ছবিঃগৌতম মাহাতো
নিরাপদ আশ্রয়ের অধিকার
আলেহো কার্পেন্তিয়ের
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : শৈবাল কুমার নন্দ
ঠিক আছে তাহলে – একসাথে গুলি ছোঁড়!” জেনারেল মাবিলান থমথমে রাগী গলায় চরম বিশৃঙ্খলা ও গলায় চেচিয়ে উঠলেন। এবং পরের আধঘন্টাতে যা চলল তা হল চরম বিশাল | গােলমাল। বিমানগুলাে তত্ত্বগত ছােট ক্ষেপনাস্ত্রের সম্পর্কে সচেতন না হয়, ও পেছনে উড়তে লাগল, যে লক্ষ্যবস্তুগুলােতে তারা আঘাত করল সেগুলাে তম সেখানে ছিল না। শেষমেশ তারা বেসক্যাম্পে ফিরে গেল। যখন সব কিছু শেয়। জেনারেল হতাশ ও বিমূঢ় হয়ে মিরামােন্তেসের প্রাসাদে ফিরে গেলেন। “আবহাওয়াবিদকে জেলে পুরে দাও,” তিনি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন।
যে জেলাগুলােতে মূলতঃ গরীবদের বসবাস সেগুলােতে ছােট ক্ষেপনাস্ত্রগুলাের স্বাভাবিক উৎক্ষেপন এর ফলে বেশ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। একবার কল্পনা করুন : তাদের বাড়িগুলাের ছাদ কার্ডবাের্ডের। সতেরােজন মারা গেছে এবং অনেক শিশু আহত হয়েছে, পার্শ্বচর শান্তভাবে জানালাে। “আমরা কি খবরটা চেপে দেব?” কিন্তু নিষেধাজ্ঞা চাপানো।” “এক্ষুনি, এবং কাগজগুলােকে সাবধান করে দাও যদি তারা কোন কিছু ছাপে, আমি যেহেতু সীমানা সংক্রান্ত ব্রিাদ আরাে জটিল হয়ে উঠল, আমি ভাবলাম যে রাষ্ট্রদূতের কোন কাজে আমি লাগতে পারি কি না, তাঁর সুন্দরী স্ত্রী গতকালই আমায় বলেছেন : | “ও এক নির্বোধ ও অপরিণত লােক।” আমার কি খুঁজে দেখা উচিৎ সেটা ঠিকমত না জেনেই, আমি সীমান্তের দেশের ইতিহাস খুঁটিয়ে পড়া শুরু করলাম। তাঁর চতুর্থ সমুদ্র অভিযানে কলম্বাস ঐ দেশটা আবিস্কার করেন, এবং তিনি যদি ঐ দেশটা সম্পর্কে কিছু বলে থাকেন – আমাদের বর্তমান ধারনাটা এসেছে মৃত্যুর পরে প্রকাশিত এক কৃষ্ণাঙ্গ গনিতবিদের লেখালেখি থেকে, যিনি ঐ সময়ে নৌসেনাপতির জাহাজে কেবিনয় ছিলেন, এবং তিনি ছিলেন ইব্রাহিম আল জারকালির বংশধর, জারকালি নিয়ে একটা সন্ধিপত্রের রচয়িতা – যদি তিনিও এ বিষয়ে কিছু না বলে থাকেন, আমি আবার বলি, ঐ আবিস্কারের দিনটাতে কলম্বাস জ্বরে ভুগছিলেন, এবং তিনি ঝলমলে ভেলভেটের পােশাক পরে হাতে পতাকা নিয়ে তীরে নেমে বলতে চাইছিলেন না “এই দেশের দখল নেওয়া হল অমুক রাজার নামে …ইত্যাদি, ইত্যাদি। তিনি কাউকে তাঁর বদলে পাঠাতেও চাইছিলেন না, কারণ তিনি জানতেন যে তাঁর পাঠানাে প্রতিনিধির মাথা ঘুরে যাবে যখন ঐ ঝলমলে সােনার-জরির নকশাওয়ালা চামড়ার পােশাকের উত্তেজক পেলবতা ও এলােমেলাে বাতাসে পােশাকের অংশ ঝাপটাবে মুখের ওপর। তাই ঐ রাজপতাকা তার নিজের জায়গাতেই থাকল, জাহাজগুলাে নােঙর করা হল, এবং সীমান্তের দেশটাতে কলম্বাসের আবিষ্কারের কোন প্রমান বা তথ্য না রেখেই চলে আসা হল, যেখানে একটা তাত্ত্বিক বিতর্ক জারি থাকলােই ও যেটা মাঝে মাঝে উসকে দেওয়া হত, তাদের মধ্যে যারা বলত “ওখানে কলম্বাসের পদার্পন হয়েছে “ওখানে কেউই পা দেয়নি, যতদিন না এক বিদগ্ধ প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হল আরবি ভাষায় গা আল জারকালির বিবরণীর পাঠোদ্ধার করতে ও বিষয়টা সবার সামনে তুলে ধরতে। সীমান্তের ঐ দেশটা আবিষ্কৃত হতে না হতেই, সভ্য মানুষদের প্রথম দলটা ওখানে লৌছতে শুরু করল : রাজ্যপালেরা, এনকমেনদেরােস (সেনাধিনায়কেরা), নিঃস্ব অভিজাত ব্যক্তিগণ, মুখখিস্তি করা সেভিলা প্রদেশের অসাধু টুনা ব্যবসায়ীরা, তাদের সবাই গাড়িভর্তি কাঠকুটো থেকেও দুনস্বরিতে ওস্তাদ, পুরনাে ও নতুন যে কোন মদে চুর হতে, এবং ইন্ডিয়ান মহিলাদের সঙ্গে অবাধ যৌনসংসর্গে অভ্যস্ত। তারপরে এল আগমনকারীদের দ্বিতীয় দলটা : শাসকেরা, গােলমেলে উকিলেরা, করসংগ্রাহকেরা, এবং হিসাব পরীক্ষকেরা, যারা দুশতকেরও বেশি সময় নিয়ে ধীরে ধীরে ওখানকার বসতিটাকে একটা বিশাল খামারে পরিণত করল, যাতে যতদূর চোখ যায় গবাদি পশু ও শস্যখেত, কেবল কয়েকটা টুকরাে জায়গাকে বাদ দিয়ে যেগুলােতে স্পেনীয় শাকসবজি লাগানাে হয়েছিল।
কিন্তু একদিন – ক বলতে পারে কিভাবে ? দেশটাতে এসে পৌছােল এক কপি “সামাজিক চুক্তি” যার লেখক রুশো, যিনি জেনেভার এক নাগরিক। এবং তারপরেই এল “এমিল”। রুশােরই এক অনুগামী ওখানকার স্কুলের ছেলেদের রুশাের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত করার পর তারা স্কুলের পাঠ্যবই পড়া ছেড়ে দিয়ে কাঠের হস্তশিল্প ও প্রকৃতি বিষয়ক পাঠে মেতে উঠল, যার মধ্যে ছিল টারানটুলাদের সুড়ঙ্গে ফেলে দেওয়া ও টিকটিকিগুলাে ব্যবচ্ছেদ। তাদের বাবা-মায়েদের মধ্যে যারা খুব প্রভাবশালী তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, যারা একটু সহজ-সরল মানসিকতার তারা জানতে চাইলেন কখন ও কোন জাহাজে রুশাের লেখা বইগুলাে পৌছােল। এবং তারপরে, আঁকড়ে ধরা শেষ খড়কুটোর মত, এসে পৌছেল ফরাসি লেখা এনসাইক্লোপিডিয়া। ভােলতেয়ারবাদী এক পুরােহিত আমেরিকাতে তাঁর প্রথম অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব ঘটালেন। তারপরে উদারপন্থী ধ্যান ধারণার উপর ভিত্তি করে ফ্রেন্ডস অফ দ্য নেশন এর প্যাটিয়টিক কাউনসিল প্রতিষ্ঠা হল। এবং এক সুন্দর দিনে “স্বাধীনতা নয়তাে মৃত্যু!” এই কলরােল শােনা গেল। এবং তাই, জাতীয় বীরেদের ঢাল করে, পুরাে একটা শতক সঁপে দেওয়া হল সামরিক বিদ্রোহ, সশ্র অভ্যুত্থান, বিপ্লব, রাজধানীতে সারিবদ্ধভাবে কুচকাওয়াজ, একক ও সমষ্টিগত বিদ্রোহ, বর্বর এবং প্রগতিশীল একনায়কদের হাতে। শান্তি ফেরানোর কয়েকটা ব্যর্থ প্রচেষ্টাও হল অগান্তে কামতের নিরপেক্ষ ধর্মবাদ প্রচারের মধ্যদিয়ে, মন্দির বানানাে হল এবং প্রশ্নোত্তরে ইতিবাচক ধর্মীয় শিক্ষাদানব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। স্বাভাবিকভাবে ঈশ্বরের উপাসক দৃশ্যমান সন্তদের ছাড়াই এক ধর্ম সামান্যই সাফল্য পেয়েছিল, ইতিবাচক পঞ্জিকার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটল, যেটাতে দিনগুলো উৎসর্গ করা হয়েছিল কলুমেলা এবং কান্টের স্মৃতিতে, তিব্বতি পুরােহিতেরা এবং একাদশ শতকের ফরাসী গীতিকবিতা (তাদের নামেও বিশেষ বিশেষ তারিখ ছিল), এবং কে কৃষিকাজসংক্রান্ত সাজসরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করবে (প্রকৃতপক্ষে আমাদের কেউই ঐ বিতর্কিত এলাকাতে বসতি স্থাপনে ইচ্ছুক নয়), ভাইয়ের মত করে তাদের সাথে আচরণ করবে, এটা জানা সম্ভব নয় যে সীমান্তের এপাশে বা ওপাশের কোন অগ্রদূত বা বসতিস্থাপনকারীকে কোন সম্পত্তি হস্তান্তর করা হল কি না – যদি বাস্তবিকই ব্যাপারটা দুপক্ষকে সন্তুষ্ট না করে। এটা ছাড়াও, সীমান্তবর্তী দেশ কিছু ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক কিছু ছাড় দেবে – তাদের দেশে প্রবেশের অধিকার, শুল্ক থেকে অব্যহতি – যে কারাের প্রতি যারা ঐ সীমান্ত এলাকার ভেতরে জমি অধিগ্রহনে আগ্রহী।চমৎকার! বেশ চমৎকার, বটে”, রাষ্ট্রদূত সমাধানের উপায়টা শুনে প্রশংসায় মুখর হলেন। “প্রত্যেকেই জেনারেল মাবিলানকে একজন প্রথম শ্রেণীর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মেনে নেবে। খাতায় কলমে সীমানার এলাকাগুলাে অপরিবর্তিত থাকবে। এবং বিমানবাহিনী আক্রমনের মহড়ার ভরাডুবির পর আমাদের জেনারেলও ঘােষনা করতে পারবেন যে আর কোন যুদ্ধ হবে না। ছেলেরা তাদের মায়ের কোলে ফিরে যাবে, লােকজন নিরাপদে বাড়িতে ফিরবে। এবং আমার দেশের সম্মানও নিরাপদে সুরক্ষিত থাকবে। তুমিই হলে সেই যে এই সমাধান বের করতে পারলে, রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী বললেন, যিনি আজ সন্ধে থেকেই কেমন একটা অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। শুক্রবার থেকে সােমবার, অথবা বৃহস্পতিবার থেকে পরের মঙ্গলবার যে মাসগুলােতে সীমান্ত সংক্রান্ত বিবাদের সমাধান নিয়ে আলােচনা সফলভাবে এগিয়ে চলছিল, শরণার্থীর ভূমিকা দুতাবাসের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠল। তাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়, কারণ তারই মধ্যস্থতায় তুলাে ও তামাকের এক লাভজনক বিনিময় ব্যবস্থা চালু হল; তাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ, কারণ যে দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্য। এতদিন নিষ্ক্রিয় ও সীমাবদ্ধ অবস্থায় ছিল, তারই উদ্যোগে ফের চালু হল, যেমন পর্বতারােহীর পঞ্চোগুলো, যেগুলাে লন্ডনে বােনা, যেগুলাে ছিল সীমান্তবর্তী দেশের জাতীয় পােশাকের একটা অংশ; স্থানীয় কেক-পেষ্টির দোকানগুলােতে উপচে পড়ল মিছরি দিয়ে তৈরী পাখি, বিভিন্ন ধরণের জন্তু জানােয়ারের আকৃতির ক্যান্ডি, নকশা করা মাটির জারভরা জ্যাম; দোকানগুলােতে যে কেউই দেখতে পেত চামড়ার বেল্ট, বার্নিশ করা ফেস্টের টুপি, এবং চৌকোগলার মেয়েদের ব্লাউজ যেগুলাে সবই বানানাে সীমান্তের ওপরে থাকা কারখানাগুলােতে। এ সমস্তগুলাে ছাড়াও ছিল বিভিন্ন গীর্জা ও সন্তদের মাটির পুতুল, গ্রামে বানানাে বিভিন্ন ধরনের গীটার, পেতাকো থেকে আসা বেহালাগুলাে (যেখানে প্রত্যেকেই একেকজন যন্ত্রপাতি নির্মাতা), আমাদের দেশের যদিও নিজস্ব সামগ্রী বা উৎপন্ন দ্রব্যের দ্বারা প্রকাশিত কোন লােককথা নেই, এক। কাল্পনিক লােকগাথা গড়ে উঠতে শুরু করল, যেটা বিদেশী পর্যটকদের কাছে খুব আকর্ষণীয় হয়ে উঠল …কিন্তু এটাই সব- ছিল না : শরণার্থী ঘরে বসে থেকে থেকে নিষ্ক্রিয়তায় ফলে যেন প্রকৃতই অসুস্থ ও সময় সম্বন্ধে এমন এক অচেতন অবস্থার মধ্যে রয়েছে যে শুক্রবার বা সােমবার, বৃহস্পতি বা মঙ্গলবারের মধ্যে কোন পার্থক্য ধরা পড়ে তার কাছে, নিজেকে দূতাবাসের সমস্ত কাজে সঁপে দিয়েছে। তাই যখন রাষ্ট্রদূত সিমেননের পরপর বেরােনাে নতুন সংস্করণের ভলিউমগুলাে পড়ায় মগ্ন ও নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছেন ইনসপেক্টর মাইগ্রেতের বন্দোবস্ত চালিয়ে যাওয়ার চিঠিচাপাটির খসড়া তৈরি, গােপন ও জরুরী চিঠিপত্রগুলাে লেখালেখি, চ্যান্সেলরের সঙ্গে যােগাযােগ রেখে চলা, বিভিন্ন প্রতিবেদন ও কার্যক্রমের সঙ্গে, শরণার্থী কিন্তু কুটনৈতিক খোঁজ রাখা এসবে ব্যস্ত রয়েছে। | “তােমাকেই তাে মনে হচ্ছে আমার দেশের আসল রাষ্ট্রদূত”, কনসাল একদিন বলেই ফেললেন, যার অভ্যেসই হল মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ দূতাবাসে চলে আসা (“খোঁজখবর ও চরগিরি করতে, রাষ্ট্রদূতের কথানুযায়ী, যিনি একটা অবাধ্য ঘােড়ার মত মুখভঙ্গী করে কনসালের প্রতি তাঁর চরম ঘৃণা প্রকাশ করলেন)। তারপর, একদিন, শরণার্থী সীমান্তবর্তী দেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করল।
★★★