খ-এ খিচুড়ির ইতিহাস
সু ক ন্যা দ ত্ত
“বৃষ্টির গন্ধে অজানা আনন্দে ক্ষুধা দেয় মাথাচাড়া,
উদর বলে খাবনা কিছুই ভুনা খিছুড়ি ছাড়া|
চাল-ডাল উনুনে চড়িয়ে গা এলিয়ে দোলনা চেয়ারে
সেতার সরোদ আর গীটারের ফিউশনে
চলে যায় আনমনা মন অন্য ভুবনে;
সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি সর্বনাশ, একি!
সাধের আহার পুড়ে হারিয়েছে বাহার, হায়রে!”
খিচুড়ি খেতে আমরা প্রায় সকলেই ভালোবাসি। বর্ষা এলেই খিচুড়ির জন্য মন আনচান করতে থাকে।শুধু বর্ষা কেন, ঘরে রান্নার উপকরণ কম থাকলে নিদেন পক্ষে ডালে চালে খিচুড়ি রান্না করাই যায়।এই রসনাতৃপ্তি,উদরপূর্তির খিচুড়ির ইতিহাস টা একটু ভাগ করে নেই।
খিচুড়ি শব্দটি এসেছে, সংস্কৃত ” খিচ্চা” শব্দ থেকে যার অর্থ হলো চাল ও ডাল মিশ্রিত খাবার।
এই খিচুড়ির কথা নানান সময়ে নানান জায়গা থেকে জানা যায়।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ বই থেকে জানা যায়, প্রাকৃত শব্দ ‘কিসর/কৃসরা’ শব্দ থেকে ক্রমান্বয়ে খিচরি (রী/ড়ি/ড়ী) হয়ে খিচুড়ি শব্দের বিবর্তন হয়েছে। মিশ্রিত চাল, ডাল, ঘি ইত্যাদি দিয়ে রান্না করা খাবারই খিচুড়ি।
গ্রীক সম্রাট সেলুকাস ৩০৫ থেকে ৩০৩ খ্রিঃ পূর্বাব্দ সময়ে ভারত আক্রমনের সময় “খিসরি” নামে একটা খাবারের উল্লেখ করেন যেটি চাল ও ডাল সহযোগে তৈরি খাবার। মরক্কো পরিব্রাজক ইবন বতুতা ১৩৫০ খ্রিঃ ভারতের থাকাকালীন খিচুড়ি জাতীয় খাবার দেখেছিলেন।রাশিয়ার ব্যবসায়ী ও ভ্রমনকারী আফানাসি নিকটিন ১৪ শ শতকে ভারতে আসেন, সে সময় জাহাঙ্গীর ছিলেন মুঘল যুগের সম্রাট। তিনি তার লেখায় খিচুড়ি র কথা লিখেছিলেন।
মহাভারত এ পান্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় দ্রৌপদী সকলের জন্য খিচুড়ি রান্না করতেন। এমনকি, কৃষ্ণ হাঁড়ির একটি অন্নদানা গ্রহনের ফলে দূর্বাসা মুনির খিদে মিটে গিয়েছিলো, সেটি সম্ভবত খিচুড়ি ছিলো।
মুঘল যুগে নানান সময়ে খিচুড়ি র কথা জানা যায়।
হুমায়ুন কে তার বেগম হামিদা খিচুড়ি তৈরি করে খাইয়েছিল। আবুল ফজল রচিত আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে নানান রকমের খিচুড়ি র কথা লিখেছিলেন। আকবর বীরবলের বাঁশের উপরে হাঁড়ি বেঁধে নিচে আগুন জ্বালিয়ে রান্নার গল্পে বীরবল খিচুড়ি রান্না করছিলেন।জাহাঙ্গীর পেস্তা, কিসমিস মেশানো খিচুড়ি খেতেন, যার নাম দেন” Lazeezan”( delicious)বা লাজিজান।
ঔরঙগজেব এর খিচুড়ি এতই প্রিয় ছিলো যে রমদান মাসে তিনি প্রায়ই খিচুড়ি খেতেন। আলমগীরী সেই খিচুড়ি মাছ ও সিদ্ধ ডিম দিয়ে তৈরি হতো।বাহাদুর শাহ জাফর মুগডালের খিচুড়ি এতই ভালোবাসতেন যে সেই সময় মুগডাল বাদশাহ – পসন্দ নামে বিখ্যাত হয়ে গ্যালো।
রানী ভিক্টোরিয়া ভারতে থাকাকালে তার উর্দু ভাষার শিক্ষক আবদুল করিম ওনার স্ত্রীর হাতের নানা রান্নার পদ খাওয়াতেন। রানীর বেশি পছন্দ ছিলো মুসুর ডালের খিচুড়ি। এই ডাল তখন, মলিকা মুসুর নামে প্রচলিত হতে থাকে।
বৃন্দাবন থেকে সুদামা তার প্রাণের বন্ধু কৃষ্ণের সাথে দ্বারকায় দেখা করতে যাওয়ার সময় দুটো পুটলি তে খাবার নিয়ে গিয়েছিল। একটিতে ছিলো চিঁড়ে ভাজা অন্যটিকে ছিলো খিচুড়ি।
ফ্রান্স পর্যটক জেন- ব্যাপ্টিস্ট ১৬ শ শতকে ছয়বার ভারতে আসেন। তার লেখায় সবুজ ডাল, চাল ও ঘি দিয়ে তৈরি খিচুড়ি র উল্লেখ পাওয়া যায়।
১৯ শতকে আওয়াদ এর নবাব নাসির উদ্দীন শাহ্ এর দসতরখ্ওয়ান বা রাজকীয় রান্নাঘর প্রসিদ্ধ ছিলো পেস্তা, কাঠবাদাম সহযোগে খিচুড়ি রান্নার জন্য। বিদেশেও উনিশ শতকের ভিক্টোরিয়ান যুগে (১৮৩৭-১৯০১) খিচুড়ি ইংল্যান্ডের রান্নাঘরে জায়গা করে নিয়েছিলো। মোটামুটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি মিশরীয়দের মধ্যে “কুশারি” নামে একটি পদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটি তৈরি হতো চাল, ডাল, চানা, ভিনিগার, টমেটো সস, পেঁয়াজ, আদা, রসুন প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে। রন্ধনপ্রণালী হিসেবে এই কুশারীকেই খিচুড়ির ভিন্নরূপ বলা যেতে পারে।১২০০-১৮০০ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে বাংলায় খিচুড়ির আবির্ভাব। চালে ডালে গরিবের আমিষ বলা হলেও প্রথমদিকে ডাল ছিল অভিজাত শ্রেণির খাদ্য। তবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রন্ধনপটীয়সীরা বলেছেন-
“দই দিয়ে খিচুড়ি খাইতে মন্দ লাগে না। মনসামঙ্গল কাব্যে স্বয়ং শিব যে খাবারটি খাবার আবদার পার্বতীর কাছে জানিয়েছিলেন, তা হল খিচুড়ি।খিচুড়ি র নানা রকমফের লক্ষ্য করা যায়।
১. উত্তরপ্রদেশে পিকায়ন্ত খিচুড়ি।
২.হিমাচল প্রদেশের বালাই খিচুড়ি মুসুর, ধনে, মাখন, দুধ সহযোগে।
৩.উত্তরাখন্ডের গাড়ওয়ালি খিচুড়ি।
৪.হায়দ্রাবাদের নিজাম এর সময়ে কিমা খিচুড়ি।
৫.তামিলনাড়ু তে পোঙগল এর সময়ে খিচুড়ি।
৬.বাংলার ভুনা খিচুড়ি।
৭.কাটিহারের সবজি মিশ্রিত রাম খিচুড়ি,
৮.সুরাটের দুধের মাঠা দিয়ে তৈরি শোলা খিচুড়ি।
৯. রাজস্থানে মিলেট দিয়ে তৈরি মশলা খিচুড়ি,
১০.মহারাষ্ট্রে নারকেল, বাদম সহ বালাচি খিচুড়ি।
বৈদিক সাহিত্যে “ক্রসরন্ন ” শব্দটি পাওয়া যায় যা হয়তো খিচুড়ি কে ই বোঝায়।