গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান” (২-য় পর্ব)

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস।

 

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান

২-য় পর্ব

অন্ধকার আর অন্ধকার

বুকের মধ্যে কিছু পাথর থাকা ভাল”— শক্তি চট্টোপাধ্যায়

একটা মাণ্ডাস ভেসে যাচ্ছে জোয়ারের টানে। এরকম ভেসে যায় কত কত। বিশেষত বর্ষাকাল বা বর্ষাকালের শেষের দিকে। লোক তাকিয়ে থাকে পাড় থেকে। কে মরেছে, কাকে সাপ কেটেছে, কতরকম আলোচনা হয়। ভাসতে ভাসতে কত মাণ্ডাস ধারে চলে আসে, চড়ায় আটকে যায়। রাত্রে কুকুর শেয়ালের রব ওঠে। লাশ ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি লেগে যায়। বিশ্রী পচা গন্ধে গোটা গ্রামটা ভরে যায়। দিনের বেলা মাণ্ডাস ধারে চলে এলে তাই কেউ কেউ মাঝখানে ঠেলে দেয়। সবাই চায়, সাগরে চলে যাক। কুকুর শেয়াল যেন খুবলে খেতে না পারে।

এটা কার লাশ? কাকে কাটলো মা মনসার বাহন? অশ্বিনী মাইতির ঘাটের দিক থেকে খবর আসে ধীরেন মালোর ছেলেকে সাপ কেটেছিল কাল রাত্রে। জমি আর পুকুরের মাঝখানে একটা সরু নালা আছে। সেখান দিয়ে মাছ চলাচল করে। ওখানে বাঁকি বসালে রাত্রে কড়া চিংড়ি ধরা পড়ে। সেই বাঁকি বসাতে গিয়েই পা পড়ে গেছিল সাপের লেজে। ফণা তুলে একটা ছোবল বসিয়ে দিয়েছে বিষাক্ত কেউটে।

“সুবল বাবাঠাকুর, তাড়াতাড়ি আইস’। ধীরেন মালোর ব্যাটাকে সাপে কাটছে। ” শুকদেব দোলুই খবর নিয়ে আসে ওঝার বাড়ীতে।

“কী সাপ? দ্যাখছে? কিছু কইছে?” সুবল কর্মকার জিজ্ঞেস করে। ঠিকঠাক জেনে গেলে সূবলের সুবিধা হয়। কোন কোন শিকড় বাকড় নিতে হবে, কত সময় থাকতে হবে সব জানা যায়। এখানে রাত ন’টা মানে অনেক। শুনশান রাত্রি। খুব দরকার ছাড়া কেউ জেগে থাকেনা। তার উপর কৃষ্ণপক্ষ রাত। নিকষ কালো অন্ধকার। হালকা বৃষ্টির ঝাপটা আসছে মাঝে মধ্যে। সুবোল গুনীন ভাতঘুমে পড়েছিল। তবে ঘুমোলেও তার কান সজাগ থাকে। রাতে ভিতে সাপে কাটলে, ভুতে ধরলে বা বাচ্চার বাতাস লাগলে, পেট ব্যথা করলে সুবল গুণিনই তো প্রধান ভরসা।

“হঁ, বাঠাকুর, তঁপ সাপ কামড়িছে। সঁ অ অ অ করিয়া ফণা তুলিয়া ছোবল দিছে, ধীরেনের ব্যাটা ঠিক দ্যাখছে।” শুকদেব বলে।
“অ.. অ….অ.. তাইলে খুব খেরাপ ব্যাপার। মা মনসা যে ধীরেনের ব্যাটার ভাগ্যে কী রাখছে, মা ই জানে…” সুবল গুণিন স্বগতোক্তি করে। তারপর গায়ে একটা গেঞ্জি গলিয়ে নেয়। কাঁধে আদ্যিকালের একটা ব্যাগ। ব্যাগে ওষুধ পত্র থাকে কিনা!

রাস্তায় এক হাঁটু কাদা। আলো নেই। ঠাউরে ঠাউরে যেতে হয়। মাঝে মধ্যে বিদ্যুতের আলো এলে সুবল আর শুকদেব পথ দেখে নেয়। তা, রাস্তা নেহাত কম নয়। হরিজিউর বাজার যেতে দিনের বেলায় ভালো রস্তায় অন্তত পৌনে এক ঘন্টা লাগে। হরিজিউর বাজার থেকে উত্তুরে আরো অন্তত মাইল খানেক রাস্তা গেলে ধীরেন মালোর ঘর। সুবল আর শুকদেব যখন পৌঁছাল তখন রাত বিশেষ বাকী নেই, বাকী নেই ধীরেন মালোর ব্যাটা পুটার জীবনও। মুখ থেকে ফ্যানা বেরচ্ছে, হাত পা কাঁপছে, ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে, তেষ্টায় সমুদ্র গিলে নিতে চাইছে সে।

সুবল দেরী করেনা কাজে লাগতে। মন্ত্রপড়া নুন ঘসে দেয় ক্ষত স্থানে। চার রকমের শিকড় বেটে আনার জন্য বাড়ির শিল নোড়া আনতে বলে। বাটা হয়, খাওয়ানও হয়। গামছা পাক দিয়ে দড়ির মতো করে সুবল। তার পর সেই দড়ির মতো গামছা নিয়ে পুটার ডান পায়ে, যেখানে সাপের দাঁত বসে আছে তার একটু ওপরে বার বার আঘাত করে আর মন্ত্র পড়তে থাকে সুবল। বাইরে লোক জমে গেছে হাজারখানেক। সকাল হয় ধীরে ধীরে। আরো লোক জড় হয়। গোটা গ্রামটা যেন ভেঙে উঠে এসেছে ধীরেন মালোর উঠোনে। উঠোনের ঝিঙে মাচাটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। এত লোকের ভীড়! ভিতরে সবাই ঢুকতে পারেনা। শুকদেব মাঝে মধ্যে বেরিয়ে খবর দিচ্ছিল এতক্ষণ। অনেকক্ষণ কেউ বেরোয়নি। বাইর থেকে হাঁকডাক শুরু হলো। বাড়ির ভিতর থেকে কান্নার রোল উঠলে সবাই অস্থির হয়ে উঠে। একটা আশঙ্কায় বুকের ভিতর দামামা বাজতে থাকে।
সুবল গুণিন বেরিয়ে আসে। ” পারলিনি, পারলিনি, আমি পারলিনি” বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

কত সাপকাটি রুগিকে চোখের সামনে মরতে দেখেছে সুবল। কিন্তু পুটা বাচ্চা ছেলে। বারো কি চৌদ্দ বয়স হবে। সবে তার বুকের পেশি ফুলতে শুরু করেছিল, গোপন জায়গায় লোম উঠছিল, গোঁফ দাড়ি কালো হচ্ছিল। সুবলের কান্না নিয়ন্ত্রণ করা সত্যিই সহজ ছিলনা। পারেওনি। সুবল কান্নায় ভেঙে পড়ছিল।

ঘন্টু ঘোড়ুই, চপল দোলুই, তপন বারুইরা সুবলকে স্বান্ত্বনা দিল, “কী আর করব কাকা! তুমি তো চ্যাষ্টা করছ, আমানকের ভরসা তো তুমি, তুমি ভাঙলে আমানকের কী হবে কাকা। উঠো, এখন অনেক কাজ কাকা।”

কলা গাছ কাটা হয়, বাঁশ কেটে চ্যালা করে ফ্যারাটি বের করে গোটা পাঁচেক কলা গাছের কাণ্ডকে পাশাপাশি সেই ফ্যারাটি গেঁথে রাখা হয়, তার উপর সাজানো হয় ফুল দিয়ে। সেটা নদীর উপর ভাসিয়ে দেওয়া হয়।তার উপর পুটার মৃত শরীর রেখে ভাসিয়ে দেওয়া হয় দরিয়ায়। শেষ বার মুখ দেখে নেওয়ার জন্য আত্মীয় স্বজন মা বাবার সে কী আকুলি! পুটা একা ভেসে চলে মাণ্ডাসে। ভেসে যায়, ভেসে যেতে যেতে অদৃশ্য হয়ে যায় একসময়।

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বগুলি পড়তে নিচের লিংকে যান

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস হেঁতালপারের উপাখ্যান

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *