গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৯তম পর্ব)”

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান“-র ১৯তম পর্ব

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৯তম পর্ব)

টোটেম

There was the Door to which I found no Key;/There was the Veil through which I might not see:/Some little talk awhile of Me and Thee/There was–and then no more of Thee and Me. (Rubaiyat xxxiii) – O. Khayyam

ওরকম দীর্ঘদেহি লোক জীবনে দেখিনি। নারকোল গাছের মতো লম্বা। একেকটা পা ফেলে একেকটা পাড়া পেরিয়ে পাশের পাড়ায় চলে যায়। কী রাজপুরুষের মতো তার বেশ! পাটভাঙা ধবধবে সাদা ধুতি, গায়ে সাদা উত্তরীয়,  মাথায় সাদা পাগড়ি। হাতে মসনদ্ইআলার আশাবাড়ির মতো দীর্ঘ ওজনদার সোজা একখানা লাঠি। নাক মুখ হাত পা সব মানুষের মতো, শুধু লম্বায় এক বুড়ো নারকোল গাছের মতো। আপনারা তো গালিভারের কাহিনি পড়েছেন। লিলিপুটের দেশ থেকে ফেরার পর তিনি দৈত্যের দেশেও চলে গেছিলেন। সেই যে ৫০/৬০ ফুট দীর্ঘদেহি মানুষের দেশ। এখানে বিপরীত।  বলতে পারেন দৈত্য চলে এসেছে মানুষের দেশে। তবে এ দৈত্য, লোকে বলে, রূপ পরিবর্তনে ওস্তাদ। তার কথার অমান্যি করলে কিংবা তার ভালোবাসার জংগলে কেউ অযাচিত থাবা বসিয়ে নষ্ট করে দিতে চাইলে সে প্রতিশোধ নেয়। মানুষের মতো গলার স্বরে সে ভোররাতে ডেকে তুলে,  তারপর এমন মন্ত্রাবিষ্ট হয়ে পড়ে সে লোক যে, সে অনায়াসে রূপ বদলে ফেলা মৃত্যুকে অনুসরণ করে শস্য খেত বা নৌকা ঘাট অব্দি চলে যায়। সেখানে তাকে কঠোর কাজ করতে বাধ্য করা হয়, যেমন ধানের পেল্লাই বোঝা সাজিয়ে তার মাথায় তুলে দেয় সেই ভৌতিক মানুষ, কিংবা একটা আস্ত নৌকাকে ঠেলে নামাতে বলে গাঙের জলে, না পারলে তার মৃত্যু অবধারিত।

সে বনের রক্ষাকর্তা,  মানুষ তাকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করে, কেউ কেউ বলে অপদেবতা। শাস্তি আর পুরস্কার দুইই যে দেয় সে শুধু দেবতা নয় অপদেবতাও হয়। মানুষের চরিত্রই এমন। সে চায় তার উপকারি নিরীহ হোক, উপকার করে যাক, কিন্তু শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা কিংবা ইচ্ছা তার যেন না থাকে। পূর্ণিমা রাত্রিতে চকচকে চাঁদের আলোয় খাসখালের উত্তর পাড়ে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে অনেকে। এক পা জলের ধারে, অন্য পা পাড়ের উপর, যেমন করে আগেকার দিনে যাত্রার অভিনয়ে সিরাজউদ্দৌলা দাঁড়াতো। হাতে সেই প্রকাণ্ড লাঠি। মাথায় পাগড়ি। খাস খালের পাড়ে একটা বয়স্ক অশ্বত্থ গাছ, সেই গাছেই তার আস্তানা, লোকে বলে।

আমি কখনো তাকে দেখিনি, যে নিজের চোখে দেখেছে তেমন কাউকেও দেখিনি। তবুও সে আছে। সবাই মানে, বিশ্বাস করে। সে পাহারা দেয় গোটা মহল্লাকে, গোটা জংগলকে। আমরা ছোটবেলায় তাকে আটভুত বলতুম। এখন কী বলি, ভাবতে গিয়ে দেখলুম, কিছুই বলি না, কারণ তাকে নিয়ে অনেক দিন ভাবিনি আমরা। দেবতা হোক আর অপদেবতা, এটা ঠিক তাকে সবাই ভয় করতো, যেন অদৃশ্য রাজা, যে রক্ষা করে, শাস্তি দেয়, মাঝরাত্তিরে ঘুরে ঘুরে দেখে তার মহল্লাকে। কেউ বেগড়বাই করলে অদ্ভুতভাবে শাস্তি দেয় তাকে। পারতপক্ষে সে ক্ষমাশীল নয়। পূর্ণ দেবতা তাকে সেইজন্যই বোধহয় কেউ বলতে চায় না।

জেষ্ঠ মাসের অমাবশ্যায় তার পূজা হয় খাস খালের পাড়ে। পূজা মানে যে সে পূজা নয়, অন্য আর পাঁচটা পূজার মতোও নয়। তার পূজা হয় ভোর রাত্রে। মাঝরাত্তিরে মোমবাতি আর বোম্বা নিয়ে অশ্বত্থ গাছের তলায় জমা হয়ে যায় জনা দশেক লোক। মহিলা আর বাচ্চারা যেতে পারে না, মানে তাদের যাওয়া নিষেধ। শুধু একজন মহিলার সেখানে প্রবেশাধিকার আছে। তাকে অবশ্য মহল্লার লোকেরা মহিলা ভাবে কি না সন্দেহ। পারতপক্ষে মানুষ ভাবে কিনাও সন্দেহ।

আজ তার পূজা। দুপুরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তা ঘাট অল্প স্বল্প কাদা হয়ে আছে। মাটির রাস্তার এক সমস্যা। ভারী বৃষ্টি হলে হাঁটু খানেক কাদা হয়ে যায়, পা কম হড়কায় কিন্তু বৃষ্টি যদি কম হয়, তাহলে কথা নেই। রাস্তায় কাদা কম কিন্তু হড়কাবে বেশি। পা রাখা মুশকিল, নখ টিপে টিপে হাঁটতে হয়। নখের গোড়া ব্যথা হয়ে যায়। বিকেলে রোদ হ’লে রাস্তা শুকিয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। একটা বিশাল কালো মেঘ চাঙড়ের মতো ক’রে ছায়া ফেলে রেখেছিল গোটা মহল্লার উপর। অথচ দুপুরে রোদ আর বৃষ্টির বাহারি খেলা হয়েছে। মালো পাড়ার বাচ্চাগুলো সুর ক’রে বৃষ্টির মধ্যে গাইছিল –

রোদ হ’টে বিষ্টি হ’টে

শিয়া’ কুত্তার ব্যা হটে,

রোদ হ’টে বৃষ্টি হ’টে

কিরণবুড়ির ব্যা হ’টে।

এই কিরণ বুড়িকে নিয়ে আমরাও ছোট বেলা সুর কেটে কেটে গান গেয়েছি। কে কিরণ বুড়ি কে জানে! আমরাও তাকে চোখে দেখিনি কোনদিন। তাকে নিয়ে জানবার আগ্রহও কখনো হয়নি। কেন জানি না। কিন্তু তাকে নিয়ে যে যেমন পেরেছে সুর কেটেছে, গান বেঁধেছে। অন্তত দ্বীপের দুটো প্রজন্ম তো বটেই।

আটেশ্বর পূজা আমরা বলিনি কখনো। রাগ করে বলতুম ‘আট ভুত’ আর ভয় পেয়ে বলতুম ‘আট ঠাকুর’। পুরোহিত ডাকা হয় না তার পূজায়। ওপারের জিটি খাল পেরিয়ে অভিরাম মুর্মু ও তাদের মহল্লার আরো অনেকে আসে। তারাই এ পূজার পুরোহিত। অভিরাম মুর্মুরা থাকে বটে জিটি খালের ওধারে, তাদের মহল্লাও আলাদা, কিন্তু তারা এই মহল্লাতেই বেশি আসা যাওয়া করে, এ মহল্লার সাথে তাদের আত্মীয়তা আছে বলতে গেলে। অভিরাম মুর্মু,  বিলাসিবালারা এপারের মহল্লাতেই বছরের বেশিরভাগ সময় কাটায়। হাতে বড় বড় লোহার শিক নিয়ে জংগলে জংগলে ঘুরে বেড়ায়,  কাঁকড়ার গর্ত থেকে শিক দিয়ে বের করে আনে সমুদ্র কাঁকড়া; কিংবা কখনো কখনো তাদের হাতে ইয়া বড় বড় বল্লম, খাস খালের ধারে ধারে কচুরিপানার ভিতর কচ্ছপ খুঁজে বেড়ায়।

ধপাস করে একটা শব্দ হয় ঘরের বাইরে। চঞ্চলী বৌদির ঘুম ভেঙে গেছে সে শব্দে।

কে গো অঠি?

কাই, আমি মন্টু সাউ গো। পড়িছি গো।

আলো নেই?

বোম্বা থাইল। পড়িয়া লিভিছে গো।

তড়িঘড়ি হাতে একটা লম্ফ নিয়ে বেরিয়ে আসে চঞ্চলী বৌদি। অন্য কেউ নয়, মন্টু সাউ বলে কথা। লোকটার মাছের কারবার আছে, পয়সাও কম নেই, কিন্তু আজ অব্দি উপকার ছাড়া কারুর ক্ষতি করেনি। শুধু কি মানুষের, কারণ ছাড়া একটা সাপ ব্যাঙ কিছুই মারতে চায় না লোকটা। এখানে ওখানে জালে সাপ জড়িয়ে যায়, লোকটা খবর পেলেই দৌড়ে এসে কায়দা করে ধরে ছাড়িয়ে দেয়। মহল্লার লোক বলে সাপকে আঘাত দিয়ে ছেড়ে দিলে ঠিক খুঁজে খুঁজে ফিরে আসে, কামড়ায়। মন্টু সাউ বলে-

“সে আমার ক্ষতি করেনি, আমি তাকে মারবো কেনি? বরং ছাড়িয়া দিলে মাউঁষের উপকারের কথা মনে রাখবে অন্নে।”

তার কথা শুনে লোকেরা ঠাট্টা করে, হাসে। কিন্তু দায় বিপদে মহল্লার লোক জানে আর কেউ থাক আর না থাক মন্টু সাউ থাকে। তবে লোকটা একটু নির্বিবাদি। চোখের সামনে অন্যায় দেখলে দু হাত তুলে মা বনবিবিকে ডেকে বলে ” ম্বা, তুই দ্যাখ মা, এনকে শাস্তি দে”।

কী হইচে কাকা? চঞ্চলী বৌদির গলায় স্পষ্টত উদ্বেগ।

লাগচে খুব কাকা?

না রে ম্বা, ঠিক আছি। মন্টু সাউ উঠে দাঁড়ায়।

শ্রীকান্ত কাইরে ম্বা?

সে তো বেড়জালে যাইচে।

অহ, কার লৌকায়?

হরিপদ মুণ্ডয়ের লৌকায় গো কাকা।

অহ।

তুমি কাই যাব কাকা?

অ মা, আইজ বাবার পূজা আছে গো ম্বা। ভোরের বেআ।

অহ, হঁ

বোম্বার তেল শেষ হইচে, আবার অদবা সাবাড়ে যাব, তোর দরে আইলি। আছে রে ম্বা? কাল পাঠি দুবো।

চঞ্চলী বৌদি ঘরে ঢুকে কাচের বোতল বের করে আনে। মন্টু সাউর হাতে দেয়। মন্টু সাউ কী যেন একটু ভাবে, তারপর বলে,

তোহরে নারকোল ছিবড়া আছে?

হঁ গো কাকা আছে। তুমার টকা চৈত মাসে ছাতু খাবে বলিয়া নারকোল ল্যাসতল। আছে। দুবো?

হঁ,  একটু দে তো ম্বা।

চঞ্চলী বৌদি নারকোল ছিবড়ে এনে দেয়। মন্টু সাউ যেতে উদ্যত হয়।

কাকা, চঞ্চলী ডাকে।

ক’ ম্বা।

আট ঠাকুরে পূজা?

হঁ রে ম্বা।

আট ঠাকুরের পূজা করে কেনি লোক?

আমানকের রক্ষা কে করে রে ম্বা? আমানকের জংগ’কে কে বাঁচায়?  সোউজন্যে তার পূজা করি আমান্নে।

কাকা!

হঁ

সেবার পুলিন মাস্টার আইসিয়া মহল্লায় কী কইতল মনে আছে?

হঁ,  জংগ’কে বাঁচাইতে হবে। নাইলে আমান্নে ভাসিয়াবো। গাছকে ভালবাসতে হবে, নাইলে বাঁধ ভাঙিয়াবে, আমান্নে ডুবিয়া মরবো।

ঠিক কইছ কাকা।

আরো কইতল, জংগ’ যদ্দিন আছে তদ্দিন এ দ্বীপ রইবে।

ঠিক কইছ কাকা। আমান্নে বুঝছি কিন্তু যানকের পইসা আছে তান্নে জংগ’ কাটিয়া শেষ করিয়া দ্যাটে, তানকে কে কী কইবে? তানকের ক্ষমতা আছে।

হঁ, কিন্তু আর চুপ করিয়া রইলে হবেনি ম্বা।

আচ্ছা, কাকা

হঁ

তানকের আট ঠাকুর শাস্তি দেয়নি কেনি?

দিবে রে ম্বা, যেদিন আমান্নে সব লোক বুঝবো, সেদিন আমানকের ভিত্রে আট ঠাকুর জাগিয়া উঠবে।  আইসি রে ম্বা।

অশ্বত্থ গাছের গায়ে কাদা মাটি দিয়ে চোখ নাক কান তৈরি করেছে অভিরাম, যেন গাছ নয়,  একটা মানুষ- গাছ। মাথায় দুটো সিংও আছে। কপালে লাগিয়ে দেয় গেরুয়া রং এর সিঁদুর, নৌকার গলুইএ যে সিঁদুর লাগিয়ে পূজা করা হয়। সামনে কলা পাতার উপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে, পাকা কলা, আতপ চাল আর কাঁচা ছোলা, আট ঠাকুরের প্রসাদ। অভিরাম হাত জোড় করে গাছের সামনে বসে আছে। তার পিছনে বসে আছে মন্টু সাউ, তারা বাগ, বিলা মালি, জগাই, গোবিন্দ মণ্ডল, ফেলু পাত্র, সুবোল দলুই,হরি রুইদাস, তিনাথ মুর্মু আর গংগা ঘোড়ুই। অভিরামের হাতের কাছে বিলাসিবালা, তাকে সাহায্য করছে। সেই একমাত্র মহিলা যার এখানে প্রবেশাধিকার আছে। শুধু কি তাই! এই কুৎসিত ভীষণদর্শন মহিলাই হয়ে ওঠে আট ঠাকুরের সত্যিকারের তপস্বিনী।  মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় ঘোর অমাবস্যা রাতে কয়েকটা জীব নিঃশব্দে বসে আছে। অভিরাম ধুতরা ফুল নিয়ে সাজিয়ে দেয় গাছের গোড়া। ছোট একটা কলা পাতায় করে একটুকরো পাকা কলা, কয়েকটা ছোলা আর আতপ চাল নিয়ে গাছের গোড়ায় রাখে। তারপর চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে। বাকীরা হাত জোড় করে মাথা নীচু করে থাকে। একটা সশব্দ নিশ্বাস ফেলে অভিরাম, সবাই বুঝে যায় এবার চোখ খুলতে হবে, হাত খুলতে হবে। অভিরাম জোরে জোরে সুর কেটে কেটে কী একটা গান গায়। সুবোল দলুই নারকোলের ছিবড়ে হাতে নিয়ে দলতে থাকে। জগাই কল্কে বের করে গঙ্গা ঘড়ুইর হাতে দেয়। কল্কে ঝেড়ে মুছে, নিজের পরনের গামছা দিয়ে পরিষ্কার করে হাত বাড়ায় জগাইর দিকে। একটা গোল সক্ত পোড়া মাটির টিকিয়া, ঠিক ছোট কাচের গুলির মতো দেখতে, জগাই কোথা থেকে বের করে গংগা ঘড়ুইর হাতে দেয়। ওদিকে মন্টু সাউ গাঁজার সংগে দুটো বিড়ি খুলে মশলা মিশিয়ে দিয়ে ফোঁটা কয়েক জল দিয়ে দলতে থাকে। হয়ে গেলে সেটা গংগা ঘড়ুইর হাতে দেয়। গংগা ঘড়ুই মাটির টিকিয়া কল্কের মধ্যে দিয়ে তার উপর মশলা দেয়। সুবোল দলুই নারকোল ছিবড়েয় আগুন ধরিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে কল্কের মুখে চেপে দেয়। ট্যাঁক থেকে একটুকরো ন্যাকড়া বের করে কল্কের পিছনে জড়িয়ে দিয়ে মন্টু সাউ কল্কে কপালে ঠেকিয়ে বলে উঠে ” বোম ভোলে!”

চক্রাকারে কল্কে ঘুরতে থাকে। একজন টান মেরে পরের জনকে কল্কে দেয় হাত বাড়িয়ে। রাম সাউ অন্ধকারে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় সবার পিছনে,

ওওওওও মন্টু,

কে গোও?

আমি রাম।

ওহহ।

বাওয়ার পোসাদ হবে?

হঁ, হবে কাকা।

কল্কে বাড়িয়ে দেয় রাম সাউর দিকে। কল্কে নিয়ে মাটিতে বসে পড়ে রাম সাউ। একটা লম্বা টান মারে,

“আহহহ! কদ্দিন পর বাওয়ার পোসাদ খাইটি!”

ভাল হইছে কাকা? মন্টু সাউ বলে।

ফাস্ কেলাস হইছে মন্টু। অটা তোর হাতে ছাড়া জব্দা হয়নি।

সহসা একটা চিল- চীৎকার আসে গঙ্গাবুড়ির ঘাটের দিক হতে। ভোর হতে আর বিশেষ বাকি নেই। মন্টু সাউ জগাইকে বলে

উঠ্ জগাই, কী হইল দেখি।

দু’জন দৌড়ে বেরিয়ে যায় খালপাড় দিয়ে। পড়িমরি করে গংগাবুড়ির ঘাটে এসে দাঁড়ায়। তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। ঝাপসা অন্ধকার ছেয়ে আছে চারদিকে। সেই অন্ধকারের বুক চিরে চিরে একটা চীৎকার উঠছে –

বাবা গোওওও, ম্বা গোওওওও, মরিয়ালি গোওওওও, খুল নারে শালা চুদির ভাইগুয়া। অই শ্লা খানকির ব্যাটা, বাবা গোওও ম্বা গোওওও,  ও বাবা আ আ,  এট্টু জ’ দে রেএএ, মরয়ালি রে এ এ এ।

মন্টু সাউ ঘাটের উপর থেকে হাঁক দেয়

কার কী হইচে গোওওওও?

আহহহ, মন্টু কাকা, মরিয়াবো গোওওও।

কেএএএ? শীকান্ত? কী হইচে রেএএএ?

হরিপদ মণ্ডল নৌকার উপর থেকে জবাব দেয়

শীকান্তকে সংকর মাছ মারচে গো দাদা।

কাই?

এই তো লৌকার সংগে বাঁধিয়া রাখছি।

খুলিয়া তুল্বিয়া লিয়ায়।

পাঁচ ছ’জন লোক কুস্তি করছে শ্রীকান্তদার সঙ্গে। তাকে তুলে আনতে গিয়ে কাদায় পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে হরি মণ্ডলরা। চঞ্চলী বৌদি আ আ আ আ করে মড়া কান্না কেঁদে আছড়ে পড়ল বাঁধের উপর। ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল গাঙের কাদায়। মন্টু সাউ তাকে ধরে ফেলে।

দাঁড়া। আমি আছি, শ্রীকান্তর কিচ্ছু হবেনি।

ও কাকা গোওওও, অকে বাঁচাও।

চুপ কর ম্বা, কিচ্ছু হবেনি।

শ্রীকান্তদাকে উপরে তুলে আনা হয়। সে আছাড়কাছাড় খাচ্ছে। মনে হয় আত্মহত্যা করতে পারলে তার যন্ত্রণা মিটবে। শুকনো পাতা আর গাছের ডাল জোগাড় করে জগাই আগুন ধরায়। তার উপর কাঁচা নিমপাতা ছড়িয়ে দেয়। গপগপ করে ধোঁয়া উঠতে থাকে আগুনের ফুলকির আগা থেকে।  শ্রীকান্তদাকে বসানো হয় আগুনের পাশে।  জনা পাঁচেক লোক তাকে কষে ধরে থাকে। তার  চীৎকারে মহল্লার ঘুম ছুটে গেছে। ভীড় জমে গেছে খালপাড়ে। মন্টু সাউ প্রথমে কাঁটা মারার জায়গাটা পরিস্কার করে দেয় জল দিয়ে। তারপর মুখ লাগিয়ে বদরক্ত চুষে বের করে দেয়। আগুন আর ধোঁয়ার যৌথ প্রহেলিকার মধ্যে পা ধরে রাখে উঁচু করে। জগাইকে বলে ” সাবাড় ঘরনু আমার পুঁটলিটা লিয়ায়”।  জগাই দৌড়ে যায়। মহল্লার মধ্যে একটা টান টান উত্তেজনা। এই যেন কিছু হয়ে যায়। বিষ্টু দলুই বলে ” এ বিঁয়াভাই বোড়ো সংকর মাছ হবে।”

হঁ ঠিক কইচ দা। বিলা মালি বলে।

খানকির পো’গুয়া বালির উপ্রে ঘাপটি মারিয়া বুসিয়া রয়।

উফফ! কী যন্তণা!

শ্লা, এর চে’ মরা ভালো। আমাকে যে বছর মারে, মনে আছে বিষ্টু দা?

হঁ, তোকেও বাঁধিয়া লেসতিলি।

এরই মধ্যে কোথা থেকে মনি মণ্ডল এসে পড়ে ভীড়ের মধ্যে।

দ্যাখি দ্যাখি, আমার ঝন্টু আসসে? ওওওওও ঝন্টু, ঝন্টু রে!

ধুর শ্লা, পাগলাচদা। ভীড়ের ভিতর কেউ একজন বলে। চঞ্চলী বৌদি ফুঁসে উঠে। মন্টু সাউ তাকে থামিয়ে দেয়। জগাই পুঁটলি নিয়ে আসে। মন্টু সাউ পুঁটলি খুলে অনেক গুলো শেকড় বের করে চঞ্চলী বৌদিকে দেয় বেটে আনার জন্য। বেটে আনলে খাইয়ে দেয়।

শ্রীকান্তদার চীৎকার ধীরে ধীরে কমে আসে। যন্ত্রণা যে কমেছে এমন নয়, দীর্ঘ সময় চীৎকার করে, যন্ত্রণা স’য়ে  এখন হয়তো আর তার চীৎকার লাফালাফি করার শক্তি নেই গায়ে। তাকে মন্টু সাউ আর জগাই ধরে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়, শুইয়ে দেয় বিছানার উপর। চঞ্চলী বৌদি ভিজা গামছা দিয়ে সারা গায়ের কাদা মুছে দেয়, উলঙ্গ করে পাল্টে দেয় তার পরনের লুঙ্গি। মহল্লার লোকেরা যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আইসি গো ম্বা, কুন সমিস্যা হইলে আমাকে ডাকবু ম্বা। আর অকে কিছু দুটা রাঁধিয়া খাবি দে ম্বা।

মন্টু সাউ চলে যায়। চঞ্চলী বৌদি ভাত বসিয়ে দেয় সেই কাক ভোরে। আগের দিনের সমরানো পারসে আর গাঙ চুনার চচ্চড়ি রাঁধে।

এলুমিলিয়ামের থালায় করে ভাত আর চচ্চড়ি মাখিয়ে বিছানায় গিয়ে পরম মমতায় খাইয়ে দেয় শ্রীকান্তদাকে। তার চোখ ভিজে যায়, বাম হাত শ্রীকান্তদার মাথায় রেখে বলে ” তুই ছাড়া আমার আর কউ নেই রে”।

খাওয়া হয়ে গেলে মুখ ধুইয়ে মুছে দেয় শাড়ির আঁচল দিয়ে। সরসের তেল মাখিয়ে দেয় সারা শরীরে। আস্তে আস্তে শ্রীকান্তদা চোখ বন্ধ করে। মনে হয় যন্ত্রনা আগের চেয়ে হালকা হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ে।

ঘুম যখন ভাঙে তখন রোদ উঠেছে। বাইরে ঝলমল করছে চারপাশ। মাথার কাছে বসে আছে চঞ্চলী বৌদি।

তুমি তখঁনু বুসিয়াছ?

চঞ্চলী বৌদি নিরুত্তর, চোখ মোছে।

কাঁদট কেনি? আমি ভাল হইচি, যন্তণা কমিছে।

আবার চোখ মোছে বৌদি।

লাল্টু কাই?

চোখ মুছতে মুছতে বৌদি বলে ” ঘাটে খেলেটে”

মনি জ্যাঠা কাই?

জাঁইনি, মনে হয়, চন্দানীর ঘাটে বুসিয়াছে। কাই আর যাবে!

কাঁদনি তুমি।

আবার চোখ মুছে বৌদি।

কাঁদতে না কইলি না, তুমি কাঁদলে ভাল্লাগেনি। তুমি হাসলে ভাল্লাগে।

আমার ভাল্লাগা! শীকান্ত‌!

হঁ কও,

তোর জীবনটা শ্যাষ হয়াল আমার জন্যে।

ক্যান? জীবনটা ভাল হইচে বরং।

আমার তোকে দেবার কিছু নাইরে!

দিছ তো অনেক কিছু।

আমি?

হঁ।

আমি তোকে কী দিছি?

শুধু আমাকে না, এ মহল্লাকে।

আমি?

হঁ

কিন্তু…

একটা পাগলীর বাচ্চাকে তুমি তুয়িয়া লেইল, পুষল, অথচ নিজে খাইতে পাইতনি। একটা পাগলা লোক, তার ঘর রয়াও নেই, তার মেইঝি রয়াও নেই, তাকেও তুমি লেইসিয়া তুমার কাছে রাখছ। অ্যাটা কি কম শিক্ষা! তুমি ছাড়া আর কে আছে এখাঁয়ে এর্কম?

শীকান্ত

হঁ

আমার তোকে দেবার কিচ্ছু নেই রে আর। আমার সব শেষ হইছে।

তুমি খুব ভালো, খুব সুন্দোর।

আমি?

হঁ

শ্রীকান্তদার কপালে চুমু খায় চঞ্চলী বৌদি। দু হাত দিয়ে বুকে টেনে নেয় শ্রীকান্তদা। তারপর বুকে মুখ গুঁজে দেয়। এক পাশ হয়ে শাড়িটা নামিয়ে দেয় বুক থেকে। মরুভূমির মতো পেটে মুখ দেয়।

অখঁ না,  বৌদি সরিয়ে দিতে চায়।

ব্লাউজ খুলে দেয়।  স্তনের বৃন্তে মুখ রাখে আর বাচ্চা ছেলের মতো জড়িয়ে ধরে।

লাল ব্লাউজ পরলে তুমাকে ভাল্লাগে।

তুই আমাকে তো অনেকগুয়া লাল ব্লাউজ আঁয়া দিছু। খুব দুষ্টু তুই।

কোমরের সায়ার দড়িতে টান মারে শ্রীকান্তদা, ঠিক তখনই জঙ্গলের ভিতর থেকে শব্দ আসে ঠক ঠক ঠক করে।

কে মনে হয় কাঠ কাটেটে, বৌদি বলে।

কাঁচা গাছ কাটার শব্দ এটা। শ্লার ব্যাটা শ্লানে জংগ’টা শেষ করদিল। শ্রীকান্তদা বলে।

কে ক’তো?

অই খানকির ব্যাটা ভানু বাগের লোকগুয়া।

বৌদি উঠে পড়ে। কাপড় ঠিক করে। তারপর বলে,  আমি যাইটি।

কাই যাবো?

আর শেষ করতে দুবোনি।

অন্নে অনেক লোক আছে।

থাউ।

মুহুর্তে বেরিয়ে যায় চঞ্চলী বৌদি। বাঁধে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়ে –

কুন খানকির ব্যাটা জংগয়ে গাছ কাটুটু?

হঠাৎ লোকগুলো থমকে যায়।

তারপর একটা লোক হেঁকে বলে –

আরে মাগি, অঠিনু কী কউটু? এঠি আয়। জংগয়ের ভিত্রে।

হাতে মস্ত এক গরান বাতা নিয়ে জংগলে ঢুকে যায় বৌদি।

বন্ধ কর সয়ার ব্যাটা সয়ামনে। তোনকের বাপের জংগ’?

একটা লোক ছুটে এসে লাঠি ধরে বৌদির গালে জোর থাপ্পড় মারে।

খানকি ম্বায়া। বোড়ো বোড়ো কথা!

বৌদি আকস্মিক ধাক্কা সামলে আবার হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আবার একটা লাঠি নিয়ে। অন্য একজন লোক, হাতে আর একটা গরানবাতা নিয়ে সপাটে বৌদির কোমরে আঘাত করে। বৌদি চীৎকার করে উঠে। প্রতি আক্রমণের জন্য হুংকার দেয়।

এদিকে খোঁড়া পা নিয়ে শ্রীকান্তদা বাঁধের উপর এসে দাঁড়িয়েছে। সে চেঁচাচ্ছে,

অই শ্লা, চোর, কুত্তার বাচ্চার দল। শ্লা অর গায়ে হাত দিছু, তোনমে জ্যান্ত ছাড়বনি আইজ।

খুঁড়িয়ে জংগলে ঢোকে।  তারও হাতে একটা গরানবাতা। জংগলের ভিতরে দুটো অশক্ত লোকের সংগে গোটা দশেক জোয়ান মদ্দের খণ্ড যুদ্ধ বেধে যায়। শ্রীকান্তদা, চঞ্চলী বৌদি আহত, রক্ত ঝরছে শরীরের জায়গায় জায়গায়, কিন্তু পিছু হটছেনা কেউ। হঠাৎ লোকগুলো থেমে গেল। শ্রীকান্তদা পিছন ফিরে দেখে মন্টু সাউ আর তার সাবাড়ের জনা পঁচিশে লোক তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদেরও পিছনে মহল্লার অর্ধেক মানুষ, বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা। ভানু বাগের লোকেরা পিছু হটে,তারপর দৌড় লাগায় যে যেদিকে পারে। কিন্তু অত সহজে ওদের ছাড়তে চায়না কেউ। পিছনে তাড়া করছে প্রায় শ’ খানেক লোক। কিন্তু জানোয়ারগুলোকে আর খুঁজে পাওয়া যায়না। সম্মিলিত লোকের রাগের আর পায়ের গতিমুখ পাল্টে যায়, তারা দৌড়ে বাঁধে ওঠে, তারপর প্রবল আক্রোশে ভানু বাগের আড়ত ঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। মন্টু সাউ থামাবার চেষ্টা করে, কিন্তু কেউ শোনে না। মুহুর্তে শ্মশান করে দেয় ভানু বাগের রাজ্যপাট।

ভেরাণ্ডা গাছের ডাল ভেঙে চঞ্চলী বৌদি আর শ্রীকান্তদার গায়ের ক্ষতস্থানে আঠা লাগিয়ে দিচ্ছিল তরুবালা ঠাকমা।

বৌদির মাথায় হাত রাখে মন্টু সাউ। চকচক করে উঠে বৌদির চোখ। পরম মমতায় মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মন্টু সাউ বলে –

কে কয়, আট ঠাকুর নেই? এই তো,তুই তো ম্বা আমানকের ঠাকুর। তুই রইলে জঙ্গল’ রইবে, দ্বীপটা বাঁচিয়া রইবে।”

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে চঞ্চলী বৌদি।

ক্রমশঃ

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস-“হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৮তম পর্ব)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *