আলোয় আলোয় অলোকরঞ্জন

পরিচিতিঃ হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখনভূমি দেশ,আনন্দবাজার, আজকাল,প্রতিদিন ছাড়াও নন্দন, পরিচয়, অনুষ্টুপ, এবং মুশায়েরা, একুশ শতক,কবি সম্মেলন এছাড়াও অজস্র লিটল ম্যাগাজিন। আশির দশকের এই কবি পেয়েছেন পঞ্চাশটির বেশি ছোট বড়ো পুরষ্কার। নব্বইয়ের দশকে ‘প্রতিশ্রুতি’, ‘ঢেউ’ এবং ‘চিলার’ নামে তিনটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন, নি:সঙ্গ মানুষের অনন্ত জিজ্ঞাসা হল কবিতা।আর এ কবিতাতেই তাঁর প্রকৃত মুক্তি।তাই আজকের বাইফোকালিজম্-এর পাতায় পাতায় থাকল তাঁরই গুচ্ছকবিতার মজলিস মোহর।হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ –গাগরি ভরে না ঢেউ অরণি বিধিবদ্ধ উপত্যকা ছায়া ফেলি ছবি হয় নিরালম্ব সাদা কালো আ্যলবাম সুলতা সিরিজ নীল আলোর গল্প বসন্ত অপেরা ইত্যাদি ইত্যাদি…

আলোয় আলোয় অলোকরঞ্জন

লিখছেনঃ হী র ক    ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়

অলোকরঞ্জনের কবিতা চিরকাল রোদবৃষ্টি,স্বপ্ন ভালোবাসায় পুষ্ট….

কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

কবি অলোকরঞ্জনের কবিতা র ভাষা চিরকাল ক্ষুধা তৃষ্ণা, রোদবৃষ্টি স্বপ্ন ভালোবাসায় পুষ্ট অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত  বাংলা আধুনিক কবিতার আলো অন্ধকার আয়ুু …এক অলৌকিকযান….
কবিতা কি বা কবিতা কেন ,কবিতা দুর্বোধ্য হবে না সহজবোধ্য হবে,এসব তর্কে না গিয়ে বরং কবিতার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ানো যাক …

এখন লিখতে গেলে সমগ্র স্নায়ুতরঙ্গ কাঁপে
এখন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে গেলে মনে হয়
তার দিকে ত্রুটি ছিল …
আর তাই ,
এসব বলতে চাই ,বলা হয় না ,
তবুও আমার
বকুলপিসির সঙ্গে বচসা ,মথুরা প্যাসেঞ্জারে ..

             কী অদ্ভুত এই ঐশ্বর্যমন্ডিত কবিতাটি যা এক আত্মীয়তার সম্পর্ক রচনা করে অতি সহজেই !

এই বকুলপিসিকে আমরা চিনি ,তার ছেলেরা 
প্রতিষ্ঠিত,তাই তারা বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে অন্যত্র,ফ্ল্যাটবাড়িতে …
বকুলপিসি একা থাকে তার একটাই সাধ অন্তত একবার মথুরা বন্দাবন তীর্থ করে আসা ,একবার মুখ ফসকে বলেওছে সে কথা আমাকে …কবিতার এই আমি হলাম তার পড়শি…আমিতো সে রকম কিছু করি না 
সকালে দুটো টিউশ্যনি ,বিকেলে ক্লাব ,অফুরন্ত সময় ! যাই না ,একবার বকুল পিসিকে তীর্থ করিয়ে আনি ,কবিরা কত কিছু জানেন …


এই সামাজিক ঘটনাটুকুও তার চোখ এড়ালো না…
এই কবি এখন থাকেন জার্মানে  ,কিন্তু  বাংলা ভাষায লেখা তার কবিতাগুলিকে আমরা কি ফেলতে পারব কখনো …

মাকে আমি আজ হাত ধরে ধরে এ পথ করাবো পার ,
মা আজ আমার শিশু,
সতর্কহাতে ঢাকি দুএকটি রুপালি চুলের গুছি
আপাতত এই ক্ষুধিত পথের ক্ষুরধার চক্রান্ত
কাম ক্রোধ মোহ মোহান্ত ব্যবসায়ী
পার হয়ে যাই
মা কিছু জানে না ,
মা আজ আমার শিশু…

এত নিখুঁত বর্ণনা ,শ্বাসরূদ্ধ হয়ে আসে এই সব কবিতা সামনে এলে সত্যি বাংলা কবিতার ঐশ্বর্য বলতে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখিত করার মহিমা বর্তায়…মায়া ভালবাসা  সম্পর্কের ,যে ছবি পূর্বতন কবিরা এঁকে গেছেন তাকেই সমর্থন করে …

        মা আজ আমার শিশু...

কিন্তু এ কথাও তো ঠিক যদি এই বিশ্ব না থাকতো ,তাহলে?তাহলে কোথায় থাকতো এই সম্পর্কের বিশ্বাস? ছিলএবং নেই ,হয়তো ঠিককথা আবার আছেও তো, পঞ্চাশেরই এক কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন সেকথা : ছিল,নেই -মাত্র এই আট মাত্রায় ধরা চারটি শব্দ জীবনের সবকিছু যেন বলে দিল …
এ প্রসঙ্গে অলোকরঞ্জনের যুক্তি নামে একটি কবিতার কিছু অংশ উল্লেখযোগ্য-

……স্টেশন মাস্টার,আপনি দয়া করে এই
লোকটিকে ছেড়েদিন ,বুড়ো লোকটার
ত্রিসংসারে কেউ নেই …
একজন আছে বটে ,দূর সম্পর্কের ,সেও টিকিটবিহীন
খুড়ো বলে ডাকা সেই সৌদাসের ছোট্ট ছেলেটা,
খুড়ো বলে কেন ডাকে ঈশ্বর জানেন ! খুব ক্ষীণ,

আরো একজন আছে ,হয়তো দূরতর সম্পর্কের ,
অথচ আত্মীয় ওর ,আমি সেইজন ……..

এমন  চিরন্তন জাগ্রত করার কবিতা এর আগে কোথাও পেয়েছি কি আমরা ?

সুনীল গাঙ্গুলি তার এক কবিতাতে লিখেছিলেনঃ

রৌদ্রে এসে দাঁড়িয়েছে রৌদ্রের প্রতিমা
এ যেন আলোরই শস্য ,দুপুরের অস্থির কুহক …..

এমন এক অবিনাশী শব্দমালা ,চাপা বেদনাবোধ  এবং সর্বোপরি সঠিক ছন্দে গ্রথিত পঞ্চাশের কবিরা,প্রোথিত করেছে এবং সম্পূর্ন করেছে বাংলা আধুনিক কবিতার পাঠ …
অলোকরঞ্জনের ফাইন আর্ট সুকুমার চিত্রকল্পের জাগরণ ঘটায়! কবিতা হয়ে ওঠে জীবনের মুক্ত সংগীত যেন …
এই সব কবিতা আজকের তরুণ কবিদের কাছে এক একটি মাইলস্টোন ,এই অল্প পরিসরে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে ধরা খুব কঠিন…
নিশ্চয়ই একদিন সুযোগ পাবো তার রচনার পূর্ণাঙ্গ আলোচনার…
জয় হোক বাংলা কবিতার  ।তবুুও যেতে যেতে কবির রচিত কিছু অসামান্য ঐশ্বর্য না বলে গেলে পাঠকদের মধ্যে পাঠের অতৃপ্তি থেকে যাবে।

(ক) মাকে বলতে সংকোচ নেই, দিন ফুরোলে আমি
তোমার কাছে গিয়ে গিয়েছিলাম, তোমার পায়ে মুখ
রেখে অগাধ শান্তি পেয়েছিলাম
ভ্রূকুটিহীন সন্ধ্যাতারা উঠল যখন
নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে অর্পিত দেহের
দায়িত্ব যে নিয়েছিলাম, সেসব কথা মাকে
বলতে বলতে

পাগল হয়ে যাবো….
            (সত‍্য/অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত)

ঋজু, টান টান এই কবিতায় আমরা দেখতে পাই
আবহমান সম্পর্কের কথা।আমাদের সামাজিক জীবন, আমাদের প‍রিবার,সংসার ভাঙচুর হতে হতে  শেষ পর্যন্ত কোনো না কোনো সম্পর্কে এসে ঠেকে।মাকে তো সমস্ত কিছু বলা যায়।মা শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই অধিকার। বলা যায়, কিন্তু সত্যিই কি সবকিছু বলা যায়।প্রেম ভালোবাসার চিরগোপন,চিরজটিল কথা?এখানে এই ভ্রূকুটিহীন সন্ধ্যাতারা র ব‍্যবহার চমৎকার।আর ঠিক এই কারণেই কখনও কখনও মনে হ ওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, বিশ্বপথিক কবি অলোকরঞ্জনের কবিতার মূল ভরকেন্দ্রটি কিন্তু লুকিয়ে আছে এই মন কেমনে,এই বাঙালিআনায়।

(খ) ও শিশুমহিলা ,আমি এ পার্কে তোমায় প্রতিদিনই দেখেছি আমার ভাই  পিন্টুর সঙ্গে ,ক্রীড়নক আমারো হৃদয় যেন তোমার দুখানি হাতে, ঋণী
তোমার দিঠির কাছে।হালকা গোলাপি হলদে ফ্রক
লাল নীল রিবন আর সেলুলয়েডের কুরুবক
ব‍্যবহার করো তুমি।মাঝে মাঝে মিন্টু রুবি মিনি
খেলায় যোগ দেয়, তুমি বাধা দাও না,হাওয়ায় অলক
সূর্যকেও প্রভাবিত অপ্রতিভ করে, বিজয়িনী তোমার প্রহরী এক

পুরুষ দেখেছি
প্রৌঢ় তিনি।বাবা কিংবা মেজোকাকা–কীরকম সে অভিভাবক?

হে শিশুমহিলা, তুমি কবে হবে পিন্টুর গৃহিণী?

 (শিশুমহল:অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত:যৌবন বাউল)

যৌবন বাউল এবং নিষিদ্ধ কোজাগরী অলোকরঞ্জনের বিখ্যাত দুটি কাব্যপ্রসঙ্গত উল্লেখ্য।
উপরোক্ত কবিতায় দিঠি শব্দের ব‍্যবহার উল্লেখযোগ্য।এমনকি কুরুবক শব্দটি, এবং কুরুবকের আগে সেলুলয়েড শব্দটিও প্রণিধানযোগ্য।
শেষ পর্যন্ত পিন্টুর গৃহিনী হওয়ার আহ্বানে অদ্ভুত এক সুন্দর স্নেহ স্নিগ্ধ কৌতুকের অবতারণা ঘটেছে।পাঠক যেন শেষ পর্যন্ত শিশুমহলে যোগ দিতে বাধ্য হয়।একজন বড়ো মাপের কবির এটাই হল ইউ এস পি।

                      সমাপ্ত

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *