ই ন্দ্র নী ল ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস
চোরাবালি(পর্ব-১৯)
সকাল সকাল উঠে পড়ার অভ্যাসটা গদাই ঘোষের বহু বছরের। এখন তো শরীরের জন্যও ওঠা জরুরি হয়ে পড়েছে। শুধু ওঠা নয় ,একটু হাঁটাহাটিরও দরকার। উঠে কখনও বাড়ির পাশের মাঠে বা কাঠগোলা ঘাটেই হেঁটে নেওয়া যায় । সকালে নদীর বাতাস মন্দ লাগে না! কিছু কাজও হয়ে যায় সঙ্গে।
আজ সকালে ঝিমলিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন গদাই ঘোষ, পাড়ার রাস্তা দিয়ে একটু হেঁটে কালী মন্দির পেরিয়ে মাঠে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকালের রোদ উঠে গেছে, তেরছা ভাবে গাছ পালা বাড়ির ফাঁক দিয়ে মাঠে এসে পড়ছে। দুদিকে বসানো গোল পোস্টের ছায়াগুলোও ব্যাঁকা হয়ে পড়েছে মাঠে। এই গোলপোস্টগুলোও গদাই ঘোষ বসিয়ে দিয়েছেন নিজের খরচে। পাড়ার ক্লাব , মাঝে মধ্যেই কিছু না কিছু আবদার করেই থাকে। গদাই ঘোষও খুব একটা ফেরান না তাদের। কত টাকাই তো কত জায়গায় নজরানা দিতে হয়! এতো পাড়ার ক্লাব। তাছাড়া সমাজে প্রভাবশালী বড়লোক– এরকম একটা ইমেজ রাখতে গেলে কার্পন্য করলে চলে না।
অকারণে মাঝে মধ্যেই ঝিমলি ডেকে উঠছে । কিংবা হয়তো অকারণে নয় ! কুকুরের ইন্দ্রিয়শক্তি মানুষের থেকে বেশি শক্তিশালী একথা গদাই ঘোষ শুনেছে, বিশ্বাস করে, ওরা অনেক কিছুই আগে ভাগে টের পায় যা মানুষ পায় না। কিন্তু এখন ফাঁকা মাঠে সে রকম কিছু চোখে পড়ে না এক, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এলাকার নেড়ি কুকুরগুলো ছাড়া। নেড়িগুলো এদিকে তাকিয়ে আছে , সম্ভবতঃ কৌতুহল ভরে ঝিমলিকে দেখছে! বিজাতীয় দেখতে ঝিমলি কুকুর হলেও যে ওদের গোত্রের নয় সেটা ওরা ভালো বোঝে! কিন্তু কাছে আসার সাহসে কুলাচ্ছে না, তার এক কারন ঝিমলির বিরাট চেহারা আর গদাই ঘোষের হাতে ধরে থাকা চকচকে একটা স্টিক, যেটা সকালে ঝিমলিকে নিয়ে বেরলে গদাই ঘোষের সব সময়ে সঙ্গে থাকে।
আর এক পাক মেরে বাড়ি ফিরতে হবে, আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে। ঝিমলিটাও অন্য দিনের তুলনায় বড় বেশিই জ্বালাচ্ছে! পাক শেষ করে বাড়ির দিকে রওনা হয় গদাই ঘোষ, প্রথম মোড়টা পেরিয়ে বাড়ির দিকে মুড়তেই আবার ঝিমলি চাপা একটা গরগর আওয়াজ করতে লাগল। হাতে ধরে থাকা কলারের সঙ্গে বাঁধা চেনটায় প্রবল টান লাগতে লাগল গদাই ঘোষের। কিন্তু এখানে তো কিছুই নেই, অন্য কুকুরও দেখা যাচ্ছে না আসে পাশে!… একটা বাইক পিছন দিক থেকে একটু ধীরে গদাই ঘোষ আর ঝমলির পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল, দুজন বসে, দুজনেই হেলমেট পরে রয়েছে। ঝিমলি গরগর করেই যাচ্ছে…
বাইকটা সামনে মোড়ে বাঁদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছু বা কারও বাড়ি খুঁজছে হয়তো ! ফাঁকা রাস্তার তুলনায় একটু যেন ধীরে চলছিলো বাইকটা! ঝিমলি এখন শান্ত হয়েছে, বাড়ি ঢুকে বারান্দায় নির্দিষ্ট জায়গায় ঝিমলিকে বেঁধে দেয় গদাই ঘোষ।
উর্মিলা এখনও ওঠেনি, তাকে আর ডেকে কাজ নেই, বাসন্তির আসার সময় হয়ে গেল ,ওই না হয় তুলবে। রুমকির ঘরে এই সকাল সকাল কথার আওয়াজ কানে আসছে। ফোনে কারও সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে নির্ঘাৎ!
ইলেকট্রিক কেটলিতে চা করাই আছে, ঢেলে নিয়ে পেপারটা নিয়ে ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে পড়ে পাতা ওলটাতে থাকে গদাই ঘোষ। সামনের পাতায় শুধু রাজনীতির খবর! এখন রাজনীতি মানেই গালিগালাজ আর চুরির খবর, বিরক্তিতে পরে পাতায় ,তার পরের পাতায় চোখ বুলাতে থাকে গদাই ঘোষ, জেলার পাতায় এসে একটা খবরে চোখ আটকে যায়। কোনো একটা পরিবেশবাদী সংগঠন কাল ডি এম অফিসে বিক্ষোভ দেখিয়েছে , প্রতিকী রাস্তা অবরোধ করেছে পনেরো মিনিটের জন্য!…পনেরো মিনিটের রাস্তা অবরোধ… বেশ মজার তো ! এই এখন একটা জিনিস মাথা চাড়া দিয়েছে, পরিবেশ আন্দোলন, সরকারও তাল মিলিয়ে গ্রীন জোন, পরিবেশ দপ্তরের ক্লিয়ারেন্স এসব ঝামেলা জুড়ে দিয়েছে। উদ্দেশ্য যত না পরিবেশ তার থেকে রেভিনিউ কালেকশান। সরকারকেও করতেই হয় সময়ের দাবী বুঝে এসব! আর এই সব সংগঠন গুলোর পিছনেও বড় বড় ধান্দাবাজ মাথা থাকে সে গদাই ঘোষ জানে।
বাসন্তি ঢুকে কখন উর্মিলাকে তুলেছে টের পাওয়া যায়নি! আর এক রাউন্ড চা আর প্লেটে করে কটা কাজু আর ডায়েট কুকিজ নামিয়ে রেখে গেলো বাসন্তি। উর্মিলা এখন এদিকে আসবে না , উনি এখন স্নানে ঢুকবেন। স্নান না করে দিন শুরুই করেন না উর্মিলা।
“গুড মর্নিং বাপি” রুমকির গলায় পেপার থেকে চোখ সরে যায় গদাই ঘোষের। একটা পায়জামা আর টি শার্ট পরে হাতে ব্রাশ নিয়ে বেশিনের আয়নার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রুমকি, কানে ইয়ার পিস গোঁজা এখনও। মেয়েটা দিন দিন মাথা চাড়া দিচ্ছে! সব দিন ভালো করে দেখাই হয় না মেয়ের সঙ্গে গদাই ঘোষের, যেদিন দেখেন সেদিনই যেন মনে হয় মেয়েটা বড্ড তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে!
“আজ কি প্রোগ্রাম আপনার ম্যাডাম?” মুচকি হাসতে হাসতে মেয়ের উদ্দশ্যে বলে গদাই ঘোষ।
“ কিছু না… মানে ওই আর কি…র্যান্ডাম, স্কুল, কোচিং ক্লাস, ইয়োগা ক্লাশ… ”
“হুম… তা পড়াশুনা কেমন চলছে?”
“ঠিক ঠাক …”শ্রাগ করে উত্তর দেয় রুমকি।
বাবা মেয়ের কিছু কথার আদান প্রদান চলতে থাকে কিছুক্ষণ এরপর। রোজ রোজ এরকম হওয়ার সুযোগ হয় না। এর মধ্যে উর্মিলা এসে গোটা বাড়িতে ধুনো আর প্রদীপের মঙ্গল আলো ছড়িয়ে গেছেন।
একসময় উঠে পড়ে গদাই ঘোষ, ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী গদাই ঘোষের ভূমিকা বদলে যায়, চিন্তা প্রবাহ বদলে যায়। একটা গোপন সুইচ আছে যেন যার একদিকে সাংসারিক গদাই ঘোষ আর একদিকে দুঁদে ব্যবসায়ী গদাই ঘোষ ! স্নান করে, খেয়েদেয়ে গাড়িতে উঠলেই সাংসারিক গদাই ঘোষের সুইচ অফ।
আজ সদর ঘাটের অফিসে ঢুকতে হবে। পিনুর কাছে রিপোর্ট নিতে হবে লোডিং এর। নতুন ছেলেটাও ক’দিন হলো আসছে, কি রকম বুঝছে পিনু জানতে হবে। একদিন আর তেমন ঝুট ঝামেলার খবর নেই। ক’দিন একটু চেপে কাজ করার কথাই বলা আছে সবাইকে। নিয়ামতের ভাইপোকে পাল্লার দিকে বোট ছাঁকনির কাজে লাগানো হলে, ওদিকে সুরিন্দারের কেউ দাঁত ফোটাতে আসবে না। যতদুর সম্ভব সংঘাত এড়িয়ে যাওয়াই গদাই ঘোষের নীতি। নেহাত তাতে কাজ না হলে পালটা এবং প্রবল প্রহার! এভাবেই এতদিন কারবারের নেটওয়ার্ক বজায় রেখেছেন গদাই ঘোষ।
বীরহাটা সিগনাল পেরিয়ে বাঁ হাতে রমেশে গাড়ি নিতেই আচমকা ব্রেক কষল রমেশ, একটা স্কুটার বাঁ দিক দিয়ে ওভারটেক করে প্রচন্ড গতিতে ডানদিকে উৎসব ময়দানের দিকে ঢুকে গেল! রমেশ বিড় বিড় করে আপন মনে কিসব বলতে বলতে গাড়ি ছোটালো আবার।
ঝাঁকুনি আর স্কুটারের কাণ্ডজ্ঞানহীন চালানোর ঘটনা আবার গদাই ঘোষের চিন্তা প্রবাহে সকালের খটকাটা জেগে উঠলো, সকালের বাইকটা ওভাবে অত আস্তে ওদের পাশ দিয়ে কেন যাচ্ছিলো! সত্যি কি কিছু খুঁজছিলো? ঝিমলিই বা কেন ওরকম করছিলো ওদের দেখে!
ক্রমশঃ…
আগের পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে