কলকাতার কথকতা(৫ম পর্ব) কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

প্রান্তিকা সরকার কলা বিভাগে স্নাতক। বর্তমানে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখির মাধ্যমে তাঁর আত্মপ্রকাশ। সাহিত্য, বিশেষত কবিতার প্রতি তাঁর অনুরক্ততা গভীর। নিজেও কবিতাই লিখতে পছন্দ করেন। কিন্তু বাইফোকালিজম্-র আঙিনায় তিনি লিখে ফেললেন একটু অন্য রকম লেখা।কলকাতার কথকতা।লেখালেখি তার একটি নেশার মত। তবে অবসরে গান শুনতে ভীষণ ভালোবাসেন।

কলকাতার কথকতা(৫ম পর্ব)

কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

গত পর্বে বলেছিলাম যে ত্রিপুরাসুন্দরী র মন্দির সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য ও গল্প নিয়ে হাজির হবো, তাই আজ আবার শেষ থেকেই শুরু করলাম। বোড়ালে অবস্থিত মা ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দিরটিতে নয়টি চূড়ার অবস্হান লক্ষ্য করা যায়, তাই এটিকে নবরত্ন মন্দির বলেও আখ্যায়িত করা হয়। মন্দির প্রবেশের পথে বিখ্যাত বোড়াল হাইস্কুলের কাছে রয়েছে সুবৃহৎ কারুকার্য মন্ডিত সুদৃশ্য তোরোণ।তোরণ থেকে সামান্য এগিয়েই মূল মন্দিরের প্রবেশ দ্বার যেখানে স্পষ্ট দৃশ্যমান “শ্রী শ্রী ত্রিপুরসুন্দরী পীঠ। ডানপাশের ভৈরব মন্দির ছাড়িয়ে মূল মন্দিরের প্রশস্ত আঙ্গিনা , যার ডানপাশে রয়েছে মন্দির কমিটির কার্যালয় এবং একটি ছোট সংগ্রহশালা। যেখানে বিভিন্ন সময়ে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ রয়েছে। এছাড়াও আছে একটি তীর্থযাত্রী নিবাস।

এবার তবে মূল মন্দিরের কথায় ফেরা যাক। মূল মন্দিরটি শ্বেতপাথরে বাঁধানো একটি সুউচ্চ ভিত্তির ওপর অবস্হিত। মন্দিরের গর্ভগৃহের চারদিকে রয়েছে একটি প্রদক্ষিণ পথ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এখানে সর্ব সাধারণের গর্ভগৃহে প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই মন্দিরের সামনেই অবস্হিত আছে একটি সুপ্রশস্হ নাটমন্দির। যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় দেবীর গুণগান গাওয়ার সাথে কীর্ত্তন, ভক্তিগীতি, গীতা পাঠ ও ভাগবত পাঠও হয়ে থাকে। এছাড়াও মহাশিবরাত্রি, শারদ নবরাত্রি প্রভৃতি বিশেষ দিনগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠান পালিত হয়। এখানে উল্লেখ্য দেবীর প্রাচীন বিগ্রহের স্হানে বর্তমানে দেবীর অষ্টধাতুর ষোড়শী মূর্তি পূজিত হয়। শ্রী পঞ্চমীর আগের দিন অর্থাৎ উমা চতুর্থী বা বরদা চতুর্থীতে দেবীর বাৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এখানে বলিপ্রথা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

মন্দিরের বাপাশে অবস্হিত আছে দেবী কুন্ড। যা প্রকৃতপক্ষে একটি ছোট পুষ্করিণী। এই কুন্ড সম্পর্কে লোকমুখে বেশ কিছু গল্পকথা প্রচলিত আছে। জানা যায় একবার এক শাঁখারী কোন এক নির্জন দুপুরে এই স্হান দিয়ে যাওয়ার সময় দেবী এক সধবা কিশোরীর রূপে তাঁর কাছে শাঁখা পরতে চান।শাঁখারী তাঁকে শাঁখা পরিয়ে দিলে দেবী শাঁখারীকে পুরোহিতের ঘর দেখিয়ে বলেন যে সেখানে কুলুঙ্গিতে মূল্য রাখা আছে এবং শাঁখারী যেন তাঁর পিতার কাছ থেকে শাঁখার মূল্য নিয়ে নেন। দেবীর কথা মতো শাঁখারী পুরোহিতের কাছে দাম চাইতে গেলে পুরোহিত অবাক হন ও কুলুঙ্গিতে রাখা শাঁখার মূল্য দেখে আশ্চর্য হয়ে যান। এরপর দুইজন মন্দিরের কাছে এসে দেবীকে ডাকাডাকি করতেই দেখতে পান দেবীকুণ্ডের মধ্যে থেকে শাঁখা পরিহিত দুটি হাত কিছু সময়ের জন্য দেখা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।

এছাড়াও মন্দিরের পেছন দিকে আছে একটি বটগাছ যেখানে মানুষ নিজেদের মনস্কামনার কথা দেবীকে জানিয়ে ঢিল বাঁধে এবং তা পূর্ণ হওয়ার পরে ঢিল খুলে দেবীকে পূজা দিয়ে যায়। রাতে এই মন্দির পরিসরে চলাফেরা বারন কেননা কথিত আছে যে দেবী রাতে তাঁর মন্দির ও বাগান পরিদর্শনে বের হন। লোকমুখে প্রচলিত আরেকটি অলৌকিক কাহিনীও এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে বয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। যে সব কন্যাদায়গ্রস্ত গরীব পিতামাতা দারিদ্র্যের কারণে মেয়ে বিয়ে দিতে অক্ষম তাঁরা এই দেবী কুন্ডে কন্যার বিবাহ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানাতেন। পরের দিন তাঁরা এই দেবী কুন্ডের ঘাটে বিবাহের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিসহ সমস্ত বাসনপত্র পেয়ে যেতেন। কিন্তু বিবাহ সম্পন্ন হলে তা আবার এই দেবীকুন্ডেই ফেরত দিয়ে যেতে হতো। একবার লোভের বশবর্তী হয়ে একটি পরিবার কিছু জিনিস নিজেদের কাছে রেখে দেয়, এই কারণে দেবী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন আর তখন থেকে এই অলৌকিক ঘটনা আর দেখা যায় নি বলেই জানা যায়। এই মন্দির সম্পর্কে এইরকমই নানা অলৌকিক কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে।

সত্যিই কী অদ্ভুত এই লোককাহিনীগুলো তাইনা! ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরের ইতিহাস ও দেবীর মাহাত্ম্য অন্বেষণ করতে গিয়ে কিছু সময়ের জন্য নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম সেই ফেলে আসা সময়ের আজানা কোন এক গহ্বরে। যার অলিগলি জুড়ে আজও বয়ে চলেছে পুরোনো দিনের চেনা চেনা মিষ্টি ঘ্রাণ, হয়তো বাতাসের আড়ালে এখনো কান পাতলে শোনা যাবে রাজা রাজরাদের সেই কথা, হয়তো বা তাই বারবার চেয়ে দেখা সেইসব দিনের আজানা ইতিকথাকে।

এই লেখাটা লিখতে গিয়ে কবি গুরুর একটা গানের কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ছিল ….

“পুরানো সেই দিনের কথা
ভুলবি কি রে হায় !
ও সে চোখের দেখা, প্রাণের কথা
সে কি ভোলা যায় ।

হয়তো বর্তমানের চর্মচক্ষু সেসব দিনকে কখনোই ছুঁয়ে অনুভব করতে পারবে না … তবে অন্তর্চক্ষু হয়তো সেই না পাওয়ার ব্যবধানকে খানিকটা হলেও দূর করতে সক্ষম হবে এইসব ইতিবৃত্তের সম্ভারে।

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকটি ক্লিক করুন

 

কলকাতার কথকতা(৪র্থ পর্ব) কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

কলকাতার কথকতা(৩য় পর্ব) কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *