শু ভ দী প দা স
পরিযায়ী
চড়ুই ঘরে জোনাকি অন্ধ, বাসা ভেঙেছে ফিরতে হবে
ফিরতে হবে পাথর বুকে, তবুও কেবল মাটির টান
আঁচল কোণে চাঁদকণা কই– ঠোঁটটা বড়ই শুকনো লাগে!
ভাতের হাঁড়িতে আগুন ফুরায়, অগ্নিদাহে খোলস ছাড়ে চিতল পা
ফিরছি আমি তোমার ঘরে―খড়কুটো সব নদীর জলে
দেখো ভাসছে কেমন নোনতা জল মরুভূমির চাদর মুড়ে।
আঁচলে কেমন ধূলোর গন্ধ, পোড়া রুটির স্বাদ টুকু কই?
বাউলিয়া সব উল্টো পথে, বেলা শেষে একতারা কই?
চোখের কোণে জাফরানী ভোর
বাড়িতো সে ফিরতেই চায়, কিন্তু বাড়ি ফেরার রাত টুকু কই?
চাঁদটা কেমন দগদগে লাল, কোণটা তেমন উষ্ণ গরম
ব্যঞ্জন থেকে বর্ণ হারায়― পোড়া রুটির ছাঁচ টুকু কই?
সে লজ্জা হতে চেয়েছিল…
ঘড়িতে যখন রাত্রি সবে দশটা আমি তখন উত্তর মুখী যাত্রী
ক্ষুধার্ত শব্দ ছুটে উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু,
চুঁইয়ে পড়া গোড়ালি পায়ে ভিনদেহী মৃত্যু মুখে উলঙ্গ ‘লজ্জা’
মাটির পুতুল থেকে জনক-কন্যা কিংবা মাটির পলি থেকে দক্ষিনেশ্বরী নয়
সে পূর্ণিমা হতে চেয়েছিল
সে ‘লজ্জা’ হতে চেয়েছিল
আজ আমি সেই পথে লজ্জার মিছিলে হাটছি…
শোকের ভাস্কর্য থেকে নুইয়ে পড়া শহরে মৃত্যুকে দেখে ‘লজ্জা’
পাশার দানে অগ্ন্যাশয় ভেঙে চৌচির― কম্বলের গায়ে মরিচার দাগ
বক্ষখণ্ড থেকে মাংশ পিন্ড কিংবা কুন্তী থেকে কর্ণ
মাটি ভেঙে মাটি গড়ে, আবারও ভাঙে
আজ আমি সেই মাটির সামনে দাঁড়িয়ে
আজ আমি সেই লজ্জার সামনে দাঁড়িয়ে
দানব থেকে দানবী কিংবা মানব থেকে মানবী নয়
সে ‘লজ্জা’ হতে চেয়েছিল
সে ‘লজ্জা’ হতে পারেনি
আজ আমি সেই পথে লজ্জার মিছিলে হাটছি…
আজ আমি সেই পথে লজ্জা হাতে মৃত্যু-মিছিলে হাটছি…
কবিতা লিখবো বলে
কবিতা লিখবো বলে জন্মের সাথে মাটি, মাটির সাথে সত্ত্বা, সত্ত্বার সাথে কয়েকটা শব্দ মিশিয়েছি
খানিকটা সময় গড়িয়ে গেল ভাঙা-গড়ায়, খানিকটা জন্মের কাছে, খানিকটা আশ্চর্য শুন্যতায়
বসন্ত-ফাগুনের মাঝামাঝি কত রাবীন্দ্রিক উপন্যাসের পাতা, কত শব্দ বোধিবৃক্ষের মতো বুক চিতিয়ে
কই কোথাও তো তারা বদলায় না?
বদলায় না ব্যাথার অগ্নিবলয়, সহজ সমীকরণ, গড়ে ওঠা মূর্তিমুখ
তবুও এ জন্মের কাছে অনেক ঋণ। মরীচিকা জেনেও রোজ দাঁড়িয়ে থাকি…
যে আলোর পথে সবাই চলে যায়। ফিরে আসে। আবারও ফিরে…
কর্কটক্রান্তি থেকে পৃথিবী কক্ষে…
আমি নিঃশব্দে ডুবে যাই
আমি নিঃশব্দে ডুবে যাই নীলনদ প্রতিভাসে, মুঠোহাতে অন্তিম বিসর্গে তোমারই গীত,
এককোন ঘিরে জগৎটা দেখছি― ঘুরন্ত পাথরটা আজ কেবলই নৈরিৎ।
জন্ম-মৃত্যুর পথে মহাকালের সুরা হাতে চেয়ে দেখি―
উলঙ্গ নিশীথের ঔরসে কত শত মাদক-সম্রাট
জন্মাবধির নেশা ডিঙিয়ে আর কত আধুনিক হবে ধৃত-লাম্পট্যে!
কাদা মাটি ভেঙে দশকের পর দশক পদচিহ্ন আঁকে উদ্দাম নৃত্যে।
রক্ত ছোঁয় শকুন-সাবক― নাভিকুন্ড হতে হত্যার গলি পেরিয়ে সমতল প্রতিবাদ,
মাটি ছুঁয়ে কফিনের বধিরতা― আজ শালীনতাও যে বড্ড অপরাধ!
প্রাপ্তির ঘর আজ শূন্য,স্বার্থের উপকণ্ঠে মিথ্যের অভিযোজন― প্রতিমার গায়ে জ্যান্ত তুলসী কাঠ,
শোকের সীমানা পেরিয়ে আগুন গায়ে লজ্জা― পুড়ে নকশি কাঁথার মাঠ।
শতাব্দী কেটে গেছে ফুল হাতে বরণে―পাশার দানে হামাগুড়ি দেয় দুষ্ট-দুঃশাসন,
আঁশকাঁটা গায়ে ঝুলন্ত কাঁটাতারে স্নায়ুকোষ ভেঙে গড়ে বিষাক্ত রসায়ন।
ধূলো মাটি হাতে শ্বশানের ছাইপাঁশে শুনছি তোমারই বন্ধুত্ব,
আমি নিঃশব্দে ডুবে যাই
তেজস্বী তর্জনী তুলে ভাগীরথী গর্ভে ফিরবে কবে রাজপুত রমণী বীরত্ব?
ক্রন্দন
চৈতন্য প্রেমের স্রোত ফেলে আঁচল হাতে বেঁধেছে শুন্যের কড়ি
এক পা পিছয়– অভিশাপ হয়ে মৃত্যু হাঁটে সুদীর্ঘ বনবাস
স্তন মুখে দেবালয়, দ্রাঘিমার শেষে ক্ষতমুখ ফোটে
শূন্যতা হাতে ভগ্ন-গর্ভ পাত্রের দিকে চোখ রেখে হাঁটে…
অন্তরীণ
জলজ নক্ষত্র ভাঁজে আটপৌরের সময়ের ভগ্নাংশ,
একটুকরো উদ্বাস্তু মেঘ আর বিক্ষত পৃথ্বী―একাংশ।
শ্রাবন স্নায়ুতে মোহগ্রস্ত মধ্যদুপুর চৌমাত্রিক শঙ্খনাদে―
যেন গোটা পৃথিবী এক আশ্চর্য দর্শন!
গাণিতিক-জীবনবাদে।
ছায়াবৃত্ত একাকী শরীর সমুদ্র স্নানে ব্যাস্ত, মাঝবৃত্তপথে―
শাশ্বতী হারিয়ে ক্লান্তিতে ঝিমোয়, দু-চোখ জাগে দুখন্ড-নাব্যতাতে।
তন্দ্রাচ্ছন্ন মৌন-শিশির শৈলচন্দ্রিমার রতিবিদ্যায়,
আজ প্রহর কেটেছে অন্যপ্রহরে ঝাপটানো চোখ-ডানায়।
অলস মুর্খামি শব্দ ভাঙে মানবিক যবনিকায়
জন্ম নেবে গলিত অঙ্গার মগজ দোয়াতে―
সীমান্ত উত্তোলিকায়।
কুয়াশা ফাঁদে আদ্র রজনী ধূম্রশলাকা দুয়ারে,
গলিত মোম তীক্ষ্ণ বাস্তবতা ছুঁড়ে ক্ষুধার্ত চিৎকারে।
বাউন্ডুলে বিবেক শুন্য হয়ে বোহেমিয়ান রঙ আকাশে―
কক্ষপথও রক্তচোরা পোড়া-সূর্য ছাইপাশে।
বেলা ক্ষয়ে এখনও এককোনে ক্ষীণ
এলোমেলো সব প্রতিধ্বনি,
আজও সুদূর সন্ধ্যায় পড়ে তারাদের দেশে
তারাদের আত্মগ্লানি।
রক্ত না আবির
বিভীষিকাময় ধরিত্রী ভূমি উত্তপ্ত গলার অক্ষে,
নিশ্চিহ্ন প্রাণ, নিরব স্পন্দন রক্ত আবীর বক্ষে।
ঘুম ভাঙা চোখে তাকিয়ে দেখি কান্না হাসির খেলা
বুঝিনা ধর্ম, বুঝিনা কর্ম– শুধু প্রাণ বিনাশের মেলা।
বুলেট আঘাতে বুকখাঁজে রক্ত-আবির বন্যা,
নির্বোধ শিশুর মুখে দেখি আবহ স্রোত কান্না।
নেশাগ্রস্ত সাবেকি জীবন মৃত্যু হাতে অসহায়,
খুঁজে স্রোত, খুঁজে মূল্যবোধ― চিরায়ত শুন্যতায়।
ভুলেনি সিরিয়া, ভুলেনি পারস্য বহ্নির হাহাকার,
ধূলোর আলাপে রঙের ধারায় কান্নার অভিসার।
আজও অনেক গল্প বাকি―দাবানলে রক্তের খোরাক পুড়ে,
আজও অনেক আবির বাকি―বসন্তের সোহাগ জুড়ে।
ফেরিওয়ালার বেশে ধর্ম খুঁজি না,
আর মুখোশের আড়ালে শান্তি
নাটকের অভিনয়ে মিছে কান্না খুঁজি না,
দেখি ধর্মচাপে অশান্তি।
ধূলির রন্ধ্রে খেলা করে একঝাঁক বসন্ত আবির,
এখনও মাটির বুক উপড়ে দেখি― রক্ত না আবির ?
শূন্যতা
(১)
শূন্য আলিঙ্গনে ক্লান্ত সাদাপাতায়
শালীনতা হারানো রবি,
গর্ব চূড়ায় ভিন্ন অস্তিত্বে পারিজাত কাননে
জীবনের বিভাজিত দুই ছবি।
উতরানো ভাতে শূন্যতার জঠরে ওদের খিদে―
শূন্যথালায় ওদের বেয়াদবি জাত,
অপরাহ্ন শেষে ধূসর বেলা ছাড়িয়ে এক-দুটো
এঁটো-কাঁটায় যেন ঝগড়ার ধারাপাত।
পিঁপড়ের সমান দেহে বিষের নেই নিবারন―
অর্বাচীন হয়ে থাক,
বিহ্বল কোলাহলে ছেঁড়া পর্দায় হাড় ভাঙা খাটুনি―
একমুঠো পান্তাভাত পেট জ্বালায় পড়ে পাক।
অভিযোগ নেই, নেই অভিমান মুঠো ভরা ভাতের―
ভাত ঘুম ঘামের ফোঁটা আঁকড়ায়,
কিছু শুকনো রক্ত পায়ের গোড়ালিতে পড়ে অঙ্গার―
ঘি-ও আগুনের চুমুতে পেট মোচড়ায়।
নরকঙ্কাল মুখে ধুলোর কলঙ্ক ফুটপাতের আয়নায়,
মনুষ্যত্ব কবেই চাপা পড়েছে ধর্মের বাহানায়।
সমাজ সম্রাট ভেবেছো কখনো ঘিরছে আঁধার
একশো আলোক বছরও অচল,
হিংস্র পশুর দলে চাপা পড়া এই ধরা তল।
জীবনের আলোকবর্ষ দূরে আষ্টেপিষ্টে শুধু তোমারই ধ্যান―
একাল অবধি শুধু জানি স্রষ্টাই দেবেন সব সমাধান…
(২)
পাড়ার মোড়ে, শহর করিডোরে মোমের দেহ ছিঁড়ে―
রাতের শেয়াল কিংবা কুকুরের একদলে,
স্ট্রীটলইট সব অন্ধ–গলাটিপে ধরে কাট পুতুলের।
রক্ত লাগা মোমবাতি গণতন্ত্র খুঁজে মৃতলাশে,
পিশাচগুলো প্রশ্নবিদ্ধ সংস্কৃতির মুখোশে।
গঙ্গার অতলে কলঙ্কের রাজটিকা, পোড়ামুখী অপবাদে,
বীরাঙ্গনাও দায়মুক্ত―আত্মহত্যা মুক্তির সুবাদে।
শুনতে পাচ্ছো মন্দিরে পূজিতা ওই মেয়ে―সেই বীরাঙ্গনা,
পুতুল ভেবে পণ্যযশ বেড়ে হয়েছে সে রক্তমাখা অঙ্গনা।
ডানা কাটা মাংশ দাঁতে ছিঁড়ে ঘুঙুর পায়ে বাইজি কোঠায়,
কামড়ে খেয়ে দৈত্যের দাঁত স্বর্ণমুদ্রা কপালে লুটায়।
বুনো শুয়োরের হইহই হাততালি যেন অন্নে ভাগিদার,
কাজল চোখ ভেসেও ভাঙ্গেনি জীবন-অন্ধকার।
রাতের মোমবাতি কাঁদে বোবামুখ শেকলে আটকে,
শীত-বিকেলে ধুলো মাখা চুলে হেনস্থা―নিষ্পাপ মুখটাকে।
রাতে নরকের দরজা খুলে জ্যান্ত কয়েদির ফলক,
পোস্টমডামের নামে রক্তকোষে ধূসর ভস্ম পালক।
বারুদদহনে রক্ততিলকে ফিরে দাঁড়াও রুদ্র কালী বেশে,
মাটিজলে অধিকার চেয়ে নিও তোমার বঙ্গদেশে।
ফিরিয়ে দিও
হাসি টুকু ফিরিয়ে দিও গুচ্ছ কদমফুল
ফিরিয়ে দিও শতকোটি বছর আগের এই নগরী,
মহীরুহ শাখায় বায়ুর দীর্ঘশ্বাস, সমস্ত সত্ত্বার জল
ফিরিয়ে দিও মৃত্যুহীন কাব্যস্রোত
বর্বরতার আভিজাত্যের প্রতিকূলে ফিরিয়ে দিও
প্রশান্ত হিমস্রোত
হে অনন্ত ফিরিয়ে দিও সৃষ্টির সেতুবন্ধন এই বিকলাঙ্গ ভিটেমাটিতে।