অলৌকিক আলোক-ধারার লোককথা(পর্ব-৩)–কলমেঃ সু ক ন্যা   দ ত্ত

সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

অলৌকিক আলোক-ধারার লোককথা(পর্ব-তিন)

কলমেঃ   সু ক ন্যা   দ ত্ত

মুগওয়ে

বেশ কয়েক বছর আগে একটা বই হাতে পেয়ে মনটা ধেই ধেই করে নেচে উঠেছিলো। বইটার নাম” Famous Tales from the Chagga Tribe of Kilimanjaro – Tanzania “. ওই চাগা উপজাতির সাতকাহন আর কী। বই কী কোনো বয়সের ধার ধারে? দাদু থেকে নাতি সকলেই বই পেলেই  গ্রোগ্রাসে গেলেন। তারপর ঝিম ধরা দুপুরে কিংবা শীতের কম্বল মুড়িয়ে বই পড়া চাইই চাই।   বইয়ের পাতা উলটে কিছুটা  এগোতেই   চাগাদের  বিষয়ে  বড়ো কৌতুহল জাগলো। এ যে পাহাড়,নদী, উপজাতির এক একটা উপাখ্যান।  “Poetry And Thinking Of The Chagga” বইয়ে ব্রুনো গাটমান কিলিমাঞ্জারো পাহাড়ের পায়ের তলায়  বসত গড়া চাগাদের সাথে ৩৬ বছর কাটিয়েছিলেন। ওনার কথায় চাগারা ” The so called Primitive races”.

 ১১ শ শতকে চাগা উপজাতি আফ্রিকার পূর্ব অংশের  কিলিমাঞ্জারো পর্বতের পাদদেশে বাস করতে আসে।  তানজানিয়ার কিলিমাঞ্জারোর গায়ে তিনটে গ্রাম। মবাহে, মারাঙ্গু আর চেকেরেনি। এই গ্রাম চাগাদের বসত ভূমি। এদের কেউ কেউ লাভায় ঢাকা   উর্বর জমিতে ( Shambas)  আলু, কলা, কফি, নানান শস্য ফলায়। কেউ পশু পালনের মাধ্যমে নিজেদের পেট চালায়। আবার কেউ বা মবেজে ( কলার তৈরি স্থানীয় মদ) বিক্রি করে। কথিত আছে, চাগারা আসার আগে ওয়াকোনইংগো বা পিগমিরা এই  অঞ্চলে বাস করতো। চাগা উপজাতির মানুষ এখানে   আসার পর তাদের সাথে   নতুন বিশ্বাস, ভাষা, আচার আচরণ, সংস্কৃতির প্লাবন আসে। এরা নিজেদের   সমাজের  যুদ্ধ বিদ্যা,  অলৌকিক বিশ্বাসের উপর ভর করে সময়ের চাকা এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। চাগা উপজাতিতে পরিবারের বদলে গোত্র  লক্ষ্য করা যায়।এই  উপজাতির বিশেষ ক্ষমতাশীল  মানুষ  মাটির বুকে    বৃষ্টি নামাতে পারে আবার   অতি বৃষ্টি কে রোধ পারে।   চাগারা মনে করেন, ওদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের  দেখা স্বপ্ন বাস্তব হয়।   শোনা যায়,   শ্বেতাঙ্গ চাগারা  প্রাচীন সময়ে   কিলিমাঞ্জারো তে আসার স্বপ্ন দেখতো।

 চাগাদের একটা লোক গানে একটা আদিমতা আছে। কিছু সময় আগে আমি  একটা গান শুনেছিলাম, 

” কিলিমাঞ্জারো নি মলিমা 
মরেফু ভেন্যে  ভিজিতো ভেঙ্গি
ওয়েন্যে সামাকি ওয়েঙ্গি
 মাইসা ইয়া ওয়াতু।”

গানটির অর্থ, কিলিমাঞ্জারো সুউচ্চ পর্বতের  গায়ে অনেক নদী আছে,  যেখানে অগুনিত মাছের বাস আর বহু মানুষের আশ্রয়স্থল। চাগাদের বাসভূমি  উর্বর কালো মাটি, ফসল, নদী, মাছের দেশ।
এরা মাটির মধ্যে পূর্ব পুরুষের ঘ্রাণ পান। ঘরে ঘরে কলা, কফির উৎপাদন চোখে পড়ে। এদের উপজাতির কোনো মানুষ  দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বিনিময় প্রথায় গবাদি পশুর পরির্বতে জমি দিয়ে যায়। চাষের জমি চাগাদের হৃদস্পন্দন, ফসল এদের ধমনী, চাষ আবাদের প্রতি ভালোবাসা শিরায় প্রবাহিত।
 চাগা সমাজ  পাপ সম্পর্কে  নিজস্ব ধারণা পোষণ করে ।  যিনি পাপ করেন তাকে শুদ্ধ না করে  ভুক্তভোগীকে  শুদ্ধীকরণের রীতি প্রচলিত। এই ” ক্লিনজিং ” প্রথার   ফলে সেই ব্যক্তি অশুভ শক্তি প্রভাব মুক্ত হয়ে পড়ে। স্থানীয় চিকিৎসক এই কাজ করার জন্য দক্ষিণা স্বরূপ প্রচুর কলা ও মদ দাবী করেন। 

 চাগা উপজাতির  একটা লোক গল্প এবার তুলে ধরি।
চাগার গল্পবৃক্ষ
গল্প-এক

অনেক অনেক আগের কথা। একদিন চাগা উপজাতির একটি মেয়ে তার এক  বন্ধুর সাথে মাঠে  ঘাস কাটতে গিয়েছিলো। বেশ কিছুটা  পথ যাওয়ার পর ওদের চোখে পড়লো  এক জায়গায়  ঘন সবুজ,   নরম, কচি ঘাস । দুজনেই তো কচি ঘাস দেখে মহা খুশী।  চাগা  মেয়েটা ঘাস কাটার জন্য এগিয়ে গেলো। সে যখনই সেই জায়গায় পা দিয়েছে অমনি সেখানকার কাদায়  পড়ে ডুবতে শুরু করলো। জায়গাটা ঘন ঘাসে ভরে থাকায় সে  বুঝতে পারেনি সেটি কালো কাদায় ভরা  বিরাট একটা জলাভূমি।   কাদায় ডুবতে ডুবতে সে চিৎকার করতে লাগলো,
” বাঁচা ও, বাঁচাও।
 মেয়েটার বন্ধু চাগা মেয়েটার গলা শুনে সেদিকে এগিয়ে গেলো। সে  তাকে হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে কিছুতেই চাগা মেয়েটা  কাদা থেকে উঠতে পারে না।   মেয়েটার বন্ধুটা ভীষণ ভয় পেয়ে সাহায্য চাওয়ার জন্য গ্রামে ছুটে গেলো। সব শুনেই গ্রামবাসী তাড়াতাড়ি ছুটে এলো সেই জলাভূমিতে।  কিন্তু মেয়েটা ততক্ষণে কাদার তলায় হারিয়ে গেছে। কেউ আর ওকে দেখতে পেলো না। গ্রামের একজন প্রবীণ, শিক্ষিত, ভবিষ্যৎ বক্তা বললেন,
” এই জায়গায় গরু আর ভেড়া বলি দিতে হবে।”
কথাটা বলার সাথে সাথেই কাদার তলা থেকে চাগা মেয়েটার চাপা গলার স্বর শোনা গেলো, আর তার পর আবার স্বর মিলিয়ে গেলো। এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর গ্রামবাসী দেখলো, মেয়েটা যেখানে   ডুবে গিয়েছিলো  সেখানে একটা গাছ গজিয়েছে। গাছটা বড়ো হতে হতে আকাশকে ছুঁয়ে ফেললো। গাছটা এতই বড়ো হয়ে গেলো যে  মাটির মানুষ গাছের মাথা  আর দেখতে পায় না। সেই জলাভূমি ও এখন আর জলাভূমি নেই। কাদা শুকিয়ে  সেখানকার মাটি শক্ত হয়ে গেছে।  রাখালের দল সেখানে গরু, ভেড়া চরাতে  নিয়ে আসে। বিরাট গাছের ছায়ায় পশুরা ঘুরে বেড়ায়। রাখালরা জিরিয়ে নেয়। একদিন দুজন রাখাল কৌতুহল বশে সেই গাছে চড়তে  শুরু করলো। উঠতে উঠতে তারা গাছের অনেক উপরে পৌঁছে  গেলো। তারপর নীচের রাখালদের বললো,
” দেখো আমরা পৃথিবী থেকে অনেক উপরে উঠে এসেছি।” 

এরপর সেই দুজন রাখাল আর নীচে নামেনি।  তারা কোথায় গেছে কেউ তা জানে না। এ ঘটনার পর  গাছটির  নাম হলো  গল্প গাছ।

 এই লোককাহিনীর মধ্যে হয়তো কোনো সাংকেতিকতা লুকিয়ে আছে। আমার মনে হয়, আগ্নেয়গিরি অগ্নুৎপাতের সময় লাভা গলিত অবস্থায় থাকে। সেই লাভা উদগিরনের   পর জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে উর্বর মাটিতে পরিণত হয়ে বাসযোগ্য হয়।  কাদা মাটি  পরে শক্ত  হওয়ার পিছনে ভৌগোলিক ইঙ্গিতটা অনেকটা তেমনই।

চাগা উপজাতিতে “ওয়াকেনিয়ংগো” বামনের গল্পের  প্রচলন আছে। কথিত আছে, এরা কিলি ধাপের নীচের অংশের গুহায় বাস করে। এই বামনরা  বড়ো  মাথাওয়ালা।  কোনো ব্যক্তি পাহাড় বিষয়ে  নেতিবাচক মন্তব্য করলে, তাকে এরা  পাহাড় থেকে ফেলে দেয়। তানজানিয়ায় বসবাসকারী চাগা উপজাতির ভূমি  ঐতিহ্যগতভাবে কয়েকটি রাজ্যে বিভক্ত। এই রাজ্যগুলো চাগাদের ভাষায় ” উমাংগী “নামে পরিচিত। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা এই উপজাতি উমাংগীর জন্য নিবেদিত প্রাণ।

এবার আসি চাগাদের আর একটি লোককাহিনীতে।

গল্প-২

অনেক অনেক কাল আগে কিটান্ডু নামে একটা গ্রাম ছিলো। একদিন হঠাৎ সেই গ্রামে বাইরে থেকে একটা অজানা লোক এলো। লোকটার বড় বড় চোখ, চুলগুলো সব উসকো খুসকো। দেখলেই কেমন ভয় লাগতো।  তার না ছিলো  ঘর, না ছিলো  খাবার।  ক্ষিদের জ্বালায়,  আশ্রয়ের জন্য সে এদিক  ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলো।  গ্রামের একটা জায়গায়  কিসোইয়ো বসে ছিলো। কিসোইয়ো কিটান্ডু গ্রামের একজন চাষী।  তাকে দেখেই ওই লোকটার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। সে কিসোইয়োর কাছে গিয়ে বললো,
” বন্ধু, যদি তুমি,  তোমার বাড়ীতে আমায়  অতিথি করে নিয়ে যাও,  খেতে দাও, থাকতে দাও তাহলে তোমার ঘরে কোনো বিপদ ঢুকতে পারবে না।”
একথা শুনে কিসোইয়ো মহা আনন্দে তাকে নিজের বাড়ীতে নিয়ে গেলো। কিসোইয়োর স্ত্রী তো অপরিচিত অতিথিকে দেখে  অবাক। 
সে তার স্বামীকে বললো,

” চেনা নেই জানা নেই একজন অচেনা মানুষ কে তুমি অতিথি করে আনলে?  আমাদের যদি বিপদ হয়?”
কিন্তু স্ত্রীর কোনো কথায় কিসোইয়ো কর্ণপাত করলো না। সে বললো,

” তোমার কোনো চিন্তা নেই। ও আমাদের সব বিপদ থেকে বাঁচাবে।  আমাদের গরু, মুরগী এমনকি আমরা দুজন আজ থেকে সুরক্ষিত। আর কেউ আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। “

” আমাদের সন্তানরা কী ওই অপরিচিতের থেকে  সুরক্ষিত?”
এই কথায় কিসোইয়ো বিরক্ত হয়ে বললো,
” আমার ওই আগন্তুকের সাথে কথা হয়েছে। তুমি এত না ভেবে রান্না করতে যাও।” 
অগত্যা কিসোইয়োর স্ত্রী কাজ করতে চলে গেলো। দিনের পর দিন সেই অতিথি খায়, দায় আর ঘুমায় অথচ গৃহকর্তা কিসোইয়ো কিংবা তার স্ত্রী এর প্রতি বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতাবোধ নেই । কিসোইয়োর  তিন জন সন্তান ছিলো। ওরা ও এই আগন্তুককে অপছন্দ করতো । একে একে তাদের বাড়ীর এক একটা মুরগী চুরি হতে লাগলো।  অতিথি রোজ মুরগী চুরি করতো  সবার আড়ালে   কাঁচা মাংস খেতো।  এমনকি কিসোইয়োর  বাড়ীর ঘুম ভাঙানিয়া  প্রিয় মোরগটা ও একদিন উধাও হয়ে গেলো।

কিসোইয়োর স্ত্রী তাকে অনেক বুঝিয়ে ও কোনো লাভ হলো না। এমনকি  প্রতিবেশীদের কথা ও সে  বিন্দুমাত্র কর্ণপাত  করলো না। 

এরপর একদিন কিসোইয়োর স্ত্রী  ভোরবেলা সূর্যোদয়ের আগে নদীতে জল ভরতে গেলো। সেই সময় কিসোইয়ো  “মবেজে” ( কলার মদ) সংগ্রহ করতে বেরিয়েছিল।  সুযোগ বুঝে  বাড়ী ফাঁকা পেয়ে   অতিথি খাবারের জন্য শিশুদের ঘরে হানা দিলো। প্রথমে সে  একজন ঘুমন্ত শিশুর হাত ধরে টান দিলো তারপর শিশুটির   ডান হাতে কামড় বসিয়ে  মাংস খুবলে নিলো। ব্যথায় শিশুটা চিৎকার করে উঠলো। ধরা পড়ার ভয়ে  প্রাণ বাঁচাতে  সেই দুষ্টু লোকটা দৌঁড়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর কিসোইয়ো ঘরে এসে দেখলো, তার ছেলের রক্তে ঘর ভেসে যাচ্ছে আর শিশুটি  যন্ত্রনায় ছটফট করছে। কিসোইয়োর স্ত্রী এসব দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। প্রতিবেশীরা কিসোইয়ো কে বললো,
” তোমার কারণে আজ এমন হলো। এসব তোমার কর্ম ফল। “

কাঁদতে কাঁদতে কিসোইয়ো আর  তার স্ত্রী  বাচ্চাটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। বেশ কিছুদিন পর ধীরে ধীরে বাচ্চাটা সুস্থ হতে লাগলো। তবে ডান হাতের দাগটা রয়ে গেলো। এই ঘটনার পর  থেকে কিসোইয়ো তার স্ত্রীর সব  উপদেশ শোনে। সে বুঝতে পেরেছে,  অপরিচিতদের বিশ্বাস করা উচিত নয়।

তানজানিয়া, উত্তর কেনিয়ার পর্বতের উর্বর মাটিকে আঁকড়ে বাস করে  মেরু উপজাতি। কিমিরু ভাষায় মেরু শব্দের অর্থ হলো ” উজ্জ্বল আলো।” আবার কিসওয়াহিলি ভাষায় এর অর্থ ঝলমলে আলো। শোনা যায়, বর্তমানে মেরুরা যেখানে বসবাস করছে,সেই তানজানিয়া কিংবা উত্তর কেনিয়া এদের আদি বাসভূমি নয়। এরা ” এনগুউ এনটুউন” বা “নুহুনটুন”( লাল মানুষ) এর দাসত্বের অধীনে ছিলো। তাদের আদিম বাসভূমির মেবওয়ার অস্তিত্ব এখন আর পাওয়া যায় না। কার ও মতে,  এই অঞ্চলটি কেনিয়ার উত্তর পূর্ব উপকূলে লামু দ্বীপপুঞ্জের মান্দা দ্বীপের পশ্চিম উপদ্বীপের মবওয়ারা মানটাঞ্জা।   আবার অপরদের  মতে, এটি ইয়েমেনে বা লোহিত সাগরের ওপারের কোনো স্থান। মুগওয়ের বাম হাতে একটা বিশ্লেষণাত্মক দন্ড থাকে। স্থানীয় মতে, তিনি  মেরু  উপজাতির সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। মুগওয়ের একটা বিশেষ ক্ষমতা ছিলো।  তিনি ছিলেন দূরদর্শী।  সাংকেতিকভাবে মুগওয়ে সূর্যাস্তের পশ্চিম দিকের প্রতিনিধি। মেরুদের বিশ্বাস মুগওয়ের ক্ষয় নেই, বিনাশ নেই।  তিনি চিরকাল খরা, দূর্ভিক্ষ, মহামারী থেকে উপজাতি কে রক্ষা করে আসছেন।

মেরু  উপজাতির  একটি লোক গল্প  ভীষণ গভীর অর্থ বহন করে। 

 

গল্প-৩

একদা দুজন দেবতা ছিলেন। একজন ছিলেন কালো অপরজন ছিলেন লাল । কৃষ্ণ বর্ণের দেবতা ভীষণ বিনয়ী, দয়ালু ছিলেন এবং সকল কে ভালোবাসতেন।  লাল  রঙের দেবতা কার পরোয়া করতেন না। তিনি ছিলেন অহংকারী  এমন কি তিনি  কার ও ভালো চাইতেন না।  এই দুজন দেবতা আকাশে বাস করতেন।   লাল দেবতা উঁচু আকাশে বাস করতো আর লাল দেবতা আকাশের একটু নীচের অংশে  পৃথিবীর কাছাকাছি থাকতেন। একবার  পৃথিবীতে  দূর্ভিক্ষ  শুরু হলো। গৃহপালিত পশুর দল খাবার, জল না পেয়ে মরতে লাগলো। অনাহারে তারা যখন মৃতপ্রায় সেই সময় কালো দেবতা লাল দেবতার কাছে অনুরোধ করে বললো , 
”  দয়া করে পৃথিবীতে বৃষ্টি নামান। শুকনো মাটি জল না পেলে ফসল ফলবে না। তাহলে সব জীবজন্তু, প্রাণী না খেতে পেয়ে মারা যাবে। “
লাল দেবতা প্রথমে এই কথায় রাজী হলেন  না। পরে  কালো দেবতার অনেক অনুরোধে তিনি আকাশ থেকে পৃথিবীতে বৃষ্টি নামাতে রাজী হলেন।। টানা কয়েকদিন ধরে পৃথিবীতে মুষলধারে বৃষ্টি চলতে লাগলো। কিছুদিন পর লাল দেবতা কালো দেবতাকে বললেন,
” এবার তুমি বৃষ্টিকে আটকে দাও। পৃথিবীতে আর জলের প্রয়োজন নেই।”
কালো দেবতা এ কথার উত্তরে বললো,
” আর কিছুদিন পৃথিবীবাসী বৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করুক। ধূসর মাটি বড়ই শুষ্ক ও তৃষ্ণার্ত। “
তারপর  আর ও কিছুদিন অবিরাম বৃষ্টি চলতে লাগলো। আবার ও কিছু সময় পর  লাল দেবতা কৃষ্ণ দেবতা কে বৃষ্টি থামাতে  বললো। এবার কালো দেবতা বৃষ্টি থামিয়ে দিলো। সময় স্রোতের বেগে চলে। বেশ কিছুদিন পর  কালো দেবতা লাল দেবতাকে পৃথিবীতে বৃষ্টিপাতের জন্য অনুরোধ করলো। এবার লাল দেবতা কালো দেবতার  কথায় রাজী  হলেন না। দুই দেবতার মধ্যে শুরু হলো বিরাট ঝগড়া। লাল দেবতা হুমকি দিয়ে বললেন,

” আমি সমস্ত পৃথিবীকে ভাসিয়ে দেবো।” 
কালো দেবতা  এই পরিস্থিতি থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে লাগলেন।   মনে করা হয়,   আফ্রিকায় যদি  মেঘের বিকট গর্জন শুনতে পাওয়া যায় , তার অর্থ হলো  লাল দেবতা কালো দেবতা কে ছাপিয়ে পৃথিবীর মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আর বজ্র ধ্বনি মৃদু  হওয়ার অর্থ হলো, কালো দেবতা পৃথিবীকে লাল দেবতার হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে।

এই গল্পে লাল দেবতা বলতে কাদের কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে মতভেদ আছে। কার ও মতে এদের গায়ের রঙ লালচে বাদামী কার ও মতে এরা লাল পোশাক পরিহিত।  গায়ের রঙ লাল ধরা হলে এরা সম্ভবত আরব দেশের লোক, কারণ তখন ও এই দেশে ইউরোপীয়দের পদার্পন ঘটেনি। আর লাল রঙের পোশাকের মানুষ হলে হয়তো এরা মাসাই, সাম্বারু কিংবা নীল নদ তীরবর্তী উপজাতি।  এই উপজাতিরা ঐতিহ্যগতভাবে লাল পোশাক পরিহিত।  আর এই  কালো দেবতা সম্ভবত আফ্রিকার মেরু উপজাতি। 

পূর্ব আফ্রিকার পাহাড়ের দেশ, হ্রদের দেশ উগান্ডা। এখানে গাছের পাতার আড়াল থেকে নানান প্রজাতির পাখির কুহুরব কানে আসে, শিপপাঞ্জি এ ডাল থেকে ও ডাল লাফিয়ে বেড়ায়। এই অঞ্চলের মানুষ অরণ্যে শিকার করে বেড়ায়, ছোট্ট কুটির বেঁধে পশু পাখী পালন করে। মাথায় ধূসর বর্ণের ঝুঁটিওয়ালা সারস উগান্ডার প্রতীক। এই মাটিতে   কিন্টুর  মৌখিক লোককাহিনী শুনতে পাওয়া যায়। আগে লোক মুখে প্রচারিত হলে ও ১৯ শতকের প্রথম দিকে এই গল্পগুলো মুদ্রণ আকারে লোক সমাজের কাছে পরিচয় পায়। বান্টু ভাষীদের কথায় কিন্টু হলো পৃথিবীর প্রথম মানুষ এবং উগান্ডার  আবিষ্কর্তা।  উগান্ডার  দেবতা এবং জনগোষ্ঠীর পিতা হিসেবে সম্মানিত কিন্টু । ওদের দেশীয় ভাষায়  ” কিন্টু” শব্দের অর্থ “জিনিস “। কিন্টুর সাথে জিসু ও ভুসুকু উপজাতির মুন্টুর নামের মিল আছে। মুন্টু হলেন এই দুই উপজাতির আদর্শের প্রতিমূর্তি।

 হ্যারি জনসন এর সংগৃহীত কিন্টুর লোক কাহিনীটি অনুযায়ী,   

গল্প-৪

বহুকাল আগে, উগান্ডায় কোনো মানুষ বাস করতো না। সেখানে খাবার ও  ছিলো না। সেই সময় কিন্টু  হাঁটতে হাঁটতে উগান্ডায় গিয়ে পৌঁছায়। ওর সঙ্গে শুধু একটা গরু ছিলো।  কিন্টু উগান্ডায় থাকতে শুরু করে।  এই  গরুটাই ছিলো ওর  বন্ধু। গরুর দুধ খেয়ে সে নিজের পেট ভরাতো। পৃথিবীতে তখন ও চাষ আবাদ, গৃহ পালন শুরু হয়নি। ওই সময়  গুলু রাজা থাকতেন আকাশে। গুলুর মেয়ে   আকাশ- দেবী নাম্বি কিন্টু কে দেখে তাকে মনে মনে  ভালোবেসে ফেলে। কিন্টুর প্রতি  মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করতে চায়। সব শুনে গুলু একটু ইতস্ততঃ করে।    নাম্বির সাথে কিন্টুর বিয়ে দেওয়ার কিছু তিনি একটা  পরীক্ষার আয়োজন করে। প্রথমে গুলু রাজা কিন্টুর  গুরুটা চুরি করে। গরু হারিয়ে যাওয়ায় সে খাবার খেতে না পেয়ে খিদের জ্বালায় কষ্ট পেতে থাকে। গুলু বলে,
” ওই যে মাঠে অনেক গরু চড়ছে,  তার মধ্যে তুমি যদি নিজের গরুটা চিনতে পারো, তাহলে আমার মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে দেবো।”
অসংখ্য গরুর ভিতর কিন্টু নিজের গরু খুঁজে পাবে কী করে? 
নাম্বি কিন্টু কে বলে,
” তুমি চিন্তা করো না। মাঠে গিয়ে দেখবে যে গরুর মাথায় মাছি ঘুরছে, সেটাই তোমার গরু।”
এরপর কিন্টু মাঠে গিয়ে খুব সহজেই গরুটা খুঁজে পায় আর গুলুর কাছে নিয়ে যায়।
 নাম্বির সাহায্যে কিন্টু গুলু রাজার পরীক্ষায় পাশ করলে দুজনের বিয়ে ঠিক হয়।  দুজনের বিয়ে হওয়ার পর ওরা  স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পাড়ি দেয়। যৌতুক হিসেবে গুলু রাজা কিন্টুকে কলা, আলু, ডাল, মিলেট জাতীয় শস্যের বীজ ও একটা মুরগী দেন। সব কিছু নিয়ে কিন্টু উগান্ডায় রাজ্য স্থাপন করে সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকে।   গুলু রাজা ওদের দুজন কে  বলেছিলেন, 
” তোমরা আর  স্বর্গে ফিরে এসো না।”
নাম্বির ভাই ওলম্বো হলো মৃত্যুর দেবতা। গুলু জানতেন, কিন্টু বা নাম্বি আকাশে ফিরলে ওলম্বো ওদের  পৃথিবী পর্যন্ত অনুসরণ করবে। কিন্টু নাম্বিতে পৃথিবীতে চাষবাস করে, মুরগী পালন করে দিন কাটাতে লাগলো। ওদের কয়েকজন ফুটফুটে সন্তান হলো। একদিন নাম্বি দেখলো ওদের মুরগীর খাবার নেই। স্বর্গ থেকে নাম্বি ও কিন্টু যে মুরগী উপহার পেয়েছিলো তার  জন্য খাবার আনতে ভুলে গেছে।  কিন্টুর কথায়  নাম্বি স্বর্গে মুরগীর খাবার আনতে গেলো। ব্যাস আর কী? নাম্বি ফেরার সময় ওলম্বো তার পিছু নিলো। মাটিতে এসেই  ওলম্বো কিন্তু আর নাম্বিকে  বললো,
” তোমার সন্তানদের আমার চাই।” 
  ওরা কিছুতেই  ওলম্বোর কাছে তাদের সন্তানদের দিতে রাজী হলো না। এরপর   নাম্বি গুলুর কাছে সাহায্য চাইলো। সব শুনে গুলু রাজা তার অপর এক সন্তান ওলম্বির ভাই কুয়িকুসিকে  যুদ্ধে পাঠালেন। বান্টু মতে, ” কুয়িকুসি “শব্দের অর্থ খনন।  কুয়িকুসি আর ওলম্বোর মধ্যে ঘোর যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধ  চলাকালীন ওলম্বি একটি গর্তে পড়ে  পাতালে চলে গেলো।  ওলম্বো যেন আর ফিরে আসতে না পেরে, তাই শান্তি বজায় রাখার জন্য কুয়িকুসি দুদিন ধরে পৃথিবীকে পাহারা  দিলো। ওলম্বি যখনই মাটির তলা থেকে   উঠে আসার চেষ্টা করে   কিন্টুর সন্তানরা তখনই চিৎকার করে তার পিঠে আঁচড় দিতে থাকে। অবশেষে  পরাজিত হয়ে ওলম্বি  পাতালে চলে যায়,  কুয়িকুসি ও  আকাশে ফিরে যায়। কথিত আছে, কুয়িকুসি যখন  ওলম্বিকে আক্রমন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে তখনই  পৃথিবীতে সুনামি ও ভূমিকম্প হয়।

 এই গল্পের ভিতর সুনামি, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথে মৃত্যুর সম্পর্ককে সুস্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে। মৃত্যু পৃথিবীতে নেমে আসলে যে কী ভয়ংকর পরিণাম হয়, ওলম্বো তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এই গল্পটা  পূর্ব আফ্রিকার উগান্ডার বাগান্ডায় মধ্যে মৃত্যুর ধারণাটি সম্পর্কে  প্রচলিত। 

বান্টুদের মধ্যে আর একটা লোককাহিনী আছে। 
গল্প-৫

বহুকাল আগে, একদিন  চাঁদ বুনো খরগোশ কে ডেকে বললো,
“বন্ধু, তোমায় পৃথিবীতে একটা খবর পৌঁছাতে যেতে হবে।
খরগোশ বললো,
” কী খবর চাঁদ?”
চাঁদ বললো, 
 ” তুমি মানুষের কাছে গিয়ে বলবে, প্রতিদিন যেমন দিনের বেলা  আমার  মৃত্যু হয় আর রাতে বেঁচে উঠি  ঠিক তেমন পৃথিবীর মানুষ ও যেন আমার  মতো রাতে জন্মায়  আবার দিনে মারা যায়।”
খরগোশ তো বেজায় খুশি হয়ে পৃথিবীর দিকে রওনা দিলো। পৃথিবার পৌঁছে আনন্দের চোটে  ভুল করে  বুনো খরগোশ  মানুষদদের বলল,

” চাঁদ বলেছেন, তোমরা একবার জন্মাবে  আর একবারই মারা যাবে।”
আকাশে ফিরে বুনো খরগোশের মুখে একথা শুনে চাঁদ তো রেগে আগুন। 
 রাগের চোটে একটা কুঠার তুলে খরগোশের মাথা কাটতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কিন্তু   কুঠারের কোপ খরগোশের মাথায় না পড়ে  উপরের ঠোঁটে গিয়ে পড়লো।  ঠোঁট কেটে তো রক্তারক্তি কান্ড। চাঁদের এই আচরণে খরগোশ রাগে অন্ধ হয়ে তার থাবা দিয়ে চাঁদের সারা শরীর আঁচড়ে দিলো।  সেই কারণেই চাঁদের গায়ে কালো কালো দাগ দেখা যায়।
শিশুদের মনে অনেক সময় চাঁদের গায়ের কালো গহ্বর নিয়ে প্রশ্ন জাগে। আমরা যাকে বলি ” কলঙ্ক”।
এই গল্প পড়ে শিশু মনে চাঁদের কলঙ্ক বা গহ্বর বিষয়ে ধারণার একটা ছাপ পড়ে যায়। 

লোককাহিনীতে পশু পাখি এসেছে রূপক অর্থে। তাই তারা কথা বলে, গান গায়, মানুষের মতো আচরণ করে। মানুষের মতো লোভ,বুদ্ধি, হিংসা, দুঃখ সহ সকল গুণ বা দোষ তার মধ্যে বিদ্যমান। এই উপজাতিরা বিশ্বাস করেন, ঈশ্বর পৃথিবী আর  আকাশ কে আলাদা   করেছেন। অতীতে আকাশ পৃথিবীর খুব কাছে ছিলো।  স্ত্রী লোকেরা বাড়ীর কাজ করার সময় যখন হামানদিস্তা ব্যবহার করতো, তখন সেই দিস্তার আঘাত  ঈশ্বরের পেটে লাগতো। তাই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আবার কার ও মতে, আকাশ পৃথিবীর নৈকট্যের জন্য মানুষের জ্বালানো আগুনের ধোঁয়ায় ঈশ্বরের কষ্ট হয়, তাই  রাগে তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন। বান্টুদের মতে, ঈশ্বর দূর্নীতিগ্রস্থ, অসত পৃথিবী থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চেয়েছেন।

নানান উপজাতির ইতিহাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লোক গল্প কে খোঁজার প্রয়াসে পূর্ব আফ্রিকার বৈচিত্র্য হার মানে। প্রতিদিনের জীবন থেকে উঠে আসা লোক গল্পকে সাজিয়ে আগামী পর্ব ও এগিয়ে চলবে পূর্ব আফ্রিকার পথে। 

সুকন্যার আগের পর্বগুলি পড়তে–

অলৌকিক আলোকের ধারায় লোককথাঃ লিখছেন–সুকন্যা দত্ত

অলৌকিক আলোকধারার লোককথা(পর্ব-দুই) কলমেঃ সুকন্যা দত্ত

 

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *