স্মৃতিকথা(দুই)
কলমেঃ স্বা গ তা ব্যা না র্জি
কথায় বলে স্মৃতির ঝাঁপি খুলতে বসলেই অজান্তে চক্ষে জল আসে, কারণ স্মৃতি সতত ই বেদনার। কিন্তু স্মৃতির প্রতিটি পাতায় আঁকা থাকে এমন কিছু গল্প ,যা সারাজীবন বহন করতে সকলের মাঝে ভাগ করে নিতে ভালো লাগে।
ভাগীরথীর পশ্চিম কুল বারাণসী সমতুল।প্রায় 150 বা তার থেকেও আগে আমার দাদুভাই এর বাবা নদিয়ার শান্তিপুর থেকে চলে আসে হাওড়া জেলার বালী গ্রামে। যেহেতু শান্তি পুর গঙ্গার পাশের গ্রাম তাই বালী পছন্দ হতে দেরি হয় নি। তার ওপর ওই প্রবাদ বাক্য তো ছিলোই যে বারাণসী তুল্য জায়গায় বসতি স্থাপন করেছেন।
বালী, ঐতিহাসিক দিক থেকে এই জায়গার মূল্য অনেক খানি, ইতিহাসের পাতায় যেমন প্রথম কাগজ কল প্রতিষ্ঠিত হবার কথা লেখা আছে, স্হানীয় ভাবে অনেক বয়স্ক মানুষদের বলতে শুনেছি কাগজ, কলম , কালি তিন নিয়ে বালী। যদিও অঞ্চলে শিক্ষিত মানুষের সাথে ছিল খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় সমান সমান।। কারণ পুরো বলি এলাকায় ছিল তিনটি জুটমিল। আর এই জুটমিল গুলি তে প্রচুর বিহারী শ্রমিকের সাথে সমাজের নিম্ন বর্গীয় অনেক মানুষ কাজ করতো।
বনেদি ,আভিজাত্য আর গরিমা কোনটাতেই উত্তরপাড়ার রাজা জমিদার দের মত না হলেও, বালী ছিল নিজস্ব বনেদিযানায় স্বতন্ত্র । ইংরেজ আমলে বালী ছিল সাহেবদের কুঠি ঘর। যে কুঠি পরবর্তী তে একটি ক্লাব এ রূপান্তরিত। সেই ক্লাব টির বয়স ও এখন 100 বছরের বেশি।
বালী তে যেহেতু শান্তিপুর থেকে আগত লোকজন বেশি ছিল তাই শাক্ত ধর্মালম্বনকারী ছিল বেশি, যদিও দেওয়ান গাজী পীর এর দরগা, এবং মসজিদ আজ ও পাশাপাশি সহাবস্থান করছে। আছে কল্যানেশ্বর শিব, যেখানে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব ও এসেছিলেন। রানী রাসমণি যখন দক্ষিণেশ্বরে জন্য হন্যে হয়ে জমি খুঁজছেন প্রথমে এই বালী গ্রামের জমি ই তাঁর পছন্দ হয়, কিন্তু বালির ছ আনি রাজারা কৈবত্যের মেয়ে বলে তাকে জমি দেন নি।যদি তখন ওরা এই ভুল না করতেন তাহলে আজ গঙ্গার এপার থেকে দক্ষিণেশ্বর দর্শন না করে কাছ থেকেই দর্শন করতে পারতাম। উত্তর পাড়ার রাজার দূরদর্শিতা তাকে ইতিহাসে জায়গা করে দিলেও বালীর ছ আনি রাজা ইতিহাসে দুর্ণামের ভাগীদার হয়েই আছেন।।
ছ আনি রাজাদের নিবুদ্ধিতে দক্ষিণেশ্বর হাতছাড়া হলেও দা দের রাসবাড়ী আজ আছে, আছে রাস পূর্ণিমায় এই অঞ্চলের 15 দিনের মেলা। আর এখন তো শ্যুটিং স্পট হিসাবে ভাড়া দেওয়াও হয়।
বালীর কথা বলছি অথচ বেলুড় মঠের কথা বলবো না তা হয়। আমাদের বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে 20 মিনিট বাসে গেলে 5 মিনিট পরেই বেলুড় মঠ। না এবারে নিলাম্বর মুখার্জি আর ভুল করেন নি জমি দিতে , 1929 সালের কোনো এক পূর্ণ লগ্নে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়, পুরো মঠ তৈরি হতে লাগে আরো 8 বছর। বেলুড় নাম থাকলেও তৎকালীন মিউনিসিপ্যাল ডকুমেন্টস আর লোকসভা কেন্দ্রে বেলুড় বালীর অবস্থান এক। এখনো বেলুড় বালী একসঙ্গে অনেকেই বলে। আজ কের বালী বেলুড় যে বিবেকানন্দ আর তার গুরু ভাইদের পদধূলিতে রঞ্জিত এ কথা সকলেই মানে ,বিশ্বাস করে।
আর ছিল রঘু ডাকাত। হম্ম পুরোনো দিনের বালীর গঙ্গার ওপর দিয়েই চলতো রঘু ডাকাতের ছিপ নৌকা। রঘু ডাকাত প্রতিষ্ঠিত কালি আজ ও দেখা যায়।যা সময়ের প্রভাবে জীর্ণ। এই কালি ডাকাতে কালি নামে পরিচিত। রঘু ডাকাতের গুরু বংশ আজ ও তার পুজো করে।প্রতি ডাকাতির আগে বলি দিয়ে রঘু কালি পুজো করে ডাকাতি করতে বেরোতেন।আজ ও এ কালি দেখলে গা ছম ছম করে।
রঘু ডাকাতের কালির উল্টো দিকেই রয়েছে জেটিয়া বাড়ি। আগে জুটমিলের সাহেব দের বিশ্রামাগার থাকলেও হাতবদল করে জেটিয়া দের হাতে বর্তমানে শ্যুটিং স্পট হিসাবে বিখ্যাত।
আমার ছোট বেলায় এই বালী গণ্ডগ্রাম না হলেও ছিল গ্রাম। কলকাতার খুব কাছেই কিন্তু গাছ গাছালি দিয়ে ঘেরা বিস্তীর্ণ মাঠ আর গঙ্গা। গঙ্গা আর বালি হাউস যা সাহেব দের কুঠি বাড়ি ছিল ওতপ্রোত ভাবে আমার আমাদের শৈশবে জড়িয়ে।
যেহেতু ইংরেজ দের কুঠি বাড়ি ছিল তাই এদের বাড়ি তৈরি র কাঠামো ছিল অন্যরকম ,মাটি থেকে প্রায় হাফ তলা অবধি শুধু হাওয়া বাতাস যাতে ভালো খেলে তার জন্য খাপ খাটা ঘর থাকতো। আর আমাদের স্হানীয় রা বলতো গুহা। আর ওই গুহা ছিল আমাদের অজানা উদ্ধার ,গুপ্তধন আবিষ্কারের জায়গা। প্রতিদিন একদল বন্ধু গুহার ভিতর ঢুকতাম , প্রতিদিন বলে যাওয়া হতো লাস্ট গুহায় কোনো এক বাক্সে হয়তো শেষ সাহেবের ব্যবহৃত একটা কিছু আমাদের উদ্ধার করতে হবে, কিন্তু ওই গুহা য় ভূত আছে তাই খুব সাবধান। বেশির ভাগ দিন ই কোনো কারণে ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পরে মাথায় আলু নিয়ে বেরতাম। নিজেরাই তখন ধুলো মেখে ভূত। বাড়ি গিয়ে একপ্রস্থ মার বরাদ্দ থাকতো ই কারণ ঝাঁকড়া চুলে চুন সুরকি আটকে জোট পরে একদম জটাধারী হয়ে ফিরলাম তো, মা চুল বেঁধে দিতে দিতে চড় থাপ্পড় চলতো ই। পরদিন আবার এক রুটিন।
বালী হাউস ঘিরে প্রচুর স্মৃতি তখন অনেক ছোট বালীর অনেক স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো বালী হাউসে। আমার পাড়ার সব বন্ধুরা ওই স্কুল গুলির ছাত্র ছাত্রী ,কেবল আমরা দুই বোন ছিলাম।অপেক্ষাকৃত দূরের স্কুলে পড়া ছাত্রী। আমাদের স্কুলের নিজেদের মাঠ থাকায় কোনোদিন এইখানে স্কুল স্পোর্টস হতো না। শিশু হৃদয়ে নিজের স্কুল নিয়ে গর্বিত হলেও ওই দিন গুলি খুব কষ্ট পেতাম কেন বন্ধুদের সাথে অংশ নিতে পারছি না?
কিন্ত স্কুল থেকে ফিরে মাঠেই থাকতাম কদিন,আর যখন ই কোনো বন্ধু জিতত সে যে কি আনন্দ বোঝাতে পারব না। এই স্পোর্টস চলাকালীন একবার হল এক মজার ঘটনা। পাশেই গঙ্গা মনে হয় মড়া এসেছে প্রচুর শকুন উড়ছে, পচা মাংস খাবে বলে, এদিকে আমার বোনের মাথায় উকুন হলে কিছুতেই সারতো না, শকুন দের গায়ে নাকি ভর্তি উকুন থাকে, আমায় বললো দিদি মাথা চাপা দে ,নইলে সব উকুন মাথায় চলে আসবে দুজনেই একসঙ্গে ফ্রক তুলে মাথায় । ওই ভাবেই ঘুরছি, কোনো স্কুলের এক দিদিমণি এসে জিজ্ঞাসা করলেন নাম কি? কোন স্কুলে পড়? বললাম। সেদিন খুব আদর করে বলে দিয়েছিলেন এভাবে ঘুরতে নেই শকুন গায়ে উকুন পোকা যাই থাক কোনোদিন নিজেদের জামা এভাবে ওপরে তুলতে নেই।নারী দের নিজেদের গুছিয়ে রাখতে হয়।
আজ বুঝি সেদিনের সেই কথা, তাই আজও দুই বোন নিজেদের গুছিযেই চলেছি।
শৈশবে ঢুকলে কত যে স্মৃতি ভীড় করে বলে বোঝানো যাবে না।
পাড়ার সকলেই সে সময় গুরুজন রাস্তায় কোনরূপ বেচাল দেখলে তারাই শাসন করতেন, কখনো মনে ও হয় নি কেন করতেন।
গঙ্গা অভিযান ছিল আমাদের এক বিশেষ খেলা, গঙ্গার পাড় ধরে হেঁটে গিয়ে পরের ঘাটে চলে যেতাম তারপর ভাঁটার টানে সাঁতরে নিজেদের ঘাটে ফিরতাম, এই পাড় দিয়ে যাবার সময় পলির ওপর অনেক সময় গোটা ফল দেখতাম বন্ধুদের সাথে কাড়াকাড়ি করে খেয়েওছি ভয় ছিল না পেট খারাপের বা অন্য কিছুর। যদিও জানতাম ওগুলো পুজোর ফল , যেহেতু শ্মশান ছিল পাশে মড়া কে দিত আর ওগুলোই আমরা কাড়াকাড়ি এখন ছেলে মেয়েরা ভাবতে পারবে?না কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় এই পরম পাওয়া গুলো পেয়েছি।
প্রতি সন্ধ্যায় কারেন্ট চলে গেলেই একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বাইরের রকে বসে যেতাম বন্ধুরা (আসলে তারা বেশির ভাগ তুতো ভাই বোন)চলে আসতে দেরি করতো না, তার পর শুরু হতো ভূতের গল্প। তখন এমন ভয় কারেন্ট এসে গেলেও কেউ একা যেতে পারতাম না। বড় কেউ থাকলে কত গল্প বলতো। এই রকম ই একজন নতুন দাদু। যখন দেশ স্বাধীনহোলো তখন কি করছিলে তোমরা নতুন দাদু? এটা একটা কমন প্রশ্ন ছিল আমাদে।, প্রতিবার একই উত্তর বাবা বললেন বাড়ির সব আলো গুলো জ্বেলে দাও। রেডিও তে জানান দেওয়া মাত্র আমরা পুরো বাড়ি পাড়া ছুটে বেরিয়ে ছিলাম।পরদিন এক উৎসব সকলে সকল কে মিস্টি খাইয়ে দিচ্ছে আনন্দ করছে। আসলে আমরা তো এদেশীয় তাই দেশ ভাগের স্মৃতি তাদের কাছে ছিল না।কিন্তু গঙ্গার ধারে বাড়ি থাকায় এই নতুন দাদুই বলেছিল কলকাতার দাঙ্গায় থরে থরে লাশ ভেসে আসতো ,নতুন দাদুর মতো ছোটরা গুনে আসতো আজ কটা এসেছে। তারপর নতুন দাদুর থেকে বড় তার দাদারা সেগুলি কে তুলে দাহ করতো আর যদি মনে হতো লাশ মুসলিমের তাহলে থানায় জমা দিত কারণ বালী তে কবর খানা নেই,থানা তখন কোনো ভাবে তাদের কবর খানায় পাঠিয়ে দিতো। ঝুলনের দিন গুলোয় এই কারেন্ট গেলেই চলতো আর এক খেলা। আমাদের পারে কাকুতি দাদু বলে একজন ছিলেন, আমাদের বাড়ির নিটিসেবা তার হাতেই হতো। বাড়িতে ঝুলন সাজাতম মা প্রতিদিন রাত্রে ভোগ দিত, আর ভোগ দিলে আরতি করতেই হয়, দাদু আরতি করতেন এক বিশেষ পদ্ধতি তে। মা যে যে আইটেম ঠাকুর কে খেতে দিতেন, কাকুতি দাদু সেগুলো নিয়েই গান করতো,যেমন” তিলের নাড়ু খেয়ে গোপাল নাচিতে লাগিল, নাচিতে লাগিল” আর আমরা ছোটরা তার সাথে তাল দিয়ে গাইতাম নাচিতে লাগিল সে এক অপার্থিব সুখ। কখনো গোপাল এলাচ দানা খেয়ে নাচ্ছে, কখনো লুচি,ছোলার ডাল, সুজির পায়েস। কারেন্ট অফ থাকলে এই আরতি অনেকক্ষুন্ ধরে হতো। ভালো থাকার আর ভালো রাখার উপকরণ হয়তো ছিল কম কিন্তু কখনো আনন্দ করতে অভাব বোধ করিনি।
আজ সব গল্প কথা হয়ে গেছে।
হাওড়া জেলার বালী গ্রাম আজ হয়তো প্রকৃত অর্থেই শহর । কলকাতার সাথে পাল্লা দিয়েই নিজেকে ঘুরে ফিরে সাজাচ্ছে। বিশ্ববরেণ্য অনেক ফুটবলার বদরু ব্যানার্জি, সত্যজিৎ চ্যাটার্জি , সাঁতারু সুমিতা পাড়ুই,উর্মিলা ছেত্রী, ভলিবল বাংলার অনেক প্রতিশ্রুতিমান প্লেয়ার, খোখো, কৰাডি আর ক্যারাটের স্বনামধন্য অনেক প্লেয়ার দের জন্মভূমি বালী আমার ও জন্মস্থান ভাবতেই গর্ব হয়।
আজ এই বয়সে এসে নিজের স্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করতে কত যে মনি মুক্ত খুঁজে পাচ্ছি বলার নয়।
বলতে গেলে নিজের ছন্দে এভাবেই বলতে পারি,
সেই গঙ্গা আজ ঠিক এক ভাবেই বয়ে চলেছে, জমছে স্মৃতি আরো,
তবু ছোট বেলা আনন্দই দিলো ,
যা ছিল মন্দ ভালো।
স্মৃতির সরণি বেয়ে যতই ছুটি একা,
পথের ধারে আজও হলো ছোটবেলার সাথে দেখা।