গানের বাগান ও ঘরানার ঘর(চার)- লিখছেনঃ সুকন্যা দত্ত

সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

[contact-form][contact-field label=”Name” type=”name” required=”true” /][contact-field label=”Email” type=”email” required=”true” /][contact-field label=”Website” type=”url” /][contact-field label=”Message” type=”textarea” /][/contact-form]

গানের বাগান ও ঘরানার ঘর(চার)

সু ক ন্যা   দ ত্ত

খেয়ালঃ

“খেয়াল “শব্দটির অর্থ কল্পনা, চিন্তা বা প্রভাব।অনেকেই মনে করেন ভারতবর্ষের খেয়াল সঙ্গীতের সৃষ্টি হয়েছে আরব কিংবা পারস্য সঙ্গীতের প্রভাব থেকে।১৩ শ শতকের সঙ্গীত রত্নাকর’ গ্রন্থে এই গানের বর্ণনা পাওয়া যায়।সেখানে খেয়াল সঙ্গীত কে রূপক আলাপ্তি বলা হয়েছে।

         খেয়াল গানের জন্ম নিয়ে নানান কাহিনি প্রচলিত আছে। কার ও মতে, খেয়াল গান এসেছে প্রাচীন ভারতের ‘প্রবন্ধ সংগীত’ থেকে যদি ও প্রবন্ধ সংগীতের সঠিক ধারণা আমাদের জানা নেই। আবার কার ও মতে,এ চোদ্দ শতকে খেয়াল গান সৃষ্টি করেছেন আমীর খসরু
অপর পক্ষের ধারণা ‘কাওয়ালি গান’ থেকে খেয়ালের উদ্ভব। খেয়াল কথাটাও এসেছে কাওয়ালি থেকে—কাওয়ালি> খাওয়ালি> খাওয়াল> খেয়াল।
আর-একটা মত হলো: দিল্লির বাদশা মোহাম্মদ শাহ রঙ্গিলের দরবারে প্রধান গায়ক ছিলেন তানসেনের মেয়ের ঘরের এক অধঃস্তন পুরুষ—নিয়ামৎ খাঁ ওরফে সদারঙ্গ। তিনি নাম-করা ধ্রুপদ গায়ক ছিলেন। কিন্তু তাঁর ধ্রুপদ গান শুনতে শুনতে বাদশার বিরক্তি ধরে যাওয়ায় তিনি নিয়ামৎ খাঁকে বিতারিত করেন। এরপর তিনি ধ্রুপদের সংস্কার করে, তাকে পরিবর্তন করে খেয়াল গান সৃষ্টি করলেন। তিনি তার শিষ্যদের গান শিখালেন। তাঁরা গিয়ে সে গান শোনালেন বাদশাকে। বাদশা শুনে ভারী খুশি হলেন। তিনি তখন নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। সদারঙ্গের পুত্র—কারও কারও মতে—ভাইপো ফিরোজ খাঁ ওরফে অদারঙ্গ খেয়ালকে আরও সুন্দর করে তৈরি করলেন। খেয়াল গান তখন ধ্রুপদের জায়গা দ্রুত দখল করে নিলো এবং তা ছড়িয়ে পড়লো অন্য গায়কদের মধ্যে।
গায়কদের সংখ্যা বাড়লে খেয়াল গাইবার ঢঙে এক-এক রকমের বৈশিষ্ট্য দেখা দিলো। এক-এক জায়গার গায়কদের এক এক ধরণের গায়ন শৈলী তৈরি হলো।এই শৈলী হয়ে উঠলো ঘরানা।
খেয়াল ঘরানার প্রাচীনতম ঘরানা হলো গোয়ালিয়র ঘরানা। এই স্থানের প্রতিটি কোণায়, শিশুর ক্রন্দনে ও সুর মিশে আছে।ওস্তাদ নাথান পীর বক্স কে খেয়াল গানের গোয়ালিয়র ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।পরবর্তীকালে হাসু খান ও হাদ্দু খানের হাত ধরে এই ঘরানা বিস্তার লাভ করে।নাথান পীর বক্স তার পিতা ওস্তাদ মক্ষান পীর বক্সের মতো গোয়ালিয়রের রাজ গায়ক ছিলেন এবং তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন।তিনি ছিলেন রাজা দৌলত রাও সিন্ধিয়ার সঙ্গীত শিক্ষক।এই ঘরানার বিখ্যাত গায়করা হলেন বড়ে ইনায়ত হুসেন খান,ওস্তাদ কুরবান হুসেন খান, বিষ্ণু দিগম্বর পালুস্কর,রেহামত আলী খাঁ প্রমুখ।

      তাজমহলের শহর আগ্রার আনাচে কানাচে সুরের তরঙ্গ বয়ে যায়।১৩০৭ সালে তৎকালীন দেব গিরি বর্তমান দৌলতাবাদের রাজা রামচন্দ্র কে যুদ্ধে হারিয়ে রাজ্য দখল করেন। এরপর আমীর খসরুর পরামর্শ ও শর্ত অনুযায়ী রাজা রামচন্দ্রকে তার সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে তার সভার গায়ক নায়েক গোপাল কে দিল্লী নিয়ে যান। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গায়ক নায়েক গোপাল দিল্লীতে গায়নের যে পদ্ধতির সূচনা করেন,তাইই নওহর বানী।নায়েক গোপালের সুযোগ্য শিষ্য সুজন দাস আকবরের রাজসভায় গায়ক ছিলেন। আকবর ওনার গানে এতই সন্তুষ্ট ছিলেন,যে সুজন দাস কে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে তার নাম দেন হাজী সুজন খান। হাজী সুজন খান আগ্রা ঘরানার একজন সম্মানীয় গায়ক ছিলেন।খেয়াল গায়ন শৈলীর মধ্যে ধ্রুপদ ও ধামারের মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। ঔরঙ্গজেবের সময়ে মুঘল দরবারে ছিলেন হাজী সুজন খানের বংশধর দয়াম খান ওরফে সরস রঙ।। কিন্তু ঔরঙ্গজেব যখন তার রাজ্য দিল্লীতে সঙ্গীত চর্চা নিষিদ্ধ করে দেন তখন বাধ্য হয়ে গায়করা তাদের বাড়ী ফিরে আসতে লাগলেন। সরস রঙ আগ্রায় ফিরে এসে তার সঙ্গীত চর্চা বহাল রাখেন।সম্রাট আকবরের সময় থেকে ঔরঙ্গজেবের সময় পর্যন্ত নায়েক গোপাল, হাজী সুজন এবং তার বংশধরেরা নওহর বানীর স্রষ্টা।এই “বানী” শব্দটি গায়ন শৈলী কে বোঝায়।এই নওহর বানী থেকেই আগ্রা ঘরানার জন্ম হয় এবং সরস রঙ এই ঘরানার বিস্তার ঘটান। এর নাম করা যেতেই পারে।এই ঘরানার প্রখ্যাত গায়করা হলেন শের খান,গুলাম আব্বাস খান,বশির খান,জোহরবি অগ্রেওয়ালি প্রমুখ।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *