স্মৃতির দৌলত

প্রদীপ ভট্টাচার্যেজন্ম ১৯৫২ সালে কোচবিহার জেলার দিনহাটায় ।দিনহাটায় স্কুল জীবন শেষ করে শিলিগুড়িতে কলেজ জীবন শুরু।বর্তমান বাসস্থান শিলিগুড়ি পুরসভার 31নং ওয়ার্ডে সুকান্তপল্লীতে । ৭০ এর দশকের শুরু থেকেই নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। পরবর্তী কালে গল্প , কবিতা ও প্রবন্ধ উত্তরের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই করোণা আবহে ঘরে বন্দি । ছোটবেলার বিভিন্ন স্মৃতি বিশেষ করে এবারের পূজোর পরিমণ্ডলে নিজের ছোটবেলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন ।

আমার ছােটোবেলা ও কিছু স্মৃতি

প্র দী প   ভ ট্টা চা র্য

পুঁইশাক ২০টাকায় একপােয়া, ধুন্দল ৮০টাকা কেজি, লাউ ৪০টাকা, পালং শাক ৮০টাকা কেজি। সেদিন বাজারে সজ্জির এরকম দাম শুনে ছােটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমরা না উচ্চমধ্যবিত্ত না নিম্নমধ্যবিত্ত, এ দুই-এর মাঝামাঝি ছিল আমাদের অবস্থান। বাবা তাঁর যৎসামান্য রোজগার থেকে কিছু সঞ্চয়, কিছু ধার করে দিনহাটার ছোট শহর থেকে বেশ খানিকটা বাইরে একটি পরিত্যক্ত ইটভাটা ও পরিত্যক্ত কবরস্থান যা সেইসময় ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল এই রকম একটা বারো বিঘার জমি এক মুসলমানের কাছ থেকে ছয়শত টাকার বিনিময়ে কেনেন। এই জমিটার চারভাগের একভাগ নীচু জমি ছিল কারণ সেখান থেকে ইট বানানাের মাটি তােলা। হয়েছিল। বাকি তিন ভাগের ঠিক মাঝখানে আমাদের বাড়ি। বাড়ি মানে মাঝে উঠোন, চারভিটায় চারটে বাঁশের চাটাই-র বেড়া আর টিন দিয়ে ছাপরা। আশেপাশে চারদিকেই চাষের জমি। দু-এক ঘর কাঠমিস্ত্রি ছিল। ছিল এক ” মুড়ি-ওয়ালি মাসি, মাসি প্রতিদিন সকালে মুড়ি ভাজত। আমরা প্রতিদিন সকালে এক আনা (ছয় নয়া পয়সা) নিয়ে মুড়ি আনতে যেতাম। মাসি গরম মুড়ি হলুদ রং-এর পিউবিটি বার্লির বড় কৌটোর দুকৌটো মুড়ি দিত। শীতকাল হলে আমরা তিন ভাই বােন তেল দিয়ে মুড়ি মেখে পূর্ব ভিটার ঘরের পিছনের দিকে যেখানে অনেকটা, প্রায় বিঘা দুয়েক জমি, যেখানে- মুলা, ধনেপাতা, মটরশুটি, আলু ও আলুক্ষেতে মিট কুমড়ো (মাটিতে যে কুমড়ো হয়। লাগানোে হত। সেখান থেকে ধনেপাতা নিয়ে কখনও কখনও একটা মূলাে নিয়ে শীতের রোদের আমেজ নিতে নিতে মুড়ি খেতাম। কথাগুলাে মনে হল করণ এখন কয়েকটা ধনেপাতা আর একটা ছোট মুলোর দাম ২০টাকা। আমার মনে আছে আমাদের বাড়ির পাশে অর্থাৎ যে দোকান থেকে আমরা চাল-ডাল-নুন-তেল কিনতাম সেই সুভাষদার দোকানে এক সের চালের দাম ছিল ছয় আনা থেকে সাড়ে ছয় আনা। অর্থাৎ সেই চাল সাঁইত্রিশ পয়সা থেকে চল্লিশ পয়সা হয়েছিল বলে আমি এক মাইল দূরে হাট থেকে চাল আনতে যেতাম। এখন ভাবতে অবাক লাগে একটা লাউ ৫০টাকা। ছােটবেলায় কলপাড়ের জঙ্গলটায় কত লাউ ঝুলে থাকত। পাশের বাড়ীর কাকিমা এসে হয়তাে বলত,–“দিদি একটা লাউ নিলাম” বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে একটা লাউ ও তার সঙ্গে কাপড়ের কোঁচড়ে বেশ কিছু সিম তুলে নিয়ে যেত। এ ব্যাপারটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। তাই বলে কি বাজারে লাউ, সিম এসব বিক্রি হত না! খুব হত। সবার তাে সব্জি লাগানাের জায়গা ছিলনা! বাবা খুব সস্তায় একসময় ইটভাটা এবং পরে কবরস্থান এবং তারও পরে নানা ধরনের গাছের গভীর জঙ্গল সস্তায় কিনেছিলেন বলে আমাদের শাক-সব্জি লাগানাের জায়গা ছিল এবং কুচবিহার জেলার মাটি চাষের খুব উপােযােগী হওয়ায় সব ধরনের শাক-সব্জির ভাল ফলন হত। আমাদের পূর্বভিটার ঘরের পিছনে কাঠা পাঁচেক জায়গায় আলু লাগানাে হত। আর আলুর আলে মাটির কুমড়ো লাগানাে হত। ঐ আলু আমরা চৌকির নীচে বাঁশের মাচা করে রেখে দিতাম। কুমড়োও একইভাবে রেখে দেওয়া হত। আমাদের প্রায় সারা বছর আলু আর-মাকে কিনতেই হত না।


কিছুদিন আগে বাজারে ছোট ছোট দেশী পুঁটিমাছ উঠেছিল। সচরাচর দেখিনা। আমি জিজ্ঞেস করতে বলল, ১০০ টাকা ২৫০ গ্রাম।” তার মানে ৪০০ টাকা কেজি। অবাক হলাম। যদিও অবাক হওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু পুঁটিমাছের কথায় একটা মজার ঘটনা মনে পড়লাে। আমাদের রান্নাঘরের পাশেই মানে ১০-১৫ পা দূরেই ছিল ডােবা। ডােবা মানে চারিদিকে ইট দিয়ে গাঁথা মাঝে বিশেষভাবে সাজিয়ে ইট পােডানাে হত। দিনহাটা-কোচবিহারে দেখেছি মাটির নীচে ইট পোড়ানাে হত। ইট পােড়ানাে দেখতে খুব মজা লাগতাে। যাই হােক ইট পােড়ানাের জায়গাটায় আমাদের ডােবা। বর্ষাকালে ডােবা ভর্তি জলে কই, মাগুর, টাকি, পুঁটি.. আরও কত কি! আমরা একটা ঘাট বানিয়ে নিয়েছিলাম। মা রাতের হাঁড়ি, কড়াই, থালাবাসন ঘাটে জলের তলায় ডুবিয়ে রাখতো। একদিন অন্যান্য ঘরের কাজ শেষ করে মা বাসন মাজতে এসে দেখে হাঁড়িতে যে দু-চারটে ভাত ছিল তা খেতে প্রচুর পুটিমাছ হাঁড়ির ভেতরে ঢুকেছে। মা হাঁড়ির মুখে একটা ঢাকনা দিয়ে হাঁড়িটা তুলে এনে জল ঝরিয়ে নিল। এরকম বার দুয়েক করতেই প্রায় ২৫০ গ্রাম পুটিমাছ উঠে আসে। তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের খাবার পাতে মা-র ধরা পুঁটিমাছ ভাজা থাকত। এখন নিজেরই বিশ্বাস হয় না। আর পাঁচজন শুনলে তাে গল্প কথা বলে উড়িয়ে দেবে।


আর একটা বিষয় এখন হারিয়ে গেছে। ভাবলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। এখন শীত পড়লেই ঘরে ঘরে হিটার.. ইচ্ছে হলেই গরম সিঙ্গাড়া অথবা চপ! কিন্তু আমার ছোটবেলা অন্যরকম আনন্দের ছিল। গ্রামে জনবসতি কম থাকায় ঠান্ডা একটু বেশীই পড়ে। ঠান্ডায় আমরা গায়ে খদ্দরের চাদর অথবা মা-র শাড়ী দু-ভাঁজ করে গায়ে জড়িয়ে ভাঙ্গা লােহার কড়াই-এ গাছের ডাল-পালা, ঘুঁটে, কাঠকয়লা এসব দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তার চারিদিকে বসে হাত পা সেঁকতাম। সঙ্গে অবশ্য কয়েকটা করে খেতের আলু নিয়ে সেগুলাে আগুনে পুড়িয়ে বেশ তৃপ্তি করে খেতাম। ঠাণ্ডা তখন আর ঠান্ডা মনে হত না। আজকে যদিও শীত থেকে রক্ষা পাবার অনেক উপকরণ আছে তবুও কেন মনে হয় শীতের সেই আমেজ বা মজা এখন আর পাইনে। অনেক কিছুই এখন খুঁজে পাইনা। আমার ছােটবেলায় দিনহাটার গ্রামে (যদিও মহকুমা) বসে সব ঋতুকে স্পষ্ট অনুভব করতে পারতাম। এখন তাে দু-তিনটে ঋতু টের পাওয়া যায়। আমার ছােটবেলায় খেতে ধান পাকলে স্পষ্ট বুঝতে পারতাম, হেমন্তকাল এখন ধান কাটা হবে, নবান্ন উৎসব হবে। রাস্তার ধারে মান্দার, অশোক, পলাশ গাছগুলাে লাল হয়ে ভরে থাকত। ধান কাটার পর নতুন চাষ করা খেতের পর খেত। ধূ.. ধূ.. করত। আর মাঝে মাঝে শুকনাে ঘু্র্ণী হাওয়া। এভাবেই বিভিন্ন ঋতু-বৈশিষ্ট্য অনুভব বা পরিবর্তনগুলাে দেখতে পেতাম। এখন সবই হারিয়ে গেল অথবা আছে দেখতে পাইনা। জানিনা একদিন সব ঋতুর বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গিয়ে শুধু নাম গন্ধ বর্ণহীন হয়ে কোন নতুন ঋতুর জন্ম হবে কি না?

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *