পথের লেখা গদ্যে “জয় বিষহরি গো”(দশ) কলমে-যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা

পরিচিতিঃ পূর্ব বর্ধমানের প্রত্যন্ত গাঁয়ের ধুলোমাটিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর। পায়ের তলার সরষেকে গড়িয়ে যেতে না দিয়ে জোর করে পিষে ফেলে ঘরে আটকে থাকা। কলমের কাছে মুক্তি চেয়ে নিয়েছিলেন। প্রকাশিত কবিতার বই কয়েকটি। একটি গদ্যের। এখন গদ্য দ্বিতীয় প্রেম। কৃৃৃৃষ্ণা, যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা ছদ্মনামেও লেখেন
পথের লেখা

কলমেঃযা জ্ঞ সে নী  গু প্ত  কৃ ষ্ণা

★জয় বিষহরি গো(দশ)

গরমের দিনে দুর্বাসা সূর্য মাঝ আকাশের দিকে সব পোড়াতে পোড়াতে। কোমড়ে গামছা বেঁধে একটা কাস্তে নিয়ে তেঁতুল ডাল ভাঙবে শিবি। জ্বালানি নেই ঘরে, চালও নেই। তার রাগ সূর্যের থেকে কম নয়। গাছে উঠে শুকনো, কাঁচা ডাল ভেঙে নীচে ফেলছে।
ধবধবে সাদা থানের বুড়ি হাঁকড় ছাড়ে, আর ডাল ভাঙিসনি। নীচে নাম, এখনি নাম বলছি!
অচেনা বুড়ি। দেখলো সে বুড়ি ঘোষ পুকুরের উঁচু পাড় থেকে সিঁড়ি দিয়ে পুকুরে নামছে। অনেকগুলো জ্বালনও হয়ে গেছে। শিবি তুড়ুক পা। জলদ হাতপায়ে ডালপালার আড়াল ছেড়ে নীচের দিকে এসে লাফ মারে। গামছায় ডালগুলো বাঁধছে। হঠাৎ উপরের দিক থেকে কেউ শিস দিয়ে তাকাতে বলছে। তাকালো। একটা ফনা মেলা গোখরো! যেখান দিয়ে সে নেমেছে সেখান দিয়ে মাথা নামিয়ে ডাল পেঁচিয় – নামছে নাকি?
কোনোক্রমে গামছায় জ্বালন নিয়ে দৌড়। জয় মা, মনসা, ক্ষমা করো মা। জয় মা বিষহরি। ক্ষমা করো – ক্ষমা করো –!
ঘাটে উঁকি মারে। বুড়ি তো নেই, কোথাও নেই! খুব উঁচু পাড়। এত তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে পারে না। মাঠের চতুর্দিকে তাকায়। নেই – নেই। এ ছলনা। অন্নদার যেমন সেঁউতিতে লাল পদ্ম ফোটানো!
ও মা বিষহরি! জয় মা বিষহরি! পাপ নিও না, মা!
দৌড়োয়, আর পুরাণ লকলকায়।

(এগারো) বাঁশবনের জাফরি
রাস্তা যেন শ্বেত চন্দনগুঁড়ো। চন্দন পায়ে রাস্তা পেরোলেই একটা দ্বীপবাড়ি। খোলা উঠোনের পর ডোবা। ডোবায় যত রাজ্যের ব্যাঙ-ব্যাঙাচি। ডিঙিমারা যত মশার রাজপাটের সঙ্গে দিনের বেলাও ঝিঁঝিঁর ডাক যেন মিলে সুর মেরা তুমহারা-র সঙ্গত। চারপাশে প্যাঁটারি , সেঁয়াকুল আর ঝাঁটিফুলের গাছ। বাঁশবনের মাঝখান দিয়ে সরু পায়ে চলা রাস্তা চলে গেছে অনন্ত বা নরকদ্বার। তবে সেদিক থেকে কুটুম-কুটুম হাওয়া আসে। খোলা পৃথিবীর খবর বলতে ওটুকুই। সেখান দিয়ে সুদূর আলোবছর পরে পরে গরু-ছাগল নিয়ে কারও আাসা যাওয়া।
দুদিক থেকে বাঁশগাছ এ ওর উপর ঢলিয়ে তৈরী একটা সুড়ঙ্গের মতো। ঠান্ডা ঠান্ডা ছায়াচ্ছন্ন সে পথে রোদ উঁকিঝুঁকি মেরে জাফরি তৈরী করেছে। এত ফটফটে উঠোন সে বাড়ির যে, তার ছটা এসে জ্যোৎস্নাতেও জাফরির কাজ। তুমি মন্ত্রমুগ্ধ হবেই।
সেখানে আস্তানা সরল পাগলের। সে পাগল গুনগুন গান করে একার মনে। অন্য মানুষের উপস্থিতিতে নিশ্চুপ। ওই বাড়ির লোকটা তাকে খাবারের ভাগ দেয়। বৃষ্টিতে তার খোলা দুয়ারে আসর জাগন ডাক। জগত সংসারের সঙ্গে তার এটুকুই সম্পর্ক।
আলো হাওয়ার চোখবন্ধ আলিঙ্গন আর অল্প অল্প দুলুনি মাটিতে মায়া হরিণের মায়াকাজল যেন। সেও খুব একা একা, খুব চুপিচুপি, যেমন আগন্তুক সরল পাগল।

(বারো) রুপোর কাঁটা গলার কাঁটা
বইএর ভেতর সাক্ষাৎ আমন্ত্রণ। লজেন্সের লোভে সে বই পৌঁছে দেওয়া পাড়ার কাকুকে। শত্তুরের বাড়িতে মেয়ে দেবে না, তাই দরজায় শেকল দেয় মেয়েকে ঘরে রেখে। ব্যথায় লাল হয়ে আকাশে আকাশে সকাল-সন্ধ্যে। ঝমঝম করা রাতে তারা খসা দুটো জানলা। জানলা দুটোয় অশ্রুত গান বেজে উঠতে পারে এমন ভাব – তোমায় গান শোনাবো তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো…
আরও লজেন্সের লোভ, ছবির বইএর লোভ দরজা খুলে দিলো। লায়লা-মজনু রাত ভোর সরষে খেতে জিনপরীর মতো ঘুরেফিরে ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়লো।
আগের দিনের আনন্দ বাজারে কোনো দরকারী খবর সন্ধানে বাড়ি দুললো ঢেউএর তালে। কাগজ না পেয়ে বড়ো দাদা গা-ভর্তি আগুন নিয়ে মাঠে গেছে তদারকিতে।
বাড়ি এলো হারানো প্রাপ্ত হয়ে, উপরি দুটো রুপোর কাঁটা। হলুদ বনে পিরীত বাসর হয়েছিলো, চেনা কাঁটা গলার কাঁটা হলো। সব পক্ষেই। দুটো বন্ধ জানলায় তারাখসার বিরাম থাকলো না আজীবন।
ফতুর হয়ে গেলেও যেমন নিয়ম তামিল করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কথা বলার সাহস থাকে না যে! নিজেদেরও কিছু সংগুপ্ত স্বার্থ ।

(তেরো) ধুলধুলে ছেঁড়া পথ
ওই চলে যাচ্ছে আলে আলে। বেভুল। যেদিক পা যায় সেদিকেই। পিঠে রোদ জল খিদে ভয়। দমাদ্দম দমাদ্দম। ওই শোনা যাচ্ছে। কান পেতো না, বুক পাতলে শোনা যাবে মারের শব্দ। তাই দিগন্ত ধরে পালাবে ভরাডুবির মেয়ে। সব ধরণের ভরাডুবি। যেমন হয়ে থাকে অন্য অন্য কত কত টুরির।
কথা বলে না, যখন বলে শুধু গালাগাল, তারপর অবিচ্ছিন্ন চুপ। তার নাকি মাথাই নেই, তায় মাথার স্ক্রু! ঘর করার টাকা ফাঁকি দে নেবার লোক কম নাকি? তিন হাত উঁচু দেয়ালের উপর কালো প্লাস্টিক-অজগরের নীচে তারা বিধবা মা-মেয়ে উবুমানুষ গুহাপ্রজা। মা বিছনা ছাড়া আকাশ দেখেনি। কাজ জোটে না, “পাগল ছাগল”। পড়শিরা পায়ে ঠেলে, “নাঙ করুনি”।
পেটের কথা শুনে শরীর গুনে কেউ পয়সা দেয় যে! তাবলে পাবলিকের “মাল”? ঝুম হয়ে থাকা রাতে পড়শি তিন যুবক তাকে কড়মড়িয়ে খায়। মুখে তাদের রক্ত লেগে থাকে।
শরীর কুড়িয়ে বাড়িয়ে জড়ো করে উঠে আসে। মুখে লাগা রক্ত দেখে চিনে নেয় যাকে ভাই বলে ডাকে –।
পালানোর রাস্তাও ছেঁড়াখোঁড়া, ধুলধুলে, মওত হয়ে গন্ধ ওঠা।

(চোদ্দো) দশের মা
ইস্কুলের মাঠে শুকনো পাতার রাশি। ভারতী সাফ করে নিয়ে যেতো যেন অক্ষর বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। আর ইস্কুলবাড়িকে পেন্নাম।
এক কপাল সিঁদুর টিপ। পান খাওয়া লাল ঠোঁট। গুমটিতে বাবুআসনে এরপর খদ্দেরদের পান সাজে পানপাতামুখী; বিড়ি সিগারেটও। দড়িতে আগুন। মৃত বোনের চার ছেলেমেয়ে পুষ্যি নয়। তাদের মা। এমন মারাত্মক অপরাধে বর মুঠো খুলে হাত ছেড়ে চলে গেছে। সেও গুমটি থেকে নেমে এলো।
ইস্কুলের মাঠ ঝেঁটিয়ে এরপর কয়েক বাড়ি।
বরুনবাবু লালঝান্ডার। মিছিলে চলো, মিছিলে চলো, ছেলেমেয়েদের গতি হবে। গতির কথা ভেবে, আর মন্ত্র জপে টোনাটুনিদের মায়ের তেত্রিশ বছর কাটলো । ছেলেমেয়েরা যত বড়ো হয়, তত মলিনতর তার সাদা শাড়ি। চুল পাখিবাসা। তবু মা সে, মাসি নয়। যেন ভারতমাতা।

লেখিকার আগের গদ্যটি পড়তে ক্লিক করুনঃ
https://www.bifocalism.com/a-prose-of-jurney-by-jajneseni-gupta-krishna/

 

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *