কলকাতার কথকতা(৪র্থ পর্ব) কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

প্রান্তিকা সরকার কলা বিভাগে স্নাতক। বর্তমানে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখির মাধ্যমে তাঁর আত্মপ্রকাশ। সাহিত্য, বিশেষত কবিতার প্রতি তাঁর অনুরক্ততা গভীর। নিজেও কবিতাই লিখতে পছন্দ করেন। কিন্তু বাইফোকালিজম্-র আঙিনায় তিনি লিখে ফেললেন একটু অন্য রকম লেখা।কলকাতার কথকতা।লেখালেখি তার একটি নেশার মত। তবে অবসরে গান শুনতে ভীষণ ভালোবাসেন।

কলকাতার কথকতা(৪র্থ পর্ব)

কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

“গোধূলি নিঃশব্দে আসি আপন অঞ্চলে ঢাকে যথা
কর্মক্লান্ত সংসারের যত ক্ষত, যত মলিনতা,
ভগ্নভবনের দৈন্য, ছিন্নবসনের লজ্জা যত …
তবে লাগি স্তব্ধ শোক স্নিগ্ধ দুই হাতে সেইমত
প্রসারিত করে দিক অবারিত উদার তিমির … “

কাল অর্থাৎ সময়ের কাছেই যেন বাঁধা পড়ে আছে এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড। কোন এক যুগের গোধূলি বেলাতেই হয়তো বীজ বপন করা থাকে উদিয়মান সূর্যের ন্যায় প্রস্ফুটিত আগামীর। তাই একমাত্র সময়ই পারে অতীতের ফেলে যাওয়া ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে, আবার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে। ঠিক যেমনটা ইতিহাস দেখায় … ধবংস আর সৃষ্টির খেলায়। যাইহোক ফিরে আসি আমাদের আলোচনায়। আগের পর্বে বোড়ালের কথা বলেছিলাম। ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক থেকে দেখলে অনেক সমৃদ্ধশালী এই বোড়াল। দ্রষ্টব্য স্থানের সাথে বেশ কিছু প্রাচীন মন্দিরের অস্তিত্বও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে এই বোড়ালকে। আজ এরকমই একটি প্রাচীন মন্দিরের গল্প শোনাবো আপনাদের। যার সাথে আমাদের পাঠ্য ইতিহাসের বিখ্যাত রাজবংশের যোগ রয়েছে।

আদি গঙ্গার তীর সংলগ্ন বোড়ালে অবস্হিত রয়েছে একটি প্রাচীন দেবী পীঠ, মা ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দির। সেন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরের পূর্ব সীমা দিয়ে একসময় নদী তার স্বতঃস্ফূ্র্ত ধারা নিয়ে আপনবেগে প্রবাহিত হতো। জানা যায় মধ্যযুগে রাজা লক্ষণ সেনের পুত্র আদি গঙ্গা দিয়েই পৌঁছেছিলেন দক্ষিণবঙ্গের ঐতিহাসিক জনপদ রাজপুরে। এই রাজপুরেই সুদূর অতীতে ত্রিপুরার রাজবংশ রাজত্ব করতো বলে জনশ্রুতি আছে।আর এই রাজপরিবারের গৃহদেবী হলেন মা ত্রিপুরাসুন্দরী। একসময় প্রবল জলোচ্ছ্বাসে এই অঞ্চলটি ধবংসস্তূপে পরিণত হয়। জানা যায় সেন রাজা সুযোগ্য সেন মা ত্রিপুরাসুন্দরীর দারুবিগ্রহ নবরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে গঙ্গার বক্ষে দীঘি খননকালে দেবীর বিনষ্ট দারুবিগ্রহটি উদ্ধার করেন বোড়ালের পত্তনিদার হীরালাল ঘোষ। সেন বংশের কোন এক রাজা সম্ভবত এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৪০ সালে মন্দির খননকার্যের সময় যে সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও সামগ্রী পাওয়া যায় তা থেকে এই অঞ্চলটি যে মধ্যযুগীয় স্মৃতিচিহ্ন বহন করে আসছে সে সম্বন্ধে একটি সম্যক ধারণা লাভ করা যায়।

বোড়ালের এই মন্দিরের গর্ভগৃহে সুন্দর চন্দ্রাতপ শোভিত সুউচ্চ পিতলের সিংহাসন আলো করে বসে আছেন সেন বংশের কুলদেবতা রাজরাজেশ্বরী ত্রিপুরাসুন্দরী। নবোদিত সূর্য মন্ডলের ন্যায় রক্তবর্ণা ত্রিলোচনা দেবী ত্রিপুরসুন্দরী। সিংহাসন বেদীতে অনন্ত শয্যাশায়ী শ্বেতশুভ্র মহাদেবের নাভিকমলের উপর পদ্মাসনে উপবিষ্টা আছেন দেবী। তাঁর চারি হস্তে শোভা পাচ্ছে পাশ, অঙ্কুশ, শর ও ধনুক। শায়িত মহাদেবের নীচের বেদীতে অবস্হান করছেন যথাক্রমে অরুণ বর্ণের ব্রহ্মা, নীলাভ বিষ্ণু, শুক্লবর্ণের সদাশিব, রক্তবর্ণের পঞ্চানন্দ এবং হরিদ্রা বর্ণের ইশ্বর _ এই পঞ্চদেবতা।

জানা যায় দেবীর এই পীঠস্থানটি দীর্ঘ সময় ধরে কিছু কারণবশত জনশূন্য অবস্হায় ছিল। পরবর্তীতে পূর্ব বঙ্গের জগদীশ ঘোষ নামে এক ধনী জমিদার সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে নৌকাযোগে এই স্হানে তীর্থ ভ্রমন করতে এসে এই মন্দিরের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনিই বোড়ালের বনাঞ্চল পরিস্কার করে এই অঞ্চলের শ্রীবৃদ্ধি ঘটান। জনশ্রুতি আছে তিনিই গ্রামে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ধোপা, নাপিত প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষদের ভূ সম্পত্তি দান করে তাদের স্হায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করেন।

ত্রিপুরাসুন্দরীর ষোড়শী বিগ্রহ ভারতের তীর্থ আঙ্গিকে এক বিশেষ স্হান অধিকার করে আছে। তন্ত্র শাস্ত্রে এই দেবীর দুটি নামের উল্লেখ আছে। যথা – ত্রিপুরসুন্দরী ও ত্রিপুরাসুন্দরী।দেবী স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল এই ত্রিভুবনের অধিশ্বরী হওয়ায় তাঁর নাম এখানে ত্রিপুরসুন্দরী। এছাড়াও দেবীর অন্যতম আরেকটি নাম হল ত্রিপুরাসুন্দরী। জানা যায় এই দেবীর ভৈরব হলেন শ্রী পঞ্চানন দেব। এই পীঠে তিনি সেন দীঘির পশ্চিম কূলে অধিষ্ঠীত আছেন। এই দেবীর ভৈরবী মূর্তিটিও বহুলখ্যাত।বাংলা সাহিত্যে যদুনাথের ধর্মপুরাণে গ্রাম্য দেবতার বন্দনায় বোড়ালের দেবীকে ভৈরবী বলা হয়েছে। সেখানে দেবীর বর্ণনায় বলা হয়েছে উদীয়মান সহস্র সূর্যের মতো তাঁর দেহ কান্তি, দেবীর সর্বাঙ্গ নানা অলঙ্কারে শোভিত, দেবীর মস্তকে মুকুট তাতে শোভা পাচ্ছে চন্দ্রকলা ,দেবীর পরিধানে রয়েছে রক্তবস্ত্র ।ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীর প্রাচীন মন্দিরের খননকার্যের ফলে মন্দির ভিত্তির বিভিন্ন স্তরে নানারকম কারুকার্য ও গাঁথুনির বিভিন্ন প্রকার কৌশল সম্পর্কে জানা যায়। এই মন্দিরে খননকার্যের ফলে খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, মৌর্য, কুশাণ, গুপ্ত, পাল ও সেন রাজাদের আমলের বহু পোড়ামাটির মাতৃকা মূর্তি, যক্ষ মূর্তি, খন্ডিত শিব মূর্তি, বিষ্ণু মূর্তি , বৃহৎ আকারের শিলা ছাড়াও আরও অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে।বোড়ালের এই দেবী হলেন পৌরাণিক বাহান্ন পীঠের অন্তর্গত। জনশ্রুতি আছে বোড়ালে দেবীর অঙ্গুলিবিহীন বাম করতালু পড়েছিল।

আজ তাহলে এটুকুই থাক। এই মন্দির প্রসঙ্গে আরও কিছু তথ্যের সাথে হাজির হবো নতুন আরেকটি পর্বে। ইতিহাসের গর্ভে নিমজ্জিত অজানাকে জানার খিদে না হয় আরও খানিকটা গাঢ় হোক!

আগের পর্বগুলো পড়তে নিচের লিংকগুলি ক্লিক করুনঃ

কলকাতার কথকতা(৩য় পর্ব) কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

 

কলকাতার কথকতা(২য় পর্ব) কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

 

কলকাতার কথকতা(গড়িয়ার ইতিবৃত্তঃ১ম পর্ব) কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *