অলৌকিক আলোকধারার লোককথা(পর্ব-দুই) কলমেঃ সুকন্যা দত্ত

সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

অলৌকিক আলোক-ধারার লোককথা(পর্ব-দুই)

কলমেঃ   সু ক ন্যা   দ ত্ত

লোক কাহিনীর প্রসঙ্গ এলেই মনে পড়ে  যায় ঠাকুমা, দিদিমার মুখে ঝিঁঝি পোকা ডাকা রাতে শোনা বিচিত্র রকমের গল্প। আমার ছোটোবেলার অভিজ্ঞতার আঙিনায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার সাথে লোকগল্পের যোগ আছে। রূপকথা কিংবা লোকগল্পের কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে থাকতে বেশ লাগতো। তারপর পরিণত  বয়সে এসে ও লোকগল্পের প্রতি  আগ্রহ কিংবা ভালোবাসায় এতটুকু ঘাটতি হয়নি। আমাদের মনের ভিতরের শিশু সত্ত্বাকে জাগিয়ে রাখার জন্য লোক কাহিনি সর্বদা সজাগ।

বেশ মনে পড়ে ছোটো বেলায় জন্মদিনে মা  একটা গ্লোব উপহার দিয়েছিলো। নীল রঙের গোলাকার সেই বস্তুটা ঘোরালে নানান রঙের আঁকা বাঁকা কী সব দেখা যেতো। প্রথম রুটি বেলতে শিখলে রুটির আকার যেমন বাঁকাতেরা হয়ে যায় ঠিক তেমন। তারপর মানচিত্রের সাথে পরিচয় হতেই দেখি পৃথিবীর তিনভাগ জল আর একভাগ স্থলে সাতটা মহাদেশ আর পাঁচটা মহাসাগর। একবার পাড়ার রবীন্দ্র জয়ন্তীতে আফ্রিকা” কবিতাটা শুনে অজান্তেই এই সোনার দেশ, হীরের দেশের জন্য মায়া জন্মেছিলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ” আফ্রিকা ” কবিতায় লিখেছিলেন, 
  ” হায় ছায়াবৃতা, 
কালো ঘোমটার নীচে 
অপরিচিত ছিলো তোমার মানবরূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।”

হ্যাঁ, চিরকাল উপেক্ষা কুড়িয়েছে আফ্রিকা। অন্ধকারাচ্ছন্ন, ভয়ংকর, বিপদসংকুল  এই মহাদেশ প্রাচীন সময় থেকে ঔপনিবেশিক অত্যাচারে জর্জরিত। কেবল বর্ণবৈষম্যের কারণে কালো মানুষরা পদদলিত হয়েছে শ্বেতাঙ্গদের কাছে।  বাইরের দেশ এই মহাদেশের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব চালিয়ে পরাধীনতার শিকলে বেঁধে রেখেছে। এই মহাদেশের সুবিস্তৃত সোনালী সাহারা  মরুভূমি,  সিংহের কেশরের মতো বাদামী সাভানা তৃণভূমি, চির সবুজ কঙ্গো নদী অববাহিকার অরণ্য, নিরক্ষীয় জলবায়ু, নীল নদ উপত্যকার উর্বর ভূমি, গ্রস্থ উপত্যকার গায়ে গড়ে ওঠা নানান হ্রদ, সুউচ্চ কিলিমাঞ্জেরো আগ্নেয়গিরিকে  আলিঙ্গনবদ্ধ করে  সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছে। এই রুক্ষ দেশে কান পাতলে  আজ ও প্রতিবাদ, বিদ্রোহ কান্নার কলরোল শোনা যায়। এখন  ও সোমালিয়ার শিশুদের হাতে ভিক্ষার পাত্র দেখা যায়, রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধের ফলে অনাথ আশ্রম ধ্বনিত হয়  মাতৃহারা শিশুর কান্নায়।   এই মহাদেশ,   সমৃদ্ধ লোকগল্পের উত্তরাধিকার। সুবিশাল আফ্রিকা  মহাদেশ লোকগল্পের কাছে আজ ও মাথা নত করে আছে। দেহে শোনিত ধারা প্রবাহের মতো বংশ পরম্পরায় লোকগল্পের স্রোত প্রবাহিত। যুব সমাজ,শিশুদের জীবন শিক্ষা, সমাজ শিক্ষার জন্য সৃষ্ট লোকগল্প জনগোষ্ঠীকে  অনুপ্রেরণা দেয়। 

আফ্রিকা মহাদেশের লোক কাহিনী সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে  ১৭০০ থেকে ১৮০০ শতকের মধ্যে।  সেই সময় বর্ণ বিদ্বেষের কারণে আফ্রিকার কালো মানুষদের পায়ে বেরী পড়িয়ে ক্রীতদাস হিসেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হতো।  শ্বেতাঙ্গ মালিক সম্প্রদায় তাদের দাসদের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, বিশ্বাসের উপর চাবুক চালিয়ে  সেগুলি পরিত্যাগ করতে বাধ্য করতো। আর কালো মানুষদের  উপর চলতো  পাশবিক নির্যাতন।

আফ্রিকায় একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে,
” You cannot work for food when there is no food for work.”  
অনাহার, দারিদ্র্যতার মধ্যে ও  দেশের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান, স্মৃতিচারণে তারা লোক কাহিনিকে অবলম্বন করে মানসিক অভাব পূরণের পথ বেছে নিতো। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম শেষে রাতে একে অপরের সাথে গল্প গুজব করতো। চাঁদের এই সময়টা তারা প্রভুদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে ছিলো। তাই পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য, বীরদের সাহসিকতা, ঐন্দ্রজালিক, পশুপালন, চাষ আবাদের নেপথ্যের আদর্শ সকল শ্রোতার সাথে কাহিনী  অবয়বে আলোচনা করতো। প্রত্যক্ষ তথ্যের বদলে গল্প কে আশ্রয় করে তারা  নিজেদের চিন্তা ভাবনা বিনিময় করতো। কখন ও এই সব গল্পের আড়ালে  পলায়নের পরিকল্পনা কিংবা গোপন তথ্য একে অপরকে পাচার করতো। 

আফ্রিকা মহাদেশের দিকে তাকালে মনে হয় হাতের একটি তালুর ভিতর বৈচিত্র্যময়তা। নির্জনতার সাথে জনবহুলতা, পাহাড়ের  উচ্চতার সাথে মরুভূমির ধূসরতা,  মালভূমি ও গ্রস্থ উপত্যকা, হ্রদ, নিরক্ষীয় অরণ্যে সবুজের সমাবেশ বিস্ময় জাগায়। 
মেরি বেথুন এর কথায়,
” The drums of Africa still beat in my heart.”

অতীতে  সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর রাতে চাঁদের আলোয় আবালবৃদ্ধবনিতা মিলিত  হয়ে গল্পের আসর বসাতো। এই মহাদেশের জলবায়ুগত এবং ভৌগোলিক বৈচিত্রের কারণে  নানান প্রজাতির বন্য প্রাণী দেখতে পাওয়া যায় । ব্ল্যাক মাম্বা, অ্যান্টিলোপ, সিংহ, সাদা গন্ডার, হাতি,জলহস্তি, কুমীর, হায়না, কালো বাস বানর প্রভৃতি প্রাণীর ছড়াছড়ি। গল্পে তারা মানুষের মতো কথা বলে, গান গায়। মানুষের লোভ, হিংসা, ধূর্ততা, সাহসিকতা, চাতুরী পশু পাখির মাধ্যমে তুলা ধরা হয়। আফ্রিকার পূর্বাংশের লোককাহিনীতে  বুনো খরগোশের মধ্যে প্রতারকের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। লোকগল্পে বাঘ কিংবা সিংহ সাহসিকতা,  হায়নার মধ্যে লোভ লক্ষ্য করা যায়।

আফ্রিকা মহাদেশে  অসংখ্য উপজাতির বাস। পূর্বের কেনিয়া, তানজানিয়া,  উগান্ডা ইথিওপিয়ায় হারমের, মাসাই, হাডজেবে, ডিনকা,টুটসি, হুটু, ডিগবো প্রভৃতি  উপজাতির মধ্যে নানান লোক কাহিনি প্রচলিত। আগেই বলেছি লোক কাহিনিতে প্রকৃতির প্রতি সম্মান, উপজাতিগত বিশ্বাস,  আচার, রীতি নীতি প্রতিফলিত হয়।

গল্প- এক

তানজানিয়ার একটি লোকগল্পের সাথে আমাদের দেশের লোক কাহিনির মিল পাওয়া যায়। 

” অনেক দিন  আগের কথা।  এক যে ছিলো বানর আর ছিলো একটা হাঙর। ওরা দুজন ভীষণ ভালো বন্ধু ছিলো।  বানরটার নাম ছিলো কিমা আর হাঙরটার নাম ছিলো পাপা। বানরটা সমুদ্রের পাশেই একটা  মাকু গাছে বাস করতো। বিরাট সে গাছে থোকা থোকা ফল ঝুলে থাকতো।হাঙর পাপা থাকতো সমুদ্রের জলের তলায়। পাপা  রোজ সাঁতার কেটে ঐ  মাকু গাছের তলায় আসতো। কিমা  ফল পেরে  দিতো আর পাপা মন ভরে সেই   ফল খেতো।  ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব গাঢ় হতে থাকে। একদিন পাপা কিমাকে বললো,
” বন্ধু  আমার বাড়ীতে কাল তোমার নেমতন্ন  রইলো। তুমি অবশ্যই আমার বাড়ীতে যাবে।”

কিমা অবাক হয়ে বললো,
” বন্ধু, আমি কী করে যাবো? তোমার বাড়ীতো সমুদ্রের জলের তলায়।   আমি তো সাঁতার কাটতে পারি না।”

পাপা  বলল, 
” চিন্তা করো না কিমা, আমি তোমাকে আমার পিঠে চড়িয়ে বাড়ীতে নিয়ে যাবো।” 

একথা শুনে কিমা খুব খুশী হলো আর  হাঙরের বাড়ী নিমন্ত্রনে যেতে রাজী হয়ে গেলো। পরের দিন পাপা কিমাকে তার পিঠে চড়িয়ে সমুদ্রের পথে নিজের বাড়ীর দিকে রওনা দিলো। অনেকটা পথ সাঁতার কেটে ওরা   মাঝ সমুদ্রে এসে পৌঁছালো সেখানে জল অনেক গভীর। জলের তলায় ডুব দেওয়ার আগে  পাপা  একটু দাঁড়ালো।
কিমা বললো,
” পাপা তুমি দাঁড়ালে কেন?”
 পাপা  বলল,
” কিমা, তুমি আমার  প্রিয়  বন্ধু। তাই তোমাকে একটা কথা বলা দরকার। “
কিমা বলল,
” কী কথা?  বলো?”
পাপা বলল,
” তোমার পাঠানো ফল খেয়ে আমাদের হাঙর  দলের নেতা খুব খুশী হয়েছেন। তাই তিনি তোমাকে আমাদের রাজ্যে নিয়ে যেতে বলেছেন। দলনেতা  তোমার হৃদপিণ্ড খেতে চান। ওনার ধারণা তুমি যখন রোজ  এতো মিষ্টি ফল খাও, তাহলে তোমার হৃদপিণ্ড ও নিশ্চয়ই খুব মিষ্টি হবে।”
কথাগুলো শুনে কিমা একটু চুপ করে গেলো। তারপর বললো, 
” বন্ধু, তুমি আমাকে এই কথাগুলো আগে বললে না কেন? আমি তাহলে আমার হৃদপিণ্ডটা সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম।”
পাপা বললো, 
” সে কী, তোমার হৃদপিণ্ডটা তোমার সঙ্গে নেই?”
কিমা উত্তর দিলো,
” না বন্ধু, আমি তো সারাদিনের কাজের পর প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওটা গাছে শুকোতে দেই। আজ তাড়াহুড়ো করে আসার সময় ওটা গাছ থেকে পেড়ে আনতে ভুলে গেছি। ওটা তো গাছেই রয়ে গেছে।”
পাপা হতাশ হয়ে বলে,
” তাহলে এখন উপায়?”
 কিমা বলে, 
” চিন্তা করো না পাপা। আমি তো তোমার বন্ধু। তোমায় কখনই দলের নেতার কাছে ছোটো করতে পারি? তুমি  আমাকে আবার মাকু গাছের কাছে নিয়ে চলো। হৃদপিণ্ডটা নিয়ে আবার আমি তোমার সাথে তোমার রাজ্যে যাবো। তোমার রাজাকে খুশী করতে পারলে আমার ভীষণ ভালো লাগবে।”

অগত্যা পাপা কিমাকে নিয়ে মাকু গাছের কাছে চলে এলো। পাড়ের কাছে আসা মাত্রই কিমা লাফ দিয়ে গাছের মগ ডালে তরতরিয়ে উঠে গেলো।পাপা তো এদিকে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ পর পাপা গাছের দিকে তাকিয়ে  বলল,
” কিমা, তুমি তোমার হৃদপিণ্ডটা পেলে?”
কিমা গাছের মগডাল থেকে হেসে উত্তর দিলো,
” তুমি কী বোকা পাপা।  হৃদপিণ্ড কী কখন ও শরীর থেকে আলাদা করা যায়?   করলে মানুষ এমনিতেই মারা যায়।  তুমি বন্ধু হয়ে আজ আমায় ঠকিয়েছো। বন্ধু কখন ও এমন কাজ করতে পারে না। তোমায় বিশ্বাস করা আমার ভুল হয়েছে। আজ থেকে আমরা আর বন্ধু নই।”
কথাটা বলে কিমা গাছের আর ও উপরে উঠে গেলো। 
এই গল্পটা নিশ্চয়ই সকলের পরিচিত তাই না? “পঞ্চতন্ত্র “এর  এই গল্পটা আমরা সবাই পড়েছি। শুধু ভারতীয় পটভূমিতে হাঙরের অস্তিত্ব তেমনভাবে না থাকায় নদী প্রধান দেশের কুমীরকে আনা হয়েছে। আর মাকু ফল পঞ্চতন্ত্রে হয়েছে গোলাপজাম গাছ। তবে কারা প্রথম কার থেকে এই গল্প সংগ্রহ করেছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
এই গল্পে বানর ও হাঙরের রূপক এ মানব সমাজের কাছে একটা  নীতিশিক্ষা দেওয়া হয়েছে।  অসম বন্ধুত্ব এবং অতিরিক্ত বিশ্বাস মানুষ কে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। 
নীতিগত গল্পগুলো জাতি কে শিক্ষিত করতে অগ্রনী ভূমিকা নেয়। 

প্রকৃতি মানবজাতির কাছে বিরাট সম্পদ। প্রকৃতি এবং পরিবেশ রক্ষা আসলে  পূর্ব পুরুষদের শ্রদ্ধা ও সম্মান রক্ষার নামান্তর । 
আফ্রিকার কেনিয়া এবং তানজানিয়ায় মাসাই উপজাতিরা বাস করে। গ্রস্থ উপত্যকার মাঝে মাঝে হ্রদ এবং পূর্ব আফ্রিকার মারসাবিত পর্বতের পাদদেশে এদের বসবাস। ওল ডোনিও লেঙ্গাই আগ্নেয়গিরি হলো  মাসাইদের ভাষায় ” পর্বতের দেবতা” বলা হয়। মাসাইদের  কাছে প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ । এরা নিজেদের পরিবার নিয়ে যৌথভাবে একটা  প্রাঙ্গন ঘিরে  বাস করে। একজন পুরুষ তার একাধিক স্ত্রীদের ভিন্ন ভিন্ন ঘর তৈরী করে এক একটি ঘরে এক একটি পরিবারকে রাখেন। বেড়া দিয়ে ঘেরা এই স্থানটির নাম বোমা। মাসাইদের মধ্যে গ্রামের চল নেই।  পুরুষতান্ত্রিক মাসাই উপজাতিতে নারীর কোনো স্বাধীনতা নেই। মেয়েরা জীবনসঙ্গী নির্বাচনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। বহুবিবাহ প্রথা মাসাই সমাজে বহুকাল থেকে চলে আসছে।   নানান দেশের ভূ পর্যটকদের মতে, মাসাই উপজাতিরা অনেক বড়ো যোদ্ধা জাতি। তবে যোদ্ধা বলতে তারা পশু শিকার করে যোদ্ধা বলে পরিচিত নয়। 

গল্প-দুই

এই বিষয়ে পূর্ব আফ্রিকায় একটি কাহিনী শোনা যায়। 

মাসাই যোদ্ধাদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় মোরান। অনেক আগের কথা, সেই সময় যোদ্ধা হওয়ার জন্য  কয়েকজন করে তরুন মোরানরা রোজ শক্তি সঞ্চয়ের করতে ওরপুলে যেতো। সেখানে গিয়ে তারা মাংস আর  স্থানীয় ঔষধ খেয়ে দিন কাটাতো। মোরানদের বিশ্বাস ছিলো, এর ফলে তাদের গায়ে বল হবে। তার ফলে  তারা  সমাজ এবং নিজের জাতিকে রক্ষা করতে পারবে। রোজ  ওরপুল যাওয়ার সময় পথে  একটা ওরাংওটাংয়ের সাথে মোরানদের দেখা হতো। সেই ওরাংওটাংটার নাম ছিলো ইকগু। এই ওরাংওটাংটা বিকেল বেলা মাসাই উপজাতির এই মানুষগুলোর   সাথে ভালো ব্যবহার করলে ও রাতের বেলা লুকিয়ে  মোরানরা  সংখ্যায় কতজন সেটা গুনে যেতো।   ইকগুর উদ্দেশ্য ছিলো ,
 মোরানদের মেরে তাদের মাংস খাওয়া । এরপর প্রতিরাতে ইকগু একজন করে মোরানকে চুপিসারে খেয়ে যেতে লাগলো।  সব মোরানদের খাওয়ার পর যখন  ইকগুর আর একজন যোদ্ধাকে মেরে খাওয়া বাকী ছিলো, সে সময় ইকগু ঠিক করলো, ওই মোরানের মাংস সে একা খাবে না।  পাহাড়ের গুহায় তার যে বন্ধুরা থাকে,  তাদের সাথে বসে জমিয়ে  মোরানের মাংস খাবে। তাই ইকগু বন্ধুদের  নিমন্ত্রন করতে গেলো। ইকগু যখন তার বন্ধুদের নিমন্ত্রন করতে গেছে  সেই সুযোগে মোরানটি গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসী  যোদ্ধাদের সব কথা খুলে বলল।  মাসাই যোদ্ধারা তো  রেগে লাল হয়ে গেলো। ঢাল, তরোয়াল  নিয়ে ইকগুকে মারতে  ছুটে এলো। যোদ্ধারা মারতে মারতে ইকগুকে যখন আধমরা করে দিয়েছে , তখন ওরাংওটাং মোরানদের একটা  অনুরোধ করে বলল,

” আমি তো আর বাঁচবো না। তোমরা সকলে আমার বুড়ো আঙুলটা কেটে নাও। তাহলে আমি যে মোরানদের  মেরেফেলেছি, তারা   সকলে  আবার বেঁচে উঠবে।”
এই কথা শুনে সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। ইকগুর কথা মতো বুড়ো আঙুল কেটে ফেলার পর সব মোরানরা আবার বেঁচে উঠলো। দেশে আবার আনন্দ ফিরে এলো।

এই লোক কাহিনীতে মাসাইদের একতা, সাহসীকতা, বলশালিতার পরিচয় পাওয়া যায়।এরপর থেকে মাসাইরা যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। 

 মাসাই উপজাতির মানুষ চাষ আবাদ, পশুপালন এবং শিকার নির্ভর।   মাসাইরা গৃহপালিত পশুর প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে পশুর রক্তের সাথে পশুরই দুধ মিশিয়ে খায়। সৃষ্টির শুরুতে মাসাই উপজাতির সাথে গৃহপালিত পশুদের সম্পর্ক নিয়ে একটা গল্প আছে। মাসাইরা কখনও নিজেদের গবাদি পশুর সংখ্যা গননা করে না, তাদের মতে এটা অশুভ। 

গল্প-তিন

আর একটা গল্পে পড়েছি,

বহু কাল আগে কথা যখন মাসাই উপজাতিদের কাছে পশুপালনের জন্য কোনো পশু ছিলো না সেই সময় মাসিনটা ছিলেন মাসাইদের প্রথম মানুষ।   একদিন ঈশ্বর  মাসিনটা কে  ডেকে পাঠালেন। তিনি বললেন,-
” মাসিনটা, আমি চাই, তুমি  একটা জায়গা বেড়া দিয়ে ঘিরে  তৈরী  কর। কাজ শেষে করে  তুমি আমাকে জানিও।”
মাসিনটা ঈশ্বরের কথা মতো, সব কাজ শেষে  ফিরে এসে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কে জানালো। ঈশ্বর তাকে বললেন,
” আগামীকাল তুমি খুব ভোরে   বাড়ীর বাইরের গিয়ে দাঁড়িয়ো। আমি তোমায় গৃহপালিত নামের কিছু জিনিস দেবো কিন্তু তুমি আশ্চর্যজনক কিছু দেখলে বা শুনলে ও কোনো শব্দ করতে পারবে না।”

মাসিনটা ঈশ্বরের কথা মতো পরদিন ভোরে বাড়ীর বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। হঠাৎ তার কানে বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দ এলো। তারপরই  সে দেখলো আকাশ থেকে চামড়ার বলয়ে আটকানো গৃহপালনের পশুর দল ধীরে ধীরে  সেই প্রাচীরে ঘেরা ভূমিতে   নামছে। সেই সময় মাটি এতটাই  কাঁপছিলো, যে মাসিনটার বাড়ী প্রায় ভেঙে  যাওয়ার যোগাড়।  মাসিনটা ভয় পেলে ও ঈশ্বরের কথা মনে করে সে নিথর ও নীরব হয়ে  দাঁড়িয়ে রইলো। মাসিনটার সাথে ঐ বাড়ীতপ তার এক বন্ধু থাকতো। তার নাম ডোরোবো।   ডোরোবো, সেই সময় ঘরের ভিতর ঘুমিয়েছিলো। তীব্র আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে গেলো। বাইরে এসে এই দৃশ্য দেখে সে  চিৎকার করে উঠলো। ঈশ্বর ভাবলেন, মাসিনটা আর্তনাদ করেছে। ফলে তিনি গৃহপালনের পশু আকাশ থেকে নীচে নামানো বন্ধ করে দিলেন। এরপর তিনি মাসিনটা কে জিজ্ঞাসা করলেন,
” এই জীবজন্তুরা কী  তোমার পালনের পক্ষে উপযুক্ত?
আমি আর তোমার জন্য পশু পাঠাবো না। যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি, তুমি ও তেমনই এদের ভালোবেসো। “

মনে করা হয় এই জন্যই মাসাইরা গৃহপালিত পশুদের এতো ভালোবাসে। অসংখ্য উপজাতির শরীর থেকে লোক কাহিনির অনুসন্ধান করে আমরা সাংস্কৃতিক গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করছি।আজ গল্পের ঝুলি এই পর্যন্ত।  পরবর্তী পর্বে আবার আফ্রিকার অপর উপজাতিদের গল্পের ঝুলি খুলবো।

আগের পর্ব পড়তে হলে ক্লিক করুন

অলৌকিক আলোকের ধারায় লোককথাঃ লিখছেন–সুকন্যা দত্ত

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *