গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান”(২০তম পর্ব)

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান“-র ২০তম পর্ব

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(২০তম পর্ব)

অপু এবং…

“My name is Nobody.” – Homer (The Odyssey)
যে বয়সে বাচ্চারা অল্প বিস্তর বৃষ্টির পর রাস্তার বা উঠোনের জমা জলে কাগজের নৌকা ভাসায়, সে বয়স এ মহল্লায় কোনো বাচ্চার কোনোদিন আসেনি। তারা সে বয়স পের করেই জন্মায়। আগেই বলেছি, আমাদের দ্বীপখানায় বেশি মানুষের বাস ছিল না। একটা বাড়ি এখানে তো আর একটা বাড়ি মাইল খানেক বা আধ মাইল দূরে। মাঠের পর মাঠ। বর্ষাকালে পুরো দ্বীপটাকে যদি একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে কেউ দেখে তো অনায়াসে সে সমুদ্র বলে ভুল করে বসবে। যেন একটা দিকচিহ্নহীন সমুদ্র, মাঝে মাঝে দু চারটে ঝুপড়ি ভাসছে তার জলে। আকাশ কালো মেঘসুদ্দু একটা উল্টানো ম্যাচলার মতো সেই সমুদ্রের উপর পড়ে আছে। আমাদের পাড়ার উত্তুরে একটা উঁচু বাঁধ আছে, সেখানে দাঁড়ালে দেখা যাবে উত্তুরে আর একটা রিংবাঁধ। আর দুটো বাঁধের মাঝে এক সর্বগ্রাসী সমুদ্র থৈ থৈ করছে। তাতে বাতাস লেগে ঢেউ উঠছে, আমরা ছোটবেলায় সে ঢেউকে কল্পনা করতুম সত্যিকারের নদীর ঢেউ বলে। কাগজের নৌকা সেখানে শুধু অচল নয়, বালখিল্যপনা, আর অমন বালখিল্যপনা করার বয়স নিয়ে আমাদের দ্বীপে বিশেষ করে আমাদের মহল্লায় কেউ জন্মায় না। কাগজের নৌকা, কাগজের এরোপ্লেন আমরা বানাতুম, কিন্তু সেটা ভাসানোর জন্যে নয়, বরং ছেঁড়া কাগজ বা ফেলে দেওয়া কাগজের ঠোঙাকে শখ করে অন্য রূপ দেবার জন্য। কিন্তু সে নৌকা কখনো ওই দিগন্তবিস্তৃত জল থৈ থৈ মহাসাগরে ভাসানোর কথা কেউ ভাবেও না, কিংবা আগেই বলেছি সেরকম ভাববার বয়স নিয়ে মহল্লায় কেউ জন্মায় না।
  আমাদের নৌকা ছিল নারকোল চাপ দিয়ে বানানো, কিংবা গেঁওয়া গাছ কেটে, তাকে নৌকার মতো করে ছেঁটে কেটে তারপর বাটালি দিয়ে কুরে কুরে খোল তৈরি করে বানানো। দ্বীপে সারাবছর এখানে ওখানে চোখ রাখলেই দেখা যায় কোথাও নৌকা তৈরি হচ্ছে তো কোথাও সারানো হচ্ছে, আবার কোথাও নৌকা বিরাকল দিয়ে উপরে তুলে তেলপাট করা হচ্ছে। ধরুন একটা নৌকা তৈরি হোল,  তাকে জলে নামাবে কে? নৌকা তো আর এক দু সের ওজন নয়, তাকে ঠেলে নামাতে গেলেও যত লোক দরকার তত লোক তখনকার দিনে পাওয়া মুশকিল। আবার ধরুন, কোনো নৌকাকে তেলপাট করার জন্য উপরে তুলতে হবে। সে তো আরো কঠিন কাজ। তখন বিরাকল লাগানো হতো। একটা মোটা খুঁটি, বলতে পারেন মোটা একখানা গাছের কাণ্ড কেটে এনে পুঁতে দেওয়া হলো,যেখানে নৌকাটা নিয়ে যেতে চাওয়া হচ্ছে, সেখানে বা তার আর একটু পিছনে।এবার খুঁটির গায়ে কোমরখানেক উঁচুতে একটা শক্ত সোজা হাত দশেক কাঠ বা বাঁশ আড়াআড়িভাবে ভাল করে বেঁধে দেওয়া হয়। একটা মোটা কাছি নৌকায় বেঁধে তার অন্য প্রান্ত পুঁতে রাখা খুঁটিতে বেঁধে দেওয়া হয়। খুঁটির আগায় ফাঁসকি কল করে টান দিয়ে রাখা হবে একটা মোটা গাছে যে গাছটা থাকবে নৌকার বিপরীত দিকে।ফাঁসকি কল এমন আলগা থাকবে যে সেটা টান রাখবে ঠিক, কিন্তু খুঁটি ঘোরালে সে খুঁটিতে জড়াবেনা। এখন জন তিন চারেক লোক আড়া বাঁশ ধরে ঘুরতে থাকবে, নৌকার সংগে বেঁধে রাখা কাছি খুঁটিতে জড়াবে আর নৌকা একটু একটু করে এগোবে। বিশ্বাস করবেন না, যে কাজ দু’শ লোক ছাড়া সম্ভব নয়, তা জনা কুড়ি লোকে অনায়াসেই করে দেয়। কাছি জড়াতে জড়াতে নৌকা চড়চড় করে এগোতে শুরু করবে। তারা বাগ বোল ধরে, আর বাকি লোকেরা বাঁশে জোর লাগায় –
অঅঅ ইন্দ্রা দিদি
হেঁইও
লোকে ভালো
হেঁইও
খুল্লে কাপড়
হেঁইও
ভিত্রে কালো
হেঁইও
চড়চড় মড়মড় করে নৌকা নেমে যায় জলের কাছে, নরম কাদায়। তারপর নৌকার মালিক চিড়ে গুড় খেতে দেয় সবাইকে। তারা বাগ খানিকটা চোলাই খেয়ে বাওয়াল মারে,
অই শ্লা, আরো লৌকা লিয়ায়, পাছায় লাথ মারিয়া লাবি দুবো।
যেকথা বলছিলাম। ছোটবেলায় আমরা নারকোল চাপের নৌকা বানাতুম বেশ মন দিয়ে। কঞ্চি দিয়ে নৌকার গলুই তৈরি করতুম। আবার গেঁওয়া কাঠের নৌকায় আমরা আলকাতরা নিয়ে তেলপাট করতুম। নৌকায় গুড়াকাঠ লাগিয়ে তার উপর ন্যাকড়ার পাল করে দিতুম। বাঁশের ফ্যারাটি তুলে চেঁছে সুন্দর করে হাল তৈরি করে লাগিয়ে দিতুম নৌকার পিছনে। তারপর মাঠে নিয়ে গিয়ে জলে ছাড়ার আগে ছোট লাঠি এনে বিরাকল করে নামানোর নকল করতুম। শম্ভু বোল ধরতো তারা বাগের মতো। দক্ষিণের বাতাসে পাল তোলা নৌকা উত্তরেই শুধু যায়, এমন বোকা বোকা ধারণা পাল্টাতে আমাদের খুব বেশি সময় লাগেনি। হালের কেরামতি করে দক্ষিণের বাতাসে নৌকা কীকরে পুবেও পাঠানো যায় তা আমরা ওই বয়সে শিখে নিয়েছিলুম। গাঙ পাড়ে দাঁড়িয়ে কতবার দেখেছি দক্ষিণের বাতাসে পাল তুলে নৌকা যাচ্ছে পুব দিকে। বাতাসের শক্তিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় হালের কেরামতিতে, তা বুঝেছিলুম। নৌকা ভাসিয়ে এক হাঁটু, কোথাও বা এক কোমর জলে দৌড়াচ্ছি নৌকার পিছু পিছু। শামুকে পা লেগে কেটে যাচ্ছে যেখানে সেখানে,  বন বাবলার কাঁটা ফুটে পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত। জলে থেকে থেকে পা সাদা হয়ে যেত। আঙ্গুলের ফাঁকে হাজা ধরে চুলকে চুলকে গন্ধ হয়ে যেত।
নৌকা নিয়ে কাজ কারবার আমাদের শৈশব থেকেই। নৌকা আর গাঙের বাইরে আর কী কী নিয়ে ভাবতে হয়, সত্যি কথা বলতে, জানতুমই না। নারকোল চাপের নৌকা আমরা বেশিদিন চালিয়েছি,তা নয়। দ্বীপের বাচ্চাদের বয়স বাড়ে খুব দ্রুত গতিতে। সত্যিকারের বৈঠা বা হাল যখন তারা ধরে তখন কাগজের নৌকা ভাসানোর বাকি সভ্যতা থেকে তারা আলাদা হয়ে যায় নিমেষে। তারা বৈঠা বায়, জংগলে সাপ তাড়ায় আর মাঝ নদীতে নৌকার গলুই থেকে কাঁকড়া ধরার দন ছাড়ে, ভাসা কাঁকড়া ধরে।
  ছোট ছোট নৌকায় দিনের বেলা ভ’রে যায় গোটা গাঙটা। দন ভাসিয়ে রাখার জন্য ছোট ছোট থার্মোকলের টুকরো বেঁধে দেওয়া হয় দনের গাছ-দড়ির সংগে। দিনের বেলা গোটা গাঙজুড়ে শুধু সাদা সাদা টুকরো ভাসতে দেখা যায়। যত দূর চোখ যায় শুধু কালো নৌকা, কালো পিঁপে আর এই সাদা থার্মোকল ভেসে আছে। বর্ষায় গাঙ মাতাল হ’লে কিছুদিন ছোট নৌকাগুলো দন ফেলা বন্ধ রাখে। সে আর ক’দিন! বর্ষাকাল মানে নৌকাডুবি, বাইর গাঙ থেকে ভেসে আসা লাশ, দু চারটে লোক নিখোঁজ হওয়া আর গাঙ পাড়ের কিছু লোকের কান্না ও হাহাকার ছাড়া আর কিছুই নয়। সেসব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। মানুষ একবারই মরে, আর মৃত মানুষের জন্য কোনো সভ্যতা থমকে দাঁড়িয়ে থাকে না। শুধু সভ্যতার তালভঙ্গ হয় নিখোঁজ লোক  দীর্ঘ দিন বাদে ফিরে এলে। বর্ষায় শুধু মৃত্যু আর হাহাকার নয়, গাঙ ভ’রে উঠে ইলিশে ইলিশে। ইলিশের মরশুম মানে হাহাকার শুধু নয়, হাসিও। বস্তুত বর্ষার সমস্ত হাহাকারকে ছাপিয়ে যায় গাঙ-পাড়ের হাসি আর চকচকে চোখ।
বর্ষা কেটে যাওয়া মানে আবার ছোট ছোট নৌকার হুল্লোড়। হাঁকডাক। চীৎকার। যেন গোটা গাঙটা আস্ত একটা পাড়া। এ নৌকা থেকে ও নৌকায় ডাক, বাঁধ থেকে নৌকার লোককে হাঁক, সে এক ব্যস্ত ব্যাপার।
বিলা রেএএএএএএ
হঁ ক’
দঁ তুলচুউউউ?
হঁ রেএএএএ
ক’টা উটচেএএএ?
উটচে এক কুড়ির মতোওও।
কিংবা বাঁধ থেকে নৌকাকে হাঁক,যেমন হয় –
শম্ভু রেএএএএএএএ
হঁ, কী রেএএএএ
ধারে আয়য়য়য়
কেনি রেএএএএএ?
আমি যাবো রেএএএএএ
যাইটি দাঁড়া আ আ আ, দঁ’টা তুয়িয়া যাইটিইইইই।
কেউ কেউ উদাসীন ভঙ্গিতে বৈঠা বেয়ে চলে যায় লুথিয়ানে।
কাই যাবু রে ঘুটাআআআ?
লুথিয়ানেএএএ
কেনি?
দু’টা কাঠ লেসতেএএ, তুই যাবুউউউউ?
নাহ, তুই যা আ আ আ।
ছপাস ছপাস ক’রে শব্দ করতে করতে চলে যায় ওপারে।
গাঙ আর নৌকা, মৃত্যুর সাথে বন্ধুত্ব আর মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখা ছাড়া এ দ্বীপের লোকেরা আর কিছু জানে না।
  বর্ষার ছুটি পড়লে, বাড়ি ফিরে  বসে থাকতুম চন্দ্রানীর ঘাটে। বিকেল থেকে রাত অব্দি। এ দ্বীপের দু’চারটে লোক আমাদের মতো ছন্নছাড়া। তারা গাঙ আর নৌকার ঘেরাটোপ থেকে কীক’রে বেরিয়ে গিয়ে অন্য সমুদ্রে পড়ে গেছে। আর সমুদ্র তাকে যখন ছুটি দেয়, সে ফিরে আসে আজন্মলালিত শৈশবের ভাঙা মাচায়, গাঙের পাড়ে; বসে থাকে চন্দ্রানীর ঘাটে। বর্ষার বিকেলে যদি হঠাৎ সূর্য  বেরিয়ে পড়ে পশ্চিমের লুথিয়ানের মাথায়, যদি সমস্ত কালো ঘোলাটে মেঘের দলকে অন্তত এক সন্ধ্যার জন্য শুষে নিতে পারে গোল থালার মতো লাল সূর্য, তাহলে তার চে’ নয়নাভিরাম, অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য আর কিছু নেই। চন্দ্রানীর ঘাটে শুধু আমি নই, আপনিও যদি তখন পৌঁছে যান জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে, আমি নিশ্চিত, আপনি এই ভেবে পস্তাবেন যে, ওই যে নৌকাটা চলে যাচ্ছে লুথিয়ানের গা ধরে সূর্যের রক্তিম আভা গায়ে মেখে, ওর মাঝি আমি কেন হলুম না!
গতকাল সন্ধ্যায় এখানে বসেছিলুম। শম্ভু গতবছরের মতো এক থালা ইলিশ মাছের ভাজা নিয়ে এসে অন্ধকারে পাশে বসেছিল কৃষ্ণচূড়ায় হেলান দিয়ে।
তুইও খা শম্ভু।
তুই খা না, আমি ডেলি খাই।
অন্ধকারে আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেখে বুঝেছিল আমি খুব রোগা হয়ে গেছি।
খাবা ঠিক হয়নি অঠি, না?
কেনি, ঠিক তো হয়
না না, তুই রোগা হইচু অনেক।
ধুর শ্লা, কী যে কউ!
হঁ রে অপু।
তারপর খড়মড় করে গামছার ট্যাঁক থেকে কিছু একটা বের করে আনে।
কী রে শম্ভু?
বিড়ি।
বিড়ি?
হঁ
তুই বিড়ি খাউ?
খাইতিনি, অখঁ খাই। বিষ্টিয়ে ভিজলে শীত লাগে, তখঁ খাইলে গা গরম হয়।
আমি হেসে ফেল্লুম।
হাসুটু কেনি?
সত্যি সত্যি গা গরম হয়?
হঁ রে, খায়া দ্যাখ।
আমি চুপ করে আছি দেখে শম্ভু আবার বলে, খাবু একটা?
বিড়ি ধরিয়ে হাতে দেয়।
টাঁআ।
আমি একটা হালকা টান মেরে ধোঁয়া ছেড়ে দেই। যেমন ছোটবেলায় পাটকাঠির এক পাশে আগুন দিয়ে অন্যপাশে মুখ লাগিয়ে টানতুম।
ধুর শ্লা।
কীরে?
ধুঁয়া খাবু তো।
ওহহ
টেনে ভিতরে ধোঁয়া ঢোকাতে গিয়ে কেশে ফেলি।
আর খাইনা অপু।
তোনকের বিড়ি খাবা ঠিক না, এগা যান্নে গাঙে খায়ে কাজ করে, তানকের জন্যে ঠিক আছে।
ওহ।
শম্ভু।
হঁ
গৌরির আর কুন খবর পাউনু?
হঁ
কী, কী খবর?
ঘরে আসতল।
সত্যি?
হঁ
তোর সংগে দ্যাখা হইচে?
না, আমি ফিচিংএ চলিতলি তখঁ।
অহ, আমি একটু হতোদ্যম হয়ে যাই।
অপু,
হঁ
গৌরি আমাকে একটা চিঠি দিইচে। আর..
আর কী?
একটা ফুল।
গোলাপ ফুল?
হঁ।
আমি চুপ করে গেলুম। আমার অভিমান হলো, শম্ভু এতক্ষণ বলেনি ব’লে।
কী হইল রে অপু?
ধুর শ্লা, বকাচদা, চুপ কর।
কী রে?
চিঠি দিইচে তোকে, আমাকে কউনু কেনি?
কদবা কইব? তোর সংগে আইজ অক্ষুঁয়ি তো দেখা হইল।
সংগে সংগে কউনি কেনি?
আরে শ্লা, কইতি রে বাল। তোকে নেই কয়া শম্ভুর কুন কাজ হইচে?
চিঠি আর ফুল চঞ্চলী বৌদিকে দিইচে।
চিঠিয়ে কী ল্যাকচে?
শ্লা, তুই নেই আইলে চিঠি কে পড়িয়া দিবে? আমার বাপ?
কেনি? কতলোক আছে পড়ার। আমি কপট রাগ দেখিয়ে বল্লুম।
ধুর শ্লা, যে যত বোড়ো সিক্কিতো হোউ, শম্ভুর চিঠি কেউ পড়িয়া বুঝি দিতে পারবে, তুই ছাড়া?
অন্ধকারে আমার হাত চেপে ধরে শম্ভু।
শম্ভু
হঁ
চিঠি লিয়ায়।
সে তো ঘরে আছে। লৌকায় লিয়াইলে লষ্ট হয়াবে বলিয়া ঘরে গুছিয়া রাখছি। কাল ফিচিংনু ঘাটে আইসিয়া সংগে সংগে ঘরে যাবো। তারপর দু’জঁ’ ঘাটে আইসিয়া বুসবো।
আচ্ছা।
শম্ভু
কী রে
আমি চুপ করে থাকি।
কী রে অপু, ক’
আমি হঠাৎ তাকে জাপ্টে ধরি। লেপ্টে রাখি বুকে।
অপু, অই অপু, কী হইচে রে?
আমি হাত আলগা করে বলি,
আমি ভাবতিলি গৌরিকে আর হয়তো তুই পাবুনি। সে যে তোর আছে, মনে করিয়া খুব আনন্দ হটে।
তোকে কইতলি না অপু, আমার ব্যা করা বৌ।
হুঁ।
  গাঙ পাড়ের লোকেরা জানে গাঙ কোনো স্থিতধী প্রবাহিণী নয়। সে আজীবন ট্রাম কারের মতো একটা রেলের উপর দিয়ে যত্নে এগোবে যতটা আবার ঠিক নিয়ম মেনে সিগন্যালের এক আঙ্গুলের ইশারায় ততটাই ফির পথে চলে আসবে, আর যেই হোক, গাঙ তেমন নয়। বরং সে উল্টো। সে প্রকৃত সুন্দরী,  কিন্তু এমন আহাম্মকি তার অহংকার যে, সে কারুর সুন্দরী বলা’কে থোড়াই পরোয়া করে। এই সে, তণ্বী একফালি ফরসা কোমরের মতো বসন্ত-ঢেউ তুলে আলপনা ছড়িয়ে দেয় ব্যাপক শরীরে, এই সে হয়ে উঠে ভয়ংকরী, দামামা বাজায় নিদারুণ শত্রুর মতো ভয়াল গর্জনে, পরক্ষণেই সে রজঃস্বলা দয়িতা, লাজুক চাঁদপানা মুখ লজ্জায় রক্তিম করে দেয় দু’ হাত প্রসারিত প্রেমিকের সম্মুখে।
  আজ যে কিছু একটা হবে তার আগাম বার্তা সে দিয়ে রেখেছিল। দুপুরে কালো মেঘের ঘনঘটা আর দমকা ঝড়ে যতখানি তছনছ হয়ে গেছে এ মহল্লা, তার চে’ বেশি কিছু হওয়ার অপেক্ষা করছিল মহল্লার মানুষগুলো। ঝড় থামার পর থেকেই আমি বাঁধের উপর এসে বসে আছি চন্দ্রানীর ঘাটে। প্রত্যেক পল অনুপল আমার কাছে একেকটা যুগের মতো মনে হচ্ছিল। কোনো নৌকা এখনো ফেরেনি ঘাটে, হয়তো ফেরার সময় হয়নি। আমার ভিতরের ঘন্টা বেজে যাচ্ছিল অনবরত। এ এক দীর্ঘ অপেক্ষা। একটা নির্জন পরিত্যক্ত দ্বীপে আমি বসে আছি অপেক্ষায় যেন। অপেক্ষাতে অপেক্ষাতে আমার বয়স থেমে গেছে। আমি টের পাইনি আমার আয়ু কবে শেষ হয়েছে, হয়তো অপেক্ষা শেষ হয়নি বলে গাঙের দিকে তাকিয়ে বসে আছি মৃত্যুকে ভুলে গিয়ে।
একটা নৌকা এলো। বিধ্বস্ত। কেবিনের উপরের চালা, যেখানে মাঝি দাঁড়িয়ে বাইর গাঙে সুগান ধ’রে রাখে,  নৌকা চালায়, সেটা ভেঙে উড়ে গেছে। আমি উঠে দাঁড়াই। কোনোক্রমে নৌকাটা ঘাটে আসতেই দৌড়ে যাই নৌকার কাছে। পিছনে একটা কোলাহল। দেখলুম গংগাবুড়ির ঘাটের দিক হতে দৌড়ে আসছে, মহল্লার বাচ্চা বুড়ো মহিলারা। আমি হতবাক হয়ে গেলুম। নৌকার কাছে নেমে আসে বাদল মাইতি।
আমার ব্যাটামনকের লৌকা দ্যাকচু, ভানু?
না গো দা, আমানকের লৌকা ডুবতে ডুবতে রইচে গো দা। কুনরকম আসসি বাঁচিয়া।
ভিড় ঠেলে মনি মণ্ডল নেমে আসে, চেঁচিয়ে বলে- ঝন্টু আসসে? ঝন্টু আসসে? ওওওও মাধবীইইইই, ঝন্টু আসসে রে।
চঞ্চলী বৌদি এসে টেনে নিয়ে যায় মনি জ্যাঠাকে। লোকটা যেতে চায় না। বিড়বিড় করতে থাকে।
কুন’ লৌকা চোখে পড়েনি, ভানু? কেউ একজন জিজ্ঞেস করে চেঁচিয়ে।
হঁ,
কুন্ লৌকা রে?
শংকর দলুইর লৌকা।
আমার গোটা শরীরে একটা বিদ্যুতের প্রবাহ ছুটে যায়। আমি জানি শম্ভু শংকর দলুইর নৌকায় ফিশিং করে।
সহসা আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল,
কুনঠি দ্যাকচ? আইসেটে?
ভানু চুপ করে থাকে।
পিছন থেকে অসহিষ্ণু হয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গংগা ঘড়ুই নেমে আসে।
আমার ব্যাটার লৌকা কাই দ্যাকচু ভানু?
ভানু আবার নির্বাক।
এবার ততোধিক অসহিষ্ণু হয়ে গংগা ঘড়ুই বলে, আরে বাল ক’ না, কাই দ্যাকচু? বিয়াঁ ভাইর মুখ দিয়া কথা সরেনি?
কী কইব কও? ভানু শান্ত।
কুন্ঠি দ্যাকচু?
বালির খায়ের লাবানু দু’ ভাঁটা দূরে।
আইসেটে?
নাহ!
মানে?
মাইর খাইচে কাকা। শম্ভুর লৌকা মাইর খাইছে।
আমি ধপ করে বসে পড়ি। আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, নৌকা ডুবে গেছে। প্রবল ঢেউএ শম্ভু বাঁচার জন্য হাত পা ছুঁড়ছে জলে। ঢেউগুলো তার মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তাকে তলিয়ে দিচ্ছে। এক সময় শম্ভুকে আর দেখা যায় না। আমার মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে যায়
আহ, শম্ভু!
পিছন ফিরে দেখলুম লাঠির উপর ভর দিয়ে গংগা ঘড়ুই হাঁটছে আর বিড়বিড় করছে,
ও ও ডুবিছে! লৌকা ডুবিছে! বালির খায়ের লাবায়!  শম্ভু ডুবিছে! মরিছে অতক্ষঁয়ে!
ক্রমশঃ…
লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন–

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৯তম পর্ব)”

 

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *