বিশ্বমিথের দরবার(৬ষ্ঠ পর্ব) “সাইবেরিয়ান পুরাণকথা”

দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি পেশায় ইংরেজীর অধ্যাপিকা তবে তাঁর ভালোলাগা ও ভালোবাসায় গাঁথা হয়ে আছে দেশ বিদেশের পুরাণে। ইদানিং দেবলীনা সেই পুরাণ সাহিত্য ও প্রতীকীবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। প্রধানত, আন্তর্জাতিক জার্নালে লেখালেখি ও বিভিন্ন সেমিনারে উপস্থাপন। একটি ইংরেজী ও একটি বাংলা কবিতার বইয়ের পর,সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে “Into the Myths” নামে দেশ-বিদেশের পুরাণ নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন। Myth Muhurto নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলরও কর্ণধার। দেবলীনাও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

বিশ্বমিথের দরবার(৬ষ্ঠ পর্ব)

কলমে-দে ব লী না   রা য় চৌ ধু রী   ব্যা না র্জি

ছবিঃ সু নি পা   ব্যা না র্জি

সাইবেরিয়ান পুরাণকথা

“There was a hint in it of laughter, but of laughter more terrible than any sadness-a laughter that was mirthless as the smile of the Sphinx, a laughter cold as the frost and partaking of the grimness of infallibility. It was the masterful and incommunicable wisdom of eternity laughing at the futility of life and the effort of life.” আজ সাইবেরিয়ার কথা লিখতে গিয়ে Jack London এর লেখা White Fang নভেলের শুরুর লাইনগুলো মনে আসছে। প্রচণ্ড শীত, বরফ, আর তুষারপাতের মধ্যে উপজাতিদের প্রতিনিয়ত বাঁচার লড়াই। হ্যাঁ, মানুষের জন্য জীবন কোন আশ্বাস না রাখলেও, মৃত্যুর করাল ছায়া নীরব সঙ্গী হলেও, জীবনযাত্রা থেমে থাকে না। শেক্সপিয়ারের King Lear এর সুরে বলি – Life comes out of Life। তাই পৃথিবীর ওই হীমকোণ অঞ্চলে তুষাররুক্ষ প্রকৃতির ছুড়ে দেওয়া সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি সাইবেরিয়ার উপজাতি জনজীবন শুধু বেঁচেই থাকেনি, বাঁচার সাথে ও স্বার্থে গড়ে তুলেছে তাদের বিশ্বাস, তাদের মিথ।

অনেক নামের, অনেক ধরনের উপজাতির বসবাস ছিল প্রাচীন সাইবেরিয়ায়। তবে প্রধানত তিনটি উপজাতি ছিল প্রধান :
• পশ্চিমে – ফিনো-উগ্রিয়ান (Finno-Ugrians)যারা ওব অববাহিকা থেকে রুশ সীমান্ত অব্দি বিস্তৃত ছিল।


• উত্তরে – সামোয়েদ (Samoyed)
• দক্ষিণে – আলতাই তুর্ক-মোঙ্গল জাতি মুনিসিস্ক অববাহিকা থেকে সুপ্রাচীন বৈকাল হ্রদ অব্দি।
• য়েনিসেই নদীর ধার ধরে প্যালিও-সাইবেরিয়ানদের বাস যাদের মধ্যে ছিল চুকচি, গিলয্যাক, কামচাডেল, য়ুকাগির
• এস্কিমোরা থাকত গ্রীনল্যান্ড, আলাস্কা, ল্যাব্রাডর, উত্তর কানাডা অঞ্চলে।

এই প্রধান জাতিদের মধ্যেই ছিল আরও অনেক উপজাতি। যেমন :
য়াকুৎ
তুর্ক-মোঙ্গল
তুঙ্গু
উগ্রিয়ান
চুকচি
গিলয্যাক
কামচাডেল
য়ুকাগির

সাইবেরিয়ান সৃষ্টি-মিথের মৌলিক বিষয়সমূহ :-

সাইবেরিয়ার পুরাণকথা জগতসৃষ্টি নিয়ে খুব লক্ষ্যণীয় ও চোখে পড়ার মতো কিছু বিষয় আছে। আমি বরং এক এক করে বলি।

● বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে একটা বিশাল ডিম থেকে। এই ডিমের অর্দ্ধেক আকাশ বাকি অর্দ্ধেক থেকেই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। হিন্দুধর্মে যে ব্রহ্মাণ্ডের কথা আছে, তার সাথে মিলটা অস্বীকার করা যায় না। তাই না?
এই যে ডিম বা অন্ডের ধারণা, এটি কিন্তু বিশ্বের অনেক মিথলজিতেই দেখা যায়। মনস্তত্ত্ব ও চিহ্নতত্ত্বে মহাজাগতিক অন্ডের ধারণার গভীরে নিহিত আছে প্রাণীজগতের সৃষ্টিতত্ত্ব। প্রাণী জগতের সৃষ্টির মূলেই দেখা যায় যে গর্ভাশয়ের মধ্যে সৃষ্ট ভ্রূণ থেকেই জীবনের সৃষ্টি। উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও তা বীজ থেকে। তাই আত্মজ্ঞান থেকেই এই ধারণা বিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব-এর অবতারণা করেছে। আর তাই এই বিরাট সাদৃশ্য।

● সোনালী ওক, বার্চ ও লার্চ গাছ হলো পৃথিবীর অক্ষের সাথে গভীর ভাবে যুক্ত। এবং ধ্রুবতারা হলো আকাশের নাভি। এই থিয়রীর মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে সাইবেরিয়াতে বসবাসকারী উপজাতিদের প্রকৃতিপ্রেম, প্রকৃতিপূজার বীজ।

● সাইবেরিয়ার বিশ্বাসে মহাজাগতিক বৃক্ষের ধারনাও খুব উজ্জ্বল। তারা মনে করত এক বিশাল বৃক্ষ আছে যার উপরিভাগ আকাশ আর মূল পৃথিবীর তলদেশ অব্দি ব্যপ্ত। আফ্রিকার চাগা উপজাতিদের মধ্যে গল্পগাছের কথাই হোক বা ইওরোপীয় রূপকথার Jack and the Beanstalk এর গল্পই হোক, এই ধারণাটি দেখা যায়।

● প্রকৃতি মাতৃস্বরূপা। মাতা পৃথিবীর প্রাণ, প্রকৃতির মাঝে গাছগাছালির মধ্যেই নিবদ্ধ। তার শাখায় জীবিত মানুষ, প্রাণীর স্থান আর প্রশাখায় থাকে সেই সব প্রাণ যাদের জন্ম আসন্ন। প্রকৃতির প্রতি প্রেম বা পূজা বা Pantheism এর ধারণাটি কিন্তু সাইবেরিয়ার পুরাণের শিরায় শিরায় বয়েছে।

● আর তাদের মহাজাগতিক নদীর জল আকাশের অশ্রুধারা থেকেই সৃষ্ট। তাই এই নদীর জলধারা অবিনশ্বর। বরফপুষ্ট নদীর জল যে সারা বছর ধরে বয়ে চলে এই ব্যাপারটা আমাদের দেশের উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের নদীর পার্থক্যই বুঝিয়ে দেয়। তাদের দেশে স্বাভাবিকভাবেই নদীগুলি perennial river তাই তারা য়েনিসেই নদীকে আকাশের অশ্রুপুষ্ট জল মনে করত।

আজ শেষ করি? যদিও শুরুর শেষ কিন্তু আজ হলো না। কি ভাবছেন? কাব্য করে ফেললাম? না, না। বলছি, সাইবেরিয়ার পুরাণকথায় বিশ্বসৃষ্টি নিয়ে প্রচলিত কাহিনীগুলি বলা বাকি রইল। ওটা গুছিয়ে বসে বলব পরের পর্বে। বলব ওদের ধর্মের কথাও। সৃষ্টির দেবতাদের নিয়েও আছে অনেক মজার গল্প। তবে একটা কথা বলে শেষ করি আজ? না আমার ভাষায় না। Mircae Eliade এর ভাষায় বলব। কেন জানেন? আরে বাবা, ন হন্যতে বা লা নুই বেঙ্গলি (La Nuit Bengali)ছাপিয়ে এই মানুষটির দুচোখ অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতা ও ধর্ম নিয়ে তাঁর চিন্তা ও ভাবধারা সোনায় লেখা আছে যে। সাইবেরিয়ান মিথলজি নিয়ে তাঁর বক্তব্যও বলব পরের দিন। তবে এলিয়াদের একটা কথা বলি – A Religious Symbol conveys its message even if it is no longer consciously understood in every part. For a Symbol speaks to the whole human being and not only to the Intelligence.

সকলে ভালো থাকবেন। আবার দেখা হবে বাইফোকালিজমের বৈঠকে।

বিশ্বমিথের দরবার-এর আগের পর্বগুলি পড়তে হলে-

বিশ্বমিথের দরবার– লিখছেনঃ দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি

বিশ্বমিথের দরবার(পর্ব-দুই)-লিখছেনঃ দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জী

বিশ্বমিথের দরবারঃ(পর্ব তিন) কলমে-দে ব লী না   রা য় চৌ ধু রী   ব্যা না র্জি

বিশ্বমিথের দরবারঃ (৪র্থ পর্ব)–দে ব লী না রা য় চৌ ধু রী ব্যা না র্জি

বিশ্বমিথের দরবার(পঞ্চম পর্ব) কলমে-দে ব লী না   রা য় চৌ ধু রী   ব্যা না র্জি

 

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *