অলৌকিক আলোকের ধারায় লোককথাঃ লিখছেন–সুকন্যা দত্ত

সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

অলৌকিক আলোকের ধারায় লোককথা

লিখছেনসু ক ন্যা   দ ত্ত

১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আমেরিকার ইতিহাসের গৃহযুদ্ধের কথা আমরা প্রায় সকলেই ইতিহাসে পড়েছি। এই যুদ্ধের পর দক্ষিণ আমেরিকায় ব্লুজ লোকগান জন্ম লাভ করে। দক্ষিণ আমেরিকায় জোর করে ধরে আনা দাসদের করুণ বিষাদ গাথা ব্লুজ লোকগান । এই দেশের  কৃষক, শ্রমিক, ক্রীতদাসদের কাছে তাদের  জীবন তাদের কাছে ছিলো  অভিশাপের মতো ছিলো।  একবেলা খেতে পাওয়া, ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শ্রমজীবী মানুষদের একমাত্র রসদ ছিলো ব্লুজ লোকগান। সারাদিনের অমানষিক  পরিশ্রমের পর রাতে সকলে একত্রিত হয়ে নিজ নিজ ভাষায়  গান গাইতো। একে অপরের  ভাষার বোধগম্যতা না থাকলে ও সুরের অনুরনন নিজ নিজ দেশের কথা মনে করাতো। সাংস্কৃতিক মিশ্রণ ভাষার ব্যবধান ছাপিয়ে  ব্লুজ লোকগানের জন্ম হয়। এই লোক গান তাদের কঠিন,  অত্যাচারিত জীবনে বেঁচে থাকার  একমাত্র রসদ হয়ে উঠলো। সকল যন্ত্রনার অবসান ঘটালো। 

 

“লোক সংস্কৃতি “শব্দটির মধ্যে  “লোক” শব্দটির অর্থ হলো সেই সকল জনগোষ্ঠী বা লোকগোষ্ঠী যাদের মধ্য থেকে এই লোককথা এসেছে। Folklore বা লোককথার একটি ভাগ হলো লোকগল্প বা Folktales. 

আধুনিক শিক্ষিত সমাজে লোকগল্প পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্তির অন্যতম কারণ হলো গল্পের মাধ্যমে আনন্দ দান করা। এর ফলে শিশু মনে নিজ জাতির সংস্কৃতির বিষয়ে ধারণা ও ভালোবাসার উদয় হয়। ইতিবাচক, নীতিমূলক চরিত্রের সাথে পরিচয় হলে শিশুমনে আদর্শ তৈরি হয়।  গল্পের প্রতি তাদের ভালোবাসা সৃষ্টি হয় এবং পাঠের দক্ষতা বাড়ে। প্রাচীন সময়ে শিশু ভোলানোর জন্য, তাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য লোকগল্পের  সূত্রপাত হয়েছিলো। গল্পের মাধ্যমে শিক্ষা দিলে শিশু মনে ছাপ তৈরি করে।  শিশুর মনে শিক্ষার  গভীর প্রভাব বিস্তারের জন্য লোকগল্পের আশ্রয় নেওয়া হয়।

লোককথা সৃষ্টির পিছনে বিশেষ কিছু কারণ রয়েছে। কেবল আনন্দ দেওয়াই নয়, লোককথা জন্মের পিছনে গভীর উদ্দেশ্য রয়েছে। এবার একে একে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।

 লোককথার  আঁতুড়ঘর   সমাজের তথাকথিত অল্প শিক্ষিত পিছিয়ে পড়া শ্রেণি, জাতি,উপজাতি। লোক মুখে প্রচলিত এই গল্পের কথক নিজের যন্ত্রনা ভুলতে লোককথার  আশ্রয় নেয়। লোককথায় জাতীয় ঐতিহ্যের ধারা বহমান।  নিজ নিজ দেশের সংস্কৃতি, বিশ্বাস, ভৌগোলিকতা, আচরণ, ধর্মবিশ্বাস, ইতিহাস উঠে আসে লোককথায়। লোককথা জীবন বিমুখ নয়,বরং জীবন নির্ভর।

লোককথা সামাজিক অবয়ব সৃষ্টি করে। কাহিনি শোনার পর শ্রোতার কাছে উক্ত সমাজ সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়। বংশ পরম্পরায় সেই ধারা প্রবাহিত হওয়ায় সেই সমাজের আদর্শ,নীতি, আচার এর সম্যক ধারণা মেলে। যে জনগোষ্ঠীর কে আমরা চাক্ষুষ দেখিনি,লোকগল্পের মাধ্যমে তাদের বিশ্বাস, ভাবনা,সংস্কৃতির সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। পূর্ব পুরুষের অস্তিত্ব,তাদের পরিচয়,  জাতীর পরিচয় লোককথায় পাওয়া যায়। 

লোককথায় মানুষের চিন্তা,অভিপ্রায়  প্রকাশ পায়। এক একটি সভ্যতায়, এক এক সময়ে বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষ কীভাবে প্রতিক্রিয়া করে সেই ” Particular thinking pattern” আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। লোককথা হলো জ্ঞানের আঁধার,  চিন্তার মাধ্যম।লোককথার মৃত্যু হয় না, যুগের পর যুগ ধরে এই গল্প মুখে মুখে এগিয়ে যায়।

Rysan এর মতে,
” Folklore can be defined as the collective objectifications of basic emotions such as awe,fear,heatred,reverence and desire on the part of social group.”
বহুত্ববাদীদের মতে, কোনো একটি স্থান থেকে বর্তমান লোককথার জন্ম হয়নি। প্রাচীন লোককথা ভৌগোলিক গন্ডী পেরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। তারপর নানান জাতির সাংস্কৃতিক মিশ্রণে লোকগল্পগুলো একটি রূপ পায়। পৃথক লোকগোষ্ঠীর ভালোবাসা, ঘৃণা, হতাশা, রাগ, দুঃখ, অহংকার,  দুর্ভাগ্য, উচ্চাকাঙ্খা মিশে মিশে একাকার হয়ে যায় গল্পে। 

লোককথায় লোক সমাজের মনস্তত্ত্ব ফুটে ওঠে। এ জাতীয় গল্পে কথকের কল্পনাশক্তির প্রকাশ ঘটে। যুক্তির বদলে বুদ্ধির পরিচায়ক লোককথা। সময়ের সাথে সাথে শ্রোতার পার্থক্য ও চোখে পড়ে।  কথকের কথনভঙ্গী এবং শ্রোতার প্রতিক্রিয়া লোককথায় প্রতিফলিত হয়। 

William Hudson সাহিত্য সম্পর্কে বলেছেন,
” It it directly related to human life.”
লোককথা বা Folktales এর ক্ষেত্রে ও এ কথা প্রযোজ্য। সাহিত্যের নান্দনিকতাকে কখনই অস্বীকার করা যায় না। নৃত্য, চিত্র,স্থাপত্য, ভাস্কর্যের মতো ভাষাও সাহিত্য প্রকাশের একটি মাধ্যম।  তাই গান, গল্প,কবিতা,উপন্যাস, প্রবন্ধ,মহাকাব্যের মতো লোককথা আমোদ প্রমোদ এবং নাগরিকদের নানান অধিকার থেকে জন্ম লাভ করে। তবে কেবল শিশু ভোলানোর জন্য নয়, আনন্দ, শিক্ষা, জাতির সংহতি ও সাংস্কৃতিক বৈধতা রক্ষায় লোককথার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে লোককথার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। লোককথার মধ্য দিয়ে পাঠক বা শ্রোতা জাতির ক্ষমতা, সাহসিকতা, প্রতিবাদ, আদর্শ,নীতির পরিচয় পায়। ফলে নিজ অধিকার রক্ষায়, রাজনৈতিক অধিকার অর্জনে তারা অনুপ্রাণিত হয়। পৃথিবীর নানান প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা একই জনগোষ্ঠী লোককথা থেকে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং জাতীয় সংহতি রক্ষায় সচেষ্ট হয়। লোককথা জাতির অভিজ্ঞতা, বোধ ও শিক্ষাকে বহন করে।

লোককথার একটি শাখা হলো লোকগল্প।  লোকগল্প সৃষ্টি হয় বিশেষ কিছু বিষয় কে কেন্দ্র করে। বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সূর্য়,চন্দ্র,নদ,নদী, পাহাড়, আকাশ,বৃষ্টি সকলের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে লোককথায়।  প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা নিয়ে লোককথা গড়ে ওঠে। ধর্মীয় বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য লোককথার আশ্রয় নেওয়া হয়।জীবজন্তুর, পশু পাখিদের রূপক এ সামাজিক কাঠামো,রাষ্ট্রনৈতিক দিক, শাসক- শাসিতের সম্পর্ক,মানুষের লোভ,নির্বুদ্ধিতা, দোষ,গুণ লোককথায় উঠে আসে। লোককথার আরেকটি দিক হলো নীতিশিক্ষা।  তাই নীতি মূলক লোককথার উদ্দেশ্য সমাজ, জাতি, জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা দান করা। 
লোকগল্পের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।
প্রথমত, এটি কথ্য সাহিত্য।  যুগ যুগ ধরে লোক মুখে গল্প প্রবাহিত হয়ে আসছে।
দ্বিতীয়ত, লোককথায় নীতিশিক্ষার দিকটি গুরুত্বপূর্ণ।  জনসমাজ কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য লোককথার আশ্রয় নিতে হয়।
তৃতীয়ত,  লোককথার ভাষা সহজ সরল। শুনে শুনে মনে রাখার সুবিধার জন্য সাধারণ ভাষায় লোককথা বলা হয়।
চতুর্থত,  লোককথার চরিত্রগুলো হয় সাধারণ। 
পঞ্চমত, গল্পগুলো কে আকর্ষনীয় করার জন্য বিশেষ নানান চমকপ্রদ ঘটনার আশ্রয় নেওয়া হয়। 
যষ্ঠত, লোকগল্পের সময়কাল হলো অতীত।  প্রাচীন সময়কে কেন্দ্র করে লোকগল্প আবর্তিত হয়। 
সপ্তমত, লোকগল্পে কথকের বিষয়ে স্পষ্টত কিছু বলা থাকে না। যারা লোকগল্প বলেন, তারা তাদের পূর্বজদের থেকে শুনে কাহিনি পরিবেশন করেন। 

সারা পৃথিবীতে বহু উপজাতিরা নিজেদের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখতে, জাতিগত মূল্যবোধ বিকাশে লোককথাকে আঁকড়ে ধরে রাখে। একটি জাতির শিকড় হলো লোককথা। তাই এই লোককথা বিচ্ছিন্ন জীবন জাতির  পরিচয়ের সংকটকে চিহ্নিত করে। আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ,  অস্ট্রেলিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার যত্রতত্র লোকগল্প ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য,  বিশ্বাস, আচার,নীতি,ভাবনাকে পরের পর্বে একে একে এক ছাতার তলায় আনার  চেষ্টা করবো।সাথে কিছু লোকগল্প তুলে আনার প্রয়াস করবো।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *