ছবিঃ প্রসেঞ্জিৎ মণ্ডল
“বাগমুণ্ডি লাচনী কথা”-
নিয়ে লিখলেন মাধবচন্দ্র মণ্ডল
সুর ও কথার সঙ্গে শারীরিক ভাষার এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন নাচ, এই নাচ স্বর্গ থেকে মর্তে নেমে এসেছে দেবাদিদেব মহাদেবের করুণায়, পুরুষ নৃত্য তাণ্ডব আর নারী নৃত্য লাস্য। স্বর্গে, মেনকা, রম্ভা উর্বশী ইন্দ্রের সভায় নৃত্য করতেন আমরা পুরাণে পাই। তাছাড়া দেবদাসীদের কথাও আমরা জানি ইতিহাস থেকে। পৃথিবীতে নাচের প্রাচীনত্ব নিয়ে গবেষণা চলবেই। আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখি সিন্ধু সভ্যতায় নর্তকীমূর্তি পাওয়া গেছে। নারী পুরুষদের নৃত্য অমরাবতী স্তুপে আছে যা অন্ধ্রপ্রদেশের ঘন্টুর জেলায় বুদ্ধমূর্তিকে ঘিরে। মৌর্য আমলেও নৃত্য প্রথার উদাহরণ পাওয়া যায় হাতিগুন্ফা শিলালিপিতেও নর্তকীদের কথা আছে। তাছাড়া অনেক মন্দিরে নর্তকীদের চিত্র খােদাই করা আছে। দেবদাসী প্রথাও দীর্ঘদিন চলেছে ভারতবর্ষে, নারীদের সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে সমাজ এখানেও। মন্দিরে নারীদের প্রবেশ নিয়ে চলছে নানান চাপানউতাের।
প্রাচীন ভারতে তাে নারীদের পঙ্গু করে রাখার প্রবনতা ছিল, গ্রন্থগুলিও নিম্নবর্ণের মানুষ এবং নারীদের অস্পৃশ্য করে রাখার বা শুভকাজে দর্শন না করার কথা বলে। “যজ্ঞকালে, কুকুর শুদ্র এবং নারীর দিকে তাকানাে চুলবেনা” একথা সাক্ষাৎ ব্রাহ্মণে (৩/ ২/৪/৬) তে বলা আছে।
যাই হােক শিল্পকে আটকানাে যায় না। নারীদের যতই অগ্নিপরীক্ষা করুক তারা তাে মায়ের জাত তারা চির-প্রণম্য।
আসি বাঘমুণ্ডির কথায়– বাঘমুণ্ডির মানকী রাজাদের নৃত্য-গীতের প্রতি অনুরাগ ছিল খুবই। সুইসা, কালিমাটি, শশতে নাচনী নাচ হতই। মানকী রাজার মধ্যে কেও কেও এর চরম রসিক ছিলেন, এমনও শােনা যায় যে জমিদারীর দিকে নজর না দিয়ে লাচনীদের নৃত্য-গীতের বিলাসিতায় দিন কাটিয়ে দিয়েছেন। জমি বন্ধক রেখেও, নিজেদের আভিজাত্য বজায় রেখেছেন। আমাদের পশ্চিম রাঢ অঞ্চলে কুড়মি, মুড়া, ভুইঞা, সর্দার প্রভৃতি সম্প্রদায়ের রসিক বেশি -এটা বললে ভুল হবে না।
ই বারের মকরে চল যাব চল কাঁসাই ধারে
সিঝা পিঠা খাব সিনান কইরে
হামি লাচইব তর হাতটা ধইরে ধইরে”
মকর, করম, বাঁদনা… এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে ঘিরে লাচনী লাচের আসর বসত। কখনাে বারােয়ারী আটচালায় এই শৃঙ্গার রসাত্মক নৃত্যটি অনুষ্ঠিত হত। বর্তমানে। লাচনী লাচের জাক জমকে একটু ভাটার টান তবে একটা কথা ঠিক, অনেক লাচনী শিল্পী ভাতা পাচ্ছেন এটা খুবই আনন্দের। লােকসঙ্গীতের এক বিশেষ শাখা লাচনী অবহেলিত, বঞ্চিত, নারীদের রসিক সঙ্গীতের তালিম দিয়ে তাকে নৃত্য পটীয়সী করে তােলে। লাচনীর উপার্জিত অর্থ রসিকের। আজকের দিনে লাচনীরাও যােগ্য সম্মান পাচ্ছেন এবং বিভিন্ন পুরস্কারে তাদের সম্বর্ধিত করা হচ্ছে। নিন্দিত নৃত্য আজ নন্দিত।
জমিদারগণই নৃত্য গীতের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন একথা স্বীকার করতেই হয়। তবুও জৌলুস হারিয়েই যাচ্ছে। মানভূমের অনেক জমিদারের জমিদারী চলে যায় ১৭৯৩ সালে যখন লর্ড কর্ণওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন। তারপর সুবর্ণরেখা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে যায়। জমিদারী মহল থেকে স্থানীয় ধনবান ব্যক্তিগণ নাচনী নাচের পৃষ্ঠপােষকতা তথা রসিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আসলে শিল্প তাে শিল্পই। আজকে হয়তাে লাচনী লাচ ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু হবে তবু যারা নৃত্য করেছেন তাদের আমি শ্রদ্ধা জানাই। বর্তমানে বাঘমুণ্ডি অঞ্চলে যে সব লাাচনীর কথা পাওয়া গেল তাদের নিয়ে কিছু লিখলাম।
চিন্তামণী দেবীঃ
প্রায় তিন বছর আগে আমি চিন্তামণী দেবীর বাড়ি যাই সঙ্গে ছিলেন প্রেমচাঁদদা প্রথমে তো তিনি সাক্ষাৎকার দিতে ইতস্তত বােধ করছিলেন তারপর শুরু করলেন জীবনের নৃত্য প্রবাহ ধারা, তিনি গ্রামে এসেছেন রসিক রামু সিং-এর সঙ্গে। দেউলি গ্রামটিতে এখনাে তিনটি দেউল বিদ্যমান, সেই জন্যই বােধ হয় নামকরণ দেউলি। চিন্তামণী জমিদারী নৃত্যে দক্ষ।
বাপের বাড়ি ঝালদা থানার ইলু গ্রামের নিকট বুরুডিতে রামপদ সিং কীর্তন দলে কীর্তন করতেন। সেই কীর্তন শুনেই প্রেমে পড়ে যান চিন্তামণী দেবী। বাপের বাড়ির লােকজন ফেরত নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু চিন্তামণী সঙ্গীতকেই ভালােবেসেছেন। ভালােবেসেছেন মনের মানুষকে। রামপদ সিং-এর বাবা ছিলেন রসিক তারও লাচনী ছিল মটুক তার নাম। রামপদ সিং-এর দাদুরও দুটি লাচনী ছিল। চিন্তামণী দেবীর এক কন্যা, তার বিবাহ হয়ে গেছে। তিনি বলেন যে মেয়ে রাগ করে আমার ওপর। রামপদ সিং-এর স্ত্রী রয়েছে তার চার ছেলে ও দুই মেয়ে। যাই হােক বাঘমুণ্ডির লােকসংস্কৃতির খনি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি নৃত্যগীত পরিবেশন করেছেন। তিনি আদিরসের জমিদারীতে নৃত্যগীত করেন। তার দলে শুকুলাল কালিন্দি, রঞ্জিৎ কালিন্দি।
সরস্বতী দেবীঃ
বাঘমুণ্ডি থানার লয়াকুই গ্রামের বর্তমানে অন্যতম লাচনী সরস্বতী দেবী। বাবার নাম রঘু সিং সর্দার, মা বিজলা সিং সর্দার। ছােট বেলা থেকেই নৃত্যগীতের উপর তার অন্তরের টান ছিলই। মাত্র বারাে বছর বয়সে তার বিবাহ হয়।তার তিন কন্যার মধ্যে এক কন্যা মারা যান। পশ্চিম সিংভূম জেলার চাণ্ডিলেই তার বাপের বাড়ি। গ্রামীণ উৎসবগুলির মধ্যে গ্রামীণ যাত্রা যা গ্রামগুলিতে হয়, সেই যাত্রা দেখেই নাচের প্রতি তার আকর্ষণ বাড়ে। তার জীবনে তিনি প্রচুর পরিশ্রম করেছেন শুধু পুরুলিয়া নয়, আশে পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ড ওড়িশায় তিনি নৃত্য প্রদর্শন করেন কোলকাতায় পালাবন্দী ঝুমুর নৃত্য পরিবেশন করেছেন। আসানসােলের এক অনুষ্ঠানে ডঃ মহুয়া মুখােপাধ্যায়ের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেছেন পবিত্ৰদার উদ্যোগে। এছাড়াও মালভূমের অন্যান্য অঞ্চলে নৃত্য পরিবেশন করেন। হৃষিকেশ মুখার্জী তাঁর ওস্তাদ তিনি তাঁর গুরু। নৃত্য-গীতের তালিম বর্তমানেও তিনি বজায় রেখেছেন। বর্তমানে বােধঘাটে বসবাস করেন। বিভিন্ন লাচনী কর্মশালা ও কলকাতার মিছিলেও তিনি যােগদান করেন। এখন ধীরে ধীরে বয়স হচ্ছে, শরীর তাে মাঝে মাঝে খারাপ হয় রােজগার ও কমে আসছে তাই তিনি বলেন বাকী জীবন ভগবানের ভরসায় আছি। আমার সঙ্গে হৃষিকেশদার যােগাযােগ আছেই ভালােমন্দ খবরাখবর নেওয়া হয়। ভগবৎ কৃপায় যেন সকলেই ভালাে থাকেন। শিল্পী ভাতা পেয়ে অনেকটা সুবিধা হয়েছে।
সাবিত্রি দেবীঃ
সাবিত্রী দেবীর পদবী তন্তুবায়। বাঘমুণ্ডি থানার রাঙ্গড়ামাটি গ্রামে তিনি থাকেন। তিনি বাঘমুণ্ডির এক বিখ্যাত নাচনী। তাঁর রসিক ছিলেন নিরঞ্জন মাহাত বাড়ি ঘােড়াবাঁধ সিঁদরী সাবিত্রী দেবীর নাম একালে মানভূম ছাড়াও সমস্ত ঝাড়খণ্ড জুড়ে বিখ্যাত ছিল। দীর্ঘদিন তিনি নৃত্য পরিবেশন করে আসছেন বিভিন্ন জায়গায়।
ভাবী দেবীঃ
মাদলাতে জিতুমুড়ার বাড়িতে ছিলেন বর্তমানে তিনি বসবাস করেন বাঘমুণ্ডির শিরকাড়ি গ্রামে। আমি তার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম বছর কয়েক আগে তিনি সাক্ষাৎকার দিতে চাননি তার রসিক আঘ্ণু মাহাতর সঙ্গে আলাপচারিতা হয়। তিনিও খুব সুন্দর ঝুমুর গাইতে পারেন।আসলে লাচনীদের পরবর্তী প্রজন্ম চায় না বেশী প্রচার হোক। কিন্তু শিল্পীর শিল্প তাে আর থেমে থাকে না বিকশিত ফুলের সৌরভ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বেই। গানের গলাটিও তার অত্যন্ত সুন্দর।
বাবী মাছুয়ারঃ
বাঘমুণ্ডির কেদড়ি তার রসিক সুচাঁদ মাহাত। তিনিও বিভিন্ন জায়গায় নৃত্যগীত পরিবেশন করেছিলেন।
মুখী দেবীঃ
মুখীদেবীর রসিক শ্রাবণ মাহাত। ধনুডিতেই তিনি থাকতেন। নৃত্যগীতের আসরে এককালীন খুবই জনপ্রিয় ছিলেন।
রুখীদেবীঃ
রুখী দেবীর পদবী মাছুয়ার তার রসিক ছিলেন চন্দ মাহাত। ফুলরাড়া গ্রামে থাকতেন।
(তথ্য হৃষিকেশ মুখার্জী)
সুরবালা দেবীঃ
শশ গ্রাম এমনিতেই ঐতিহ্যপূর্ণ। মানকী রাজাদের দুর্গোৎসব নৃত্যগীতে জমজমাট হয়।বর্তমানে সুরবালাদেবী প্রায় প্রতি ববছর নবমীর দিনে নৃত্য-গীত পরিবেশন করে থাকেন। সুরবালা দেবী ও তার রসিক বসন্ত সিং বাবু শশতেই কৃষিকাজ ও মজুর খেটে দিন যাপন করেন। অত্যন্ত সহজ সরল বসন্ত সিং বাবু।
শকুন্তলা দেবীঃ
তুনতুড়ি গ্রামে দীর্ঘকাল পূর্বে লাচনী ছিলেন শকুন্তলা দেবী। তার রসিক ছিলেন বড় সিং বাবু। বিভিন্ন জায়গায় তিনি নৃত্য গীতে অংশগ্রহণ করেছেন।
(তথ্যঃ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চট্টরাজ)