কৃ ষ্ণা   মা লি ক-র হাট দর্শন লিখছেনঃ হাটের মানুষ বাটের মানুষ(পর্ব-পাঁচ)

[contact-form][contact-field label=”Name” type=”name” required=”true” /][contact-field label=”Email” type=”email” required=”true” /][contact-field label=”Website” type=”url” /][contact-field label=”Message” type=”textarea” /][/contact-form]

পরিচিতিঃ পূর্ব বর্ধমানের প্রত্যন্ত গাঁয়ের ধুলোমাটিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর। পায়ের তলার সরষেকে গড়িয়ে যেতে না দিয়ে জোর করে পিষে ফেলে ঘরে আটকে থাকা। কলমের কাছে মুক্তি চেয়ে নিয়েছিলেন। প্রকাশিত কবিতার বই কয়েকটি। একটি গদ্যের। এখন গদ্য দ্বিতীয় প্রেম। কৃৃৃৃষ্ণা, যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা ছদ্মনামেও লেখেন। 

 

কৃ ষ্ণা   মা লি ক-র হাট দর্শন লিখছেন

 

হাটের মানুষ বাটের মানুষ(পর্ব পাঁচ)

সেহারার হাটের ইতিহাস

 

একটা কথা কদিন ধরে খুবই মনে হচ্ছিল।হাটে হাটে বেলা কাটছে বটে, তা হাটের ইংরেজিটা সঠিক কী হতে পারে? যা দেখলাম, সেগুলো আমার যেন কেমন মনে হলো বেলাগসই। আসলে শব্দটা বে-লাগসই। যার ব্যবহার আমি অন্তত অন্যত্র দেখিনি।তাই শব্দটাকে তাক মতো ব্যবহার করতে পেরে বেশ একটু আত্মপ্রসাদ লাভ করছি, ভুল-ঠিক জানি না। যেমন বানিয়েছিলুম “উলসে ওঠা” শব্দটা।ওমা! তার বেশ কিছুদিন পরে দেখি সে শব্দ একজন কোথায় যেন ব্যবহার করলেন! তা হোক গে, শব্দ খাঁচায় আটকে রাখার জিনিস নাকি? বাংলা ভাষার প্রসার হলে লাভ বই ক্ষতি তো কিছু নেই। তো হাটের ইংরেজি খুব একটা ঠিক মনঃপূত হলো না।- market, mob, fair, mart, assembly এইসব শব্দে যেন ‘হাট’এর ‘হার্ট’ বা নিদেন তার ফ্লেভারটা ঠিকঠিক পাওয়া যাচ্ছে না। আর একটা ইংরেজিতে ‘হাটে’র স্বভাবটা খানিকটা ধরা পড়ে বটে, তবে সেটাও কেমন খানিকটা গালাগাল দেবার মতো। কিংবা ‘হাট’ ব্যাপারটাতে নাক সিঁটকানোর মতো। তা হচ্ছে disturbingly noisy place. ব্যাপারটা ভাবুন একবার! আরে ওর যে স্ব-ভাবটাই এই! কেন কেউ ডিস্টার্বড্ হবে? যদি কেউ তা হয় তাহলে তার হাটে যাবার দরকারটা কী? ওই যে বলছিলাম, গালাগাল দেবার মতো?

অথচ এই হাট হলো গ্রামবাংলার অর্থনৈতিক জীবনের প্রাণকেন্দ্র। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই এই হাটের উপর অধিকাংশতঃ নির্ভরশীল হতেন একসময়। ইদানীং “বাজার” নামক তথাকথিত সুসভ্য বিষয়টি বেশ – যাকে বলে কেত দেখিয়ে ঝকঝকে দন্তবিস্ফার করে মানুষের হাতের কাঁচাটাকা কড়মড়িয়ে খাবার জন্য লোভী জিভখানা পেতে রেখেছে।তাই কিছুটা হলেও সেই disturbingly noisy place টি কিছু “নয়েজ” ঝরিয়ে ফেলে কিছু ঝিমিয়ে গেছে।

যখন যানবাহনের এত চল হয়নি, লোকে গরু-মোষের গাড়ির উপর দূরের রাস্তায় নির্ভরশীল, তখন হাট খুব দরকারী একটা ব্যাপার ছিল। আশপাশের ক’টি গাঁয়ের লোকজন পণ্য কেনাবেচার জন্য আসতেন। একসময় হাট মানে খদ্দেররা পরস্পর চেনা। দরাদরি কেনাকাটার ফাঁকে ফাঁকে মুখ দেখাদেখি, গায়ে গা ঠেকাঠেকি। তারপর কারও ডিস্টার্ব হলো কিনা থোরাই কেয়ার করে চেঁচিয়ে “হাট করত” – “হেই লখি! কাপড় কিনছিস না কি লো?” এর প্রত্যুত্তরে সেই লখি হয়তো “নয়েজ”এর মানে কথার “ষষ্ঠীপুজো” করে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ লো! তা তোর হাট করা হয়ে গেল?” অল্পবয়সী কটি মেয়ে তখন খলবল করতে করতে রঙিন ফিতে চুলের কাঁটা সেফটিপিন এসবের পশরায় বুকের ভেতরের খুশির সোঁদাল পাখিটাকে ছেড়ে দিয়েছে, দ্রব্যগুলির ভেতর তাদের ঝুঁকে পড়া মুখেচোখে যেন দোলের রঙঢালা নয়ানজুলি। দরকার মতো দরদামও করছে।মেয়েদের একটা অংশ হঠাৎ ভাগ হয়ে মাটিতে কালো পলিথিনের উপর বিছিয়ে রাখা একরাশ হাল ফ্যাশানের ব্লাউজের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে কানুখুড়ো চালাকচতুর রাসুকে দেখে ডাকল।সে তখন মাটিতে বিছানো চাষের জমির কাজে লাগে যেসব লোহালক্করের জিনিস তার সামনে উবু হয়ে বসে নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে মিষ্টি মিষ্টি হেসে দরাদরি করছিল।তার একখানা খুরপি আর পাসিকোদাল লাগবে। সে পাশের গাঁয়ের লোক। সবাই সবাইকে মোটামুটি চেনে-টেনে। দরাদরিতে তার বেশ নামডাক আছে। তাই তাকে দেখতে পেয়ে কানুখুড়ো বুকে বল পেলে, ডেকে বললে, ভাইপো, একবারটি চলো দিকিনি! একখানা মাথা ঘুরুনি জাল কিনব, একটুন দরদাম করে দেবে!-এই ছিল হাটের চরিত্তির।এখন যেমন ইন্দাস, সোনামুখী, পাত্রসায়ের, ঘাটাল, গোঘাট, আারমবাগ, হুগলির মায়াপুর, সোদপুর, বর্ধমান শহর এসব জায়গা থেকেও লোক এদিককার হাটে আসছে। বিশেষ করে সেহারার হাটে। বাঁকুড়া থেকে মশাগ্রাম রেল যোগাযোগ ভালো হওয়ায় হাটুরেদের সুবিধা হয়েছে। ঝাঁ-চকচকে দোকানবাজার, শপিংমল, মার্ট ( কেত দেখলে বেশ মানানসই শব্দ) , অনলাইন শপিংএর ব্যাপক প্রসারের কারণে এখন হাটের “চরিত্র নষ্ট” হতে বসেছে কিনা আরও কিছুদিন নজর রেখে তবে নিশ্চিত হতে হবে। দুম করে বদনাম করে দিলে চলে না। তবে মন যে সামান্য দুলেছে তাতে সন্দ মোটেই নেই।

এক একটা হাট বসে জায়গার গুরুত্ব অনুযাায়ী। ভূস্বামীরা আগেকার দিনে পুকুর খনন, বৃক্ষ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি হাটও বসাতেন অনেক সময়। তবে গ্রামাঞ্চলের সব হাটেরই অত ঐতিহ্যের গৌরব আছে এমন নয়। প্রয়োজনের তাগিদে সাধারণ মানুষ নিজেরাই যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং জলের সুবন্দোবস্ত আছে এমন জায়গায় জিনিসপত্র জুটিয়ে এনে কেনাবেচা শুরু করে দিত। প্রথম প্রথম ছড়িয়ে ছিটিয়ে একটা দুটো পশরা, তা বেড়ে হয়তো পরিপূর্ণ একখানি হাট।

আমাদের দক্ষিণ দামোদর এলাকায় অগুন্তি হাট। সম্ভবত কেবল দক্ষিণ দামোদর বললে ভুল হয়। হাট বাংলার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য যা অর্থনীতিকে আরও প্রসারিত করে।বাস রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাজার। সে হলো সারা সপ্তাহের ব্যাপার। স্থায়ী দোকান। এর গায়ে গায়ে সপ্তাহে একদিন বা কোথাও কোথাও দুদিন হাট বসে। হাটের পশরায় অল্প কিছু তফাত বা বিশেষত্ব, বৈচিত্র আছে বই কি!
আপনাদের একদিন মাছের জাল বিক্রেতা ভবানীদাদার কথা বলব। তিনি এক মজার মানুষ। কথাই বলেন বেশ একটু রহস্য করে, তাতে মজার রসপান, হয়তো সেই চটুল ঠাট্টায় খানিকটা গ্রাম্যতা আছে, তা খানিকটা হালকা। তবু তিনি যে এক দিলখোলা মানুষ সেটাই যথেষ্ট। প্যাঁচার মতো মুখ করে রাখেন না। বাড়ি তাঁর হুগলী জেলায়। তিনি হুগলী আর বর্ধমান জেলার নানা জায়গার হাটেই যান মাছ ধরার জালের পশরা নিয়ে। সব হাটেই তাঁর বসার নির্দিষ্ট জায়গা আছে। অন্যদেরও সাধারণত তাই হয়। যে যেখানে বসে জিনিস বিক্রি করেন সেটাই তাঁর জায়গা। অন্যরা কেউ সে জায়গা দখল করবেন না। এ এক অলিখিত নিবন্ধীকরণ। তো তিনি বলেছিলেন, এই এলাকায় সবথেকে ভালো হাট, মানে ভদ্রসভ্য হাট আরকি, সে হলো বর্ধমানের বর্ডারে বাঁকুড়ার আকুইএর হাট। তারপর সেহারা বাজারের হাট।
“সেহারার স্থানীয় লোকজন ভালোই, তবে বাইরের কিছু উটকো লোক জুটে কখনও কখনও ঝামেলা পাকায়। সেহারার হাট আকারে পেকারেও সবচে’ বড়ো”। এইসব বলছেন, সেই সময় একজন খদ্দের এসেছেন। একটা জাল দেখিয়ে জিগ্যেস করলেন, এই “কারেন” (কারেন্ট) জালের দাম কতো, কাকা? কাকা জাল বুনতে বুনতে অপাঙ্গে একবার নজর ফেলে যেন নিজের মনে বলছেন সেইভাবে গ্রাম্য রসিকতা করলেন। তা গাঁয়ে ঘরে ওসবের চল আছে। বললেন, “ভালো মেয়ের বিয়ে হয় না, ভালো জিনিসের খদ্দের জোটে না”। খদ্দেরকে তিনি দিলেন তাতিয়ে। ভালো দামে জিনিস বেচার এ হলো একটি তরিকা।

আমার হাতের কাছে যে হাটগুলো আছে সেগুলোতেই এখনও পর্যন্ত যেতে পেরেছি। এবার একটু দূরের জায়গাগুলোতেও যাব। হাতের কাছের হাটগুলোর একটা স্থান ও বারের তালিকা দিই। এই তালিকা আমার পরম শ্রদ্ধেয় জয়ন্ত কুমার মল্লিক দাদাও চেয়েছেন। –
সোমবার – নাড়ুগ্রাম, শ্যামসুন্দর
মঙ্গলবার – সেহারা, পলাশন
বুধবার – বাদুলিয়া, রায়না
বেষ্পতিবার – বেড়ুগ্রাম, শ্যামদাসবাটি
শুক্রবার – নাড়ুগ্রাম, শ্যামসুন্দর
শনিবার – পলাশন, শাঁকারি
রবিবার – বাদুলিয়া, শ্যামদাসবাটি
এগুলি ছাড়াও বহু জায়গাতেই হাটের অবস্থান। যেমন নতু-হরপুর (হরিপুর), লোহাই, পহলানপুর, জামালপুর, কাইতি, ইন্দাস ইত্যাদি ইত্যাদি।এইসব হাটের ভেতর সেহারার মতোই বড়ো হাট বসে রায়নাতেও। সেহারার হাট পাঁচমিশেলি, সঙ্গে গরু-মোষের হাট। আমদের পূর্ব বর্ধমান জেলায় গরু-মোষের হাট মোট এগারোটি। গরুর হাটে কিছু ব্যবসায়ী গরু নিয়ে আসেন হাঁটিয়ে । হালপাঁচন হাতে নিয়ে গরুর পাল শাসন করে নিয়ে আসা।যেগুলো বিক্রি হলো না, সেগুলোকে একই ভাবে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। অন্য কোথাও আবার তারা পরীক্ষার মুখোমুখি হবে বিকোনোর জন্য। এই ব্যাপারটায় মনোবেদনার কোনো কারণ তেমন নেই। তবে যারা দূরত্বের কারণে বা সময় বাঁচানোর তাগিদে যানবাহন মারফত গরু আনেন সেটি বড়ই মর্মান্তিক দৃশ্য।

ছোট হাতি বা বড়ো, কিংবা যে ট্রাকে করে গরু-মোষ নিয়ে আসা হয় সেখানে হয়তো দেখা যায়, তিনটি গরুর স্থান হবে, তার বদলে চার নম্বর গরুটিকে চেপেচুপে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। তারা অবলা প্রাণী, হাজার কষ্ট হলেও তো প্রতিবাদ করতে পারবে না, বা তা প্রকাশ করতে পারবে না! গাড়ী চলার সাথে সাথে ঝাঁকুনিতে তাদের কী পরিমাণ কষ্ট হয়, ভাবলে শিউরে উঠি – গায়ে গায়ে ঘষা লেগে তাদের গায়ের ছালচামড়া না উঠে যায়! ডাঁশের কামড় খেতে থাকলেও হয়তো তাদের চোখ সজল হবে, তবু লেজ ঘুরিয়ে তাড়াতে পারবে না সেই হুলবিশিষ্ট প্রাণিটিকে। বড্ড নির্দয় দৃশ্য। যখন দাস ব্যবসা ছিল, তখন মানুষকেও ঠিক এভাবে জন্তুর মতো করেই আনা-নেওয়া চলত। হয়তো আরও বেশি যন্ত্রনাদায়ক হতো তাদের নিয়ে আসা যাওয়া, তাদের রাখা, বা কেনাবেচার ব্যাপারগুলো। তাদের পরস্পরের সঙ্গে মোটা রশি বা শেকল বেঁধেও নরব্যবসাদাররা নিশ্চিন্ত হতে পারত না, প্রত্যেকের হাত ও পা আলাদা আলাদা ভাবে অনেক সময় বাঁধা থাকত।পশুর সঙ্গে তো আর মানুষের যন্ত্রনা অনুভূতির তুলনা হতে পারে না! তবে যাতনা নিজের কাছে নিজেরটুকু এক্সট্রিম।তা পুরোপুরি কখনও অন্যের দ্বারা উপলব্ধও হতে পারে না।

সেহারার হাট প্রথমে ছিল কেবলই গরুর হাট। পরে ধীরে ধীরে অন্যান্য পণ্যের পশরায় তা সেজে উঠেছে। একটু একটু করে চন্দ্রকলার মতোই বেড়ে উঠে এখন পূর্ণ যৌবনবতী। রূপ তো আছেই, রঙটঙ মেখে পটের বিবিটির মতো আরও মনোহারী হয়ে দর্শন দিয়ে চলেছে ফি মঙ্গলবার। সেহারা বাজার হলো একটা জংশন জায়গা। বর্ধমান, হুগলী, বাঁকুড়া তিনটি জেলার প্রাণকেন্দ্র না হলেও তাকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এখন দুই মেদিনীপুরও কিছুটা সংযুক্ত হয়েছে শহর বর্ধমান ও বর্ধমানের শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে যাতায়াতের “কমন” রাস্তাটির কারণে ।

সেহারার হাট বসিয়েছিলেন পাশের লাগোয়া গ্রাম কাঁটাপুকুরের চৌধুরীরা। চৌধুরী গোলাম রহমান এই হাটের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি খুব সম্ভব দেশের স্বাধীনতা লাভের পরে পরেই এই হাট বসান। শুধু হাটই নয়, এখানকার বাজারটিরও প্রতিষ্ঠাতা তিনি। সেই সময় ছিল কেবলমাত্র চৌধুরী মার্কেটটি।এখন গায়েগতরে বেড়ে বিস্তার লাভ করেছে সে। গোলাম রহমান সাহেবের ইন্তেকাল হয়েছে বহু আগেই।তাঁর ছেলেপুলে ভাইপোদের পর এখন তাঁর নাতিরা হাটের উত্তরাধিকারী।তাঁদের এখন অনেক শরীক। পাকা রাস্তার দুদিকে হাট। বর্ধমানের দিক থেকে আসতে প্রথমে গরু ও মোষের হাট। তারপর অন্যান্য নিত্য প্রয়োজীয় জিনিসপত্রের। গোলাম রহমান সাহেবের এক নাতি ইমানুল চৌধুরী, যিনি অন্য শরিকদের সঙ্গে সঙ্গে একজন উত্তরাধিকারী। তাঁর সঙ্গে কথা বলব বলে গরুর হাটের সামনে গিয়ে আমি ভ্যাবাচ্যাকা। এতদিন দূর থেকে দেখেছি, ভেতরে আসার প্রযোজন হয়নি।খুব উৎসাহে উদ্যত ফণা নিয়ে ধাবিত সাপ যেমন আচমকা বিশেষ শেকড়ের স্পর্শে থমকে যায়, আমারও যেন তাই হলো।

ইমানুল চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে হলে গরুর দঙ্গল পেরিয়ে যেতে হবে। বিভিন্ন আকার প্রকার, বিভিন্ন রঙের অজস্র গরু খুঁটোয় বাঁধা। দুটো গরুর ভেতর দু হাতেরও ফাঁক নেই। তাদের শিঙেরও কত বাহার। গরুর শিং হলো পুরুষ মানুষের গোঁফের সমতুল। নানান ছাঁদের গোঁফ দিয়ে তাদের কেতা বোঝা যায়। পালোয়ানী পাকানো গোঁফ দেখে কখনও কখনও তাকতও মালুম হয় বইকি! তাহলে অত কেতাদুরস্ত পাল পাল গরুর ভেতর দিয়ে আমার যাওয়াটা কেন সাপের মুখে শেকড়ের মতো বা জোঁকের মুখে নুনের মতো হবে না? কুমীর ভরা খাল পেরিয়ে আমাকে যেন ওপারে যেতে বলা হচ্ছে। হাটুরেরা অভয় দিচ্ছেন, যান না! যান! কিচ্ছু হবে না। খুব শান্ত গরু। কেউ কেউ আবার একজন “মেয়েছেলে”র গরুর হাটে ঢুকে পড়া দেখে তাঁদের গরুর মতনই লাল লাল চোখ করে বেজায় বিরক্ত ও সন্দিগ্ধ হয়ে অদৃশ্য সিং নাড়াতে লাগলেন। তো অভয়দাতাদের অভয়দানেও ভয় যাবার নয়। অনুরোধে কেউ কেউ গরুর গায়ে দাঁড়িয়ে তাকে আড়াল করে আমাকে যেতে সাহায়্য করছেন। শেষে একজনের হাত চেপে ধরে তাঁর পিছন পিছন গিয়ে পৌছঁলাম ইটের গাঁথনি তোলা একতলা অফিস ঘরটিতে। সেখানেই চৌধুরীদের পাওয়া যাবে। তাঁরা হাটের কেবল মালিক নন, তার দেখভাল কর্তাও বটেন। কোনো ঝঞ্ঝাট ঝামেলা হলে মিটমাটও করে দেন। জনাকয় শরীক বসে আছেন। দেখলাম গরু-মোষ বিক্রিবাটার পদ্ধতি। যে প্রাণীটিকে ক্রেতার পছন্দ তার জন্য বউনি দিতে হয় একটাকা।তবে গরুর প্রচুর দাম ।বয়স ও আকার অনুযায়ী পাঁচ-সাত হাজার থেকে ওই কুড়ি-বাইশ হাজার পর্যন্ত। এ হাটে বাছুর মোষ তেমন আসে না। সাধারণত পরিণত বয়সের মোষই কেনাবেচা হয়। তাই একজোড়া মোষের দাম তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার টাকায় বিকোয়। চল্লিশ হাজারও হতে পারে কখনও কখনও। গরু মোষ বিক্রি হয়ে গেলে ক্রেতা এই অফিসেই চালানটি কাটেন।–

“ কেনাবেচা কাগজে কলমে আমাদের অপিসে বসেই হয়। গরু বা মোষ বিক্রি হলে ক্রেতা ইচ্ছা অনুযায়ী দশ টাকা বা পনের টাকা আমাদের দিয়ে থাকেন। সে টাকা রসিদ দিয়ে আমরা নিই। টাকাটা নিতে হয়, নাহলে ধরুন, এতগুলো লোক সারাদিন বসে দেখভাল করছেন। আমরা নিজেরা হাটে ঘুরে কোথায় কি হচ্ছে তা তো দেখতে পারি না। আমরা অফিস সামলাই।আমাদের নিয়োগ করা কর্মী আছে, তারাই ঘোরাঘুরি করে হাটের উপর নজর রাখে।তাদের মজুরি দিতে হয়। সে টাকা আসবে কোথা থেকে?” ইমানুল চৌধুরীর কথাগুলো শুনলাম।কৌতুহলী হয়ে জিগ্যেস করি, “সারাদিনে মোটামুটি কীরকম আয় হয়?”
“যেদিন যেমন, কম বেশি হাজার পাঁচেক টাকা। লেবার টেবার পেমেন্ট করে আমাদের লাভ কিছু থাকে না। এটা তো আর আমাদের উপার্জনের মাধ্যম নয়! দাদুর প্রতিষ্টা করা হাট। এখন কত বেড়েছে, তা দেখভাল করতেই হবে এই একটা দিন। আমাদের সবারই জমিজমা, অন্যান্য ব্যবসাপত্র আছে।”

বাদুলিয়ার হাটে গিয়ে দেখেছিলাম সেখানে পঞ্চায়েতের তৈরি বাঁধানো চত্বরে হাট বসছে, যেটা আগে খেলার মাঠে বসত।ফলে জলকাদায় অসুবিধা হতো খুব। সেখানে পঞ্চায়েত দশ টাকা করে তোলা নিয়ে থাকে। তবে খুবই আনন্দের কথা, যে সেই টাকা ত্রাণ তহবিলে সঞ্চিত থাকে। এলাকার অভাবী মানুষের বিভিন্ন রকম দরকারে তা ব্যয় করা হয়। হাটুরেরা তাই খুশি হয়েই সে টাকা দিয়ে থাকেন।

ফেরার সময় ভীত ভুজঙ্গের মতই উল্টোমুখে কোনোরকমে লেজ সামলে কীভাবে শরীর আাঁকিয়ে বাঁকিয়ে পালিয়ে এলুম গরুর দঙ্গল থেকে – সে আর নাই বললাম। আজ এই পর্যন্ত।পরের পর্বে আবার কোনো মানুষরতনের গল্প। আমরা সাধারণত কেয়ার করি না, কী অসীম মূল্যবান বোধ ও অনুভূতি তাঁদের অকিঞ্চিৎকর জীবনের ভেতর লুকিয়ে আছে।ধানের শুঙোয় সামান্য উসকে দিলেই গড়িয়ে নামে পরতে পরতে পটের কাহিনীর মতো জীবনের ধারা।

ক্রমশঃ…

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে

কৃ ষ্ণা   মা লি ক-র হাট দর্শন লিখছেনঃ হাটের মানুষ-বাটের মানুষ(পর্ব-৪)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *