জ য় ন্ত কু মা র ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(৩-য় পর্ব) “অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা”

পরিচিতিঃ জন্ম- ১৯৫২, হুগলী শহর শিক্ষাদীক্ষাঃ স্নাতক- কবি, স্নাতকোত্তর- ববি; গবেষণাপত্রঃ উত্তরবঙ্গ উপ-হিমালয়ের বনবস্তির আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা; প্রাক্তনী- বন্যপ্রাণ শাখা, বনবিভাগ (১৯৭৬-২০১২); জীববৈচিত্র্য-বাস্তুসংস্থান বিষয়ে গ্রন্থকার, জার্নাল-পর্যালোচক; দেশবিদেশে প্রকাশনা ১৪০। মুক্তির সন্ধানে সঙ্গীত চর্চা। বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁরই একটি গদ্য

জয়ন্ত কুমার মল্লিক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(৩-য় পর্ব)

 

অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা

তিন

চেহারা পরিবর্তন: উঁচু চোয়ালের হাড়
চুলের জঘন্য বল কাটার পরে, তাদের চেহারা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। তারা আবার মানব শিশুর মতই দেখায়। কিন্তু সাধারণ শিশুদের থেকে তাদের বৈশিষ্ট্যে একটা পার্থক্য ছিল। চোয়ালের হাড়ের গঠন উত্থিত এবং উঁচু ছিল। এর আগে তারা চুলের বল দিয়ে ঢেকে গিয়েছিল এবং হনু দেখা যায়নি। হাত ও পায়ের পরিবর্তনের মতো চোয়ালেও হাড় চিবানো এবং হাড়ের সাথে লেগে থাকা মাংস ক্রমাগত কামড়ানোর ফলে কিছুটা পরিবর্তন এসেছিল। যখন তারা চিবানোর সময় তাদের চোয়াল নাড়াতো, তখন ওপরের এবং নীচের চোয়ালের হাড় দৃশ্যমানভাবে খোলা এবং বন্ধ হয়ে যেত, ঠিক মানুষের চোয়ালের বিপরীত।
দাঁত
ওদের দাঁতের গঠন অমসৃণ, খুব সূক্ষ্ম, ধারালো প্রান্তযুক্ত এবং ঘন সন্নিবদ্ধ ছিল। চোখের লাইনে সারিবদ্ধ চারটি দাঁত, যেমন, শ্বাদন্ত, সাধারণ মানুষের চেয়ে লম্বা এবং আরও বেশি সূক্ষ্ম ছিল। মুখের ভেতরের রং ছিল রক্ত-লাল, স্বাভাবিকভাবেই মানুষদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় না।

বসা বা দাঁড়ানো
তারা মাটিতে উবু হয়ে বা হাঁটু গেড়ে বা অন্য কোনো ভঙ্গিতে বসতে পারত, কিন্তু দাঁড়াতে পারত না। তাদের হাঁটু এবং নিতম্বের জোড়গুলো বন্ধ বা খোলা যেত না কারণ জোড়গুলোর নমনীয়তা বা নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারিয়ে গিছল। সেই জোড়গুলো ছিল বড়, উঁচু এবং ভারী, বাইরে শক্ত কড়া পড়ে গিছল চার হাতপায়ে হাঁটার জন্য।

চোখ
তাদের চোখগুলি কিছুটা গোলাকার ছিল এবং দিনের বেলা ঘুমের কারণে ভারী দেখতে লাগত। কিন্তু রাত বারোটার পর সেগুলো পুরোটা খুলে যেত। অন্ধকারে তাদের চোখগুলো থেকে একটা অদ্ভুত নীল আভা বেরোত, ঠিক যেন একটি বিড়াল বা কুকুরের মতো। রাতের বেলা তাদের চোখের দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে থাকলে, আপনি তাদের শুধু দু’টি নীল শক্তিশালী আলো ছাড়া চারপাশে আর কিছুই দেখতে পাবেন না, এমনকি চোখের অধিকারীকেও নয়। আপনি কেবল দুটি নীল আলো অন্ধকারে রশ্মি ছড়াতে দেখেবেন, যা তার ফোকাস বক্রতার বাইরে অন্য সমস্ত জিনিসকে অদৃশ্য করে তোলে।

একদৃষ্টি

২০শে ডিসেম্বর, ১৯২০
এই দিন যখন তারা সবেমাত্র হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছিল তখন আমি হঠাৎ একটা ঘটনা বুঝতে পেয়েছিলাম। একদৃষ্টির এই ব্যাপারটি সাধারণত রাতের অন্ধকারে বোঝা যেত, কিন্তু যখন কোনও আলো আনা হত তখন এই নীল আলো মোটেও দেখা যেত না। তারা দিনের চেয়ে রাতে ভাল দেখতে পেত।

অন্ধকারে দৃষ্টির সংবেদন

৩রা জানুয়ারী, ১৯২১
এই দিনে বোঝা গেল যে একটি খুব অন্ধকার রাতে যেখানে মানুষের দৃষ্টি চলে না এবং কার্যকলাপ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়, তারা একটি অসম ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে সহজেই ভ্রমণ করতে পারত। তারা অন্ধকার জায়গায় মানুষ, শিশু, পশু, পাখি বা অন্য কোনো বস্তুর অস্তিত্বও সনাক্ত করতে পারত যেখানে মানুষের দৃষ্টি এরকম কোন কিছু করতেই পারত না।

নাক ও ঘ্রাণশক্তি
তাদের চ্যাপ্টা নাক এবং বড় গোলাকার নাসারন্ধ্র ছিল ঠিক আদিবাসীদের মত, তবে তাদের বিপরীতেও, তবে, শুঁকে বা ঘ্রাণ নিতে তারা নাকের মাংসল পাটাগুলোকে প্রসারিত এবং সংকুচিত করত। নাকের ছিদ্র ঠোঁট স্পর্শ করেনি বটে তবে খোলা অংশগুলো সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বড় ছিল।

উত্তেজনা
যে কোন উত্তেজনার সময় ওদের নাকের ছিদ্র থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ শ্বাসের সংগে বের হয়।

১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯২২
ওদের একটি শক্তিশালী ঘ্রাণশক্তি ছিল এবং ওরা পশুদের মতো অনেক দূর থেকে মাংস বা যে কোনো কিছুর গন্ধ পেত। ১৯২২ সালের পনেরই সেপ্টেম্বরে কমলা সত্তর গজ দূর থেকে মাংসের গন্ধ পেয়ে দ্রুত রান্নাঘরের বারান্দায় ছুটে যায়, যেখানে মাংস ছাড়ানো হচ্ছিল। একটি হিংস্র চেহারা দিয়ে, সে এটিকে খাবলে ধরতে চেষ্টা করেছিল, তার চোখ বনবন করে ঘুরছিল, চোয়াল এদিক ওদিক নড়ছিল, এবং দাঁত কিড়মিড় করছিল। এই সময় সে এক ভয়ঙ্কর গর্জন করে ওঠে যা মানুষ বা প্রাণী কারোরই নয়।

১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯২২
এই দিন কমলার সহজাত প্রবৃত্তি তাকে এতিমখানার ছাত্রাবাস থেকে প্রায় আশি গজ দূরে কম্পাউন্ডের বাইরে নিক্ষিপ্ত একটি পাখির অন্ত্রের সন্ধান পেতে সাহায্য করেছিল, আর সেখানে তাকে সেটা খেতে হাতেনাতে ধরা হয়। যখনই তারা কোনো কিছুর গন্ধ পেত, এবং যদি তারা বস্তু, প্রাণী বা মানুষ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইত, তারা তাদের নাকটি বাতাসের দিকে উঁচিয়ে বাতাস শুঁকে তার গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করত। যখন তাদের কোন খাবার দেওয়া হত, তারা তা খাওয়ার আগে সবসময় ঘ্রাণ নিত।

কান এবং শ্রবণশক্তি
তাদের বড় চ্যাপ্টা কান ছিল। উত্তেজনার সময় তাদের কান কাঁপত এবং তার রঙ পরিবর্তন হয়ে যেত। তারা দারুণ শ্রবণশক্তির অধিকারী ছিল এবং সহজে হালকা পদধ্বনি বা যে কোনো আওয়াজ শুনতে পেত। ন্যূনতম শব্দ তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত।

ঠোঁট এবং দাঁত

৩১শে ডিসেম্বর, ১৯২০ এবং ২৯শে জানুয়ারি, ১৯২১
ওদের ঠোঁট মোটা আর মুখ চওড়া ছিল। যখন ঠোঁট ফাঁক করত, তখন সাদা দাঁতের একটি সারি দেখা যেত। রাগলে ও ভয় পেলে ওদের ঠোঁট কাঁপতে দেখা যেত। এটি ১৯২০ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়, যখন ওরা বেঞ্জামিনকে কামড় দিয়েছিল এবং আঁচড়ে ছিল, সেইসাথে ২৯শে জানুয়ারী, ১৯২১ সালে, যখন রোদাকে নেকড়ে-শিশুরা একইভাবে আক্রমণ করেছিল।

গাল

ওদের গাল ছিল পূর্ণ এবং মাংসল। চিবুকের হাড়গুলো অনুপাতের বাইরে উঁচু ছিল, শঙ্কুর মতো বাইরে বেরিয়ে থাকত।

থুতনি
কমলার চিবুক গোলাকার ছিল, কিন্তু অমলার একটু ছুঁচালো ছিল। এটি মুখের আদলের সাথে তীক্ষ্ণ দেখাতো।

মুখের আদল
কমলার আদল ছিল গোলাকার, আর অমলার কিছুটা ডিম্বাকার।

কপাল
মেয়েদের কপাল ছিল সরু এবং বলিরেখায় পূর্ণ।

ভ্রু
তাদের ভ্রু ছিল ঘন ও লম্বা।

অভিব্যক্তি
ওদের মুখের অভিব্যক্তি ছিল উজ্জ্বল এবং মনোরম। সাধারণভাবে কমলার মুখ সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল এবং স্নিগ্ধতায় পূর্ণ ছিল যা দ্রুত ক্রোধ বা ভয়ের উত্তেজনায় হিংস্রতায় পরিবর্তিত হয়ে যেত।

স্পর্শ
কমলা-অমলার খুব সংবেদনশীল ত্বক ছিল। ন্যূনতম স্পর্শ তারা অনুভব করতে পারত এবং সেটা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠত।

ঘাড়

চওড়া কাঁধে তাদের ঘাড় ছিল ছোট এবং পেশীবহুল।

হাত ও পা
মেয়েদের হাত এবং বাহু লম্বা ছিল, প্রায় হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছে যেত; পেশীবহুল এবং সুগঠিত হওয়ায়, বাহু এবং হাত খুব শক্তিশালী এবং তৎপরতার পরিচায়ক। বাহুর দৈর্ঘ্যের অনুপাতে, হাত, কব্জি থেকে তর্জনী পর্যন্ত, স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে দীর্ঘ ছিল। কিন্তু সেগুলো ছিল নিঃসন্দেহে খাঁটি মানুষের হাত। কনুইয়ের জোড় এবং কব্জিও ছিল বড়, ভারী, নমনীয় এবং শক্তিশালী।

নখ
হাত ও পায়ের নখ ভেতরের দিকে অবতল আকারে ক্ষয়া ছিল। এটি আঙ্গুল দিয়ে মাটি আঁচড়ানোর কারণে হয়েছিল; পায়ের নখের অবতলতা তাদের হাঁটুতে ভর দিয়ে চলার সময় মাটিতে ঝাঁকুনি দেওয়ার কারণে হয়েছিল, যদিও তারা সাধারণত সব হাতপায়ে চলাফেরা করত।

পা

তাদের পা ছিল অদ্ভুত আকৃতির। পায়ের আঙ্গুল এবং গোড়ালি প্রসারিত এবং মাটিতে সমতলভাবে থাকত, তবে কিছুটা বাঁকা ছিল, কৌণিকভাবে বাঁকানো ছিল। দু’টি পায়ের বুড়ো আঙুল সাধারণত মানুষের চেয়ে লম্বা ছিল এবং কিছুটা বাঁকা ছিল, মাটিতে সমতল রাখলে একটি কোণ তৈরি হত। তারা পাশে আঁকাবাঁকা ছিল না, কিন্তু কোণটি একটি তাঁবুর মতো ওপরের দিকে উঠে ছিল।
পায়ের আঙ্গুলগুলো তুলনামূলকভাবে পাতলা চেটো বা পাতার সাথে সংযুক্ত ছিল এবং একটি চ্যাপ্টা গোড়ালিতে গিয়ে শেষ হয়েছিল, গোড়ালির জোড় একটি বড় বলের মতো দেখাতো। হাঁটুর জোড়গুলোও আনুপাতিকভাবে বড়, ভারী এবং শক্তিশালী ছিল।

দাবনা এবং কোমর
নিতম্ব কোমর পর্যন্ত চ্যাপ্টা ছিল এবং মোটেও মাংসল ছিল না। তাদের কোমর ছিল পাতলা এবং দুপাশে নমনীয়, শক্তপোক্ত এবং মেরুদণ্ডের সাথে সরল রেখায় যুক্ত।

মাথা
তাদের মাথা ছিল লম্বাটে, স্লিম, অস্থিযুক্ত এবং ওপরের দিকে টানা। সামনে থেকে চোখ দুটো যেন গর্তে সেট হয়ে গেছে। পাতলা, লম্বা নাক, দু’টি বড় নাসারন্ধ্রে শেষ, একজোড়া ঠোঁট মোটা এবং লম্বা। চিবুক যেন নীচে একটু ঝুলন্ত।

শরীর
সামগ্রিকভাবে শরীরের গঠন শক্তি এবং তৎপরতার কথা বলে।

লেখা পাঠাতে পারেন

 

আগের পর্বগুলি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকগুলিতে

জ য় ন্ত   কু মা র   ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা

জ য় ন্ত কু মা র ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(২-য় পর্ব)–অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা

 

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *