সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা আধুনিক কবিতার বিস্ময়
হী র ক ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
পাঁচের দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় …তিনিই লিখতে পারেন …শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম,শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধ্যাবেলা এই ভুবন পেরিয়ে আসা …শুধু কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি …
বাংলা কবিতাকে মেদ মুক্ত করা ,ঝরঝরে কথ্য ভাষা ব্যবহারের স্পর্ধা দেখানো ,হালকা শব্দের
মধ্যেও মায়া তৈরীর কৌশল ,মৌলিক চিত্রকল্প বাক্যবিন্যাসে অভিনবত্ব বাংলা ভাষার পাঠককে
মুগ্ধ করেছিল ..যেমন
প্রতিটি আত্মার সঙ্গে আমার নিজস্ব ট্রেন …অসময় নিয়ে খেলা করে …
কিংবা
জাদুঘরে, অজস্র ঘডিতে আমি অজস্র সময়
লিখে রাখি…
অথবা
সুখ,সুখ নয় পাপ ,পাপ নয় দোলে দোলে না
ভাঙে ,ভাঙে না,…..দৌডতে দৌডতে …..…….
একদিকে তার সমাজ ভাবনার কবিতা,অন্যদিকে তার নীরা সিরিজের
কবিতাগুলি একের পর এক মুগ্ধ করে গেছে
পাঠের পর বেশ কিছক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয় …
তখন আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে এক অসম্ভবের জগৎ ,যারা ষডরিপু ছুঁল না অসম্মানে,দুখ সুখের আনন্দ বেদনার রোমাঞ্চ সঙ্কুল যে মরণ বরফের মতো সাদা অথচ আছে
বলেই জীবনের এই জয়গান
এই কবিই এক জায়গা লিখেছেন ..
“অপরের কবিতা পাঠ করার সময় আমি শুধু একজন বিনীত নম্র ও উদগ্রীব পাঠক ,এবং
নিজস্ব আবেগ ও বাসনার সঙ্গেই কবিতাকে ,মেলাতে চাই…তাছাডা কবিতার কাছে আর কী দাবি করব ?”
সুনীল সারাটা জীবন স্বর সৌন্দর্য এবং সত্তার সন্ধান করে গেছেন ,সর্বদা নিজেকে সজ্জিত করেছেন কবিতার জন্য..নিজেকে সদা জাগ্রত রেখেছেন খুুঁডেখুুঁডে তীব্র অনুভুতি এবং প্রজ্ঞার দ্বারা ,বাংলা কবিতার ঐশ্বর্য প্রতি মুহূর্তেে অনুপ্রেরণাময ,তার সজাগ উপস্থিতি তরুণ কবিদের এখনো প্রাণিত করে …
যখন তিনি লেখেন– “আমার ভালবাসার কোনো জন্ম হয় না…কেননা আমি অন্যরকম ভালবাসার হীরের গয়না ,শরীরে নিয়ে জন্মেছিলাম…আমার কেউ নাম রাখে নি …”
তিনটে চারটে ছদ্মনামে …আমার ভ্রমণ মর্ত্যধামে …আগুন দেখে আলো ভেবেছি ,আলোয আমার হাত পুডে যায়…অন্ধকারেে মানুষ দেখা সহজ ভেবে ঘূর্ণিমাযায় …অন্ধকার মিশে থেকেছি ,কেউ আমাকে শিরোপা দেয়,কেউ দুচোখে হাজার ছি ছি …তবুও আমার জন্মকবচ ভালবাসাকে ভালবেসেছি …আমার কোনো ভয়
হয়না …আমার ভালবাসার কোনো জন্ম হয় না ………
সুনীলের অধীত জ্ঞান,মনীষিতা আলাপনৈপুন্য ,অসাধারন প্রফুল্লতা সামাজিক বৈদগ্ধ্য লেখক এবং ঔপন্যাসিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি কবি
এটিই তার একমাত্র শনাক্তকারী পরিচয় প্রমাণ হিসেবে প্রকাশ করতে ভালবাসতেন …
সংবেদনশীল সৌন্দর্যের অপমান যখন প্রাযশই বাংলা কবিতার ভুবনকে কালোআঁধারে পর্যবসিত করতে চাইবে তখন সুনীল গাঙ্গুলির রচনা বাংলা কবিতার পাঠককে পথ দেখাবে ..
আমরা যে সভ্যতাকে ধ্বংস করি,সেই সভ্যতাকে আমরাই গড়ে তুলতে সম্মুখীন হয়েছি।তিনি ই বলতে পারেন:
….আমি ই সেই মানুষ আমাকে চেয়ে দ্যাখো
আমি ফিরে এসেছি
আমার কপালে রক্ত
বাষ্প-জমা গলায়, বাস ওল্টানো ভাঙা রাস্তা দিয়ে ফিরে এলাম—-
আমি মাছহীন ভাতের থালার সামনে বসেছি
আমি দাঁড়িয়েছি চালের দোকানের লাইনে
আমার চুলে ভেজাল তেলের গন্ধ
আমার নি:শ্বাস……
কিংবা যখন সুনীল বলেন:
…আমার গলা পরিষ্কার ,আমি স্পষ্ট করে কথা বলবো
সমস্ত পৃথিবীর মেঘলা আকাশের নিচে দাড়িয়ে
একজন মানুষ
ক্রোধ ও কান্নার পর স্নান সেরে শুদ্ধভাবে
আমি
আজ উচ্চারণ করবো সেই পরম মন্ত্র
আমাকে বাঁচতে না দিলে এ পৃথিবীও আর বাঁচবে না……
অন্যত্র তার ঋজু কন্ঠ শুনতে পাই:
…একজন মানুষ আর একজন মানুষকে বলে,
রক্তপাত ছাড়া পৃথিবী উর্বর হবে না….
এবার আমরা তুলে ধরবো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই অমোঘ কবিতার কিছুটা অংশ:
.…..একদিন কেউ এসে বলবে
তোমার বসবার ঘরে আমার একটা চৌকি পাতবার জায়গা আছে
আমি ঐখানে আমার খাটিয়া এনে শোবো
আমার গাছতলা আর ভাল্লাগেনা
একদিন কেউ এসে বলবে
তোমার ভাতের থালা থেকে আমি তিন গ্রাস তুলে নেবো
কারণ আমার কোনো থালাই নেই
আমার অনাহার একঘেয়েমির মতো
ধিকধিক করে জ্বলছে
আর আমার ভাল্লাগে না।…
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এককথায় বাংলা
কবিতার আত্মীয়।কবি শঙ্খ ঘোষকে যদি
পেলের সঙ্গে তুলনা করা যায় তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিশ্চিত ভাবে মারাদোনা।
একসময় পঞ্চাশের দশকের কবিরা
বিশেষতঃ সুনীল শক্তি অলোকরঞ্জন শঙ্খ তারাপদ উৎপলকুমার শরৎকুমাররা
মধ্য রাতের কলকাতাকে শাসন করেছেন।কিন্তু পু্রোভাগে সবসময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
তার সহবত,স্বভাবসুলভ উদারতা পান্ডিত্য
টাওয়ারিং পার্সোনালিটি এবং সর্বোপরি নেতৃত্ব
দেবার ক্ষমতা সকলকে মুগ্ধ ই শুধু করেনি,দিনে দিনে আস্থাভাজন করে তুলেছে।
পরবর্তী কালে সম্পাদক হিসেবে ও তিনি ভিন্ন ঘরানার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।
যদিও খুব অল্প বয়স থেকেই কৃত্তিবাস সম্পাদনা তার এই অভিজ্ঞতাকে পুষ্টি জুগিয়েছে।
এমনকি বাংলা প্রকাশনা জগত ও ছিল তার হাতের মুঠোয়।যখন প্রকাশকরা মন্দার মধ্যে পড়ত তখন তাদের আশ্রয় ছিল সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং শঙ্খ ঘোষ দুজন দুই মেরুর হ ওয়া সত্ত্বেও তাদের বোঝাপড়া এবং সহবৎ ,শ্রদ্ধার সম্পর্কটি যে কোনো অনুজ কবির
সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করার মতো।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর আগে যে শেষ সংখ্যা সম্পাদনা করেন তাতে কৃত্তিবাসের যুদ্ধ নামে যে প্রবন্ধটি লেখেন, তাতে শঙ্খ বাবু র
কলম যেন সত্তর বছর আগের সেই সময়ের কবি সম্পাদক এবং রুচিশীল মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।
এতক্ষন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে আমরা
যে তথ্য এবং তার কবিতা সম্পর্কে বক্তব্য
রেখেছি তাতে মূলত:তার সমাজভাবনার
দিকটায় তুলে ধরা হয়েছে।
নীরাকে বাদ দিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কখনো সম্পূর্ণ হতে পারে না পাঠকের হৃদয়ে।
….মাঝে মাঝে কী চমৎকার আড়াল
আমি তোমাকে দেখতে পাই না
নীরা ,তুমি সুদূরতম নৌকায় একা,ছড়িয়ে দিয়েছ দুই ডানা
আমি দুরন্ত মেলট্রেনে বসে একটাও স্টেশনের নাম পড়তে পারছি না…
লাল চুল ওয়ালাদের ক্যামেরা এখনো ঘুরছে গলি ঘুজির আনাচে কানাচে
কেউ আর ভালবাসার কথা বলেনা
মানুষের সভ্যতা ভালবাসার কথা শুনলেই
হাহা হিহিতে ফেটে পড়ে
বাথরুমে মুখ ধুতে গিয়ে কেউ একা একা
কাদে আর
জলের ঝাপটা দেয়
নীরা,আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে
হারিয়ে যেওনা
নীরা ,অমৃত খুকি, হারিয়ে যাস নি।
★অংশ- নীরা,হারিয়ে যেও নাঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
রোমান্টিক ভাবনার ঈশ্বর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
যখন লেখেন:
…লুকিয়ে রেখোনা কোনো গোপন সিন্দুকে
কিংবা লিখোনা দলিলে
না দিলে থাকে না কিছু
ভালবাসা ডুবে যায়
স্বখাত সলিলে….
অংশঃ “যৎসামান্য” সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সুনীল যে সুনীল একথা বুঝতে আরো কমপক্ষে
পঞ্চাশ বছর লাগবে বাঙালি পাঠককে।অক্ষর বৃত্তের উপর এমন অদ্ভুত কাজ খুব কম
কবির কাব্যে পরিলক্ষিত হয়।
আর ও একটি কথা না বললেই নয়, তা হল শব্দ চয়নের গভীরতা ।এবং এতবড়ো ভার্সেটাইল
প্রতিভা বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনাতেও দুর্লভ।
এই রচনায় তার অপরিচিত লেখা গুলির দিকে ই মূলত: দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি।এবং যেসব লেখা তার পাঠকের মুখে মুখে পঠিত এবং আবৃত্তির আসরগুলিকে মন্ডিত করে রাখে
সেগুলি থেকে ও দূরে থাকার চেষ্টা করছি মাত্র।