগে।