জ য় ন্ত    কু মা র    ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(৬-ষ্ঠ পর্ব) “অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা”

পরিচিতিঃ জন্ম- ১৯৫২, হুগলী শহর শিক্ষাদীক্ষাঃ স্নাতক- কবি, স্নাতকোত্তর- ববি; গবেষণাপত্রঃ উত্তরবঙ্গ উপ-হিমালয়ের বনবস্তির আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা; প্রাক্তনী- বন্যপ্রাণ শাখা, বনবিভাগ (১৯৭৬-২০১২); জীববৈচিত্র্য-বাস্তুসংস্থান বিষয়ে গ্রন্থকার, জার্নাল-পর্যালোচক; দেশবিদেশে প্রকাশনা ১৪০। মুক্তির সন্ধানে সঙ্গীত চর্চা। বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁরই ধারাবাহিক গদ্য।

জ য় ন্ত    কু মা র    ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(ষষ্ঠ পর্ব)

অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা

 

ষষ্ঠ পর্ব

নেকড়ের স্বভাব, গতি-প্রকৃতি
প্রাণীজগতে বিভিন্ন প্রাণীরা দলবদ্ধভাবে থেকে জীবনযাপনের নানা অভ্যাস গড়ে তোলে। আপনারা ‘নেকড়ে’ শব্দটার সাথে ‘নেকড়ের পাল’ (“pack”) কথাটাও শুনে থাকবেন। নেকড়েরা দল বেঁধে বসবাস ও শিকার করে। কিন্তু প্রকৃতিতে, নেকড়ের পালগুলি বেশিরভাগ মানুষের ধারণার চেয়ে খুব আলাদাভাবে কাজ করে। তাদের ক্ষমতার কাঠামো নিয়ে আমাদের ভুল ধারণাও থাকতে পারে। “আলফা নেকড়ে” এমন একটি শব্দ যা মাঝে মাঝেই শোনা যায়। এই ধারণাটি ১৯৪৭ সালের প্রাণী আচরণবিদ রুডলফ শেনকেলের লেখা একটি গবেষণায় পাওয়া যায়। এই ধারণা অনুসারে, নেকড়ের পালগুলি একটি “আলফা পুরুষ” এবং একটি “আলফা মহিলা” পরিচালনা করে। এই শীর্ষ নেকড়েরা অন্যান্য নেকড়েদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে একটি পালকে শাসন করে যতক্ষণ তারা অন্যদের থেকে বেশি শক্তিশালী থাকে। একই লিঙ্গের মধ্যে সব ধরণের প্রতিযোগিতাকে ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণ ও দমন করে উভয় ‘আলফা নেকড়ে’ তাদের সামাজিক অবস্থান রক্ষা করে। আলফা নেকড়েরা “বিটা নেকড়েদের” থেকে উন্নত হবার জন্য বিটাদের আনুগত্য পায়। অনুক্রমিকভাবে বিটাদের পরে রয়েছে “ওমেগা নেকড়েরা”। একটি ওমেগা নেকড়ে পুরুষ বা মহিলা হতে পারে এবং এটি বলির পাঁঠা, পালের সর্বনিম্ন মর্যাদার সদস্য। ওমেগা পালের বাসার উপকণ্ঠে বাস করে, সাধারণত শেষে খায়। ওমেগা পালের চাপ (স্ট্রেস) কমায় এবং ছানাদের সাথে খেলাধূলা করে।

এককভাবে একটি নেকড়ে বাঘ বা সিংহের মত অতটা শক্তিশালী নয় বলে, শিকার করার ক্ষেত্রে তাদেরকে বাধ্য হয়েই ঐক্যবদ্ধ হতে হয়। দলের প্রত্যেক সদস্যের পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিকতাবোধ অবাক করার মতো। নেকড়েদের মূল শক্তি তাদের সংখ্যা। গড়পড়তা একটি পালে কয়েকটি থেকে শুরু করে ৩০ বা ৪০টি পর্যন্ত নেকড়ে থাকতে পারে এবং এদের এলাকা ৪০ বর্গকিলোমিটার বা তারও বেশি অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত থাকতে পারে। এক নেকড়ে নিজের এলাকার সীমানা স্থির করে দেয় তাজা মলমূত্র দিয়ে, যাতে বাকি নেকড়েরা তা জানতে পারে৷ জীববিজ্ঞানীরা ডিএনএ বিশ্লেষণ করে নেকড়েদের আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারেন৷ মল বিশ্লেষণ করে প্রত্যেক নেকড়েকে আলাদা করে শনাক্ত করতে পারা যায়, জানা যায় একটি এলাকায় কত জন নেকড়ে, কত পরিবার বা গোষ্ঠী রয়েছে৷
একপাল নেকড়ে অত্যন্ত ভয়াবহ রকমের ক্ষিপ্র শিকারী। এরা শক্তি বাঁচানোর জন্য একঝাঁক শিকারকে পর্যবেক্ষণ করার পর তাদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল সদস্যকে শনাক্ত করে এবং সেই শিকারটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে আক্রমণ করে সহজেই মেরে ফেলে সেই প্রাণীর চামড়া, হাড় – সব খেয়ে নেয়৷ দক্ষতার ক্রমে নেকড়ে হায়েনা এবং বন্য কুকুরের ওপরে অবস্থান করে। স্বভাবগতভাবে হায়েনা ও বন্য কুকুরদের চালচলন কিছুটা নেকড়েদের মতোই, তবে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। হায়েনারা সাধারণত অন্যের শিকার চুরি করায় অভ্যস্ত। কিন্তু যখন দলবদ্ধভাবে শিকার করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তখন হায়েনারা অত্যন্ত হিংস্র হয়ে উঠে, তারা শিকার ধরার পর জীবন্ত অবস্থাতেই শিকারকে ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করে। তবে হায়েনারা বুদ্ধিমান। তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। আর বন্য কুকুররা আকারে অনেকটা ছোট হলেও দলবদ্ধভাবে বেশ কার্যকরী শিকারী; যদিও তাদের শিকার ধরার পদ্ধতিটা অনেকটা এলোমেলো ও অগোছালো।

নেকড়ে সমাজ ব্যবস্থা

সামাজিক প্রাণীদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদে আসীন হয় আলফা- পুরুষ বা মহিলা, বা উভয়েই একসাথে এই ভূমিকা পালন করে, তাদের মাঝে মাঝে ‘আলফা জুটি’ হিসাবেও উল্লেখ করা হয়। একই সামাজিক গোষ্ঠীর অন্যান্য প্রাণী আলফা বা আলফাসের প্রতি সম্মান বা অন্যান্য প্রজাতি-নির্দিষ্ট অধীনস্ত আচরণ প্রদর্শন করতে পারে। ওপরে বর্ণিত শেনকেলের আলফা-বিটা-ওমেগা তত্ত্ব বন্দী নেকড়েদের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। কিন্তু বাস্তবে বন্য পরিবেশে এই অনুক্রম অনেকটাই অন্যরকম বা ব্যাপক। আগেই বলেছি নেকড়ের একটি পালে সাধারণত একটি ‘আলফা’- পুরুষ ও স্ত্রী নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। সাধারণত এই ‘আলফা’ স্ত্রী-পুরুষ ও তাদের পূর্ববর্তী ১-৩ বছরের বংশধর বা সন্তানদের (এক্ষেত্রে মানব শিশুদুটি অর্থাৎ কমলা-অমলাকেও যোগ করতে হবে) নিয়েই নেকড়ের একেকটি পারিবারিক পাল এবং অনেকগুলো পারিবার নিয়ে একটি যৌথ পাল গঠিত হয়। তাই একপাল নেকড়ের পারস্পরিক বন্ধন হয় অত্যন্ত মজবুত। ‘আলফা’ যে কোন প্রকার বিপদ-আপদ থেকে তার পালকে আগলে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে। নেকড়েরা নিজের এলাকা রক্ষায় কোন প্রকার ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। এরা প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দেবে, তবুও নিজের এলাকায় শত্রুর অবস্থান মেনে নেবে না। আলফা সাধারণত খাদ্য সংক্রান্ত এবং অন্যান্য ক্রিয়াকলাপগুলিতে শেষ সিদ্ধান্ত নিতে পারে যদিও এর পরিধি প্রজাতির মধ্যে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। পুরুষ বা মহিলা একই লিঙ্গ বা সাথীদের কাছে অগ্রাধিকার পেতে পারে; তবে কিছু প্রজাতিতে কেবলমাত্র আলফা বা একটি আলফা জোড়া প্রজনন করে।

প্রায়শই বিটা আলফা বা আলফাসের সহযোগী, কার্যতঃ সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসাবে কাজ করে এবং যদি একটি আলফা মারা যায় বা অন্য কেউ আলফা হিসাবে বিবেচিত না হয় তবে দলের নতুন আলফা হিসাবে অভিষিক্ত হয়ে কাজ করবে। ওমেগা সাধারণতঃ পালে তৃতীয় স্তরে থাকলেও দেখা গেছে যে কখনো ওমেগা বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং বিটাকে আলফার মতো কোনও দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার পরিবর্তে বা বিটার মতো আলফাকে সহযোগিতা করার পরিবর্তে স্বনির্ভর এবং নেতৃত্বদানকারী বা কমান্ডিং গোষ্ঠী গঠনের দিকেও মনোনিবেশ করতে পারে। বস্তুতঃ প্রাণীদের সামাজিক প্রেক্ষাপট তাদের আচরণ এবং সামগ্রিক প্রজনন সাফল্যের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।
ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলি। জেনেটিক ড্রিফট (এলিলিক ড্রিফট নামেও পরিচিত) হল একটি সুনির্দিষ্ট প্রজাতির জীবগোষ্ঠীতে জিন (এলিল) এর সংখ্যায় পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে জিনের সংখ্যা বাড়তেও পারে বা কমতেও পারে। এই পরিবর্তন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নয় বরং সম্পূর্ণ ঘটনাচক্রে এলোমেলোভাবে জীবের জনগোষ্ঠীতে ঘটতে পারে। জেনেটিক ড্রিফটের কারণে জিনগত বৈচিত্র্য সম্পূর্ণভাবে হ্রাস পেতে পারে বা প্রজাতির স্থানিক অবলুপ্তিও ঘটতে পারে।
কোনো জনপুঞ্জ যদি আকারে ছোট হয়, তবে এলিলের সংখ্যা কম হবে, এবং সে জনগোষ্ঠীতে জেনেটিক ড্রিফটের প্রভাব বেশি হবে এবং যে জনপুঞ্জ আকারে বড়, তাদের উপর জেনেটিক ড্রিফটের প্রভাব কম হবে। সুতরাং স্থানীয় আবাসে কোন নেকড়ের পালে যাতে এই বিপর্যয় না ঘটে সেইজন্যই পালের নেতৃত্ব প্রজনন ক্রিয়াকলাপ পরিচালনা করে।
একটা বড় নেকড়ের পালের চলার নির্দিষ্ট ধরণ আছে। প্রথমে থাকে সবচেয়ে বয়ষ্ক, অসুস্থ ও দুর্বল নেকড়ে কারণ তাদের ধীর গতি অনুযায়ী বাকি দল চলবে। বয়ষ্ক নেকড়ের অভিজ্ঞতাও বেশী। তার চেনা নির্দেশিত পথেই বাকি দলের সদস্যরা হাঁটে। তাদের ঠিক পিছনে চলে দলের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং যোদ্ধা ধরণের নেকড়েরা। তাদের কাজ অগ্রবর্তী দলকে সাপোর্ট দেয়া এবং শত্রু পক্ষের যে কোন অতর্কিত আক্রমণ হলে তা সামাল দেয়া। তাদের ঠিক পিছনে, মাঝের সদস্যরা সবচাইতে সুরক্ষিত কারণ তাদের পেছনে থাকে খুব শক্তিশালী এবং যোদ্ধা নেকড়েরা। তাদের কাজ পিছন থেকে কোন আক্রমণ এলে সুরক্ষা দেওয়া। তাদের পিছনে একাকী নেকড়েটাই আলফা দলনেতা বা নেত্রী। সবার পিছনে সদা সতর্ক প্রহরী হয়ে সে থাকে।

একটি প্রাণীর পদমর্যাদা শুধুমাত্র শারীরিক ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে না, মানসিক বিকাশের স্তরের ওপরও নির্ভর করে। দলে নেতা বা নেত্রী সবচেয়ে স্মার্ট। তাকে পুরো পাল দেখতে, নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করতে এবং আদেশ দিতে হয়। তার দায়িত্ব হলো কেউ পিছনে পড়ে থাকছে কিনা, কারো কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা তার খেয়াল রাখা। নেতা বা নেত্রীকে শিকার সংগঠিত করতে হয় (নেকড়েদের একটি দলচালিত শিকারের ধরণ রয়েছে যার জন্য একটা ভাল সংগঠন প্রয়োজন), শিকারের বিভাজন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। পালের মধ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয়। দেখতে হয় যেন ছোটরা বড়দের আনুগত্য স্বীকার করে এবং পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকে। যখন বড়রা প্রত্যেকের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, তখনই এগুলো বাস্তবায়িত হয়। বস্তুতঃ নেকড়েদের একটা দুর্দান্ত সংগঠিত সমাজ রয়েছে যেখানে প্রত্যেকে তাদের অধিকার এবং বাধ্যবাধকতা বোঝে। দলে সবাই সহাবস্থান করতে পছন্দ করে। লিঙ্গ এবং বয়স অনুসারে দুর্বলদের সংগে সবলদের একটা পারস্পরিক সমঝোতা থাকে। নেতা বা নেত্রী তার নিজের বিবেচনার ভিত্তিতে খাদ্যের বন্টন করে। উদাহরণস্বরূপ, পর্যাপ্ত খাবার না থাকলে সে ছানাদেরকে তার নিজের ভাগ দিয়ে দেয়। তার কাজ হল পালের প্রত্যেকের যত্ন নেওয়া কারণ বিশেষ করে ছানাদের ঠিকভাবে বড় হয়ে ওঠার ওপর নির্ভর করে দলের ভবিষ্যৎ। একটি হরিণকে হত্যা করার পর, নেকড়েরা শিকার করা বন্ধ রাখে যতক্ষণ না সমস্ত মাংস শেষ হয়ে যায় এবং শুধুমাত্র ক্ষুধা তাদের শিকার করতে যেতে বাধ্য করে। নেতা বাসস্থান, শিকার, সুরক্ষার সমস্যাগুলির সমাধান করে। ক্ষুধার্ত নেতা যদি দলের নেতৃত্ব দিতে অক্ষম হয়, তবে সবাই বিপদে পড়বে, তাই তার খাদ্যের প্রাক-অধিকারের এই বিষয়টি বিতর্কিত নয়। মজার বিষয় হল, নেতা নিজে সুরক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত, কারণ বিপদের মুহুর্তে শুধুমাত্র সে দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নেয়, দলের বাকি সদস্যরা তার আদেশ পালন করে।
যোদ্ধারা নেতার দলের জন্য নিরাপত্তা দেয় এবং খাবার সরবরাহ করে। আক্রমণের ক্ষেত্রে, শুধুমাত্র যোদ্ধারা প্রতিরক্ষার জন্য রুখে দাঁড়ায়, বাকি সদস্যদের অন্যান্য কাজ থাকে। সিনিয়র যোদ্ধা শিকার এবং সুরক্ষা সংগঠিত করে, নেতার মৃত্যু বা দলের নেতৃত্ব দিতে অক্ষমতার ক্ষেত্রে নেতার আসনে অভিষিক্ত হবার ক্ষেত্রে সে প্রথম প্রতিযোগী।
বড় মা হল একটি প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীনেকড়ে যার শাবক লালন-পালনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সে তার শাবক এবং কম অভিজ্ঞ মায়েদের সন্তান পালন সম্পর্কে একজন নেত্রির দায়িত্ব পালন করতে পারে। শুধু “সন্তান”-এর জন্ম দেওয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই স্ত্রীনেকড়েকে এই পদের ভার দেয় না। যে কোনও পদের জন্য, এখানে একটি নির্দিষ্ট সাইকোফিজিকাল বিকাশ প্রয়োজন, জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকা দরকার। মায়ের কাজগুলির মধ্যে রয়েছে সন্তানদের দেখভাল ও শিক্ষাদান করা। নিজের বাচ্চার ক্ষেত্রে সবসময়ই মা নেকড়ে থাকে সতর্ক। সে তার বাচ্চাগুলোকে খুবই আদর যত্ন করে। মা নেকড়ে একসঙ্গে বাচ্চা দেয় পাঁচ থেকে চৌদ্দটি, তবে বেশিরভাগ সময় টিকে থাকে গড়ে ছ’টা। মা সবকটাকে খাইয়ে দাইয়ে বেশ আরামে রাখে। তারা মনের সুখে সারাদিন খেলা করে, আর মা তাদের চারপাশে ঘুরঘুর করে, যেন তাদের কোন ক্ষতি না হয়! মা শিকারে গেলেও বাসা ছেড়ে বেশি দুরে যায় না, বাচ্চাদের কাছে কাছেই থাকে। তবে তাদের বয়স ছয় মাস হলেই মা তাদের ভর্তি করিয়ে দেয় প্রাথমিক স্কুলে। স্কুল মানে তার নিজেরই স্কুল। সেখানে সে তার বাচ্চাদের ধীরে ধীরে শিকার করতে শেখায়। আবার একটি দলের ওপর শত্রুর আক্রমণের ঘটনা ঘটলে, মায়েরাই সমস্ত দুর্বলদেরকে নিয়ে যায় নিরাপদ স্থানে, যখন যোদ্ধারা সুরক্ষার লাইন ধরে রাখে। বাচ্চাদের খাওয়ানো এবং লালনপালনের সময়কালে, পালের সমস্ত মা দলের বিশেষ সুরক্ষা এবং অভিভাবকত্বের অধীনে থাকে।
বড় মা প্রয়োজনে নেত্রীর পদ নিতে পারে। সে বয়স্ক যোদ্ধার সাথে কখনোই প্রতিযোগিতা করে না। খালি পদটির জন্য সবচেয়ে যোগ্য সেই হয় যে দল সুষ্টুভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম। তবে যোগ্য প্রার্থীকে চিহ্নিত করার জন্য কোন প্রাণঘাতি লড়াই সচরাচর দেখা যায় না।
সব প্রাপ্তবয়স্ক নেকড়েদের প্রজনন করার অনুমতি দেওয়া হয় না। এই ব্যাপারে প্রধান শর্ত হল একটি বৃহৎ পালে তার স্থান এবং ভূমিকা। নেকড়েরা জোড়া বাঁধে সারা জীবনের জন্য। যদি জুটির একজন মারা যায়, অন্যজন নতুন দাম্পত্য সম্পর্ক তৈরি করে না বললেই চলে। অতএব, যারা দম্পতি নয় তারা একটি ছোট নেকড়ে পরিবারে তৃতীয় অভিভাবক হিসাবে বাস করে, শাবকদের শিকারের কলা-কৌশল শেখায় এবং বড় হতে সহায়তা করে। শাবক লালনপালনের জন্য ভারপ্রাপ্ত অভিভাবকরা দু’টি উপ-ভাগে বিভক্ত-
পেসতুন – অল্প বয়স্ক নেকড়ে যারা স্বাভাবিকভাবেই যোদ্ধার পদ দাবি করে না, আগের কয়েক বছরে জন্মে একটু বড় (সাব-অ্যাডাল্ট) হয়েছে। তারা তাদের মায়েদের অধীনস্থ ও তাদের আদেশ পালন করে এবং তার থেকে কম বয়স্ক নেকড়ে শাবকদের লালন-পালনে সহায়তা করে ও নিজেরা বড়দের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জন করে।
কাকা- একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ যার নিজের পরিবার নেই এবং সে প্রয়োজনে বা সুবিধামত নেকড়ে শাবকের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে।
সিগন্যালম্যান – বিপদের সময় পালকে সতর্ক করে যাতে দলের আরও দায়িত্বশীল সদস্যরা সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ছানা হল দলের সবথেকে কনিষ্ঠ সদস্য; বড়দের আনুগত্য প্রদর্শন ব্যতীত তাদের কোন দায়িত্ব নেই, তবে খাদ্য এবং সুরক্ষার ক্ষেত্রে তারা অগ্রাধিকার পায়।
নেতা যত বেশি শক্তিশালী এবং অভিজ্ঞ, তত বেশি সক্রিয়ভাবে সে সমস্ত ঝগড়া দমন করে, ফলে দলের মধ্যে কম বিরোধ এবং আগ্রাসন হয়, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ দলটিকে আরও ঐক্যবদ্ধ করে। সময়ের সাথে সাথে, শক্তিশালী পুরুষরা তাদের নেতার চারপাশে এক ধরণের “রক্ষণ দল” গঠন করে এবং আক্রমণ ও প্রতিরক্ষায় দলের প্রধান মেরুদণ্ড হিসাবে কাজ করে। কিন্তু যখন কিছু পুরুষ, প্রাপ্তবয়স্ক এবং শক্তিশালী হয়ে নেতাকে মানতে চায় না, তখন তারা দূরে গিয়ে নিজেদের আলাদা সংসার তৈরি করে।

নেকড়েরা ভিলেন, সুপ্রাচীন কাল থেকেই৷ অজস্র গল্প, রূপকথা, ‘ক্ল্যাসিক, সিনেমা — ওদের পক্ষে তেমন ভালো কথা কেউ বলেননি৷ অনেকটা ভাড়াটে খুনির মতোই ওদের আচরণ৷ ৮ থেকে ১৬ জনের দলের সবাই পোড় খাওয়া শিকারি৷ ওরা জানে কখন হামলা আর কখন নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে হয়৷ মাটির ওপর ওদের থাবার দাগ দেখলে ঘুম উড়ে যায় গৃহস্থদের৷ অনেক গৃহপালিত পশুর টুঁটি ছিন্নভিন্ন হয়েছে ওদের ধারালো দাঁতের কামড়ে৷

ক্রমশঃ

লেখা পাঠাতে পারেন

 

আগের পর্বগুলি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকগুলিতে

জ য় ন্ত কু মা র ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(৫-ম পর্ব) অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা

জ য় ন্ত কু মা র ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(৪র্থ পর্ব) “অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা”

 

জ য় ন্ত কু মা র ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(৩-য় পর্ব) “অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা”

 

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *