আদরের চাদরে আঁকা স্মৃতিগুলো
কলমেঃ সু ক ন্যা দ ত্ত
কু ঝিকঝিক রেলগাড়ী চলে যায় বাড়ীটার পাশ দিয়ে। কয়লার কালো ধোঁয়া ছেড়ে যাওয়া বিরাট ইঞ্জিনটা মাথার উপরের নীল আকাশটাকে কালি মাখিয়ে দেয়। আমি মুড়ির বাটি হাতে হাঁ করে বারান্দা থেকে চেয়ে থাকি । এখানে চায়ের কাপের চুমুকে এফ এম রেডিও বাজে না। একটা খয়েরী রেল গাড়ীর হুইসল সময়ের জানান দিয়ে যায়। এখানে শীতের কুয়াশার চাদর সরলে দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা নিজের মাথা উঁচিয়ে দেখা দেয়।
ছবিটা জলপাইগুড়ির আদর পাড়ার বাড়ীর। মনের আকাশে স্মৃতি ছবি আঁকার জন্য রঙ তুলি ধরে। তখন ও আমার জন্ম হয়নি। পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান দেশভাগের আগে ১৯৬৪ সালে রঙপুর নীলফামারির ভিটে মাটিতে গড় প্রণাম ঠুকে
কোচবিহারের বর্ডার পেরিয়ে জলপাইগুড়ি আসেন আমার মায়ের পরিবার। আমার দাদু ওনার মা, ভাই বোন, স্ত্রী, কন্যাসহ এপারে এসে প্রথমে জলপাইগুড়ির আদর পাড়ায় বাড়ী কেনেন। এপারের মানুষ চিরকাল তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ” রিভিউজি” তকমা দিয়ে গেছে বাস্তুহারা শিকড়হীন ওপার বাংলার মানুষগুলোকে। তবু এদেশে এসে খাবার জন্য, বাঁচার তাগিদে লড়াই করে নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় করেছে এই মানুষগুলো। পরে অবশ্য আমার দাদু হলদিবাড়ীতে বসত বাড়ী কিনে বসবাস শুরু করেন। ওনার দুই অবিবাহিত বোন ও এক দাদা রয়ে যান আদরপাড়ার বাড়ীর আঁচলে।
আমি যে সময়ের কথা বলবো, সেটা ৯০ এর দশক।
স্মৃতির কাঁচে জমে থাকা কুয়াশাকে মুছে আজ অতীতে যাওয়ার চেষ্টা করতে বসেছি। আমি তখন অনেক ছোট। মায়ের হাত ধরে পুজোর ছুটিতে দার্জিলিং মেলে চেপে প্রতি বছর কয়েকদিন ছুটি কাটাতে যেতাম জলপাইগুড়ির আদর পাড়ার বাড়ীতে। তখন সে বাড়ীতে থাকতেন মায়ের ফুল পিসি ও সেজ পিসি। আর থাকতেন আমার মায়ের ডাক্তার জেঠু। বাড়ীতে সব সময় অতিথি সমাগম লেগেই থাকতো।
এ বাড়ীর দাওয়ার সামনে বেড়ার উঁচু পাঁচিল। তার ওদিক দিয়ে চলে গেছে সমান্তরাল রেল লাইন।
বাড়ীর বা দিকে সিগন্যাল পোষ্ট। সারাদিন লাল বাতি জ্বলার পর সবুজ বাতি জ্বলে উঠলেই বুঝতে পারতাম, ট্রেন আসার সংকেত । রোজ ট্রেন যেতো সকাল আটটায়, দুপুর বারোটায় আর বিকেল পাঁচটায়। হলদিবাড়ি টু নিউ জলপাইগুড়ি। আবার সেই ট্রেন ফিরে আসতো ওদিক থেকে। মাঝে জলপাইগুড়ি। সকালে রেলের কামরার জানলায় ধারে বসে থাকা লোকগুলোকে দেখে আমি হাত নাড়তাম। পরিচয়হীন মানুষগুলোকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য পরিচয়ে বাঁধার চেষ্টা করতাম। এই সখ্যতায় পরিচয়টা তেমন আবশ্যক ছিলো না। তারপর রেলগাড়ী থামতো কয়েক হাত দূরের স্টেশনে। আদর পাড়ার বাড়ী থেকেই স্টেশন দেখা যেত। হুড়মুড়িয়ে লোক নামতো। তারপর ঢং ঢং করে দুটো ঘন্টা বাজতো। সবুজ পতাকার সংকেত পেয়ে রেলগাড়ী আবার দৌঁড় লাগাতো।
সময় এগিয়ে গেলে নতুন ঘটনার জোয়ার লাগে পুরোনো ইতিহাসে। বর্তমান সময়ের কথা সময় পেরোলেই গল্প হয়ে দাঁড়ায়। মায়ের দুই পিসি আমার সেজদিদা আর ফুল দিদা। চিরকাল ওনাদের দেখেছি সরু কালো পেরে সাদা শাড়ীতে। সারা শরীরে রঙের ছাপ বলতে কেবল পান খাওয়া লাল টুকটুকে দুটি ঠোঁট। ফুল দিদা ছিলেন বাংলায় এম. এ আর সেজদিদা সেই সময়ের বি. এস.সি পাশ। ওনাদের ব্যক্তিত্ব, স্নেহপরায়নতা, মমতায় আমরা ডুবে থাকতাম।
এ বাড়ীতে ঢোকার পথে টিনের সরু গেট। সেটা ঠেললেই বাড়ীর ভিতর এক ফালি উঠোন। ওখানে রোদের আলো তেমন খেলতো না। দরজার পাশে লাল জবা ফুলের দুটো গাছ। তাতে ঝাঁক ভর্তি ফুলে ভরে থাকতো।তারপর পাঁচটা সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই বারান্দা। লম্বা বারান্দার গায়ে পর পর ঘর। বারান্দায় পর পর তিনটে কাঠের চেয়ার পাতা। তাতে ফুলদিদার হাতে বোনা আসন পাতা। বারান্দার সামনে শান বাঁধানো কুয়োতলা আর স্নানঘর। কুয়োতলার বাম পাশে কামিনী ফুলের গাছ আর ডানদিকে স্নান ঘর। আর ও ওপাশে কয়লা রাখার ঘর। প্রতিদিন সেই ঘর থেকে কয়লা এনে উনানে চাপিয়ে আগুন জ্বালানো হতো। কুয়োর চাতালে একটা পোড়া মাটির বিরাট চারি রাখা থাকতো। বাজার থেকে জিওল মাছ আনা হলে মাটির চারিতে শিঙি, মাগুর, শোল, কই ঢেলে দেওয়া হতো। এ বাড়ীর কুয়োটা আমার মনে রহস্যকে উস্কে দিতো। কুয়োর ভিতর কালো কুচকুচে টলটলে জলের দিকে তাকালে মনটা শীতল হয়ে গেলে ও এক অজানা ভয়ে গা ছমছম করতো।মনে হতো কুয়োর ভিতর অনেক নীচে অজানা একটা অন্ধকার জগৎ আছে। বিদ্যুতের তার সেই অবধি পৌঁছায়নি। ওখানে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলে আর ফিরে আসার কোনো উপায় নেই। ঠিক সেই সময় মা কে হারানোর ভাবনায় মন কেমন করে উঠতো। ছুটে চলে আসতাম বাড়ীর বারান্দায়, মায়ের কাছে। লুকিয়ে মায়ের আঁচলটা ধরে বসে থাকতাম।
মাটির চারিতে প্রতিদিন জল ভরতো চারু মামা। চারু মামা ও বাড়ীর কাজের লোক, সদা হাস্যময়। সে আনন্দে ও হাসে আবার কেউ বকলে ও হাসে। চারু মামার মুখ দেখে কখন ও সুখ- দুঃখের পার্থক্য করতে পারিনি। জীবনে জটিলতার সাথে তার কোনোদিন কোনো সখ্যতা ছিলো না। পড়াশোনা না জানলেও ভীষণ বিশ্বস্ত ছিলো চারু মামা। চারু মামার বাবা, মা আর বোন থাকত তিস্তা পাড়ে। আর নিজের পরিবার ছেড়ে সে থাকতো এ বাড়ীতে। চারু মামা ছিলো আমাদের কাছে সরলতার নিপুণ চাবিকাঠি। জলপাইগুড়িতে একবার ভূমিকম্প হলে চারু মামা লাফিয়ে উঠে বলেছিলো,
” ভূঁইকাপ হচ্ছে, ভূঁইকাপ।”
সে কথা শুনে আমাদের সে কী হাসি।
কদমছাট চুল, চাপা নাক আর ছোটো দুটো চোখে দায়িত্বশীল চারু মামা এ বাড়ীর সকল কে আপন করে নিয়েছিলো।
আমার জন্মের বহু আগের কথা। মায়ের মুখে শুনেছি ১৯৬৮ সালের বিধ্বংসী বন্যায় জলপাইগুড়ি ভেসে যাবার জোগাড়। হু হু করে তখন তিস্তার জল শহরের রাস্তা ঘাট, ঘর, বাড়ী গিলে খাচ্ছে। আদর পাড়ার বাড়ীর উপরে টিনের চাল। সেখানে তৃতীয় ঘরের চাল লাগোয়া একটা খুপরি ঘর ছিলো। চিলেকোঠার সংস্করণ বলতে যা বোঝায়। ঘরের আসবাবপত্র উঁচু করার পর ও যখন জলের সাথে পাল্লা দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়লো, তখন মই খাটিয়ে কয়েকটা বাসনকোসন আর স্টোভ নিয়ে সকলকে খুপরি ঘরে ঠাঁই নিতে হয়েছিলো। ভয়ংকর সে বন্যা। রাক্ষসী রানী শহর কে নিজের পেটের ভিতর পুরে ফেলতে চায়। কিছুতেই তার খিদে মেটে না। গরু, মহিষ ভেসে যায় জলের তোড়ে। মানুষের ঘরের ছাউনি, জিনিসপত্র সব একে একে চলে যায় নদীর বুকে। খুপরি ঘরে দিন রাত থাকা আর খিচুড়ি খাওয়া, এই ছিলো বন্যার দিনগুলোর রোজনামচা। কোথায় তখন রেললাইন? সব তলিয়ে গেছে জলের নীচে। জলপাইগুড়ি শহর তখন রূপকথার গল্পে রাক্ষসপুরীর মতো জলের তলায় আর একটা রাজ্য তৈরি করেছে। তার সাথে ক্রমাগত বৃষ্টি শহরকে বিশ্রাম নিতে দিচ্ছে না। তারপর ধীরে ধীরে বন্যা কমলে মৃতপ্রায় শহরের আনাচে কানাচে ফসিলের সমাধি চোখে পড়ে।জলপাইগুড়ি বর্ষায় তিস্তার জ্বরে কাবু হয়। শহর জুড়ে জল হাঁটু ছোঁয়। টানা বৃষ্টিতে চারদিক ঝাপসা লাগে। রাগে ফুঁসতে থাকা তিস্তা বন্যা আনে এই শহরে। আমি বহুবার তিস্তা পারে গিয়েছি। নদীর পারের মানুষগুলোর বৃন্তান্ত বড়ো বিচিত্র। বর্ষায় ঘর হারানো মানুষগুলো শুকনো সময়ে আবার গুটি গুটি পায়ে এখানেই ঘর বাঁধতে আসে।
বর্ষায় শহরে জল বাড়লে চারু মামা হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে বাজারে যেতো। ফুলদিদা পইপই করে বলে দিতেন,
” চারু, টাটকা বোরলি কিংবা কাজলি মাছ পেলে তবেই আনবি। আর ধনে পাতা আনবি মনে করে।”
চারু মামা বাজার থেকে ব্যাগ ভর্তি বোরলি মাছ আর কাজলি মাছ এনে বটি দিয়ে কাটতে বসে যেতো। কয়লার ঘর থেকে একমুঠো ছাই এনে মাছ কাটতে কাটতে বলতো,
” ভালো মাছ পেয়েছি। একদম টাটকা।”
আমার ছেলেমানুষ এই মনটায় মাংস খাওয়ার লোভ উঁকি মারলে ও বাঙালির বাঙালিয়ানা যে মাছে আর ভাতে তা মনে করিয়ে দিতেন ফুলদিদা। জলপাইগুড়িতে গরমকালে সকাল বেলা দুধ,আম, কাঁঠাল, মুড়ি দিয়ে খাওয়া সারা হতো। তারপর আমার মা আর ফুল দিদা মিলে দুপুরের রান্নায় জুটে যেতো। এখানকার মডিউলার কিচেনের কাছে তখনকার রান্নাঘর বড়ই সেকেলে আর ছিমছাম। ঘরের ভিতর উনুন আর স্টোভ। পাশে শিল নোড়া, মশলার কৌটো আর খানিক বাসন কোসন। দেওয়ালে ঝোলানো থাকত বাজারের ব্যাগ । পাশে হাতা খুন্তি আর তার নীচে শাক সবজীর ঝুড়ি। কিচেন চিমনির ধোঁয়া নিয়ন্ত্রনের আভিজাত্য পেরিয়ে কয়লার ধোঁয়া মাখা এই রান্নাঘর রান্নার সময়ে আমার মা আর ফুলদিদার সাংসারিক গল্পের আসর। রান্না করে স্নান সেরে ফুলদিদা বারান্দায় আসন পেতে খাবারের আয়োজন করতেন। সেজদিদা তখন ঠাকুর ঘরে। পঞ্চমুখী জবা ফুল সাজিয়ে পুজো করতে করতে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে যেতেন।সকলের হাতের কাজ সারা হলে একসাথে খেতে বসতাম। তারপর কাঁসার থালায় বেলী ফুলের মতো সাদা নরম গরম ভাত, ডাল, কুমড়ো ভাজা, কালো জিরে কাঁচা লঙ্কা ধনে পাতা দিয়ে কাজলি আর বোরলি মাছের ঝোল আর আমের টক সকলের পাতে পরিবেশিত হতো। একবার সেজ দিদার হাতে তৈরি পিঁয়াজকলি আর বেগুণ দিয়ে মাছের চচ্চড়ী খেয়ে ছিলাম। আহা সে স্বাদ আজ ও মুখে লেগে আছে। আদর পাড়ার বাড়ীতে আর একটা মাছ খেয়েছিলাম বেশ মনে পড়ে, চাপলি। এসব চেটেপুটে খেয়ে মন ভরে যেতো।
এ বাড়ীর প্রতিটা ঘরের সাথে আমার একটা নিজস্ব গল্প আছে। ঘরগুলো মনে পড়লেই অতীত নিজের ঝাঁপি খুলে বসে। বাড়ীর প্রথম ঘরটা আমার কাছে সবচেয়ে মায়াবী। ওটা ছিলো বড় মামার ঘর। সমস্ত ঘর জুড়ে কাঁচের আলমারী আর তাতে ঠাসা ঠাসা বই। ইন্দ্রজাল কমিক্সের গোটা দুনিয়া এখানে ঠাঁই পেয়েছে। আদর পাড়ার বাড়ী গেলে আমি কাঁচের আলমারি খুলে বই বের করে পড়তে বসে যেতাম। নতুন আর পুরোনো বইয়ের গন্ধে ঘর ম ম করতো। বড় মামা খুব ভালো ছবি আঁকতেন।আমরা আদর করে ডাকতাম বমমামা। সারা ঘরে মামার আঁকার রঙ- তুলি, ছবি আঁকার কাগজ। এ ঘরে দুটো জানলা ছিলো। আর তার পাশে ছিলো দুটো খাট। উত্তরের জানলার পাশেই একটা স্বর্ণচাপা গাছ ছিলো। ফুলের সুবাস ঘরটাকে আগলে রাখতো।
তার পরের ঘরটা ঠাকুর ঘর। একফালি ঘরে ঠাকুরের আসন আর জামাকাপড় রাখার আলনা। এই ঘরটা ধূপ কাঠির সৌরভ মাখা।
তৃতীয় ঘরের ঢুকলেই চোখে পড়তো দেওয়াল জুড়ে সারদা মা, রামকৃষ্ণের ছবি। ফুল দিদা আর সেজদিদা রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিত ছিলেন। দেওয়ালে ছবিতে রক্ত জবা ফুলের মালা ঝোলানো।এই ঘরে রাখা পানের ডিবা থেকে জর্দা আর চমন বাহারের মিষ্টি গন্ধে এই ঘরটা জীবন্ত হয়ে থাকতো। এর পাশেই ছিলো সরু একফালি রান্নাঘর।
শেষ ঘরটায় ডাক্তার দাদু থাকতেন। ভীষণ গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। রোগী দেখে বাড়ী ফিরে সারাদিন ওই ঘরে বসে বই পড়তেন। ঘর থেকে তেমন একটা বেরোতেন না। অবিবাহিত সাংসারিক জীবন বিমুখ দাদু কে আমি খুব ভয় পেতাম। ডাক্তার দাদুর ঘরটা আমার কাছে ছিলো আতঙ্কের। তার কারণটা অবশ্য বেশ অদ্ভুত। দাদুর অনুপস্থিতিতে আমি একদিন ওই ঘরে ঢুকেছিলাম। ঘরের ভিতর জিনিস বলতে একটা খাট আর একটা টেবিল। সবুজ রঙের টেবিল ক্লথ পাতা সেই টেবিলের উপর বইপত্রের পাশে একটা টিফিনবাক্স রাখা ছিলো। আমি সেই বাক্সের ঢাকনা সরিয়েই আৎকে উঠেছিলাম। বাঁধাই করা দুই পাটি দাঁত। সেই বয়সে নকল দাঁতের বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিলো না। তাই ওগুলো দেখে মনে হয়েছিলো, এ নেহাৎ কোনো রাক্ষসের দাঁত, খুলে রেখে গেছে। ছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম।। তারপর থেকে সেই ভীতি আমায় তাড়া করে বেড়াতো। এরপর যতবার আদরপাড়ার বাড়ীতে গেছি, ওই ঘরের ত্রিসীমানাতে ও ঘেঁষিনি।
জলপাইগুড়ি শহরের পাড়া আর রাস্তার মোড়ের নামগুলোয় ভারী সুন্দর। আদরপাড়া, পান্ডা পাড়া, আশ্রম পাড়া, মহামায়া পাড়া, অনন্ত পাড়া, রায়কত পাড়া, বেগুনটারি মোড়, কদমতলা, তিন নম্বর ঘুমটি, চার নম্বর ঘুমটি আর ও কত কী। নামের বৈচিত্র্য ভৌগোলিক বৈচিত্র্যকে ও হার মানায়।
আদর পাড়ার কাছেই আশ্রম পাড়া। মা সারদার আশ্রমের নামানুসারে ওই পাড়ার নাম আশ্রম পাড়া।
আদর পাড়ার বাড়ীর সামনে রেললাইন গেট পেরিয়ে আশ্রম পাড়ায় যেতে হতো। সন্ধ্যার আরতি দেখতে আশেপাশের পাড়া থেকে অনেকে আসতো। আশ্রমে পাঁচদিন ব্যাপী দুর্গাপুজোর প্রধান আকর্ষণ হলো কুমারী পুজো। অষ্টমী পুজোর দিন লাল বেনারসী পড়িয়ে কুমারী মেয়েকে বরণ করে ধূমধাম করে পুজোর সকল নিয়ম চলতো। যুবতী মেয়েরা রঙ বাহারি শাড়ী, গয়নায় সেজে অঞ্জলি দিতে আসতো আর ছেলেরা স্বপ্নালু নয়নে জুলজুল করে চেয়ে থাকতো। রেল গেটের ওপারটা আমার কাছে ছিলো অচেনা রাজ্য। এ পার থেকে যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এখন ট্রেনের জানলা থেকে স্মৃতি বিজরিত আদর পাড়ার বাড়ীর প্রাণহীন অবয়বটা চোখে পড়ে। ফুল দিদা,সেজদিদা, বমমামা সকলে গত হয়েছেন। তারপর সে বাড়ীর মালিকানা বদল হয়েছে। কারা ও বাড়ীতে থাকেন সে বিষয়ে আমরা অজ্ঞাত।
মনে কেবল কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। সে বাড়ীর পড়ার ঘরে এখন কারা বাস করে? কুয়োতলায় স্নানঘরের সামনে সেই মাটির চারিটা কী আজ ও আছে? আজ ও কী লাল জবার গাছ দুটো বাঁচিয়ে রাখার জন্য কেউ জল দেয়? চারু মামা এখন কোথায় থাকে? বন্যা এলে চারু মামার পরিবার কোথায় যায়? জানা নেই। এসব ভাবলে আমার দু গাল বেয়ে শুধু জল পড়ে। সময় খুব অদ্ভুত। সে চলে গেলে ও মায়া রেখে যায়। মানুষ বাসা বদলায়, দেশ বদলায়। ভাসমান জীবনে পুরোনো স্মৃতিগুলো সম্বল হয়। খড়কুটো আগলে বেঁচে থাকার মতো এগুলো আগলে বেঁচে থাকে। এতো শুধু দেশ বদল নয়, বদলির চাকরী কিংবা ভাড়া বাড়ীতে থাকা মানুষ এমন অভিজ্ঞতা নিয়েই দিনপাত করে। নস্টালজিয়া মন কে শীতল করে দেয়।