অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প(৮ম পর্ব) কলমেঃ সু ক ন্যা   দ ত্ত ছবিঃ বি জে তা   সে ন

সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প(৮ম পর্ব)

কলমেঃ সু ক ন্যা   দ ত্ত

ছবিঃ বি জে তা   সে ন

 

কথা দিয়েছিলাম আজ উত্তর আফ্রিকার পথে হাঁটবো। উত্তরাংশ বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি।  চলুন, সকলে মিলে  ” সাহারায় শিহরণ ” উপভোগ করতে যাই। 
” Individually, every grain of sand brushing against my hands represents a story, an experience, and a block for me to build upon for the next generation.” 
মরুভূমির রহস্যময়তা আমায় হাতছানি দেয়। 
বিস্তীর্ণ সোনা গলানো মরুভূমি,  পিরামিড স্বমহিমায় ভূষিত, ফ্যারাও, মমির দেশ মিশর। উত্তর থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের তরঙ্গ ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। আলজারিয়া, লিবিয়া,  মরক্কো, মিশর, সুদান, পশ্চিম সাহারা দেশের হৃদস্পন্দন এখানে অনুভূত হয়। উত্তরের সুবিশাল সাহারা পেরোলে আর ও উত্তরে অ্যাটলাস পর্বত।  আবার নীল নদকে উর্বর অঞ্চলে  জনজাতির পদচিহ্ন পাওয়া যায়। জলপাই,  ডুমুর,  খেজুর জাতীয় গাছের মাঝে মাঝে কাটা জাতীয় গাছ ও চোখে পড়ে।  এখানকার বালুকাময় অঞ্চলে নানান উপজাতি নিজেদের প্রাণবায়ু বিস্তার করে।  তুয়ারেগ, বারবের, হাউসা, বেদুইন উপজাতি তাদের লোকবিশ্বাস,  লোককথাকে বুকে নিয়ে এখানে বাস করে। বেদুইনদের সিংহভাগ মধ্য প্রাচ্যে বাস করলে ও উত্তর আফ্রিকাতে ও তাদের অস্তিত্ব  আছে। 

প্রথম গল্পে আলোচনা করবো, সাহারা সৃষ্টির কাহিনী। আরবী সাহারা শব্দের অর্থ মরুভূমি। লোককথায় সাহারা মরুভূমি গড়ে ওঠার একটি সুন্দর গল্প রয়েছে। আসুন, প্রথমে সে গল্পটি তুলে ধরি। 

সাহারা সৃষ্টির গল্প…

সাহারা সৃষ্টির কারণ
গল্প-১

বহুকাল আগের কথা। সে সময়  পৃথিবী ক্ষুদ্র ছিলো।  সেখানে একটি সুবিশাল বাগান ছিলো, যার মধ্যে লম্বা তাল গাছ, সুগসুগন্ধি  জুঁই ফুল ভরে থাকতো। পাখির মধুর সুরে ভূস্বর্গ প্লাবিত হতো।  পৃথিবীর সকল পুরুষ  অনুগত, সৎ এবং বিশ্বস্ত ছিলো। জগতে মিথ্যার কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। 
একদিন পৃথিবীতে মিথ্যা কথার আর্বিভাব হলো। একজন পুরুষ  মিথ্যা বলতে শুরু করলো। এরপর  সৃষ্টিকর্তা জনবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন,
” যখন এ পৃথিবীতে কেউ মিথ্যা কথার আশ্রয় নেবে, তখন আমি পৃথিবীতে একটি করে বালুকণা ফেলবো। “
তখন পুরুষেরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে অহংকার করে বলল,
” একটি বালুকণার পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হবে না। সামান্য বালু দানা কী করবে?”
কিন্তু দিনের পর দিন মিথ্যা বলতে বলতে বালুকাময় স্থান বেড়ে তৈরি হলো সাহারা মরুভূমি।  
তবে মাঝে মধ্যে গাছ, জলের সমারোহে মরুদ্যান দেখতে পাওয়া যায়। মনে করা হয়, এগুলো পুরাতন বাগানের চিহ্ন।

বিশ্লেষণঃ

পৃথিবীতে মিথ্যার ছায়া যত বাড়তে থাকে, ততই সে শুষ্ক হয়ে ওঠে। মনের সরসতা মানুষের সততায় বেঁচে থাকে। দূর্নীতি, মিথ্যাচার পৃথিবীকে নীরস করে দেয়। নেমে আসে অভিশাপ। বালুকাময় স্থান চাষ আবাদ,  শিল্প, বসবাসের উপযোগী নয়। পানীয় জলের অভাব, মাটির বন্ধুরতা কঠোর জীবনকে ইঙ্গিত করে। এই গল্পে দেখা গেল, ভূভাগে যত দূর্নীতি বাড়ছে ততই সবুজের সমারোহ ধূসরতায় ঢেকে যাচ্ছে। তবে এখন ও সততা আছে বলেই সেদিককে আলোকপাত করছে মরূদ্যান। শুষ্ক, বালুময় জায়গায় প্রাণের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে মরূদ্যান নিজেকে মেলে ধরেছে। আরেকটি লক্ষ্যনীয় বিষয়,  মিথ্যাচার শুরু হলো পুরুষ দ্বারা। এর পিছনে দুটি কারণ হতে পারে। প্রথমত, পুরুষকেন্দ্রিক সমাজের ইঙ্গিত থাকতে পারে এই গল্পে। তারা সমাজের প্রধান, সকল কাজে তারাই এগিয়ে আসে, স্ত্রী লোকের ভূমিকা গৌণ, পিছিয়ে পড়া শ্রেণি। অপরদিকে নারী যে নিষ্কলুশ, পবিত্র,  সততার প্রতীক সেদিকটি আলোকপাত করার জন্য মিথ্যাচারে পুরুষ কে এগিয়ে দেওয়া হলো। 

তবে শোনা যায়, একসময় সাহারায় সবুজের সমারোহ ছিলো। প্রায় ২০ হাজার বছর আগে ইউরোপ মহাদেশের সিংহভাগই ছিলো হিমবাহ আবৃত। ফলে সেখানে শীতল হাওয়া বয়ে আসতো উত্তর আফ্রিকার সাহারায়। নদী, হ্রদ, অরণ্য, তৃণশোভিত মনোরম ভূখন্ড  ধীরে ধীরে উষ্ণ হতে শুরু করলো। অনাবৃষ্টি, তাপপ্রবাহে পরিণত হলো মরুভূমিতে। 

আসি দ্বিতীয় গল্পে। 

 

গল্প-২

উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে মিশর।  মিশর বললেই মনে আসে পিরামিড,  সোনালী বালি, ফ্যারাও, নীলনদের কথা। ফ্যারাওরা রাজনৈতিক এবং সামাজিক নেতা, উচ্চ এবং নিম্ন মিশরের অধিষ্ঠাতা।  তিনি সকল ক্ষমতার ঊর্ধ্বে,  মিশরের রক্ষাকর্তা, মন্দিরের সর্বেসর্বা। ঈশ্বর সাধনার জন্য তিনি মিশরে প্রতিটি আরাধনালয়  গড়ে তোলেন। মিশরবাসীর কাছে তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি।যুদ্ধে বিজয়ী ফ্যারাওরা পরাজিত মানুষের কাছে মহামান্য শাসক। তাই  তারা তাদের সকল মূল্যবান সামগ্রী ফ্যারাও কে নিবেদন করেন। বিভিন্ন মন্দির গাত্রে নানান কাহিনী খোদিত আছে। তেমন একটি কাহিনী হলো ফ্যারাও তৃতীয় রামেসেস এর বিজয় সম্মেলন। 

গল্প
 মিশরের ফ্যারও তৃতীয় রামেসেস একবার যুদ্ধের জন্য  নুবিয়াকে আক্রমন করেছিলেন।  যুদ্ধের কারণ ছিলো দুটি। প্রথমত, সে সময় নুবিয়া ছিলো স্বর্ণ, কাঠ, হাতির দাঁত, বন্য প্রাণীর ভান্ডার। অন্যদিকে মিশরের দক্ষিণে অবস্থিত নুবিয়া থেকে আক্রমনের ভয় ছিলো। তাই রামেসেস রথে চড়ে তীর ধনুক নিয়ে নুবিয়াবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ফ্যারাও কে তার দুই পুত্র সন্তান অনুসরণ করলেন। ভয়াবহ সে যুদ্ধে কিছু সৈন্য প্রাণ হারালো, কেউ রণক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গেল। বাকী সৈন্যরা আহত হয়ে হাল ছেড়ে নিজেদের গ্রামে ফিরে গেল। ঘরে ফিরে নিজেদের স্ত্রী এবং সন্তানদের পরাজয়ের সংবাদ দিলো। পরাজিত নুবিয়াবাসীর কাছে ফ্যারাও তৃতীয় রামেসেস হলেন সর্বময় কর্তা। নিয়ম অনুযায়ী বিজয়ী ফ্যারাও এর জন্য তারা দলে দলে  নানান রকম খাবার, পশুর মাংস, সোনা, দামী উপহার আনতে লাগলো। রামেসেস সুবিশাল চাঁদোয়ার তলে বসলেন। তার পরণে দামী পোশাক,  মাথায় মহামূল্য  রত্নখচিত মুকুট। ফ্যারাও উপদেষ্টা ভিজিয়র( Vizier) 
রামেসেসের বন্দনা শুরু করলেন। পরাজিত নুবিয়াবাসী শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নানান বন্য প্রাণী নিয়ে আসলো।  একটি চিতা, এক জোড়া ষাঁড়,  একটি জিরাফ,  একটি গ্যাজেল হরিণ এবং একটি উটপাখি দিয়ে কয়েকজন সম্বর্ধনা জানালো। আর ও কয়েকজন ফ্যারাও এর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করলো, একটি সিংহ তৃতীয় রামেসেস কে দান করা হলো। একে একে জড়ো হলো হাতির দাঁত, ইবনি কাঠ, সোনা। অপর টেবিলের উপঢৌকন এ ছিলো উট পাখির পালক, উটপাখির ডিম, পশুর চামড়া, সোনাদানা।  নুবিয়ার প্রধান ফ্যারাও তৃতীয় রামেসেস কে একটি বড়ো সোনার হার পড়িয়ে দিয়ে সম্মানিত করলো।  রামেসেস এর এক পুত্র পিতার পাশে দাঁড়িয়ে সকল কিছু পর্যবেক্ষন করতে লাগলো।

বিশ্লেষণ-

এই গল্পে ফুটে উঠছে মিশরবাসীর আচার আচরণের কথা। ফ্যারাও যে জনসমাজের সর্বময় কর্তৃত্ব সে কথা এখানে প্রকাশিত। অস্ত্র দান করে নুবিয়াবাসী ফ্যারাও এর প্রতি বশ্যতা স্বীকারের দিক নির্দেশ করলো। এবার থেকে তারা রামেসেস এর প্রজা। 
সিংহ বনের শক্তিশালী প্রাণী, পশুরাজ।  ফ্যারাও কে সামান্য সওগাত দেওয়া যায় না। তার উপহার হতে হবে রাজার মতো। মিশরের পাশ্ববর্তী স্থানগুলিও যে  সম্পদে সমৃদ্ধ সে কথাও এখানে ফুটে উঠেছে। ফ্যারাওদের বীরত্বের কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে এই গল্পে। 

আসি তৃতীয় গল্পে….

গল্প-৩

ফ্যারাও প্রথম অ্যামেনেমতের  বাহিনীর একজন কর্মকর্তা ছিলো সিনুহে।  সে একবার রাজকুমার সেনভোস্রেট -এর সঙ্গে লিবিয়ায় যায় । সেখানে গিয়ে  রাজা আমেনেমেতের মৃত্যুর  সম্পর্কিত একটি কথোপকথন কানে আসে।  এর  ফলে ভয়ে সে মিশর ছেড়ে পালিয়ে যায়। লেবানন, ফিলিস্তান ঘোরার পর অবশেষে  উচ্চ রেটজেনু (সিরিয়া )তে পৌঁছায়। তারপর সিরিয়া পৌঁছোলে  বেদুইন সর্দার আমিনেনশি তাকে আমন্ত্রন জানায়। তিনি সিনুহে কে দত্তক নেওয়ার পর বড় মেয়ের সাথে বিবাহ দেয়।   আমুনেনশির জামাতা হয়ে   তার ছেলেরা তাদের নিজস্ব অধিকারে প্রধান হয়ে ওঠে।  সিনুহে আমুনেনশির পক্ষে বিদ্রোহী উপজাতিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বৃদ্ধ বয়সে  অসুস্থ অবস্থায় মিশরে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে সিনেহু ।  একক যুদ্ধে একজন শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার পর তিনি তার স্বদেশে ফিরে আসার জন্য প্রার্থনা করে। 
ফ্যারাও প্রথম সিসোস্ট্রিস কে সে ইচ্ছার কথা চিঠিতে লেখেন,
” হে মহান রাজা, অনন্তকালে যাত্রার পূর্বে আমি স্বদেশে ফিরে শেষ দিনগুলো কাটাতে চাই। “
একথায় ফ্যারাও তাকে সাদর অভ্যর্থনায় বহুল উপহারে সমাদর করে মিশরে আনেন। তারপর তার জন্য একটি বৃহৎ  স্তম্ভ নির্মান করান। সেখানে সিনুহেকে সমাহিত করা হয়। 

বিশ্লেষণ

“দ্য স্টোরি অফ সিনুহে” একটি মহাকাব্য যেটি  আটশ বছরেরও বেশি সময় ধরে জনপ্রিয় ছিল। মহাকাব্যের ছোটো ছোটো অংশ লোকগল্প হিসেবে লোকমুখে প্রচারিত হতে লাগলো।  এই কাহিনীতে সিনুহে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যার দুঃসাহসিক কাজ বর্ণনা করা হয়েছে। জীবনের শেষ পর্যায়ে মিশরে ফিরে আসা তার দেশ প্রেমের পরিচায়ক।  এই গল্পের মাধ্যমে একজন বীরের গাথা রচনা করে জনজাতির মধ্যে দেশ প্রেমকে জাগরিত করা হলো। লোকগল্পে তৎকালীন রাজনৈতিক এবং সামাজিক দিক ফুটে উঠেছে। এছাড়া মিশরীয় সিনুহে এর সাথে যাযাবর উপজাতির মেলবন্ধনে বেদুইন জীবনের দিকটি সুন্দররূপে ফুটে উঠছে।  

মিশরীয় পর্ব এত দ্রুত সমাপ্ত করা সম্ভব নয়। তাই পরের পর্বে আর ও মিশরীয় গল্প নিয়ে আসবো। 

সুকন্যার আগের পর্বগুলো পড়তে নিচের লিংকগুলি ক্লিক করুনঃ

 

“অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প”(৭ম পর্ব) কলমেঃ সু ক ন্যা   দ ত্ত ও ছবিঃ বি জে তা   সে ন, সুনিপা ব্যানার্জী

স্বপ্নধারার পর্বকথা(৬ষ্ঠপর্ব) কলমেঃ শু ক্তি   চ ট্টো পা ধ্যা য় ও ছবিঃ সু নি পা  ব্যা না র্জি

অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প(৫ম পর্ব) কলমেঃ সু ক ন্যা   দ ত্ত

অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প(পর্ব-৪) কলমেঃ সু ক ন্যা দ ত্ত

 

অলৌকিক আলোকধারার লোককথা(পর্ব-দুই) কলমেঃ সুকন্যা দত্ত

অলৌকিক আলোকের ধারায় লোককথাঃ লিখছেন–সুকন্যা দত্ত

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *