কৃ ষ্ণা মা লি ক-র হাট দর্শন লিখছেন
হাটের মানুষ বাটের মানুষ(ষষ্ঠ পর্ব)
ভাঙা হাটে গিয়ে পড়েছি।যাবার রাস্তায় স্মৃতি তাড়া করে নিয়ে গেল।কতদিন পর এই রাস্তায়।তবু অচেনা লাগে – সেই রাস্তাই কি? কোথা সেই পায়ের পাতাডোবা ধুলো? কোথায় সেই দিকশূন্যপুরের দিকে উধাও হওয়া চন্দন রঙা গুঁড়োমাটির থি র থি র কাঁপন লাগা জলরেখার মতো সেই ধূলোর ধারাস্রোত? এখন তো ডবল লেনের পিচঢালা কালো ড্রাগন মুখ থেকে বেরনো আগুনে রাস্তার ধারের সবুজকে পুড়িয়ে দিয়েছে। সে রাস্তায় থেকে থেকে গতির ঝড়ে তুলোধোনা করা বাইক, নয়তো ট্রাক।কখনও টোটোর ফনফনে ছুটে যাওয়া।
সেসব পার হয়ে যখন পৌঁছোই তখন ছোট হাটখানি ভেঙে গেছে।পূর্ব বর্ধমান জেলার রায়না থানার পলাশন গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন এই পলাশনের হাট।বর্ধমান থেকে ভায়া শ্যামসুন্দর হয়ে গোতান, দামিন্যা, আরামবাগগামী বাস চলাচলের পাকা সড়কের ধারে এই হাট বসে।সারা সপ্তাহ ধরে স্থায়ী কাঁচা সবজির বাজার বসে ঢালাই দেওয়া ছাদের নীচে পাকা শানের উপর।এখানে সপ্তাহে দুদিন হাট।শনি ও মঙ্গলবার।হাটের দিন বাজার চালু থাকে দুপুর একটা পর্যন্ত।সকাল থেকে ওই সময়টুকুর মধ্যে কেনাবেচা সারা।
আজও আমি গেলাম যখন তখন ভিন গাঁয়ের হাটুরেরা ঝুড়ি বস্তা সব গোছগাছ বাঁধাছাঁদা সারছেন, কেউ কেউ বাঁধা লটবহর ছোট হাতি, বা বড়োতে তুলে বাগিয়ে রাখায়।বিক্রি না হওয়া জিনিসগুলি তাঁদের বাড়তি মাথাব্যাথার কারণ।বলতে ভুলে গেছি, এই হাটে সাধারণত শাকসবজি, ফলমূল নানা ধরণের বীজ ইত্যাদির বিক্রিবাটাই বেশি, তা বলে যে অবনী ঘোষের বিদ্যুৎবাম জাতীয় মলমটলমের ঘোষণাকরা ঠেলাগাড়ি থাকে না, বা খাবে ঘরে, মরবে বাইরে গোত্রের ইঁদুরমারার সেঁকো বিষটিষ পাওয়া যায় না তা নয়। সেহারার হাটে দেখা হয়েছিল যে রাধেশ্যাম ঘোষের সঙ্গে, যিনি ঘুরে ঘুরে গামছা বিক্রি করেন, তাঁর সঙ্গে এখানেও।বাস ধরবেন বলে স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছেন।আমায় দেখে হাসলেন।আমি হাসার আগে বুঝতে চেষ্টা করলুম তাঁর হাসিটা ভেতর থেকে এলো কিনা।মানে হচ্ছে আজ বিক্রি বাটা কেমন হয়েছে তা বোঝা।দেখলাম হাসিটা দিলখোলাই বটে।তখন জানতে চাইলাম, আজ কেমন?
দেখি মুখটা করুণ করার চেষ্টা করছেন, ওই আরকি, বাজার ভালো নয় !” আমি চেপে ধরতে হেসে ফেললেন।বললেন, হ্যাঁ! তা আজ বিক্কিরি মন্দ নয়।-তবে? আমার শঙ্খ ঘোষের পদ্যটা অকারণেই মনে পড়ে গেল – “দুঃখু দুঃখু মুখ করে খুব ফূর্তি করেছি”।
আমি এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত টহল দিলাম একবার।ইদানীং মানুষ বড়ো অবিশ্বাস করে মানুষকে। কাউকে কিছু জিগ্যেস করলে আগে চোখ তুলে তাকিয়ে থাকবে কিছুক্ষণ। হাটের লোক নয় বুঝতে পারলে তোমার জিজ্ঞাসার উত্তরে তোমায় জিগ্যেস করবে।কেন? কী দরকার আপনার? কোথা থেকে আসছেন? এসব জেনে আপনি কী করবেন? আপনি কে? – এসব আমার গা সওয়া হয়ে গেছে।আমিও গাঁয়ের লোক, আমাকে অত কাত করা যায় না।জানি, পরণের কথা দু-একখানা বললেই তাঁরা গপ্প জুড়ে দেবেন।উপরে যতই কঠিন দেখাক, আসলে বড়ো সরল সহজ।অবশ্য খব শক্ত ঠাঁই হলে আমিও ঠাঁই বদল করে নিই।
হাটের একবারে দক্ষিণ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ভাবছি, আজ বড়োই দেরি করে ফেললাম।হাটের চরিত্রটা বোঝাই গেল না। চায়ের দোকান দেখে ওই ঘোর রোদের ভেতর দুপুর বারোটায় আমি ন্যাকা সেজে চা চাইব কিনা ভাবছি, তাকিয়ে দেখি তাঁর গ্যাস স্টোভ পুড়ে পুড়ে ক্লান্ত হয়ে এখন জিরোচ্ছে।তার সারা গায়ে দুধ চা চিনি জলের মামড়ি।বার্নারের চারপাশে প্রচুর কালি ও শক্ত জমাট নোংরা।সেটা একপাশে বসানো।সামনে ছোট্ট চৌকিমতো।তার উপর বস্তা বিছিয়ে কয়েকটি কৌটো সাজানো।চায়ের উপকরণ আর দু-তিন ধরণের বিস্কুট। দোকানির মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঘেমো মুখ।সকালে স্নান সেরে হয়তো কপালে সিঁদুরের একটা ফোঁটা পরেছিলেন ঠাকুরকে ফুলজল দিয়ে।এই ঘন দুপুরে তা আর বোঝার উপায় নেই, কেবল আবছা আবছা লালচে দাগটুকু রয়ে গেছে।দোকানি হাতের বেড়ে হাঁটু জড়িয়ে উদাস চোখে তাকিয়ে আছেন।
দোকানটি একটি পাকা একচালা ঘরের সরু একফালি বারান্দায়, ঘরের দেওয়ালের গা থেকে ঢালু করে খড়ের ছাউনি দেওয়া।হয়তো রোদজল থেকে দোকান বাঁচাতেই এই উপায়।বারান্দার ধার ফুটখানেক উঁচু করে ইটের গাঁথনি ও সিমেন্ট দিয়ে মাজা।সেখানে সম্ভবত খদ্দের বসে চা পান করে।আমি গিয়ে বসলাম।বললাম, চা আর হবে না বোধহয়- !
হাঁটুকে হাতের বাঁধন মুক্ত করে সোজা হলেন মুহূর্তে।বললেন, না, দিদিমণি।দোকান বন্ধ করেছি।
“আজ কেমন বিক্রি হলো?”
“ভালো না!”
“অন্যদিন কেমন হয়?”
#প্রাঞ্জল হলেন।বললেন, হাটের দিন একটু বেশি হয়, এই একশ বিশ পঁচিশ কাপ।অন্য দিন দুপুর পজ্জন্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পঁচিশ কাপও হতে চায় না।
“ওতে সংসার চলে?” প্রশ্ন শুনে বললেন, “চলতে কি চায়? ওই র-ঠ র-ঠ করে চলছে।জমিজায়গা নাই।গায়েগতরে আর খাটতে পারি না, বুকের দোষ-!”
আমি ভাবছি আর জলে ডুবছি, দুবেলায় যদি পঞ্চাশ কাপ চা-ও বিক্রি হয়, তাতে ক’টাকা থাকতে পারে।তখন উনি আমায় জলে ডোবা থেকে খানিকটা বাঁচালেন।বললেন, একটাই ছেলে, সে হ্যাচারিতে কাজ করে হাজার পাঁচেক পায় তাই কিছুটা সুরাহা।”
মানুষের জীবন কেমন যেন মনে হয় , পুঁজভর্তি ফোঁড়ার মতো, সামান্য খোঁচা লাগলে জমা বদরক্ত বেরিয়ে আসে।কখনও হাসি হয়ে তো কখনও কান্না, কখনও বেদনা , কখনও দুঃখ বা আক্ষেপ হয়ে।ছোটবেলায় দেখেছি মানুষের ঘা ফোঁড়া এসব খুব হতো।ইদানীলকালে আর সেসব চোখে পড়ে না বোধহয় দূষণে দূষণ ক্ষয় হয়ে গেছে! আমার এক খুড়তুতো কাকুর গালে ফোঁড়া হয়েছিল ইয়াব্বড়ো সাইজের।ঠাকুমা একটা ধানের সুঙো দিয়ে, অর্থাৎ সুঁচোলো অংশটা দিয়ে ফোঁড়ার মুখ উসকে দিতেই গলগল করে নেমে এলো পুঁজরক্ত।
যখন জানতে চাইলাম, কতদিনের এই চায়ের দোকান? তখন হাসলেন, সামনে জলভর্তি একটা লোহার জবরদস্ত বালতি দেখালেন – কত দিনের পুরনো বলুন তো? উত্তর নিজেই দিলেন।আমার ছেলে যেদিন হলো, ২০০০ সালের পাঁচুই বোশেখ – এর বয়স তার থেকে কিছু বেশি।ছেলের জন্মদিনই আমার দোকানটা চালু হলো।বালতিটা নতুন আছে, তবে আমার বয়েস বেড়েছে।আর অবস্থাও বিশেষ পাল্টায়নি।
আমি হ্যাঁ হ্যাঁ করে সায় দিই, আর মনের চোখে সব দেখতে থাকি।
“ফাইব পজ্জন্ত পড়েছি।তারপর মা আর পড়াতে পারল না।পড়া ছেড়ে কাজে ঢুকলুম।দুর্গাপুরে একটা ভাতের হোটেলে কাজ করতুম, সেখান থেকে কলকাতায়।ভাতের হোটেল ছেড়ে মনোহারি দোকানে।খাওয়া দাওয়া দিতে মালিকেরা পিছপা হতো না, জানলেন? মানুষ খাবারের দাম ধরত না, পেটে দুটো খাবে বই তো নয় – এরকমই ভাবত তখনকার দিনে।তাই পঞ্চাশ ট্যাকা মাইনের সবটাই প্রায় থেকে যেত।কিন্তু আমার মন টিকলুনি।পালিয়ে এলুম।
তখন আমি জমির কাজ করতুম।সন্ধ্যে পজ্জন্ত কাজ করে পাঁচশিকে, দু-ট্যাকা মাইনে আর সাতশো গেরাম চাল।—”
গল্পে গল্পে বেলা গড়ায়।তাঁর বাবার দুই পক্ষে দশটি ছেলে আর তিনটি মেয়ে।তাঁর বাবার কলকাতায় দোকান ছিল।ছেচল্লিশের “রাইটের” সময় তিনি চলে এলেন দোকান ফেলে।বন্ধ দোকানগুলো খোলার তাগাদা দিল সরকার।নাহলে নিলাম করে দেবে।তবু তিনি গেলেন না।তাঁর বাবার প্রথম পক্ষের ভায়রাভাই ৫০০ টাকায় নিলাম ডেকে নিয়েছিল, “এখন তাদের খুব রমরমা।”
“বাবা আমার ছিল আমুদে লোক।গান গাইত দল জুটিয়ে, ফুটবল দল গড়ত, ফানশান করত।এই করে বেড়াত, আর ওদিকে দোকান লাটে উঠল।বাবা বললে, নিজের লোকই তো নিলাম ডাকছে, অসুবিধে কি? সমসময় ফূর্তিতে আছে।সৎ বড়োদাদা ঘুমন্ত বাবাকে বেঁধে রেখে “আইরেন সেফ” ভেঙে ট্যাকাপয়সা সোনা রূপো যা ছিল নিয়ে পালিয়ে গেল তার শ্বশুরবাড়ি।তবু বাবা হেসে বললে, যাক গে যাক-!” একটু থেমে বললেন, কথাটা প্রায় মুদ্রাদোষের মতো বেশ কয়েক বারই বললেন, “ইসব আমি আর কীকরে জানব! বাবা য্যাখন যায়, আমি ত্যাখন সাত মাসের।
জমি জায়গা ছিল ভালুই, তাই তত অভাব ছিল না ঠিকই, তবে বাবা ধরে রাখতে পারলুনি।তার শখ সবাইকে খেলো।বাবা মরলও বৈঠকখানা ঘরে গান গাইতে গাইতে।কাকা সব বাজায় রেখেছিল বলে পলাশন বাজারের এইসব দোকানদানি দেখছেন সব তার তরফের।রাস্তার ওপারে বেনেপাড়ায় আমার বাড়ি।” একটু থেমে বললেন, বাবাও মরল আর মাও লোকের ঘরে মুড়ি ভাজতে ঢুকল এক আনার বিনিময়ে।তা এক আনারও মূল্য ছিল ত্যাখনকার দিনে।আমি আর এসব কীকরে জানব।বাবা য্যাখন যায় আমি সাত মাসের।লোকে বলে তাই শুনেছি।মা বলত কিছু কিছু।”
আপনি গান করেন না? এত উদাস আর নিরিহ চা-ওলা জীবনে দেখিনি।কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দেখে আর তাঁর বাবার গল্প শুনে বুঝেছি ফল্গু অন্তঃসলিলা, তাই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লাম।
নিরাশ হলাম না।– “আমি দলের সঙ্গে ভিড়েছিলুম।পাশের পাড়ায় বাউলের আখড়া ছিল।গান ভালোবাসতুম।যেতুম রিয়াসিলে।তবে বৌ খুব রাগ করত।ওখেনে দশ এগারোটা মেয়েও ছিল।তাদের সঙ্গে গান গাওয়া পছন্দ করতুনি।তাই ছেড়ে দিলুম আস্তে আস্তে”। আচমকা চুপ করে গেলেন। কিন্তু আমি ভাবছি, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, মা কলির ভক্ত হওয়া মানানসই হতো না? তার বদলে দেখি ইনিও বাউলদলের। তা এমন আমি দেখেছি বিলাসিনী বাউলের বেলাতেও।বাউল হয়েও যিনি কৃষ্ণরাধার নাম নেন কথায় কথায়। ইনি কালীকে জবাফুল দিয়ে প্রণাম করলেও বাউলের মনটা তাঁর বজায় আছে।তাঁর কথা শুনে আমি আর কিছু বললাম না।বাড়ি ফিরতে হবে।আমার মেয়েরা অপেক্ষা করছে।
উঠব উঠব করছি।বললেন, “আমার চলে যায়, এতেই খুশি।ধরুন না ক্যানে, কত লোকের চোখ নাই, পা নাই, হাত নাই।একটা গোটা শরীর তো আমার আছে? দিন তো চলে যাচ্ছে মোটা ভাত কাপড়ে! আর কী চাই? ভগবান আমায় ছেলেমেয়ে দিয়েছে, তারা বেঁচে বর্তে আছে।এই ধরুন না, বাড়ি গেলে আমার বৌ আমার সামনে ভাতের থালাটা ধরে দেবে। হয়তো মাছমাংসর বাটি থাকবে নে, পাতে একটুন নুন আর শাকপাত তো থাকবে – ব্যাস!”
আমি ভালো থাকার মন্তর জপতে জপতে বাড়ি ফিরি। তাঁর শেষের কথাগুলো আমরা হরবখৎ বলে থাকি।সে বলতে হয় বলে বলা।কিন্তু কখনও কখনও কোনো কোনো কথা কেমন স্যাঁক করে এসে বিঁধে যায়।তাই ফেরার পথে রোদ-গরম একটু কম লাগতে লাগল।
পথে জলশূন্য পুকুর পড়ল, তার মাঝখানে বেলগাছের মোটা ডাল পোঁতা।যখন প্রথম ওই পুকুর খনন হয়েছিল তখন মাঝপুকুরে ওই ডাল পোঁতা হয়েছিল গ্রাম্য রীতি মেনে।এখন তার সামান্য জলকাদায় পথের কুকুর লুটোপুটি খাচ্ছে।বাঁকের মুখে একলা মুখশুকনো বেড়ালটি রাস্তা পেরিয়ে গেল নিরাসক্ত ভঙ্গিতে।গাছের পাতা ঝরঝর সরসর করে কী যেন বলে।সবই কেমন পূর্ণ হয়ে ওঠার অপেক্ষায় বলে মনে হলো।কিংবা হয়তো পূর্ণই।কেবল আমাদের খন্ডিত চোখে তা ধরা পড়ে না।
আগের পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে
কৃ ষ্ণা মা লি ক-র হাট দর্শন লিখছেনঃ হাটের মানুষ বাটের মানুষ(পর্ব-পাঁচ)