বেড়ু-বেড়ু বগুড়ান- লেখা ও ছবি– রাকেশ সিংহ দেব

          ★বাইফোকালিজম-এর তরফ থেকে বাইরে না বেরোতে অনুরোধ।
              লক-ডাউন মেনে চলুন নিজের ও সকলের সুরক্ষার কথা ভেবে।
                                 মানস ভ্রমণ করুন লেখায় লেখায়

               বেড়ু-বেড়ু বগুড়ান 

  লেখা – রাকেশ সিংহ দেব
ছবি- রাকেশ সিংহদেব ও কৌশিক জানা
 সপ্তাহান্তে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে কাছেপিঠে বেরিয়ে পড়ার সাহেবি কেতায় বেশ ভালোই মজেছে পায়ের তলায় সরষে ছড়ানো আম বাঙালিরা। তাই রোজ রোজ খোঁজ পড়ছে নতুন নতুন উইকএন্ড ডেস্টিনেশনের। এরফলে বাঙালি ইন্টারনেট, পত্রিকা ঘেঁটে বাড়ির কাছাকাছি খুঁজছে একখণ্ড অবসর যাপনের ঠিকানা। এ যেন রবি ঠাকুরের ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া / ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া…’ দর্শনের একেবারে ব্যবহারিক ভাবসম্প্রসারন। সেই মোতাবেক আমিও মাছে ভাতে ঘুরনচণ্ডী বঙ্গসন্তান। তাই রোজকার কর্মজীবনের বাইরে একটু ব্রেক পেয়ে আমিও স্টেপ আউট করে হাঁকিয়ে ফেললাম মহারাজকীয় এক ছোট্ট ছুটির ছক্কা। সেই ছক্কা বাড়ির বাউন্ডারি লাইন পেরিয়ে সোজা উড়ে গিয়ে পড়ল পূর্ব মেদিনীপুরের এক স্বল্প পরিচিত বালুকাবেলায়। জায়গাটার নাম, বগুড়ান। পুর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি থেকে ভায়া রসুলপুর প্রায় ১২ কিমি দূরে বঙ্গোপসাগরের তীরে এক ছোট গ্রাম। উন্মত্ত কোলাহলমুখর পৃথিবীর বাইরে যেন প্রকৃতির এক নিরালা ওয়ান্ডারল্যান্ড!  


কাঁথি থেকে বগুড়ান যাওয়ার রাস্তাটা বেশ চমৎকার। রাস্তার একপাশে চওড়া নোনাজলের খাল আর অপরপাশে বাড়িঘর, দোকানপাট, জেলেদের বাড়ি। ভাঁটার সময় কিনারা থেকে কুইজাল দিয়ে মাছ ধরে এখানকার স্থানীয় জেলেরা। রাস্তার ধারে সুপারি, খেজুর, নারকেল, কাজুবাদাম থেকে শুরু করে আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, পেয়ারা, সবেদা গাছের সমারোহ। গাছের ডালে ডালে বেনে বৌ, ছাতারে, শালিখের কিচিরমিচির। ভূপৃষ্ঠ থেকে মাটি উঁচু করে তার উপর রাস্তা বানানো হয়েছে। কয়েক জায়গায় বৃষ্টির জলে মাটি ধুয়ে গিয়ে রাস্তার ধারে গভীর গর্ত হয়ে গেছে। শৌলা বাঁধের উপর উঠবার পর রাস্তার দুপাশের দৃশ্যপট বদলে গেল। এবার রাস্তার দুপাশে দেখতে পেলাম সারি সারি চিংড়ি চাষের জন্য বানানো নোনাজলের ভেড়ি। খালের মাধ্যমে নোনাজল এনে ভর্তি করা হয়েছে জলাশয়, আর তাতেই চাষ হচ্ছে চিংড়ি। খালের ধারে হাঁটু অবধি কাদাজলে ছাঁকনি জাল নিয়ে খুদেরা নেমেছে মাছের খোঁজে। বর্তমানে বাগদা চিংড়ির চাষ কাঁথি মহকুমার সমুদ্র উপকূলবর্তী গ্রামগুলিতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চাষাবাদের বিকল্পধারা হিসাবে এখানকার বহু মানুষজন বর্তমানে চিংড়ি চাষ করছেন। এই চাষ তাদের এনে দিয়েছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। এভাবেই চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্থব্য বগুড়ানের দোরগোড়ায়। পাকারাস্তা থেকে একটা সরু মাটির রাস্তা চলে গেছে সমুদ্রের দিকে। সেপথ ধরতেই আমাদের স্বাগত জানাল একজোড়া নীলকণ্ঠ (Indian Roller)। আমাদের আওয়াজ পেয়ে উজ্জ্বল ময়ূরকণ্ঠী ডানা ঝাপটিয়ে মিলিয়ে গেল সামনের ঝাউবনে। 

মাটির রাস্তার শেষমাথায় রয়েছে একটি পাকা মন্দির। সর্পশোভিতা হংসবাহিনী মা মনসা এখানকার আরাধ্যা দেবী। মন্দিরের পাকা চাতালে বসে আমরা আমাদের ক্যামেরা ঠিক করে নিলাম। সমুদ্রের গর্জন কানে আসছে, অদূরে চোখে পড়ছে জলের নীল রেখা। মন্দিরের সামনে থেকে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম সমুদের দিকে। 

বগুড়ানের সাগরতটে পা রেখেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল। দীগন্ত বিস্তৃত নীল জলের রাশি, সফেন ঢেউ, বিস্তীর্ণ চওড়া সোনালি বালুতট, বালুতটের গায়ে ঝাউবনের রেখা, প্রায় নির্জন এবং কোলাহলবিহীন পরিবেশ। এককথায় এ যেন এক ঈশ্বরীয় প্রশান্তির দেশ। ঝাউবনের গা ঘেঁষে ফুটে আছে কাশফুল। দু চারজন স্থানীয় জেলে তাদের জাল মেরামত করতে ব্যস্ত। জলরেখার একটু ভেতরে জাল খাটানোর জন্য বাঁশের খুঁটি পোঁতা আছে। এক যুবক তার মশারির থেকেও সূক্ষ্ম ছিদ্রযুক্ত জালে বাগদা চিংড়ির মীন (স্থানীয় নামে ‘পিন’) সংগ্রহ করছে। পাড়ে উঠে একটা ঝিনুকের খোলার সাহায্যে একটি একটি করে মীন বেছে পরিস্কার জল ভর্তি একটি আলাদা পাত্রে তুলে রাখছে। এক জেলে দম্পতি তাদের ছোট মাছ ধরার জালটি পাতছে আর তাদের শিশুসন্তান আনন্দে দাপাদাপি করছে হাঁটুজলে। বালুকাবেলায় তখন Kentish plover, Black-headed sea gull, Whiskered Tern, দাঁড়কাক সহ উপকূলবর্তী নানান পাখির মেলা। জেলেরা যেখানে তাদের জাল পরিস্কার করেছিল সেখানেই তাদের ভিড়। বালির উপর পড়ে থাকা ছোট লটে মাছ, সাদা কুচো চিংড়ী, ছোট কাদা কাঁকড়া খাওয়ার জন্য তারা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়াউড়ি করছে। 
বগুড়ান সৈকতের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল এখানকার লাল কাঁকড়া বা, Red ghost crab । ভাঁটার সময় সমুদ্রের জল দূরে সরে গেলে বালিয়াড়ির উপরিভাগের ছোট ছোট গর্ত থেকে লক্ষ লক্ষ লাল কাঁকড়া স্নানের জন্য সমুদ্রের দিকে পাড়ি জমায়। দল বেঁধে পালে পালে বালুতটে তাদের চলার ফলে অবর্ণনীয় এক লালের স্রোতে ঢাকা পড়ে সমস্ত সৈকত। কি দ্রুত আর দলবদ্ধ তাদের চলাফেরা! চলার ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, মারামারি, খুনসুটি চলে নিয়মমাফিক। মানুষের পায়ের শব্দ বা কোলাহলে এরা বিভ্রান্ত ও ভীত হয় কিন্তু পালিয়ে যায়না। সেখান থেকে সরে গিয়ে আবার তারা জলের দিকে চলতে থাকে। জলের কাছে পৌঁছানোর পর এই লাল কাঁকড়ারা ভিজে বালির মধ্যে নিজের শরীরটা দাবিয়ে বসে পড়ে। ঢেউয়ের জল তাদের গায়ের উপর দিয়ে বয়ে গেলেই হয়ে যায় সাগরস্নান। স্নান সেরে রোদে গা সেঁকতে সেঁকতে আবার ইউটার্ন নিয়ে নিজেদের গর্তের দিকে চলা, এই রোজকার রুটিন। লাল কাঁকড়া ছাড়াও এখানে একটি বড় দাঁড়ওয়ালা ফিডলার ক্র্যাব, রঙিন ফুলুরি কাঁকড়া (স্থানীয় নাম) ইত্যাদি প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলির কোনটাই মনুষ্য ভোজ্য প্রজাতির কাঁকড়া নয়। খাওয়ার উপযোগী কাঁকড়া এখানকার কর্দমাক্ত জলা জায়গাগুলি বা নোনাজলের খালে পাওয়া যায়। 

এখানকার উর্বর মাটিতে প্রায় সারাবছর চাষবাস চলে। চাষবাসের বাইরে এলাকার মানুষজনের বড় জীবিকা হল সমুদ্রে মাছ ধরা। মাছ ধরার সাথে রয়েছে মাছ কেনাবেচা, মাছ বওয়া, মাছ বাছাই, মাছ শুকনো করে শুঁটকী মাছ তৈরি, বিক্রিবাটা। এখানকার অধিকাংশ জেলের পুঁজি কম,সামান্য তাদের রসদ; তাই তারা সমুদ্রের অপেক্ষাকৃত অগভীর এলাকায় মাছ ধরে। এরা পরম্পরাগত মৎস্যজীবী। জালও আছে বিভিন্ন রকম যেমন- ভাসানি জাল (ইলিশ, বেহেদি ইত্যাদি মাছ ধরবার জন্য), বেহেদী জাল (লইট্যে, রুলি ইত্যাদি মাছ ধরবার জন্য), টানিং জাল (চিংড়ির জন্য) । জনা চারেক মিলে কাঠি জাল দিয়ে কিনারা থেকেই ধরে থাকে সুস্বাদু কানুয়া মাছ। অগভীর সমুদ্রে মাছ শিকারে মেলে নেহারী, ছুরি, সাদাপাতা, রুলি, ভোলা, পাঁকড়া, খসলা, তপসে, রিবন ফিস বা পাটিয়া, লালপাতা, গুইচাকা, লটে, চিংড়ি এইসব মাছ। এখানে সাদা ও লাল দুরকম চিংড়িই পাওয়া যায়। সাদা চিংড়িকে স্থানীয়রা বলে ‘ঘুঘুয়া’। স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়ের মানুষেরা বালুতটের ধারে বাঁশ, খড়, তারপলিন আর পোড়ামাটির টালির তৈরি ঘরে বসবাস করে। সেখানে তারা গরম বালি আর পাতলা বাঁশের তৈরি মাচার উপর রোদে মাছ শুকিয়ে শুঁটকী মাছ তৈরি করে। প্রায় মাস দেড়েক ধরে কাঁচা মাছ একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে শুকনো করবার পর এককেজি মাছ থেকে প্রায় তিনশ থেকে চারশ গ্রাম শুঁটকী মাছ পাওয়া যায়। এরপর চালুনিতে চেলে শুঁটকীর গা থেকে বালি ঝেড়ে নিয়ে তা পাঠানো হয় বাজারে বিক্রির জন্য। 
বগুড়ানের পরিস্কার জল স্নানের জন্য আদর্শ। ঠাণ্ডা নীল জলে গা ভিজিয়ে স্নান সেরে ফেলা যায় অনায়াসেই। দৃশ্যসুখের মাঝে সদাব্যস্ত আমাদের সাধের ক্যামেরাগুলিকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার প্রয়োজনে, আমরাও নেমে পড়েছিলাম জলে। এক শীতল মধুর অনুভূতি যেন একনিমেষে ভুলিয়ে দিল সব ক্লান্তি। সোনালি বালুকাবেলার খোলা খাতায় জলের অক্ষরে এখানে প্রতিমুহূর্তে লেখা হচ্ছে নতুন নতুন চিত্রপট। যার অনুভূতি হয়ত সাময়িক, কিন্তু আবেদন শাশ্বত। ঈশ্বরের স্বাক্ষাৎ দর্শন কেউ পেয়েছেন কিনা জানা নেই। এই শান্ত, আপাত নির্জন, নিরুপদ্রব প্রকৃতির মাঝে দু-দন্ড কাটালে তাঁর স্পর্শ অনুভব করা যাবে এব্যাপারে আমি আশাবাদী। 
                                                                                   

                                          


কীভাবে যাবেনঃ

কলকাতা থেকে কাঁথির নিয়মিত বাস চলছে। দীঘাগামী ট্রেনে বা বাসে কাঁথি চলে আসুন। কাঁথি থেকে গাড়ি ভাড়া করে বেড়িয়ে আসুন বগুড়ান। কাঁথি থেকে ভায়া রসুলপুর ট্রেকার চলছে বগুড়ান যাওয়ার জন্য। এছাড়া প্রথমে চলে আসুন সমুদ্র সুন্দরী দীঘায়, তারপর সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে একবেলা ঘুরে আসুন বগুড়ান। 

কী করবেনঃ

 ১। বগুড়ান একটি রিমোট ভিলেজ। দোকান বাজার নেই, তাই পর্যাপ্ত পানীয় জল ও শুকনো  খাবার সঙ্গে রাখুন।
২। অবশ্যই চেখে দেখবেন স্থানীয় ডাবের জলের অপার্থিব স্বাদ।
৩। রোদের হাত থেকে বাঁচতে সানগ্লাস, টুপি, ছাতা সঙ্গে রাখুন। 
৪। স্থানীয় মানুষজনের রোজনামচার সঙ্গী  হোন। উপভোগ করুন তাদের সরল জীবনযাত্রা। 
গ্রীন টিপস
১) খাবারের প্যাকেট ও নোংরা যেখানে সেখানে ফেলবেন না। এই এলাকায় প্রতিদিন মাছ ধরা হয় তাই স্থানীয়রা অসন্তুষ্ট হবেন। 
২) লাল কাঁকড়াদের পেছনে ছুটে বা চিৎকার চেঁচামেচি করে অযথা তাদের বিরক্ত ও বিভ্রান্ত করবেন না। দূরত্ব রেখে উপভোগ করুন তাদের চলাচল। 
৩) সমুদ্র সৈকতের উপর যান চলাচল নিষিদ্ধ । পায়ে পায়ে ঘুরে প্রকৃতিকে উপভোগ করুন। পকেট ভরে কুড়িয়ে ফেলুন সুখ স্মৃতির ঝিনুক। 
৪) সমুদ্র সৈকতে চলাফেরার সময় সতর্ক থাকুন। এই এলাকায় চোরাবালি থাকবার খবর আছে। 
৫) মদ্যপান বা নেশা করে সমুদ্রে নামবেন না। এলাকাটি প্রায় নির্জন। বিপদে পড়লে কাছাকাছি সাহায্যের জন্য কাউকে নাও পেতে পারেন। গভীর জলে না যাওয়াই ভালো। যেখানে মানুষজন আছে সেখানেই জলে নামুন। 
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *