নন্দিতা পাল-র নাটক ‘অন্যদেশ’

পরিচিতিঃ নন্দিতা পাল জন্ম : সেপ্টেম্বর, ১৯৬৮ পড়াশুনো : যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবনে ‘বিকল্প’ পত্রিকার অন্যতম সহযোগী। বর্তমানে ‘অনুপ্রাস’ পত্রিকার প্রকাশক। প্রথম গল্প প্রকাশ রাঁচির ‘মাহুত’ পত্রিকায়। নানা স্বাদের লেখায় আগ্রহী। বিশিষ্ট সমাজকর্মী। আজ বাইফোকালিজম্-র পাতায় রইল তাঁরই একটি নাটক।

 

“অন্যদেশ “

কাহিনিনাট্যরূপ– নন্দিতা পাল।

চরিত্র পরিচয়

যজমানী পুরোহিত শ্রী নিবারণ চক্রবর্তী, তার স্ত্রী রমা , স্বামী পরিত্যক্তা কন্যা দামিনী, তার কিশোরী কন্যা সুচেতনা, তালাকপ্রাপ্ত এক গরীব মুসলমান কন্যা আয়েশা এবং তার কিশোর পুত্র তথাগত। দামিনীর বাল্যবন্ধু করিম, সহপাঠী বারিণ ঘোষাল। স্কুল শিক্ষিকা সুরঞ্জনা , স্কুলের সহকারী কাম কর্মবন্ধু রামদীন। এছাড়া প্রতিবেশী, গ্রামবাসী জনাকয়, হাফ নেতা গোছের মাতব্বর, মৌলবী সাহেব, মুদিখানার মালিক এবং দুজন পুলিশ কর্মচারী।

কথামুখঃ

 

একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। এবং রবীন্দ্রনাথের “জাতীয়তাবাদ” গ্রন্থটির মূলসুর এই নাটকের ভিত্তি পদচারণা ও পথ খোঁজার চেষ্টা মাত্র।
” ভারতবর্ষে সত্যিকারের ‘ন্যাশানালিজম’ এর চেতনা কখনো ছিল না। যদিও শৈশবকাল থেকে… ধারণা ত্যাগ করে লাভবান হবে”।[ পৃ ৯০. জাতীয়তাবাদ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ]

১ম দৃশ্য

উত্তর চব্বিশ পরগণার ধলা গ্রাম। টিন আর খড়ের একটেরে চালা ঘরগুলোর পাশ দিয়ে মেঠো রাস্তা চলে গেছে সিঁথির মতো একে বেঁকে।গ্রামের শেষমাথায় আছে সবেধন নীলমণি এক অাপার প্রাইমারি ইস্কুল। গোটা কতক নলকূপ, একটা টিমটিমে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বারো পনেরো দোকানঘর, যার চৌহুদ্দি রান্নার দাওয়া থেকে দেশের রাজনীতি রাজ্যপাট অবধি। হাজার দেড়েক বর্ণহিন্দুর বসবাস। হাজারো অভাব আছে, তবে স্বভাবের ঘর ভরাট। রোজকার জীবন একভাবে চলে যায়।বেশিকিছুর জন্য যেতে হয় ট্রেন ধরে শহরে, বসিরহাটে। ইস্কুলের পাশের রাস্তা ধরে মাইল খানেক হেঁটে ডানদিক ঘেঁষে বাঁক নিয়ে ঘুরে গেলে দেখা যায় আর এক ছোটো বসতি শ’ খানেক মুসলমানের বাস। এ গ্রামে একটাই অাটচালা অাছে, ঐ হল চন্ডীমন্ডপ। প্রয়োজন- অপ্রয়োজনের, বিবাদ- মীমাংসার, আড্ডা – উৎসবের একমাত্র জায়গা। পুজোর তো বটেই। এ কাহিনির শুরু এখানেই। চলছে জোর মিটিং, গল্প – গজ্জোল্লা। সামনে মনসা পুজো। তারই তোড়জোড়।

১মগ্রামবাসী — ‘ আরে আরে, সবাই এক্কেরে তাড়াতাড়ি আইসা পড়স।’

২য়জন — ‘কই গো, আসো দেকি সব্বাই, একখানে জড়ো হও ত্বরিত কইরা। আলুরি ঝালুরি ফালাইয়া, আগে কাইজের কথাখান পাইড়া ফেলো দেহি। আর নাগাল সময় নাই।’

৩য় জন – ‘ সরো সরো দেখি, ঠাকুর মশাইরে আগে বসতে দাও, দেখি।’

সবাই মিলে, ‘আসেন আসেন ঠাকুর মশাই’ , ‘বসেন’। ‘হ্যাঁ বসুন চক্কোত্তি মশাই, কাজের কথাটা হয়ে যাক, আগে।’

নিবারণ চক্রবর্তী – এই বসি। ‘এবার আপনেরা বলেন, কি ঠিক হল! পুজো, খাওয়া দাওয়া, সন্ধ্যার গানের জলসা, সবই হবে তো! না কি কিছু অন্য বন্দোবস্ত থাকছে? ‘

চক্কোত্তির জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ঘুরে গেল মাতব্বর ঘোষালের দিকে। দু একজন উসখুস করছে। তাই দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করল ঘোষাল,

বারিণ ঘোষাল – নেতা কাম মাতব্বর, স্বভাবী গ্রাম্ভারি আওয়াজে, ‘তো এই হল গিয়ে ওই.., ওই একই থাকছে সব। পুজো তো হচ্ছেই, হবে হবে। খাওয়া দাওয়াও থাকছে… শুধু করমালি চাচাদের…,’ কি বলতে গিয়েও চক্কোত্তির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই থেমে গেল। ঠাকুর মশাইয়ের চোখ তখনো ঘোষালে আটকে আছে।

ঠাকুরমশাই – ‘ হ্যাঁ, বলতো করমালির ছেলে করিমের কি খবর, আসে নি তো!! ওর জ্বর কি সারে নি, জানো কিছু তোমরা, ঘোষাল?’ একটু থেমে, ‘চালাখানায় তো নতুন খড় লাগাতে হবে। সেবারের মতোন যেন না হয়, অবেলার ঝড়ে বা রোদে বসে কেউ যেন না খায়! কি বল, ঘোষাল!!’

ঘোষাল – সবার দিকে চোখ বুলিয়ে, ‘ আজ্ঞে হ্যাঁ, সে তো বটেই। আমতা আমতা করে , ওই যে করিমের ভাগ্নে ভাগ্নিগুলোকে নিয়ে দামিনী কমল বিমল সব একপাতে একসাথে বসে খেলো যে সেবার, সেইটা নিয়েই এরা সব,, এই তোমরা নিজেরাই বলো না, ঠাকুর মশাইকে।’

ঠাকুর মশাই – উচ্চস্বরে হেসে উঠে, ‘ ওহ্ এই ব্যাপার! আমি ভাবছি কি, কী না কি হল। দেখো বাবা, সস্নেহে ঘোষালের দিকে চেয়ে, এমন ঘটনা তোমার বাবার আমলেও কত ঘটেছে। তাছাড়া, তুমি আর করিম এক ক্লাসে পড়েছো, খেলেছো, পিঠোপিঠি বড় হয়েছো। এসব আর আজকাল কেউ মনে রাখে না। ‘ অল্প থেমে, আমি বলি কি, বাবা,, এবার তোমরা মিটিয়ে নাও। থাকো দুভাইয়ের মত। ‘
সবার দিকে তাকিয়ে, ‘ কি বল সব, তাহলে এই কথাই থাকল।’

ভিড় হইহই রইরই করে উঠল। সবাই একসাথে হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই হবে। ‘ সবাই বল, জয় মা মনসার জয়!’

২য় দৃশ্য

চিত্রঃ ২

নিবারণ চক্রবর্তী মশায়ের বাসা। দুটো ঘরের সামনে একচিলতে দাওয়ায় বসেছে কচিকাঁচাদের পড়ার ক্লাস, তারই শোরগোল। রবিবারের সকাল দুপুর সন্ধেয় চলে দামিনীর পাঠ কাম কারুশালা। সকালটা ছোটোদের পড়াশোনা, দুপুর গ্রামের বৌদি দিদিরা ভীড় জমায়, খবর শোনে কিছু শেখা পড়াও হয়। সন্ধেয় আসে বন্ধুরা। অাছে দু একজন, মাঝে সাঝে আসে স্কুলের দিদিমণি সুরঞ্জনা।

‘ সুচি, সবাইকে চুপ করা, শুরু কর, বই খুলতে বল, – দামিনীর গলা ভেসে এল।

সুচেতনা , (ঘরনাম সুচি) ‘ হ্যাঁ, মা আ আ। এই চুপ চুপ, চুপ কর সব। সবাই চুপ। দামিনী দিদি এখুনি আসছে। বই খোল সব। খাতা পেনসিল গুছিয়ে নিয়ে বস।’

দামিনী, ‘ দেখ তো কে কে পেনসিল আনে নি,, এই এই এসে পড়েছি, দাওয়ার খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে জলচৌকি নিয়ে বসেই ,, এ্যাই ছোটন বল দেখি সেই কবিতা, ‘পড়েছিস… কে কে পড়েছিস বল!! বল! খোকন পারবি? নাড়ু, কিশোর, তরুণ, টুকি, রিন্টি, ঝিল্লি, বুলবুল কে পারবি,, কি রে বল। ‘(পজ) ‘যে পারবে তাআর এই (হাতে তুলে রঙিন মোড়ক দেখায়) লজেন্স। ‘

এবারে কাজ হল। কিশোরের হাত উঠল, দেখাদেখি রিন্টি, একে একে আরও।
‘ বল, শুরু কর।’

কিশোর – ‘ কাল ছিল ডাল খালি, আজ.. আজ আজ.. ‘

রিন্টি – ‘ ফুলে যায় ভরে
বল দেখি তুই মালী
হয় সে কেমন করে।’ একদমে শেষ করেই শ্বাস নিল।

দামিনী– ‘ এ কী রে! মেয়ে! দম অাটকে মরবি যে! ‘ বল তালে তাল মিলিয়ে। ‘ নে, সুচি সবাই কে একসাথে । ‘

সুচি —
‘আমারটা শুনে তাল মিলিয়ে বল সবাই। ‘
‘ কাল ছিল ডাল খালি…
আজ ফুলে যায় ভরে
বল দেখি তুই মালী
হয় সে কেমন করে… ‘

তালে তালে সুর উঠছে দামিনীর পাঠশালে, সকালের কচি রোদ ঝিকমিকিয়ে স্নান করাচ্ছে দিনকে। মেঠো রাস্তা ধরে সে সুর ছড়িয়ে পড়ছে এদিক সেদিক।

দামিনী– ( নীচু স্বরে) , ‘ আরে, এ হল রবিঠাকুরের কবিতা, এ কি যেমন তেমন করে বলা যায়! আজ পড়বি সারাজীবন বুকে রাখবি,পালন করবি, লালন করবি, তবেই তো শিখবি।’ (গলা গভীর করে) ‘ ‘এই ভাবকে জীবন দিয়ে আত্মস্থ করতে হয়।’

৩য় দৃশ্য

চিত্রঃ ২

ঐ একই উঠোনে সন্ধ্যের আলো আঁধারি, ধোঁয়া ছড়াচ্ছে কাঠকয়লার উনুন, নিভে যাওয়া দিন হাতছানি দিয়ে ডেকে নিচ্ছে অন্ধকারকে। গাঢ় চাপা গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। দু চারটি শাঁখ বেজে উঠে জানান দিল, দিন শেষ। রাত শুরু।আশৈশব গোল্লাছুট থেকে স্লেট পেন্সিল পেরিয়ে সংসার জীবনে পৌঁছে গিয়েও না জিরোনো দুই বন্ধুর একান্ত ফিসফাস।

করিম – ‘ খবর শুনেছিস… চারদিকে তো ক্ষেড়নাট্য চলছে রে, চলছে তো চলছেই!!’

দামিনী – ‘ তা, তুই কি করবি? সবাই যদি নিজের মাথাখানা বন্ধক দিয়ে রাখে! আর অন্ধ সেজেই স্বর্গ সুখ ভোগের স্বপ্ন দেখে সুখ পায়। কি করার আছে, বল! ‘
‘ তা, তোর শরীর কেমন আছে? এত ভুগছিস কেন, বারবার?’

করিম — ‘ আর, শরীর!! রাখ তো শরীর।
সর্বনাশা ক্ষেড়নাট্যের অকৃত্রিম চাষ আবাদ চলছে! ‘ ‘ সবাই দুহাত তুলে বাহ্ বাহ্ করছে। আর তুই পড়ে রইলি আমার জ্বর নিয়ে! ‘ শ্বাসরুদ্ধ গলায়.. থেমে থেমে, ‘ আর দিন কি মাস কয় পরে যদি আমি “না” হয়ে পড়ি,?? পারবি সয়ে নিতে। ‘

দামিনী – চাপা চীৎকার মেশানো কান্নায়, ‘ করিম!! চুপ! একদম চুপ!!’

করিম – গাঢ় কন্ঠে, ‘ তোর ফেলে আসা সংসারের মতোই,, হয়ত একদিন আমি আমার পরিজন পরিবারদের নিয়ে বাতিলের দলে পড়ে থাকব। দেশের ডাস্টবিনে শুয়ে থাকব বড় আস্তাকুঁড়ে গিয়ে পড়ার অপেক্ষায়।’ ‘সেদিন কি তুই
থাকবি, পাশে, ডাকলে পাবি, শুনতে??’

দামিনী — ‘কেন আমরা পড়তে গেলাম, বলতো!!’ ‘বারবার আফসোস হয়, পড়াশোনা না শিখে গাধা সেজে থাকা অনেক সহজ, জানিস। এখন না পারছি, গাধা হতে। না পারছি মানুষের রোখ চেপে থাকতে!
আমরা কি এভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম রে!’ ‘ রবীন্দ্রনাথ পড়া কি এতই ব্যর্থ হল?’

করিম — ‘না। তুই ঠিক উল্টো পথে ভাবছিস। তুই যে ঠিক রাজার পথেই অস্ত যেতে চাইছিস! দোষ কি তোর! আমার! আমাদের!! এ যে ভুলভুলাইয়ার কারখানা ঘর।’
‘আজকাল খুব স্যারের কথা মনে পড়ে। সুধীরবাবুর গমগমে ভরাট স্বরের সেই বিরাট প্রশ্ন , – ‘এই দেশ কি আমার? ‘
‘মনে আছে তোর স্যারের কথা, নির্বাস পড়ানোর কথা! সারা ক্লাস ঘর নিস্তব্ধ। শ্বাস পড়লেও বুঝি শোনা যাবে! ‘
বেদনা মাখা স্বরে, ‘আমরাও যে বাদ পড়ে গেলাম মায়ের কোল থেকে। আমরা কি কেউ নই, বল!’

রমা – জলদ গম্ভীর স্বরে.., ‘ভূগোল দিয়ে মাকে ভাগ করা যায় না, বাবা। মায়ের কোলের কি কোন জাতধর্ম হয় রে!’
চমকে উঠে দুজনে পিছনে তাকায়।

দামিনী – ‘ মা!! ‘
মার হাতে ধরা সন্ধে দীপের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে কপালে ঠেকায়।
করিম চুপ।

রমা – ‘আয় বাবা! সন্ধের আলো ছুঁইয়ে দিই তোর কপালে। সব অমঙ্গল কেটে যাক! এত ভাবিস না করিম। অামি তো অাছি!! ‘

করিম– ‘ মা কে তো মনেও পড়ে না, মাসি। জ্ঞান হওয়া ইস্তক তোমার হাতেই তো মা কে ছু্ঁয়ে থাকা। কিন্তু, আজ আর কিছুতেই শান্ত থাকতে পারছি না, সান্ত্বনাও পাচ্ছি না।’
‘মাসি, তোমার হাতটা আর একবার রাখবে মাথায়!’

রমা – ‘ তোরা ভাবিস, আমি বুঝি না, কিছুই। ক্ষেউড়নাট্যের মিথ্যে মুখোশকে চিনেছি জীবন দিয়ে! দামির সংসারটাও তো ছিল মিথ্যে রঙ মাখানো ফানুসের – জবরদস্তির। জোর খাটানো যায় মেয়েদের ওপর। সে যদি বউ হয়, মেয়ে হয়, মা হয় বা বোন। সেখানে জুলুমবাজিকেই ভালোবাসার স্নেহের মুখোশ পরানো থাকে! কিন্তু মন! সে তো কোন জুলুম মানে না! তাকে আটকায় কে? ‘

দামিনী – ’মা’, আবেগে মায়ের কাঁধে মাথা রাখে। ‘আয় ভাই, আজ আমাদের শান্তির বড় প্রয়োজন। মা, মা, তুমি এত ভাব।’

রমা – ‘ভাবতে তো হবেই। আজ যদি তোদের রাস্তা খুলে দিতে পারি, তবেই তো তোরা পথ দেখাবি সুচিদের।’
‘আমার দায় কোনদিন ফুরোবে না রে! শুধু বদলে যাবে।’

করিম – ‘ মাসি ‘ , রবিঠাকুরের সইয়ের গল্পটা আরেকবার বলবে!’

রমা – ‘দূর পাগল। কলেজ পাশ দিলি তোরা, আর আমি শোনাব তোদের গল্প।তোরাই বরং শোনা, আমি শুনি।’

করিম – ‘ না, মাসি, তোমার বলায় যে স্বাদ আছে, তোমার সুরে যে ধার থাকে তাই কি আর বই পড়ে ক্লাস করে পাওয়া যায় ? ‘

রমা – ‘পাগল, ছেলে!! আমি সব ভুলে গেছি রে।’

দামিনী – ‘মা, ওমা বলো না মা। তোমার মতো করে কেউ তো পারে না, বলতে!’

রমা – ‘ তোরা কি পাগল হলি! আমার ছিস্টির কাজ পড়ে আছে যে, আঁচ উঠে যাবে।এইবেলা যাই রান্না শেষ করি। ‘

সুচি – পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে,
‘বলো না দিয়া, আমিও শুনি।’

রমা– ‘ ওরে পাকা বুড়ি! তুইও এসেছিস। যা পড়তে বোস। দাদাই বকবে রে মেয়ে।’

সুচি – ‘ তার ঢের দেরি আছে।তুমি বল তো!’

করিম, দামিনী – ‘ হ্যাঁ বল, বল, বল… ‘

রমা – ভেতরটা গুছিয়ে নিয়ে… ‘ সে তখন বিরাট যুদ্ধ শুরু হয়েছে বিশ্বজুড়ে। বাপ রে, সে কি ভীষণ ব্যাপার স্যাপার। বড় বড় দেশগুলো সব একে অপরের শত্রু হয়ে উঠছে দিনে দিনে। এ বলে আমি বড়! অন্য দেশ বলে আমি আরো বড়। আরেক দেশও থেমে থাকে না জানায় সে হচ্ছে মহাবড়। তাবড় তাবড় বড়দের লড়াই থামানো কি যে সে ব্যাপার! এই লড়াই দেশের জন্য, জাতির জন্য, দেশীয় জাত্যাভিমানের জন্য। জাতীয়তাবোধের অহংকারে মত্ত দেশগুলিকে থামানো কি সহজ ভাবে হয়! দুই দেশের দুই মহাপুরুষ নেমে এলেন শান্তির বারতা নিয়ে। জাতিগত অহং এর থাবা থেকে পৃথিবীর মানুষকে বাঁচাতে, মানবিকতাকে রক্ষা করতে এক অসামান্য চুক্তির বন্দোবস্ত করলেন তাঁরা। জার্মান দার্শনিক ও উপন্যাস লেখক রম্যাঁ রল্যাঁ সমস্ত বিশ্ববাসীকে ডাকলেন, বোঝালেন যুদ্ধের ভয়ংকর ক্ষতির দিককে।এতে মানুষের কোন লাভ তো নেইই, উলটে অবর্ণনীয় দুর্দশা, কষ্ট। চিঠি লিখলেন আমাদের কবি রবিঠাকুরকে। এই চুক্তিতে প্রথম এশীয়, প্রথম ভারতবাসী হয়ে সই করলেন রবিঠাকুর। লিখলেন একটি বিখ্যাত গান। —

‘নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগলো …
নীল দিগন্তে,
বসন্তে..
সৌরভের শিখা জাগলো…’

৪র্থ দৃশ্য

গ্রামের চন্ডীমন্ডপে ভীড় জমে উঠেছে। আটচালার জায়গায় জায়গায় ছোটো ছোটো জটলা। সকালের সব জরুরী কাজ বাদ দিয়েই প্রায় সবাই এসে জড়ো হয়েছে। মৌমাছির গুঞ্জনের রোল সকালের রোদের মত বাড়ছে – কমছে। খুব গুমোট। কুল কুল করে ঘামছে সবাই। মুখে সবারই চিন্তার ভাঁজ। ঘোষাল মশাইকে অাসতে দেখে গুঞ্জন বাড়ল। দু একজন এগিয়ে গেল।

১ম গ্রামবাসী – ‘আসেন আসেন ঘোষাল মশাই। ‘

২য় জন – ‘ বোসো বাবা, জুত করে বোসো দেখি, ‘ একটু যেন বেশিই খাতির দেখালেন বৃদ্ধ রামরতন ঘোষ।

৩য়জন – ‘ এট্টু জল আনব না কি, বারিণবাবু, যা ঘাম দেচ্ছে! আজ যেন বড্ড গুমসী হচ্ছে গো! ‘

ঘোষাল – চারদিকে তাকিয়ে দেখে বাড়তি খাতিরটুকুতে বেশ খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করে,, ‘ তা সবাই এসে পড়েছেন, দেখছি। তা বেশ, ভাল ভাল। হাত তুলে, ‘ ও চাচা, ও করমালীচাচা এসেছেন দেখছি, বা খুব ভাল। ভাল আছেন তো, চাচা।’ চাচা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। ‘মৌলবী সাহেব নমস্কার। ‘

গাঁয়ের পশ্চিম কোণে ছোটো এক মসজিদ অাছে। মৌলবী সাহেবের তত্ত্বাবধানে তার কাজ কারবার চলে। এগাঁয়ে আলাদা কোন মন্দির নেই। দরকারও পড়ে নি। বছরকার তিনটে পুজো মনসা কালী আর সরস্বতী সবই চন্ডীমন্ডপের আটচালায় মেরাপ বেঁধে করা হয়। দুই সম্প্রদায়ের মানুষই সমানভাবে হাত লাগায় সবকাজে।

ঘোষাল – ‘কই গো সব এসে পড়েছো। তাহলে আর দেরি কেন, শুরু করা যাক।’

১মজন – ‘আজ্ঞে, পুরোহিত মশাই আসেন নাই।’

ঘোষাল – ‘সে কি রে, হাবুল!! ঠাকুর মশাইকে আজকের খবর দেওয়া হয় নাই!’

১ম জন – ‘আজ্ঞে দ্যাওয়া হইছে তো! আইবেন কইয়া দেছেন। অই অই তো আসতাছেন ঠাকুর মশাই।’

চারপাশের গুঞ্জন ফিসফিসানি থিতিয়ে গেল। সব একদম চুপ। ঘোষাল নিজেই উঠে এল পুরোহিত মশাইকে আহ্বান করতে।

ঘোষাল – ‘আসুন কাকা, আসুন , আসুন, শরীর ঠিক আছে তো?’ কন্ঠে মধু ঝরছে,, ‘এত দেরি করলেন যে,, সবাই বসে আছি।’

পুরোহিত নিবারণ চক্রবর্তী — ‘ হ্যাঁ, বাবা, ভাল আছি। ঘরের নিত্য পুজা সেরে আসতে একটু যা সময় গেল। ‘ একটু থেমে, ‘ তা তোমাদের এত জরুরী তলব কেন বাপু, বল!! আমার আর কয় ঘর পুজা আছে যে, দেরি হলে সব রাগ করবে, জানোই তো। ‘ সবার দিকে তাকিয়ে , ‘ তা বল সব। শুরু করো। ‘ ঠাকুর মশাই বাইরে শান্ত, কিন্তু ভেতরে ঝড় চলছে। দামির কথাগুলো নাড়াচাড়া করছে মনের ভেতর।

সবাই মিলে, ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ শুরু করেন, ঘোষাল বাবু। ‘

ঘোষাল – গম্ভির ভাব ফুটিয়ে গলা খাঁকারি দিল।
খানিকটা বিনয় মেশানো গলায় সুরু করল –
‘আপনারা সবাই জানেন, অামাদের গ্রামে খুব শান্তিপূর্ণ ভাবে থেকে অাসছি অামরা সবাই, আজ্ঞে হ্যাঁ, সবাই (জোর দিয়ে)ইই থাকছি। সে আমার বাপ ঠাকুরদার আমল থেকেই এমন চলছে। কোন অসুবিদা টসুবিদা কিস্যু হয়নি। হয়নি, কারণ সবাই এক ছিলাম। যে যার মতো, আবার সব একসাথে চলছিলাম। কি!! কারোর কোন সমস্যা ছিল? ‘

সবাই সমস্বরে – ‘ না না না,, না ছিল না। ‘

ঘোষাল – ‘কিন্তু আজ হচ্ছে।’ ‘ কি মৌলবী সাহেব? কি সুজন কাকা? কি করমালি চাচা?? কি চক্কোত্তি মশায়? হয়েছে?? ‘(জোর) ‘হয় নি।’ ‘ করিম আসে নি??’ চেঁচিয়ে, ‘ হাবুল করিমকে খবর দিস নি? ‘

১মজন – ‘ করিম ভাই তো শহরে গেছে সেই পরশু বেলাবেলি , তার ফিরতি রাত হবে, চাচা বললে যে, আজ্ঞে। ‘

মনে মনে বেশ খুশ হয়ে গলায় মেজাজ ফুটিয়ে শুরু করল,
ঘোষাল – ‘ যা নিয়ম, তা নিয়ম। সবার জন্য। হ্যাঁ, সবার জন্যই এক। কেউ যদি সেটা ভাঙে, তাইলে তো ভাবতে হয়। ‘ থেমে, ‘ দামিনী এ গ্রামের মেয়ে, অামার বন্ধু, এক কেলাসে একসাথে পড়েছি আমরা। হ্যাঁ, করিম ও তাই। আমরা সব বন..,’

‘তা সে সব ইস্কুলের ব্যাপার,, বাইরের ব্যাপার। তাই বলে একেবারে ঘরের ভেতর নিয়ে তোলা! কি জাত তার ঠিক নেই!! তাও হিন্দু হলেও না হয়,, হতো!! এ যে একেবারে মোসলমানের বেটি! সঙ্গে অাবার এক বেটাও রইছে।
এটা ঠিক হয় নি, ঠাকুর কাকা( ধমকের সুরে)।’

ঠাকুরমশাই – ‘কি করবে বলো,’ কাঁচুমাচু স্বরে, মেয়েটি কদম গাছতলায় ঠায় বসে, একরত্তি ছেলেটাকে নিয়ে।’

‘আমিও যে দেখে গেলাম পুজো সারতে। কিন্তু সন্ধ্যের জল ঝড়ে ওদের ওভাবে বসে থাকতে দেখে , আর পারে নি।’ ‘ তাছাড়া, ছেলেটার গায়ে জ্বর ছিল। এখনো নামে নি।’

‘পড়িয়ে ফেরার পথে তাই দামি আর পারে নি ওদের না নিয়ে এসে।’

ঘোষাল – ‘আপনি উঁচু বংশের বামুন, কাকা। তায় পুজো আচ্চা করেন, আপনার ঘরে কি না, মোসলমানের বেটি? ছি! এও কি মানা যায়, কাকা?’

ঠাকুরমশাই – ‘আমি তো জাত ধর্ম দেখিনি, বাবা।’ ‘অভুক্ত অসুস্থ, ভেবেই, একাজ করেছে দামি। ‘ ‘ওকে তো তুমি চেনো, বাবা।’

ঘোষাল – দাঁতে দাঁত চিপে, নীচু গলায়, ‘ সে আর চিনি না! এই বার তোমার বিষ যদি ঝাড়তে না পারি,’ ‘মানুষ হলে তো কথাই ছিল না কাকা, এ যে ভিন্ন। ওদের সাথে আমাদের চলে না!’
‘ ব্যাস!’
‘ কি বল, সবাই?’

সভায় নিরবতায় গুঞ্জন উঠল।

ঠাকুরমশাই– ‘ কিন্তু আমাদের গাঁয়ে তো সবাই মিল মিশেই ছিলাম। সেই তোমার বাপ ঠাকুদ্দার আমল থেকে। এখনও তাইই তো আছি। ‘
সবার উদ্দেশে, ‘একই রকম তো আছি না কি, বল তোমরা।’ ‘ চুপ করে থাকলে হবে না, সবার মতই দরকার। এ আমার একার কিছু নয়, গাঁয়ের এতগুলান মানুষ কেউ তাকে ঠাঁই দিল না, কেউ ডাকল না সারাদিনমান।’

‘ একজন মেয়ে একটি শিশুকে আশ্রয় দেওয়া অপরাধ!! ‘
‘মৌলবী সাহেব ?? ‘
‘করমালি ভাই?? ‘
‘তোমরাও তো কিছু করলে না। আমি তো বাধ্য হয়েই… সেটাই দোষের।’

ঘোষাল – চেঁচিয়ে থামিয়ে দিয়ে,, ‘ অত দোষ ঘাট বুঝি না কাকা। যা নিয়ম, সবার জন্যই এক নিয়ম।’ ‘তাছাড়া কেমন মেয়েছেলে, কে জানে?’

ঠাকুরমশাই– চীৎকার করে উঠে, ‘বারিণ! আহ্, থামো তো এবার! চুপ করো বাবা! আর যে সইতে পারছি না।’

ঘোষাল– ‘আমায় চুপ করিয়ে লাভ নেই কোনো। দামিনীর তো মাথায় ছিট আছে,’ নীচু গলায়, ‘নিজের ঘরও তো টেকাতে পারে নি। ওর আবার কথা!’

ঠাকুর মশাই – অপমানটা চুপচাপ গিলে নিয়ে, ‘ওরা চলে যাবে, বারিণ। একটু সেরে উঠুক। আমি নিজে গিয়েই তাকে তার বাড়ি দিয়ে আসব।’

ঘোষাল- হাসি, ‘সে টি হবার যো নেই, ঠাকুর মশাই।’ হেঁ হেঁ, হাসি, ‘কি মৌলবী সাহেব বলুন দেখি, মুখ খুলুন এবার। আমি যে একাই বলে যাচ্ছি।’

মৌলবী – হাতে ধরা তসবী চোখে মুখে বুলিয়ে, ‘ও মেয়েকে কেউ ঘরে তুলবে না, বাচ্চা টাকেও না। ওর তালাক হয়ে গেছে।’

ঠাকুরমশাই- মাথাটা কি দুলে উঠল। তলে তলে সব ঠিক করা ছিল। শুধু তারাই জানত না কিছু। ভাঙা গলায় তাও শেষ চেষ্টা করলেন, ‘ভাই করমালি, কি হবে ও মেয়ের! ‘ও অমলের বাপ কথা কইছো না যে, কিছু তো বল! দিশা দাও কিছু।’

ঘোষাল– ঠাকুর কাকাকে নিস্তেজ দেখে, আরও উল্লসিত হল, খুশি মিশিয়ে শুরু করলো, ‘ওদের কথা থাক, কাকা। আপনি নিজের কথা ভাবেন। আপনি কি করবেন? চলবে কি করে? এ গাঁয়ে কি কেউ আর আপনাকে ডাকবে? ‘

ঠাকুরমশাই – ‘মানে! মানে তো বুঝলাম না, বাবা।’

ঘোষাল – ‘মানে আর কি, ওই আপনার পুজোয় আর কাজ নেই। কেউ আর আপনাকে দিয়ে পুজো করাবে না! ব্যাস! ‘

ঠাকুরমশাই- ‘পুজো বন্ধ হয়ে যাবে! এই গাঁয়ে! আমার বাবার আমল থেকে চলে আসা পুজো বন্ধ হবে! তোমরা বন্ধ করবে।’

ঘোষাল – ‘ বন্ধ হবে কেন! ‘

ঠাকুরমশাই – ‘ পুজো কে করবে? পূজারী তো কেউ নেই। ‘

ঘোষাল– ‘ সে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। সে আমাদের ব্যবস্থা আমরাই করব।’ ‘ অামি,’ দাম্ভিকতার সঙ্গে, ‘আমি করে দেব। শহর থেকে নিয়ে আসব, একেবারে খাঁটি পুরোহিত। পুরো ভারতীয় হিন্দু। ওসব বেজাতের ছায়াও মাড়াবে না। এক্কেবারে খাঁটি পুরুত!

 

৫ম দৃশ্য

দামিনীদের বাড়ি। সন্ধের অন্ধকার নেমে এসেছে। বাইরে শেষ ভাদ্র ঢালছে অঝোরে। বিদ্যুত চমকের সাথে সাথে টিমটিমে জ্বলা বাল্বটাও নিভল। হঠাৎ করেই কাদালেপা স্যাঁতলা হাওয়া ভিজিয়ে দিল। জানলার পুরনো কাপড়ের পর্দাটা ভিজে ন্যাতার মতো লেপটে গেল পাশের দেওয়ালে।অন্ধকারে ভেজা বাতাস সবার মুখগুলো মুছিয়ে গেল।

সুচি – ‘ দিয়া, ও দিয়া ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিয়ে যাও না। ও দিয়া…, ও মা, মা আ আ।’

দামিনী – ‘ দাঁড়া, একটু সবুর কর, অানছি, আনছি ।চেঁচাস না। তোর যেন তর সয় না। বাড়ির কি অবস্থা দেখছিস না। ‘

সুচি – কাঁদো কাঁদো ভাবে, ‘অামার ভয় করছে মা, তুমি কোথায়, অামায় ধরো।’

দামিনী – ‘আয়, হাত ধর,, নে।’

রমা – ‘ এই যে বাপু, আলো নিয়ে এসে পড়েছি। ভয় নেই , দিদি। আমরা আছি তো! চল, তোকে দাদার ঘরে নিয়ে যাই।’

দামিনী – ‘ না মা! ‘
‘ ও এখানেই থাক। বাবারও তো শরীরটা ঠিক নেই। বাবাকে বিরক্ত করবে।’

রমা – ঝংকার দিয়ে উঠে, ‘তুমি তো ভারি স্বস্তি দিয়েছো, দিয়েই চলেছো কান্না দমিয়ে, এই একরত্তি অার মড়ার উপর কি ঘা দেবে! ‘

দামিনী – ‘আঃ,, মা,, চুপ করো। ‘গভীর গলায়, ‘ মা! মাগো! তুমি এভাবে বোলো না। আমার সব সাহস তো তুমিই মা। আমি দেখছি মা৷ কি করা যায়।’

রমা – ‘ হ্যাঁ!! তাই তো। তুমিই তো দেখবে! এই যে দেখছো, দেখে রেখেছো আমাকে, তোমার বাবাকে,, সূচিকে,, নিজেকে,,’ ধরা গলায়, ‘নিজের সংসারকে,!! এত দেখেও শান্তি পাও নি। আবারো দুটি মুখ বাড়িয়েছো!! ‘
‘জন্মইস্তক আমাকে শান্তিই তো দিচ্ছো। দিয়ে আসছো।’ কান্না চেপে দ্রুত বেরিয়ে গেল রমা।

দামিনী– ‘যা তো সুচি, দিয়ার কাছে যা। দেখে আয় দাদাই কি করছে? বই নিয়েই যা। ‘কি ভেবে,’ থাক, আজ আর পড়তে হবে না। যা দাদার সাথে গল্প কর গে, যা। ‘আর, শোন, চোখে চোখে কথা হল মা- মেয়ের, ‘দিয়ার সাথেও’। দামিনী জানে, মায়ের সব রাগ ক্ষোভ জল হয়ে যায় নাতনীর কাছে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। নিজেকে গুছিয়ে নিল দামিনী। হয়ত, নতুন মেয়েটির জড়োসড়ো ভাব কাটাতেই আরেকটু সময় নিল। কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখল মেয়েটির। হাত বাড়িয়ে ওর ছেলের কপালে অালতো ছোঁয়ালো। মুখে হাসিভাব ফুটিয়ে কাছে টানল নতুন মেয়েটিকে।

দামিনী– ‘তোমার নামটা যেন কি!’

আয়েশা – ‘ খুব আস্তে, আয়েশা।’

দামিনী – ‘আয়েশা। হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ‘সান্ত্বনা দিয়ে, ‘ভেবো না। কিছু না কিছু ব্যবস্থা হবে। তার অাগে তোমার গল্পটা কি! ভালো করে বলতো, শুনি।’

আয়েশা – কাঁদতে কাঁদতে নাকটেনে,, ‘আমার কিসু গল্প নাই, দিদি। আমার সুদু মরণ আছে গো, দিদি! কেন য্যান্ মরি নাই। যানো, ঐ পোলায়ডা আমায় মরতে দ্যায় নাই,, দিদি! অামরা অহন কোথায় যামু? ‘ কান্নায় ভেঙে পড়ে আয়েশা।

দামিনী– ‘শোনো, চুপ করো। কান্না থামাও। এতকাল তো কাঁদলে, কোনো সুরাহা হল কি? যা করে তোমার, তোমার ছেলের কোনো কাজে লাগবে না, উপকারে আসবে না, সেই দিকে আর পা চালিয়ো না, ভাই। কেঁদে তুমি হাল্কা হতে পারবে না। রাস্তাও কিছু বেরবে না। তার চে ‘আমার কথার ঠিকঠিক উত্তর দাও তো, দেখি!’

‘তুমি তো এ গাঁয়ের বউ। বাপ ভাই কেউ নেই? সেখানে যেতে পারবে না! আছে কেউ সেখানে দেখার…?’

আয়েশা – ‘কেউ নাই গো দিদি, আমার।’
‘বাপডা আগেই মরছিল। ছোটত থাকতেই নানির কাইছে রাইখ্যা অাম্মি য্যান কুথায় চইলা গেল। আর ফেরে নাই! নানি অামারে এইহানে শাদি করায়া দেছিল। গেল সনের আগের সন, যেইবার খুব ভাসাইল, অয় গো, নদী ভাইস্যা গেল,, নানিডাও আমারে থুইয়া বেহস্তে চইল্যা গেল গিয়া।’
কাঁদতে কাঁদতে ‘আমি এক্কেরে একা হইয়া গ্যালাম। কেউ কুথায় নাই গো, দিদি।’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে, ‘হেই লাইগ্যাই তো পোলাডার বাপ খেদায় দিল। কেউ নাই যে এড্ডু কিছু কয়, দিদি।’

দামিনী– ‘তোমার শ্বশুর বাড়ির কেউ কিছু বলল না!!’

আয়েশা – ‘ কি কবে গো, দিদি। হগ্গলেই তো উনারে ভয় খায়! তাই ছাড়া, শরিয়তে নিয়ম নাই। ‘

দামিনী – ‘ কি নিয়ম নাই?’

আয়েশা – ‘ ঐ কথাখান কইয়া দিলে আর কুনও কথা চলে না! আল্লাতালার নিয়ম,, দিদি। তার ওপর কি কুনো কথা কওন যায়!!’

দামিনী – ‘ এমন কোনো নিয়মের বিধান নেই। আল্লাতালা এসব কিছু বলেন নি; বরং তিনি স্বয়ং তালাকের বিরোধিতাই করেছেন। এসব ভুল ব্যাখ্যা পরে এসেছে।’

আয়েশা – ‘ কি কও দিদি!’

দামিনী – ‘ তোমাকে মুখেই তালাক দিয়েছে? না.. লেখাপড়া করে দিয়েছে!!’
‘তোমার বরের নাম কি?’ মানে ‘তোমার ছেলের বাবার নাম কি?’

আয়েশা – মাথা নিচু করে, ‘আসরফ মিঞা।’

দামিনী – ‘ ও৷ ওহ,, বুঝেছি। জামাকাপড় সেলাই করে যে আসরফ ভাই!! করমালি চাচার চারঘর ছেড়ে যার দোকান?’

আয়েশা -‘হ’ ‘হ’,, দিদি।’

দামিনী – ‘আচ্ছা, তোমার নানি আর ছেলে পেল না! ওর তো আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল, শুনেছি। ‘

আয়েশা – ‘ হ’। তারে ছাইড়াই তো আমার লগে শাদি হইল।’

দামিনী – ‘এই টুক ছেলে নিয়ে এখন কোথায় যাবে, কি করবে, কিছু ভেবেছো!?’
‘আমাদের অবস্থা তো দেখছো, কদ্দিন টানতে পারব, এভাবে, জানি না। ভাবতেও পারছি না।’

আয়েশা–’অ, দিদি গো, আমরা কুথায় যাবো! যাওনের কুনো জাগা না – ই গো দিদি!’ কান্নায় ভেঙে পড়ে।

দামিনী– ‘কেঁদো না, ওঠো।’ থেমে,’দেখি কি করতে পারি!’
স্বগতোক্তির ঢঙে, ‘ নিজের জন্যই কিছু করতে পারলাম না! তোমার কি উপকারে অাসতে পারি,, দেখি।’ ‘খবর পাঠিয়েছি করিমকে। শহর থেকে ফিরেই অাসবে,, ঠিক জানি।’ ‘দেখি, কাল দিদিমণিও আসবেন। একবার নিশ্চয় আসবেন, ঠিক। নাহলে, আমিই যাব।’ মনে মনে, ‘যেতে তো আমায় হবেই। জলে পড়ে তো আর সাঁতার বন্ধ করা যায় না। নইলে চলবে কি করে!’

‘এতগুলো মানুষের ভাতের যোগান! সে তো,, একটা কিছু করতে হবে। আর তাকেই করতে হবে। ‘
গভীর চিন্তায় ডুবতে থাকে দামিনী। বাবার বয়স হয়েছে। তাছাড়া এত ধকল আর নিতে পারছে না,, বাবা। আর মা, একা কতদিক সামাল দেবে?? টাকার যোগান হবে কোত্থেকে?
আজ হাঁড়ি চড়েছে। কাল কি হবে! কালের ঘরে শনি! উফ, এতো দুঃখেও কবিতা আসছে,, ভাবলে হাসিও পায়, কান্নাও পায়। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে প্রবোধ দেয়, নিজেকে শক্ত করা ছাড়া তার কোন গতি নেই। আজ যেখানে তারা দাঁড়িয়ে আছে, তার জন্য দায়ী তো সে- ই ই।
মনে মনে ভাবে,, সত্যিই সে নিজে কতখানি দায়ী! না তার শিক্ষা!! না কি তার মানবিক সত্তাই তাকে চরাচর নিয়ে ডুবিয়ে মারতে চাইছে!

মাথায় আলগা ছোঁয়ায় চমকে তাকায়। দেখে মা দাঁড়িয়ে আছে। সেই মা। রাগ হীন, বিরক্তি হীন, ভরসা দাত্রী মা। অস্ফুটে বেরিয়ে আসে,, ‘মা! মা গো!’

রমা – ‘ চল, খেতে চল। রাত বাড়ছে।তোরা দুটিতে খেয়ে নিয়ে, আমায় ছুটি দে।’

 

৬ষ্ঠ দৃশ্য

চিত্রঃ ২

রাত প্রায় গভীর। দেশ গাঁয়ে একে গভীর রাতই বলা চলে। কোথাও শব্দ নেই। কোন শব্দতোলা ঘড়িও নেই এ বাড়িতে। টিকটিকিগুলোও ঘুমোচ্ছে বোধহয়। তেলাপোকারাও কোথায় সেঁধালো, কে জানে। ফর্ ফর্ করে মশারির মধ্যেও ঢুকে পড়ে ঘুম ভাঙিয়েছে কতরাত। গা বেয়ে জামা বেয়ে উঠে এসেছে অজান্তেই। এত জলঝড়ে সেগুলোর দেখা নেই। কেন। মশাদের তানসেনী খেয়ালও বেপাত্তা। গা ঘিনঘিনে পোকামাকড়গুলোয় আজ এত টান কেন! চাদ্দিকের নীরবতায় তোলপাড় হচ্ছে রমার ভেতরটা। একটু শব্দ চাই। তার এই মধ্য পঞ্চাশের জীবনে কম ওঠা পড়া তো দেখে নি সে। সে কি আজ ভেঙে পড়ছে ভেতরের ভেতরে! নিজেকে টেনে তোলার সামর্থ না থাক, সাহসটুকু তো ধরে রাখতে হবে। হবেই। নইলে যে কেউ অাস্ত থাকবে না। না মানুষগুলো না সংসার।

উফ! একটু শব্দ চাই তার। অন্তত বেঁচে যে অাছি,, এই বোধটুকু অবশেষ থাক।
নাঃ, আর পারা যাচ্ছে না। শ্মশান শান্ত এই রাত আর শেষ হবে না। না মরে মরার মতো শুয়ে থাকা অসহ্য। মশারি ঠেলে উঠতে গিয়েই বিপত্তি।

দামিনী– ‘কি হল মা?’ ধড়মড় করে উঠে বসল।

রমা – ‘ শো না তুই। ঘুমো দেখি।’

দামিনী– ‘ তোমার মতো আমারও যে ঘুম অাসছে না,, মা।’

রমা– ‘দাঁড়া, আগে বেরোই।’ ‘দম আটকে আসছে, আমার। মশারিটা খুলে দে তো! একপাশ।’

দামিনী – ‘পুরোটা খুলে দিই, মা। এ রাতে আর ঘুম আসবে না মা।’

রমা– ‘তোর এই গা লেপটানো বয়স অার নেই।’ ‘সরে বোস। জানলার কাপড়টা সরিয়ে দে তো!’

দামিনী– ‘কতদিন তোমার গায়ের মা মা গন্ধটা পাই নি! আহ!’

রমা – ‘আদিখ্যেতা রাখ। মরছি নিজের জ্বালায়।উনি এলেন!’

দামিনী– ‘তোমার কোলে কতদিন শুই না!’

রমা– ‘ যত সৃষ্টি ছাড়া কাজ! এমন সোহাগের বয়স এখন সুচির । তোমার নয়।’

দামিনী– জানে, মার রাগ না পড়া অবধি তুমিই চলবে। আরও কতদিন যে তুইয়ের দেখা পাবে না, সে নিশ্চিত। তবু মার কোলেই শুয়ে, দুহাতের বেড়ে জড়িয়ে নিল মা কে। ‘একটু শুই।’

রমা– ‘অবাধ্য মেয়ের কপালে চুলে হাত বুলোতো , বুলোতে, ‘কি করা যায়, বল তো! ও মেয়ের কি কোথাও ঠাঁই হবে না?’

দামিনী– ‘ সেটাই ভাবছি।’

রমা– ‘তোমার বাবা তো শয্যা নিলেন। আমি কি করে সামাল দেবো রে!’ কান্না ভেজা গলায়,
‘আর কিভাবে সামলাব সব?’
থেমে, ‘ঘোষাল বাড়ির বড় পুজো গেল, বছরকার পাব্বণিও আর জুটবে না। বাকি পাঁচ ছয় মাসিক বন্দোবস্তের ধরা ঘরগুলো কি আর রাজীবের সামনে মুখ খোলার সাহস দেখাবে? ‘

দামিনী– ‘সবাই কি পুজো করতে না করে দিয়েছে?’

রমা – ‘না, এখনো মুখে কিছু জানায় নি। কিন্তু সে আর কতদিন! বারিণের বউ লেখা নাকি খুব কান্নাকাটি করছিল। তোমার বাপের মতো এত নিষ্ঠা সহকারে কেউ কি পারবে, পুজোর কাজ করতে, সেও বলেছে।’

দামিনী– ‘তো, সদু মাসি কিছু বলল না! বারিণ ছিল সেসময়, বাড়িতে!’

রমা– ‘বৌ ঠাকরুন তো পষ্টই জানালো যে, দোষঘাট তো হয়েইছে। সে মোছলা বেটিকে তাড়িয়ে প্রায়শ্চিত্তির করতে হবে ঘটাপটা করে। আর সেসব কি না ওই বারিণই করাবে।’

দামিনী– পটাং চাবুকের মতো উঠে,, ‘ কিসের প্রায়শ্চিত্ত!! মা। একটা অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়া, দোষ! অপরাধ! আমরা কি চোর না খুনি?? কি দোষ করেছি, আমরা?’

রমা – ‘ দোষ তো বটেই। শত হলেও দোষই রে! এ যে ধম্মকম্মের ব্যাপার!! ‘
তাছাড়া, ‘আমরা একে গরীব। তায়, মেয়ে মানুষ। আমাদের সবচেয়ে বড় দোষ তো সেটাই।’ ‘পুজো – আচ্চায়- সমাজে – ঘরে – পরে – পরিবারে সব তাতেই আমরাই তো দোষের ভাগী। সে দোষ করলেও দোষী, না করলেও দোষী। এ যে বিধির বিধান, রে!’

দামিনী – ‘মা, তুমি বলছো,, একথা।’
‘তুমি বোলো না, মা,, এভাবে।’

রমা – ‘আমি যে তলিয়ে যাচ্ছি, দামি, অামি যে হেরে গেলাম দামি! কাওকে জিতিয়ে দেওয়ার সাধ্য নেই, আমার। তোকেও না।’

দামিনী – ‘মা! তুমি হেরে গেলে, অামি কি করে টিকব, মা।’

রমা- ‘ কাল থেকে পুজোর চালকলাটুকুুও ঢুকবে না ঘরে। কি বেড়ে দেব, তোর বাপের সামনে, ছেলেমেয়ে দুটির থালায়। রাতে ঘরে কি জ্বালাব। বিজলির ছিরি তো জানিসই। আধ ডিবে কেরোসিন দিয়ে জ্বালাবো কি?’
দামিনী – ‘ ওহ্, কেরোসিন তোলা হয় নি যে গেল হপ্তায়।’

রমা- ‘রামমুদি আর দেবে না, কেরোসিন।’
‘পাঠিয়েছিলাম সুচিকে ওই ছেলের সাথে, কেরোসিন আনতে। দেব বলেও দেয় নি, শেষমেষ।
উল্টে বলেছে, তথাকে নিয়ে জানি আর কোনদিন না যায় তার দোকানে। ধমকধামক খেয়ে সুচির সে কি কান্না। আর দেখ, ও ছেলের কান্ড, সুচির দেখাদেখি সেও কেঁদে ভাসাচ্ছে।
খবর তো কিছুই রাখো না, তুমি। এই যে পাড়া বেরিয়ে ঢুকলে, তা রামরতন ঘোষ পড়াতে দিলে নাতনিকে ? ‘

দামিনী – ‘আমি আজ পড়াতে যাই নি, মা। করমালি চাচাদের পাড়ায় গেছিলাম।’

রমা- ঝেঁঝেঁ উঠে, ‘ তা সে পাড়ায় কি দরকার তোমার! আশ মেটে নি, এখনো।’

দামিনী – ‘জাকিরুন আপার খোঁজে গিয়েছিলাম।’ ‘আয়েশার যদি কিছু হিল্লে হয়।’

রমা – ‘ সে আবার কে? ‘
রেগে, ‘আর কত জ্বালাবি রে!! সুচির কথাটাও ভাববি না, একবার!’

দামিনী – ‘ভাবি মা, ভাবছি বলেই তো ছুটেছিলাম তার খোঁজে। তিনিও শহরে গেছেন।
করমালিচাচার গলি ধরে সোজা ডানদিকে মোড় নিলে যে ছোটো একচালা ঘর।সেখানেই থাকে জাকিরুন আপা।’
গলায় খুশি ফুটিয়ে, ‘সেই যে ইস্কুলের অনুষ্ঠানে শহর থেকে ডাক্তার নিয়ে এসে ক্যাম্প করা হল। ছেলে মেয়েদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হল। তখনই আলাপ হয়েছিল। উনি অনেক কাজ করেন মা। বিপদে পড়া মেয়েদের নানারকম কাজ শেখান, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখান। তাছাড়া, যে মেয়েদের ইস্কুলে যেতে দেয় না বাড়ির লোকেরা, তাদের নিজের ঘরে পড়ান। এটা আমার জানা ছিল না। অাজ জানলাম।’

রমা – ‘ওহ্’, তাচ্ছিল্যের সুরে, ‘তো এবারে সুচিকেও সেখানেই পাঠিও। কাল থেকে সেও সেই ঘরেই পড়বে, না হয়।’

দামিনী – ‘কেন! সুচি ইস্কুলে যাবে। সাথে তথাগতকেও যেন নিয়ে যায়।’
কি ভেবে, ‘না থাক। তথাগতকে আর আয়েশাকে নিয়ে আমি পরে যাব।’

রমা – ‘ তুই বোধহয়, খেয়াল রাখিস নি, আজ রোববার।’ ‘তোর পাঠশালেও কেউ আসে নি আজ। আসবেও না আর।’

দামিনী – ‘সে তো বৃষ্টির জন্য।
তাছাড়া, কটা টাকাই বা পেতাম, পড়িয়ে। আমি তো অন্যসুখেই পড়াতাম, মা। সে তুমি জানো।’

রমা – ‘এখন যে সব জানার বাইরে পড়ে গেছি রে!’

দামিনী – ‘মা, মাগো! দুটো দিন চালিয়ে নাও। চালিয়ে দাও। ‘

রমা – কপালে দুহাত ঠেকিয়ে, ‘ সবদিক রক্ষা ক’রো ঠাকুর। এ আঁধারে আলো ফোটাও।’

দামিনী – ‘ কোন ঠাকুর আলো দেবে,, মা! ‘
‘থানের ঠাকুর? না রবিঠাকুর!! ‘

খুব সজাগ মনে মা কে খোঁচাটা দিল সে। সে জানে, মার চিন্তায় রবিঠাকুর ঢুকে পড়লে কঠিন লড়াই সহজ হয়ে যায়। লড়াই করাটা সহজ মুক্তির পথ পায়।

আজ একটা সোজা পথ দরকার, তার, তার মায়ের, তার মেয়ের, বাবার। এমনকি আয়েশার আর তথাগতরও।

ক্রমশঃ…

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *