বিশ্বমিথের দরবার (পর্ব দুই)
কলমে-দে ব লী না রা য় চৌ ধু রী ব্যা না র্জি
ছবিঃ সুনীপা ব্যানার্জী ও দৃশান
আফ্রিকান লেখক চিনুয়া আচেবির লেখা একটা লাইন আছে, “There is no story that is not true”। আসলে গল্প যতই কল্পনার রঙে রাঙা হোক তা অবশ্যই মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত; আর মস্তিষ্কপ্রসূত মানেই তার একটা অনুভব বা চেতনা আছে। সেই অনুভব বা চেতনার ভিত্তিতেই মানুষ কল্পনা করে। আবার এ কথাও অনস্বীকার্য যে কল্পনার উৎস হিসেবে সে চেতনা বা অনুভবের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ একটা অভিজ্ঞতা থাকেই যা কাহিনীর অবতারণা করতে সাহায্য করে বা কাহিনীর প্রচার ঘটায়। এই ভাবেই সৃষ্টি হয় পুরাণকথা বা লোককাহিনী।
বিখ্যাত মিথবিশেষজ্ঞ জোসেফ ক্যাম্পবেলের বেশ কালজয়ী একটা কথা মনে পড়ল; তিনি লিখেছেন, “Every myth is psychologically symbolic. It’s narratives and images are to be read, therefore, not literally, but as metaphors”। অর্থাৎ মিথ বা মিথলজি হলো প্রতীকী। তাই পৃথিবীর প্রাচীন পুরাণগুলিতে যে কাহিনীগুলি পাওয়া যায় তার মধ্যে কি সত্য কি অসত্য তার সন্ধান করা প্রকৃতপক্ষে অযৌক্তিক। মিথের মজাটাই হলো গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বাস্তবকে খুঁজে নেওয়া, বা তার সাথে নিজেদের চেনা জগতের বা অভিজ্ঞতার সাদৃশ্য চিনে নেওয়া।
এবার আলোচনা করা যাক মিথ বা পুরাণকথার উপযোগিতা বা তাৎপর্য নিয়ে। মিথ বা পুরাণকাহিনীর গুরুত্ব গভীর বলেই যে তা কালজয়ী এ কথা অনস্বীকার্য।
আমার কি মনে হয় জানেন, ‘Mythology records our everything about our beginning, being and belonging’, মানে পুরাণের মাঝে লুকিয়ে আছে আমাদের সৃষ্টির কথা, জীবনচর্যার অভিজ্ঞতা, ব্যক্তি হিসেবে ও সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের ভুমিকা এবং লয় বা ধ্বংসের সম্ভাব্য কাহিনী। কাহিনীগুলো যখন তৈরি হয়েছে তখন তো নিশ্চই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আলো ছিল না ঠিকই কিন্তু প্রকৃতি যে মানুষকে বিজ্ঞানের প্রথম পাঠ শেখায় এ কথা তো বিশ্বাস করতেই হয়। জীবনযাপন করতে করতেই মানুষ তাই সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশ সম্বন্ধে নিজেদের চেতনা ও ধারণাকে গল্পের আকারে উপস্থাপন করে এবং সেটাই পুরাণকথার একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট। বিশ্বের সব মিথেই তাই বেশ কিছু মুলগত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। কারণটা খুব সহজ। যতই ভৌগলিক দুরত্ব, ভাষার ভিন্নতা আর পৃথক ধর্ম থাক, মানুষের জীবনধারা ও প্রকৃতি মোটামুটিভাবে এক। তাই এই সাদৃশ্য বেশ স্বাভাবিক।
পুরাণ বা লোককথার একটা ভীষণ পজিটিভ দিক হলো যে এগুলি কোন এক ব্যক্তি বা একটি ক্ষুদ্র দলের সৃষ্টি নয়। কোন জাতি বা গোষ্ঠীর সমবেত বিশ্বাসের কথা, তাদের সকলের অভিজ্ঞতার গল্পরূপ তাই তা পক্ষপাতদুষ্ট নয়। সংশ্লিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর গৌরব ও বিশ্বাসের কথা বললেও, প্রাচীন পুরাণকথা অন্যদের বিশ্বাসকে ছোট করে না।
মিথলজি বা পুরাণকাহিনী, উপকথা মানুষের মুখে মুখেই জন্মেছে ও প্রচার পেয়েছে। শুধু ‘বেদ’ই শ্রুতি নয় যে কোন দেশের পুরাণ ও লোককথা এক প্রজন্ম থেকে অন্যতে ছড়িয়ে পড়েছে যুগের পর যুগ পার করে মানুষের মুখে মুখেই। একে ইংরেজিতে বলে oral formulaic code। মহাকাব্যগুলির সৃষ্টিও এই ভাবেই। পুরাণ মহাকাব্যের লিখিত রূপ এসেছে অনেক পরে। ফলত, মিথের বোধগম্যতা অনেক বেশি।
সমাজ সৃষ্টির সাথে সথেই নীতিবোধ, নিয়ম, পাপ-পুণ্য, অধিকার, দায়িত্ববোধ, কর্তব্যচেতনা এগুলির প্রয়োজন হয় মানুষের। এই সমস্ত বিষয়গুলিকে সহজবোধ্য ও স্মরণযোগ্য করে মানুষের মধ্যে অনায়াসে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যেই এই কল্পকাহিনীর অবতারণা।
বন্ধুদের আরেকটা কথা বলি, আশা করি সহমত হবেন, ধর্ম কিন্তু থেকে পুরাণ জন্মায় না, পুরাণ ধর্মকে জন্ম দেয়। এখানে ঠিক Religion বলতে যা বোঝায় আমি তা বলছি না। আর তাই যদি হয়েও থাকে, ধর্ম বলতে কি বোঝায়? ফিজিক্স, কেমিস্ট্রিতে আমরা যা পড়েছি তাতে ধর্ম হলো বৈশিষ্ট্য। পদার্থের ধর্মকে কি রিলিজিয়ন বলব আমরা? আর যদি বলতেও চাই, তাহলে অর্থটা পরিষ্কার হয়ে থাক। ধর্ম হলো বৈশিষ্ট্য। পুরাণকথা বা সংশ্লিষ্ট জাতির অভিজ্ঞতা থেকে সার্বিক বিশ্বাস আর তার থেকেই জন্মায় এক একটি জাতির বা গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য। সেটাই সমাজস্বীকৃত ভালো-মন্দের বা ঠিক-ভুলের বৈপরীত্যকে সকলের দৃষ্টিগোচর করে সামাজিক পরিকাঠামোয় মানুষকে বেঁধে রাখে যাতে একটা সমাজে সুস্থতা ও সৌষ্ঠব বজায় থাকে। আর গল্পের গ্রহণযোগ্যতা সব থেকে বেশি, তাই কাহিনীর আকারে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আধুনিকতম যুগ পর্যন্ত ব্যপ্ত হয়ে আছে প্রাচীন সব পুরাণকথা, উপকথা। বেশিরভাগ প্রাচীন সভ্যতা হারিয়ে গেলেও পুরাণকথাগুলি হারায়নি।
আচ্ছা পুরাণ বা মিথলজিকে শুধুই কি কল্পকাহিনী মনে হয়? গল্পের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, রীতিনীতি, সম্পর্কের অভিঘাত – এগুলিও যে নিহিত থাকে পুরাণকথার গল্পগুলি কল্পনার মোড়কে।
দার্শনিকদের মতে মানুষের অভিজ্ঞতা, চেতনাতেই লুকিয়ে আছে সৎ – অসতের ধারণা। আর এই বৈপরীত্যই মানুষের পথ নির্ধারক। আর মন্দ ও ভালোকে যতটা সম্ভব সততার সাথে পক্ষপাতহীনভাবেই পুরাণকাহিনীগুলিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। যাতে মানুষ বৈপরীত্য দেখেই নির্ধারণ করতে পারে নিজের কর্ম ও ধর্ম। রেনে দেকার্তের মতে ‘conquer yourself than the world ‘। ব্যক্তির জীবন ও মন থেকেই উঠে আসে মিথ। বলা যায়, কল্পনা আর গল্পরূপ হলো সজ্জা মাত্র। আবার মনস্তাত্ত্বিকদের মতে মানুষের অচেতন মনই কল্পকাহিনীর জন্ম দেয়। আর এও সত্য যে অচেতন মন কিন্তু এমনি এমনি কল্পনা করতে অক্ষম। কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা বা চেতনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অস্তিত্বকে ঘিরেই কল্পনার সৃষ্টি। কার্ল জাঙ্গ-এর ভাষায়, “the whole of Mythology could be taken as a sort of projection of the collective unconscious”। তাহলে বলা যেতেই পারে যে বিশ্ব মিথের দরবারে কি নেই? আছে বিজ্ঞানচেতনা, নৈতিকতা, সমাজচেতনা, রাজনীতি, অর্থনৈতিক অবস্থা … আরও আরও অনেক কিছু। যা কিছু মানুষ ভাবতে পারে। কারণ মানুষের অভিজ্ঞতা আর ভাবনার যোগফল হলো পুরাণকথা বা মিথলজি। পুরাণকথার দরবারে আমাদের জন্য নতুন কিছু আবিষ্কার করার মতো নেই। আমরা যেটা করতে পারি তা হলো তথ্য ও তত্ত্বের সন্ধান ও উদ্ঘাটন। প্রিয় কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের কথা দিয়ে আজ শেষ করি, “the world is full of magic things patiently waiting for our senses to grow sharper”।
আজ এখানেই ইতি টানলাম। পরের পর্ব থেকে থাকবে এক একটি প্রাচীন সভ্যতার শ্বাসবায়ু বা পুরাণকথার বৈশিষ্ট্য, বিশ্বাস আর কল্পকাহিনীর আড়ালে থাকা বাস্তবের কথা। কোন দেশের পুরাণকথা দিয়ে শুরু করব, সেটা আর বলছি না। এটা বরং চমক হিসেবেই থাক। বন্ধুদের তরফ থেকে কোন প্রশ্ন বা তথ্য থাকলে বাইফোকালিজমের কমেন্টস সেকশানে জানাতে পারেন। আলোচনার মাধ্যমে আমরা সমৃদ্ধই হবো।
আগের পর্বঃ