স্বপ্নধারার পর্বকথা(৮মপর্ব) কলমেঃ শু ক্তি   চ ট্টো পা ধ্যা য় ছবিঃ সু নি পা  ব্যা না র্জী 

শুক্তি ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে এখন নিভৃতেই তাঁর লেখা-লিখি নিয়েই ব্যস্ত। ইতিমধ্যেই যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন সাহিত্য পত্র পত্রিকার সাথে। লিখেছেন বাস্তবের আলোকে দেশ-বিদেশের পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী ও বেশ কিছু কবিতাও। এছাড়াও শুক্তি যুক্ত “জিজীবিষা” নামক লিটল ম্যাগাজিনের সাথে। সেখানেও তাঁর নিয়মিত লেখালেখি। নাচ তাঁর ভীষণ প্রিয় এছাড়াও শুক্তির ছবি আঁকা ও ফটোগ্রাফি নিয়ে অগাধ আগ্রহ।আজ থেকে প্রতি সপ্তাহে বাইফোকালিজম্-র পাতায় থাকছে তাঁর এই ধারাবাহিক।

স্বপ্নধারার পর্বকথা(৮মপর্ব)

কলমেঃ শু ক্তি   চ ট্টো পা ধ্যা য় 

ছবিঃ সু নি পা  ব্যা না র্জী

ম্যাকবেথঃ
(প্রেতাত্মা) “তুমি বলতে পার না আমি এ কাজ করেছি। আমাকে লক্ষ্য করে তোমার রক্তাক্ত কেশ ঘন ঘন নেড় না’…
হ্যাঁ, আমি মানুষ। আর এমন সাহসী যে যাতে স্বয়ং শয়তানও ভয় পায় তাও দেখতে পারে। অনুরোধ করছি তোমায়, ঐ দিকে তাকাও। দেখছ ওখানে! একে এখন তুমি কি বলবে? আমি কিসের পরোয়া করি?
(প্রেতাত্মাকে) তুমি যদি মাথা নাড়তে পার তাহ’লে কথাও বলতে পার। যাদের আমরা প্রথিত করেছি কবর সমাধি যদি তাদের ফিরিয়ে দেয় তাহ’লে আমাদের মৃতদেহের নিরাপদ সমাধি হোক শকুনের পেট।”
MACBETH
(to GHOST) Thou canst not say I did it. Never shake
Thy gory locks at me.
…Ay, and a bold one, that dare look on that
Which might appall the devil.
Prithee, see there! Behold! Look! Lo! How say you?
Why, what care I? If thou canst nod, speak too.
If charnel houses and our graves must send
Those that we bury back, our monuments
Shall be the maws of kites.

 

ghost of banquo

Shakespeare’র “Macbeth”-এর সেই বিখ্যাত উক্তি। “Macbeth”-এ হ্যালুসিনেশনের কথা বলা হবে আর Banquet scene এর কথা থাকবে না, তা অসম্ভব।
ম্যাকবেথ যখন ব্যাঙ্কোর ভূতকে দেখতে পায়, তখনই স্থান-কাল-পাত্র ভুলে অসংলগ্ন কিছু কথা বলতে শুরু করে। এটা আর কিছুই না ম্যাকবেথের হ্যালুসিনেশন। অপরাধপ্রবনতাই তার মনে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। অতীতে তাদের হাতে ঘটে যাওয়া ডানকানের হত্যা, সাথে ছিল তার রাজ্য শাসনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা, এই সব মিলিয়ে ম্যাকবেথের তখন মানসিক বিপর্যয় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই অবস্থায় সে ব্যাঙ্কোর ভূতকে দেখতে পায়। বলা ভাল হ্যালুসিনেট করে। আগেই বলেছি, স্বপ্ন শুধু ঘুমের মধ্যে দেখা কিছু ছবি নয়। স্বপ্ন মানুষের মানসিক পরিস্থিতির প্রতিফলনও বটে। পূর্বে করা কাজের কিছু স্মৃতি থাকায় তার সাথে সম্পর্কিত কিছু মনগড়া ছবি ম্যাকবেথের চোখের সামনে ভেসে উঠল। যা তার চিন্তারই ফল।
শুধু “Macbeth” নয়, Shakespeare’র আরও বিভিন্ন নাটকেই হ্যালুসিনেশনের কথা পাই। “Hamlet” হল সেরকম একটি নাটক। Prince Hamlet(প্রিন্স হ্যামলেট) বারবারই King Hamlet অর্থাৎ, তাঁর বাবার ভূতকে দেখতে পেতেন। হ্যামলেটের বাবাকে তাঁর কাকা Claudius(ক্লডিয়াস) হত্যা করেছিলেন। কিন্তু সে কথা চাপা পড়ে যায়, সময়ের অতলে। যদিও প্রিন্স হ্যামলেট তাঁর বাবার মৃত্যু ভুলতে পারেন না। হঠাৎই একদিন তাঁর বাবার আত্মা তাঁকে এসে দেখা দেয়। প্রথমে তিনি আশ্চর্য হন, ভাবেন এটি তাঁর চোখের ভুল। নিছকই দৃষ্টিভ্রম ছাড়া কিছুই না। কিন্তু পরে তা বিশ্বাস করেন। তাঁর বাবা, হ্যামলেটকে তাঁর মৃত্যু রহস্য জানান। জানান যে, তাঁর ভাই ক্লডিয়াসই তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী। শুধু একবার নয়, চারবার হ্যামলেট তাঁর বাবাকে দেখতে পান।
“…but know, thou noble youth,
The serpent that did sting thy Fathers life,
Now wears his crown.” ( King Hamlet)

 

Ghost of Hamlet

শুধু তাই নয়, কিং হ্যামলেট তাঁর পুত্রের কাছে ক্লডিয়াসের অপরাধ জানান। বলেন যে, তাঁকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। আর রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁর স্ত্রী ও হ্যামলেটের মা Gertrude-এর সম্মন্ধে। ক্রিটিকদের মতে,প্রিন্স হ্যামলেটের এই কিং হ্যামলেটকে দেখা, তাঁর উত্তেজনা, দুঃখ, হতাশা ইত্যাদির ফল। তার মানসিক চাপই তাকে অজান্তেই হ্যালুসিনেশনে বাধ্য করেছে।

আগের সপ্তাহেই আপনাদের অডিটরি ও ভিস্যুয়াল হ্যালুসিনেশনের কথা বলেছিলাম, মনে আছে? এই হ্যালুসিনেশনের ক্ষেত্রে আপনি বিভিন্ন শব্দ শুনতে পেতে পারেন। অদ্ভুত কিছু শব্দ, যা কিছু ক্ষেত্রে প্রীতিকর বা অপ্রীতিকর দুইই হতে পারে। হয়তো মনে হবে কেউ যেন হেঁটে চলে গেল বাইরে দিয়ে, কিছু একটা পায়ের শব্দ। কিন্তু অন্যরা হয়তো সেই শব্দ শুনতেই পায়নি। আবার এমন কিছু হয়তো আপনি দেখতে পাবেন, যা অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
এইরকম একটা গল্প বলি আপনাদের, যার উল্লেখ Shakespeare-এর “Tempest” এ আছে। Prospero (প্রসপেরো) ও Miranda (মিরান্ডা, প্রসপেরোর একমাত্র মেয়ে) কে Antonio(প্রসপেরোর ভাই), নেপেলসের রাজা Alonso’র সাথে মিলে, ছলের দ্বারা রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। ছোট্ট মেয়ে মিরান্ডাকে নিয়ে প্রসপেরো রাজ্য থেকে চলে যাওয়ার সময় Gonzalo(গনজালো) অনেক সাহায্য করেছিলেন। একটি নৌকো করে প্রসপেরো একটি দ্বীপে এসে উপস্থিত হন। সেই সময় সেখানে একটি গাছে Ariel(এরিয়েল) নামক একটি স্পিরিটকে আটকে রেখেছিল সাইকোরাক্স নামক একটি ডাইনি।

Ariel with Stephano, Teinculo and Caliban

প্রসপেরো জাদুবিদ্যা জানতেন। তিনিই এরিয়েলকে সেই বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেন। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী, এরিয়েলকে তাঁর অধীনে থাকতে হবে, এবং প্রসপেরোর কথা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এরপর এক সময় ঘটনাচক্রে অ্যালোনসো, অ্যানটোনিও, গনজালো প্রমুখরা সেই দ্বীপে এসে উপস্থিত হয়। জনহীন সেই দ্বীপে তারা নিজেদের একা ভাবে, কারণ তারা জানত না, সেই দ্বীপের অধীশ্বর প্রসপেরো। সেই দলে স্টিফানো, ট্রিনকুলো নামক দুজন লোক ছিল, যারা প্রসপেরোকে হত্যা করে সেই দ্বীপটি দখল করতে চাইত। তাদের দলে যোগ দেয় ক্যালিবান(প্রসপেরোর দাস)। এদিকে প্রসপেরো তাদের দুরভিসন্ধির কথা জানতে পেরে এরিয়েলকে পাঠায় তাদের সায়েস্তা করার জন্য। এরিয়েল গিয়ে বিভিন্ন সুরে গান করা শুরু করে। মাঝে-মাঝে তা ভীষণ মিষ্টি, আবার কখনো কখনো তা বড়ই অদ্ভুত। এই সব শব্দ শুনে স্টিফানো, ট্রিনকুলো বেশ ভয় পেয়ে যায়। ক্যালিবান তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও এই অদ্ভুত ঘটনায় তারা বেশ ভীত ও চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। স্টিফানো, ট্রিনকুলো ও ক্যালিবানের এই পরিকল্পনা নষ্ট করে দিতে প্রসপেরো ও এরিয়েল কিছু স্পিরিটকে পাঠায় হিংস্র কুকুরের রূপে। যা দেখে তারা ভয় পেয়ে যায়। সেই জন্তুকে আর কেউই দেখতে পায়নি। এই শব্দ শোনা বা অপ্রাকৃতিক কিছু দেখা কিন্তু তাদের হ্যালুসিনেশন ছাড়া আর কিছুই নয়।
ভয়ঙ্কর কোন ঘটনা, ভয়-আতঙ্ক, পরিচিত কোন ব্যক্তির আত্মা দেখা দেওয়া ,অপরাধবোধ এইগুলোই কিন্তু শুধু Shakespeare’র লেখার উপজীব্য ছিল না। Romantic Comedy “A Midsummer Night’s Dream”-এও এই ধরনের মজাদার কিছু ঘটনা দেখা যায়। যদিও তার বিশ্লেষণ কিছু ক্ষেত্রে মজার হয় না। যাক সে কথা, এখানে আমরা এই নাটকের কিছু চরিত্রের কথা আগে জেনে নিই। এথেন্সের রাজা থেসিউসের সাথে হিপোলিটার বিবাহ আসন্ন। এই রাজ্যেরই দুই অধিবাসী লাইসান্ডার ও হারমিয়া একে অপরকে ভালবাসে। কিন্তু হারমিয়ার বাবা লাইসান্ডারকে, হারমিয়ার যোগ্য বলে মনে না করায় তিনি ডিমেট্রিয়াসের সাথে হারমিয়ার বিবাহ ঠিক করেন। এই প্রস্তাবে অসম্মত লাইসান্ডার ও হারমিয়া সেই রাত্রে পালিয়ে যায় ও একটি একটি জঙ্গলে এসে উপস্থিত হয়। তাদের সাথে হারমিয়ার বন্ধু হেলেনা ও হারমিয়ার এক অনুরাগী ডিমেট্রিয়াস তাদের অনুসরণ করে সেই জঙ্গলে আসে। সেই জঙ্গলে থাকত ওবেরন ও টিটানিয়া নামক পরীদের রাজা ও রানি। তাদের দু’জনের কোনো এক বিষয়ে মনোমালিন্য হয়। সেইরাত্রে টিটানিয়া নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে, তাকে সায়েস্তা করার জন্য, ওবেরনের কথায় তার বিদূষক ও তার সঙ্গী পাক(Puck) টিটানিয়ার চোখে একটি love potion দিয়ে দেয়। এই potion বা মিশ্রণটির বিশেষত্ব হল, এটি চোখে দেওয়ার পর, প্রথমে চোখ খুলেই সেই মানুষটি যাকে প্রথম দেখতে পাবে , তাকেই সে ভালবেসে ফেলবে।

Titania and Bottom

এই সময় আবার একটি নাটকের দল সেই জঙ্গলে আসে। বটম(Bottom) নামে সেই নাটকের দলের এক নাট্যকার চাইত সেই দলের পরিচালক হবে, ভালো ভালো নাটক করবে ও তাদের দলের দেশজোড়া নাম হবে। কিন্তু বটম ছিল, সাধাসিধে নিরীহ নিপাট ভালোমানুষ। সে তার দল নিয়ে সেই জঙ্গলে রাত্রিবাস করতে এলে, পাক(Puck) সেই বটমের মাথায় রসিকতা করে একটি গাধার মাথা চাপিয়ে দেয়, এবং পরদিন টিটানিয়ার ঘুম ভাঙতেই সে বটমকে দেখে(সেই potion-এর জন্য) যথারীতি তার প্রেমে পড়ে যায়।
এদিকে ওবেরনের কথায় হেলেনার প্রতি ডিমেট্রিয়াসের মনে অনুভূতি জাগানোর জন্যই ডিমেট্রিয়াসের চোখে সেই potion দিতে গিয়ে, পাক ভুল করে লাইসান্ডারের চোখে সেই potion দিয়ে দেয়। তার ফলে, হিতে বিপরীত হয়। লাইসান্ডার চোখ খুলেই প্রথমে হেলেনাকে দেখতে পেয়ে তার প্রেমে পড়ে যায়। এদিকে হার্মিয়া ঘুম থেকে উঠে দেখে লাইসান্ডার হেলেনাকে তার জীবনসঙ্গিনী রূপে স্বীকার করতে উদ্যত। এই ঘটনায় হার্মিয়ার মন ভেঙে যায়।এইরকম এক অদ্ভুত হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় পাকের একটি ভুল potion দেওয়ার জন্য। কিন্তু অবশেষে এই সমস্যার সমাধান হয়। ওবেরন-টিটানিয়ার মনোমালিন্য মেটে। হার্মিয়া ফিরে পায় তার মনের মানুষ লাইসান্ডারকে। পাকের জন্যই আবার সমস্যার সমাধান হয়।
Shakespeare এখানেই তাঁর master stroke দিয়েছেন। Fairies, fantasy ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি indirectly হ্যালুসিনেশনের ধারণাকে পেশ করেছেন তাঁর এই বিখ্যাত romantic comedy “A Midsummer Night’s Dream” -এ। যেখানে পাক, ওবেরন, টিটানিয়া এদের মধ্যে দিয়ে supernatural বা অতিপ্রাকৃত (যেমন: পরী) কিছু দেখানো হলেও তা অনেকক্ষেত্রেই হ্যালুসিনেশনেরই রূপ। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, টিটানিয়া যখন বটমের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তখন তার মাথায় বসানো ছিল একটি গাধার মাথা, যা অন্যরা দেখে হেসে লুটোপুটি খায়, কিন্তু টিটানিয়ার সেইদিকে যেন খেয়ালই নেই।
আবার যখন এরিয়েল কে আমরা দেখছি অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা দিয়ে, নিজে অদৃশ্য থেকে অন্যকে ভয় দেখানো বা অন্যের পরিকল্পনা জেনে প্রসপেরোকে জানানো, অথবা জাহাজের সব মানুষদের এক ঘরে কিছুক্ষণের জন্য আটকে রেখে পুরো জাহাজকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া, এইসবই নাট্যকারের সৃষ্টি, যার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অতিপ্রাকৃত উপাদান। তবে অতিপ্রাকৃত মানেই তা ভয়ঙ্কর নয়, কিছু ক্ষেত্রে তা যুক্তিসঙ্গত বা মজাদারও বটে।

তাহলে বন্ধুরা আজ এই অবধিই থাকলো, পরের পর্বে আবার আপনাদের জন্য নিয়ে আসবো, এরকমই কিছু সাহিত্যের অমর সৃষ্টি

আগের পর্ব পড়তে নিচে ক্লিক করুনঃ

 

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *