বিশ্বমিথের দরবার(পঞ্চম পর্ব) কলমে-দে ব লী না   রা য় চৌ ধু রী   ব্যা না র্জি

দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি পেশায় ইংরেজীর অধ্যাপিকা তবে তাঁর ভালোলাগা ও ভালোবাসায় গাঁথা হয়ে আছে দেশ বিদেশের পুরাণে। ইদানিং দেবলীনা সেই পুরাণ সাহিত্য ও প্রতীকীবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। প্রধানত, আন্তর্জাতিক জার্নালে লেখালেখি ও বিভিন্ন সেমিনারে উপস্থাপন। একটি ইংরেজী ও একটি বাংলা কবিতার বইয়ের পর,সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে “Into the Myths” নামে দেশ-বিদেশের পুরাণ নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন। Myth Muhurto নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলরও কর্ণধার। দেবলীনাও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

বিশ্বমিথের দরবার(পঞ্চম পর্ব)

কলমে-দে ব লী না   রা য় চৌ ধু রী   ব্যা না র্জি

ছবিঃ সু নি পা   ব্যা না র্জি

অপদেবতার কথা আর কি বলবো, অনেক বাকি এখনো। আজ তাই এই পর্বে আরও কিছু অপশক্তি, দানবী, রোগজনিত বিশ্বাস, প্রাকৃতিক শক্তি প্রভৃতির কথা বলি।

উপীর (Upyr):

ইন্টারনেটে খুঁজে দেখুন, সত্যিকারের ভ্যম্পায়ারের নাম পাবেন। আমি না হয় বলে দিই কয়েকটা নাম। জুলিয়া কেপলস যিনি নাকি প্রতি মাসে দুই লিটার করে রক্ত পান করেন। লিয়া বেনিঙহফ আর তার স্বামী আরো ড্রেভেন নামে এক দম্পতির ভিডিও ভাইরাল হয়। তারা একে অপরের রক্ত পান করেন সম্পর্কের প্রথম লগ্ন থেকে বলেই তারা জানিয়েছেন। এতে নাকি তারা সুগভীর তৃপ্তি পান। তাহলে কল্পনা থেকে কি বাস্তব, নাকি বাস্তব থেকেই কল্পকাহিনীর সৃষ্টি? ইয়োরোপের লোকবিশ্বাসে তো ভ্যাম্পায়ারের ধারণা বরাবরই ছিল। যেমন ছিলেন ট্রানসিলভেনিয়ার সেই কাউন্ট ড্রাকুলা। পোল্যান্ড ও বাল্টিক তটভুমি সংলগ্ন স্থানে উপীর নামক এক ভ্যাম্পায়ার অপদেবতা হিসেবে ঘুরে বেড়াত বলেই স্লাভদের বিশ্বাস। Occultist ডিওন ফরচুনার মতে ডাইনিবিদ্যা বা Occultism এ আছে যে সদ্য মৃত আত্মা মানব শরীর থেকে রক্তপান করে অশরীরি হয়েও পৃথিবীতে অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে। আর এই অশরীরি অপশক্তির স্লাভিক পরিচয় হলো এরা উপীর। তারা মৃত্যুর দূত এবং আকাশের দেবতার অনুচর।

রুসাল্কি (Rusalki)
রুসাল্কি

শুরুতেই বলেছিলাম, স্লাভিক মিথে খ্রিস্টধর্মের প্রভাবের কথা। পরবর্তীতে কিছু দানবী বা অপশক্তির কথা বলা হয়েছে যাদের উৎপত্তি কাহিনী তাই বলে। এই রুসাল্কি হলো এক রকমের দানবী যাদের বাস জলে। যেমন – সরোবর, দীঘি, পুকুরের পাশে। এদের সৃষ্টি সম্পর্কে বলা আছে যে এরা হলো, Unbaptised spirits (খ্রিস্টধর্মের দীক্ষার আগে মৃত) শিশু ও কুমারী কন্যাদের বিদেহী আত্মা এই রুসাল্কিতে পরিনত হয়। তারা সূক্ষ্ম শুভ্র বসনে বা নগ্ন অবস্থায় ঘন গাছের শাখায় লুকিয়ে থাকে। হাল্কা, লম্বা চুল, তন্বী রুসাল্কিরা ওত পেতে থাকত। ছোট্ট শিশুদের চুরি করা, বা অল্পবয়স্ক পুরুষদের ভুলিয়ে হত্যাও করত। অপবিত্র আত্মা হিসেবেই এদের পরিচিতি। এদের শান্ত করতে প্রাচীন স্লাভিক মানুষেরা রঙিন সুতো, কাপড় প্রভৃতি গাছের শাখায় বেঁধে দিতেন। তাহলে গাছে সুতো বাঁধার রীতি কিন্তু বাংলার বুকেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আর ঘন বনাঞ্চলে অনেক মানুষই হারিয়ে যেত যাতায়াতের পথে। তার থেকেই এই বিশ্বাস। লোকে বিশ্বাস করত যে এরা বৃষ্টিকে ডাক পাঠায়, বৃষ্টি আনে পৃথিবীর বুকে। প্রকৃতিপুজোর চেতনা কিন্তু খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তনের সাথে সথেই চলে যায়নি। তাই না!

বাদজুলা (Badzula)::

 

অলক্ষ্মীকে ভুললে চলে? সমুদ্রমন্থনের সময় লক্ষ্মীর আগে তিনি উঠেছিলেন। দুর্ভাগ্যের দেবী তিনি; সর্বস্বান্ত করে দেন মানুষকে। কি ভাবছেন? স্লাভিক পুরাণকথা বলতে গিয়ে হিন্দু পুরাণে ঢুকে পড়েছি? না না। অলক্ষ্মীকে চেনেন বলেই শুরু করলাম তাকে দিয়ে। আসলে স্লাভদের দেবী বাদজুলা হলেন ঠিক অলক্ষ্মীর মতোই। ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভাগ্যের দেবী। অলক্ষ্মীর মতো তিনিও কুরূপা, ময়লা বসন পড়া এক দেবী যিনি নাকি পথে পথে ঘুরে বেড়ান। শীর্ণকায়, ভয়াল দর্শন এই দেবীও প্রাচুর্যের পরিপন্থী। মানুষ এড়িয়ে চলে এই দেবীর নজর। আসলে প্রকৃতিতে সবটাই আছে, কিন্তু সমাজ সংস্কৃতিতে রীতি আছে, আছে ছক বা code , যাতে অপশক্তির আবাহন সম্ভব নয়। কিন্তু তার মানেই তা নেই, তা তো নয়। আর অপশক্তি আছে বলেই শুভশক্তির জয়জয়কার।

ব্লাসন্যা (Blaznya)

Hallucination বা দৃষ্টিবিভ্রম কিন্তু নতুন না। ধরুন ঘরে বসে আছেন, কখনো মনে হয় না যে পিছনে কেউ এসে দাড়িয়েছে? বা কখনো মনে হয়নি দরজার কড়া নড়ে উঠল, আর আপনি দেখলেন – কেউ না তো? অথবা হয়তো আপনি অফিস থেকে ফিরছেন, হঠাৎ দেখলেন কেউ আপনার পাশ কাটিয়ে চলে গেল, কিন্তু আসলে কেউ কিন্তু নেই। এগুলি আমাদের অবচেতন মনের প্রভাব। বাস্তব না হলেও মিথ্যা তো নয়। স্লাভিক মিথলজিতে এই মায়া বা ভ্রম বা Hallucinationএর জন্যেও এক অপশক্তির দায়ীত্ব দেওয়া হয়। তার নাম ব্লাসেন্যা বা ব্লাস্নিত বা ব্লাসন্যা। এরা আমাদের চোখের সামনে দৃষ্টিভ্রম সৃষ্টি করে বা শব্দমায়ার জাল বিস্তার করে ভীতির উদ্রেক করে।

প্রকৃতি নির্ভরশীলতাঃ

জার-প্তিকা (Jar-ptica) 
জার-প্তিকা

রুশ উপকথার ফুলভরা বাগানে আগুনপাখির গল্প মনে আছে? বাজপাখির মতো দক্ষ, ময়ূরের মতো সুন্দর। পালক তার সোনার মতো উজ্জ্বল। আগুনপাখি। সেই যে বণিককন্যা সুন্দরী মারুশ্যকার সেই ঝলমলে বাজ ফিনিস্ত!
স্লাভিক পুরাণকথায় সে আগুনপাখির বাস দেবতাদের ডেরায়, ঘন নীল আকাশের ওপাড়ে ইরী নামের এক সুন্দর বাগানে। অনেক ফল ফুল ফোটে সেখানে। সোনার আপেল খেতে ভালবাসে এই আগুন পাখি জার-প্তিকা। এই পাখিটির অস্তিত্ব বা বিশ্বাসের সাথে আমার গ্রীকদের পেগেসাস ও বাংলার পক্ষীরাজের বেশ সাদৃশ্য লাগে। জীবজন্তুকেও অস্বীকার করা হয়নি পেগান বা প্রকৃতিনির্ভর স্লাভিক সভ্যতায়।

● স্লাভিক সভ্যতায় প্রকৃতিনির্ভরতা বেশ লক্ষ্যণীয়। দেবতা, অপদেবতা, পশু,পাখি, গাছ, নদী – সবেতেই অতিলৌকিকতার স্পর্শ লেগে আছে। আকাশ, বাতাস, নদী, সরোবরের মতো প্রাণী, উদ্ভিদ এমনকি মানুষের রোগ, ভয় সব কিছুতেই দেবত্ব আরোপিত হয়েছে। ভারতবর্ষে যেমন ‘পঞ্চতত্ত্ব’ নিয়ে দার্শনিক চিন্তনের স্থান আছে, যা অত্যন্ত পরিনত মননশীলতার পরিচয়; স্লাভিক সংস্কৃতিতেও ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোমের অস্তিত্ব একরকম ভাবে বর্তমান। এবং তার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দেবত্ব আরোপ করার মাধ্যমে।

স্লাভ সংস্কৃতিতে প্রকৃতি নির্ভরশীলতা যে কতটা গভীর তা বলা বাহুল্য। প্রকৃতির সমস্ত উপাদানের মধ্যে, মানুষের জীবনচর্যার ছায়ায়, তাদের ভয় ও বিস্ময়ের স্ফুরনেই তাই অদৃশ্য শক্তির প্রকাশ প্রকট হয়ে থাকে। জীবন থেকেই জীবনের পরিচিতি, পরিচিতি থেকেই বিস্ময় আর বিস্ময় থেকেই বিশ্বাস।

বিশ্বমিথের দরবার” আগের পর্বগুলি পড়তে ক্লিক করুন

বিশ্বমিথের দরবারঃ (৪র্থ পর্ব)–দে ব লী না রা য় চৌ ধু রী ব্যা না র্জি

বিশ্বমিথের দরবারঃ(পর্ব তিন) কলমে-দে ব লী না   রা য় চৌ ধু রী   ব্যা না র্জি

বিশ্বমিথের দরবার(পর্ব-দুই)-লিখছেনঃ দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জী

বিশ্বমিথের দরবার– লিখছেনঃ দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি

 

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *