অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প(৪র্থ পর্ব)
কলমেঃ সু ক ন্যা দ ত্ত
মনে আছে “The Pirates Of The Somalia” সিনেমার কথা? পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়ার জলদস্যুদের জীবন কাহিনীকে সমগ্র বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য জয় বাহাদুর নামের একজন উঠতি সাংবাদিক সূদূর আফ্রিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন। ভারতের পশ্চিমের আরব সাগর পেরিয়ে এডিন উপসাগরের কোল বেয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় সোমালিয়ার উত্তরে। তখন এদেশের মানুষ যুদ্ধ, ক্ষুধা, নির্বাসন, দারিদ্রতার লড়াইয়ে সামিল। পথে ঘাটে সৈন্যদের কড়া নজর। সোমালিয়ার জলদস্যুরা নিজেদের “সমুদ্রের রক্ষাকর্তা” বলে পরিচয় দেয়। এদের মতে,
“এদেশের সরকারের সাথে আমার লড়াই নেই, লড়াই অনাহারের সাথে।”
শুধু খিদে নয় নিজেদের ভাষাগত ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য সোমালিয়ার মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লোকগল্পগুলো কে বাঁচিয়ে রেখেছে । এখানকার পাথুরে মাটি, সাভানা অঞ্চল, গুবান মরুভূমি, উপকূলীয় অঞ্চল সোমালিয়ার মানুষকে অস্তিত্বের জন্য সর্বদা লড়াই-এ প্রস্তুত করে নিয়েছে। সংগ্রামের স্পৃহায় এখানের লোকগল্পগুলোকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। এই সোমালিয়ায় গোষ্ঠীর প্রচলন চোখে পড়ে খুব। দারদ, ঈশাক, হাউয়ে, ধীর প্রভৃতি নানান গোষ্ঠীর বসবাস। শেখ আবদিরাহমান বীন লোহিত সাগর পার হয়ে এদেশের পূর্বাংশে বসত জমায়। ঈশাক গোষ্ঠী ১৩ শ থেকে ১৪ শ শতকে ঈশাক বীন আহমেদ আরব থেকে বর্তমান উত্তর পূর্ব সোমালিয়াতে এসে বসবাস শুরু করেন।
এবার আসুন সোমালিয়া কয়েকটি লোকগল্পের দিকে নজর দেওয়া যাক। হলিউডের “The silence Of the Lambs” সিনেমায় থমাস হ্যারিসের বিখ্যাত সংলাপটা মনে আছে?
” I ate his liver with some fava beans and a nice chianti”. নরখাদক শব্দটা শুনলেই বুকের রক্ত কেমন হিম হয়ে আসে, তাই না? সোমালিয়ার তেমনই একটি লোক কাহিনী বলি।
প্রথম গল্প
একসময় এক গ্রামে এক নরখাদক দানবী বাস করত। খাবারের জন্য সে রাতের আঁধারে গ্রামে ঘুরে বেড়াত। গ্রামবাসীরা তো দানবীর ভয়ে তটস্থ
সে গ্রামেই আর সকলের সাথে বাস করতো এক দম্পতি। গ্রামের সকলেই যাযাবর। একদিন সেই লোকটি গবাদি পশুদের পানীয় জল আর খাবারের সন্ধানের জন্য গ্রামের বাইরে গেল। যাওয়ার আগে সে তার স্ত্রী কে ডেকে বললো–
“আমি খাবার সংগ্রহ করতে দূরে যাচ্ছি। তুমি ঘরের দরজা আটকে রেখো। “
স্ত্রী বললো,
” আচ্ছা যাও তবে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।”
লোকটি আর ও বললো,
“শোন, আমি রাতে ফিরবো না। বাইরে থেকে কেউ ডাকলে কিন্তু দরজা খুলো না। মনে রেখো ওই নরখাদক দানবী কিন্তু মানুষের মাংস খাওয়ার জন্য এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব সাবধান। “
কথাগুলো বলে লোকটি দলের সাথে বেড়িয়ে গেলো। সেদিন রাতে লোকটি আর ফিরলো না। সন্ধ্যার আলো নিভে গিয়ে ধীরে ধীরে রাত হল।
চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরে কার ও শব্দ শোনা যাচ্ছে না। গ্রামের সকলে তখন ঘুমিয়ে পড়েছে।
হঠাৎ স্ত্রী লোকটি শুনলো, বাইরে কে যেন কড়া নাড়ছে।
স্ত্রী লোকটি বললো,
” কে? “
বাইরে থেকে উত্তর এলো,
” আমি গো। তোমার স্বামী। দরজা খোলো।”
স্ত্রী লোকটি মনে মনে বললো,
” এটা তো আমার স্বামীর গলা।”
আনন্দে এগিয়ে গিয়ে সে ঘরের দরজা খুলে দিলো।
আসলে স্ত্রী লোকটি আনন্দের চোটে ভুলেই গিয়েছিলো,যে তার স্বামী আজ রাতে বাড়ী ফিরবে না বলে গেছে। তার উপর আবার দানবী তার স্বামীর গলা নকল করে ডাকছিলো। দরজা খুলতেই সে দেখলো,স্বয়ং দানবী তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে কী ভয়ানক চেহারা তার। বিরাট বড়ো বড়ো চোখ থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছে। মুলোর মতো দাঁতের ফাঁক থেকে লাল ঝরছে। দরজা খুলতেই দানবী স্ত্রী লোকটির উপর ঝাপিয়ে পড়লো। এখন স্ত্রী লোকটি তো ছিলো গর্ভবতী। দানবী স্ত্রীলোকটিকে খেয়ে তার এবং তার সন্তানের মৃতদেহ একটা গর্তে লুকিয়ে রেখে দিলো। তারপর স্ত্রী লোকটির পোশাক পরে ঘরে বসে গৃহকর্তার অপেক্ষা করতে লাগলো।
কিছুদিন পর লোকটি তার প্রতিবেশীদের সাথে গ্রামে ফিরে এলো। সে ঘুণাক্ষরেও দানবীকে চিনতে পারলো না। লোকটি ভাবলো, তার স্ত্রী ঘরে আছে। এতদিন খাবার, পানীয় জলের সন্ধানের পর অবশেষে তারা একটা বাসযোগ্য স্থানের খোঁজ পেয়েছিল। লোকটি তার স্ত্রী কে ডেকে বললো,
“এবার আমরা অন্য গ্রামে যাবো। তুমি জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও।”
গোছগাছ শেষ হওয়ার পর গ্রামের সকলে মিলে ভিন্ন গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। নতুন জায়গায় পৌঁছে ঐ গোষ্ঠীর সকলে ঘর বাঁধলো। লোকটির পোষা একটা কুকুর, একটা মুরগী, একটা বিড়াল, একটা ছাগল আর একটা ভেড়া ছিলো। যখনই স্ত্রী লোকটি উটের দুধ দুইতে যেত, উটটা দৌড়ে পালিয়ে যেত। মুরগীকে খাবার খাওয়াতে গেলে ও সে ও ছুটে পালাতো। এমনকি তাদের পালিত ছাগল, ভেড়া, বিড়াল কেউই স্ত্রী লোকটির ধারে কাছে ঘেষতো না। তাদের পালিত পশুদের হঠাৎ এই আচরণ দেখে লোকটির সন্দেহ হল। অবশেষে লোকটা বুঝতে পারল, এটা তার স্ত্রী নয়, বরং সেই নরখাদক দানবী যে তার স্ত্রীর ছদ্মবেশ ধারণ করেছে। ঘটনাটা বোঝার পর লোকটা দানবীকে মারার পরিকল্পনা করতে লাগলো। একদিন সুযোগ বুঝে সে দানবীকে মেরে ফেলে। মনের দুঃখে হাঁটতে হাঁটতে লোকটা সেই পুরোনো গ্রামে গেলো। কিছুক্ষণ খোঁজার পর তার চোখে পড়লো একটা উঁচু ঢিপি। সেই ঢিপি খুঁড়তেই তার স্ত্রী ও সন্তানের মৃত দেহ বেড়িয়ে এলো। লোকটি কান্নায় ভেঙে পড়লো।
এই গল্পে রয়েছে যাযাবর গোষ্ঠীর কঠোর অস্থায়ী জীবনের কথা। বিপরীতে রয়েছে নরখাদক দানবীর কথা। এখন প্রশ্ন হল নরখাদক বলে সত্যিই কি কিছু আছে? এর পিছনে রয়েছে একটি বড় ইতিহাস। ক্যানিবলিজম আফ্রিকার ইতিহাসে বিরল নয়। দানবীর আড়ালে আফ্রিকার নরখাদক, হেড হান্টারসদের তুলে ধরা হয়েছে। কথিত আছে, এই হেড হান্টারসরা মৃত শত্রুদের মাথা সংগ্রহ করে তাদের জীবনীশক্তি, শক্রর গুণাবলি শোষন করে নাকি প্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস করে দিত।
সোমালিয়ার মাটিতে নরখাদক ধেগধীরের গল্প সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আমাদের দেশে যেমন জুজুর কথা বলে ছোটদের ভয় দেখানো হয়, তেমন আফ্রিকায় ধেগধীরের কথায় শিশুরা ভয় পায়। ধেগধীর শব্দের অর্থ “লম্বকর্ণ”। এই নরখাদক দানবীর গায়ে বিরাট শক্তি, তার গতি বাতাসের মত। শ্রবণ শক্তি অবিশ্বাস্য, একটি কান অন্য কানের চেয়ে অনেক লম্বা। এবার আসি ধেগধীরের একটি গল্পে…
২য় গল্প..
অনেক অনেক আগের কথা, এক ভয়ানক দানবী ধেগধীর সোমালিয়ার হারগেগা উপত্যকায় ঘুরে বেড়াত। একসময় সেই জায়গায় সবুজের সমারোহ ছিল কিন্তু ধেগধীরের অভিশাপে সেই স্থান ধূসর বালুকাময় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিল। বহু বছর সেখানে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় খাবারের অভাবে পশুরা রুগ্ন হয়ে যেতে লাগল। ধেগধীর দানবী ছিল বাতাসের মতো শক্তিশালী ও গতিময়। তার ছুঁচালো লম্বা কান দিয়ে সে দূর থেকে আসা উটের দলের আভাস পেত।
একদিন সকালে ধেগধীর খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে হাতে একটা কাস্তে আর পিঠে একটা বস্তা নিয়ে সে পাহাড়ের ধাপে ধাপে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ধেগধীর মনে মনে বলল,
“কাঁটা গাছের নীচে বসে যে মেয়ে আসন বুনবে, সেই আজ আমার খাবার হবে।”
কিন্তু সারাদিন ধুলো মাখা পাথুরে রাস্তায় ঘুরেও ধেগধীর খাওয়ার জন্য কোনও মানুষকে পেল না। খিদে, তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সে বাড়ী ফিরে এলো। এর আগে কখনও তাকে খালি হাতে ফিরতে হয়নি। ধেগধীর একটা কৌশলের কথা ভাবল,
“আমি আমার বিশেষ জাদু শক্তি দিয়ে একা পথ চলা পথিককে ফাঁদে ফেলব। পথ চলতে চলতে ওরা ক্লান্ত হয়ে যখন জলের সন্ধান করবে, সেই সময়টা হবে আমার শিকারের সময়।”
ধেগধীর তার মেয়ে বুতিকে ডেকে বলল,
” যাও, কাঠ, ঘাস আর খড়কুটো জোগাড় কর।”
ধেগধীরের মেয়ে কাঠ, ঘাস, খড়কুটো জোগাড় করে জড়ো করে পুরোনো বসতবাড়ির পাশেই একটা নকল কুঁড়ে ঘর তৈরি করলো। ধেগধীরের বাড়িতে একটা বড়ো জালা ছিলো, যার নাম বো-ধীর। বো-ধীর হলো মানুষের মাংস রাখার পাত্র। ধেগধীর বো-ধীরের কানে কানে বললো,
“কেউ যদি তোমার গায়ে হাত দেয়, তাহলে তুমি আমাকে শিস দিও। আমি দূর থেকে বুঝতে পারব।”
কথাটা বলেই খিদায়, তৃষ্ণায় ক্লান্ত ধেগধীর ঘুমোতে চলে গেলো।
সেইদিন বিকেলে, ধেগধীরের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে একজন বিধবা মহিলা তার নাদুসনুদুস ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছিল। মহিলাটি ভেবেছিল, যতক্ষণ সে গন্তব্যে না পৌঁছোবে, ততক্ষণ সে চলতেই থাকবে কিন্তু অনেকটা রাস্তা হেঁটে খিদে আর পিপাসায় তারা ক্লান্তি অনুভব করল। হঠাৎ ধেগধীরের মেয়ের বানানো নতুন কুঁড়েঘর দেখে মহিলাটির মনে একটু আশা জাগল।
বাড়ীর সামনে এসে মহিলাটি দেখল বুতি বসে আছে। তাকে দেখে মহিলাটি অনুরোধ করে বলল,
“দয়া করে আমায় জল দিয়ে একটু সাহায্য করুন।তেষ্টায় আমাদের বুক ফেটে যাচ্ছে, জল না পেলে আমরা মারা যাব।”
কথাটা শুনে ধেগধীরের মেয়ের বড়ো মায়া হল। সে ঘর থেকে একটা গ্লাসে জল এনে বলল,
“এই নিন, জলটা খেয়ে নিন।”
মহিলাটি জল খেল, তার ছেলেকে খাওয়াল। এরপর ধেগধীরের মেয়ে বললো,
“আমি দেখি, আপনাদের খাওয়ার জন্য কিছু পাই কিনা। তবে খুব সাবধান। আমার মা ধেগধীর একজন নরখাদক। উনি ঘুম থেকে জেগে আপনাদের দেখলেই খেয়ে ফেলবেন।”
কথাটা শুনে মহিলাটি ভয় পেয়ে গেল।
ধেগধীরের মেয়ে বলল,
“কাল সকাল পর্যন্ত আপনারা লুকিয়ে থাকুন। মা শিকারে বেড়িয়ে গেলে আপনারাও চলে যাবেন।”
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মহিলা তার ছেলেকে নিয়ে কুঁড়েঘরের পিছনে ঘাসের মাদুরের পিছনে লুকিয়ে পড়ল। ধেগধীরের মেয়ে ওদের জন্য চুপিচুপি বো-ধীরের ভিতর থেকে শুকনো মাংস চুরি করতে গেল কিন্তু সে বো-ধীরের ঢাকনার সাথে ধাক্কা খাওয়ায় বো-ধীর শিস বাজাতে লাগল। নিঃশব্দ রাতে সেই শিসের ধ্বনি শুনে ধেগধীর চিৎকার করে বলে উঠলো,
“কে? কে ওখানে? আল্লা! কে আমার পাত্রে হাত দিয়েছে?”
ধেগধীরের মেয়ে ভয়ে ভয়ে বললো,
” মা, আমি মাটির পাত্র থেকে ছাগলের শুকনো মাংস নিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু বো-ধীরের সাথে ধাক্কা লেগে গেছে।”
বুতির কথা শুনে ধেগধীর বললো,
“তুমি মিথ্যে কথা বলছ, আমি একটা নাদুসনুদুস বাচ্চা ছেলের গায়ের গন্ধ পাচ্ছি।”
বুতি বললো,
” মা, তুমি হয়তো আমার গায়ের চর্বির গন্ধ পাচ্ছো।”
ধেগধীর গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বললো,
” না না, আমি একজন যুবতী মেয়ের মাংসের গন্ধ পাচ্ছি।”
কথাগুলো বলেই ধেগধীর সমস্ত ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল।
ঘাসের গালিচার ভিতর থেকে সেই মহিলা আর তার ছোট ছেলেটি ধেগধীরের চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে গেল।
বুতি তাড়াতাড়ি ঘাসের গালিচা সরিয়ে মহিলাটিকে বলল,
” তোমরা তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালিয়ে যাও। দৌড়াও।”
মহিলাটি তার ছেলেকে পিঠে নিয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকলো। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
” হে মহান আল্লা, আমাদের রক্ষা কর।”
প্রার্থনায় সাহস সঞ্চয় করে এবার সে দৌড়াতে শুরু করলো। সে জানতো ধেগধীর বাতাসের চেয়েও দ্রুতগামী।
মহিলা ও তার ছেলেকে দেখে এবার ধেগধীর ও তাদের খাওয়ার জন্য পিছু নিল। মহিলাটি দৌড়নোর সময় প্রার্থনা করে চললো। অনেকটা পথ আসার পর, সে পৌঁছোলো হারগেগা উপত্যকায়।
” আমাদের শত্রু আমাদের পিছনেই। আমাদের পালাতেই হবে। এই বলে মহিলাটি কাঁদতে লাগলো।
হারগেগা উপত্যকা বললো,
” যদি তুমি পাপ মুক্ত হও, তাহলে আমি তোমায় পার হওয়ার অনুমতি দেবো কিন্তু তুমি পাপী হলে আমি তোমায় গিলে খাবো।”
সেই মহিলাটি তাদের পুণ্যের ফলে সহজেই উপত্যকা পার হয়ে গেল।
ধেগধীর পড়লো মহা ফ্যাসাদে। মহিলাটি তো তার ছেলেকে নিয়ে তখন তার নাগলের বাইরে। এবার সে ও হারগেগা উপত্যকাকে বললে,
” হে উপত্যকা,
তোমার সুবিশাল আকার আমার পথে বাঁধা সৃষ্টি করছে।
দ্রুত ছুটে চলার পথ আগলে রেখেছে।
দেখো, ওই যে স্থূলকায়া মহিলাটি ছুটে চলেছে।
দেখো দেখো, তার ছোট ছেলেকে পিঠে নিয়ে”।
এরপর সে ঐ মহিলাটির মতো একই ভাবে হারগেগা কে প্রার্থনা করে বলল,
” আমাকে ও ওদের মতো পথ তৈরি করে দাও। আমি যেন তাকে খেয়ে আমার উদরপূর্তি করতে পারি।”
হারগেগা উপত্যকা তাকেও উত্তর দিল,
” যদি তুমি পাপ মুক্ত হও, তাহলে আমি তোমায় পার হওয়ার অনুমতি দেব কিন্তু তুমি পাপী হলে আমি তোমায় গিলে খাব।”
কথাটা শুনে ধেগধীর লাফ দেওয়ার জন্য উপত্যকার ধারে যেতেই তার পাপের কারণে হারগেগা তাকে গিলে ফেলল।
তারপর হারগেগায় শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। কাঁটা ঝোপ আর ঘাসের দল বড়ো হতে লাগলো। সারা অঞ্চল সবুজে ছেয়ে গেলো। গবাদি পশুর দল স্থূলকায় হওয়ায় প্রচুর দুধ দিতে লাগলো।
আকাশে বাতাস আনন্দে বলতে লাগল,
” ধেগধীর মারা গেছে। এই মাটিতে শান্তি নেমে এসেছে।”
এই ক্যানিবলিজম আফ্রিকার পূর্ব প্রান্তে আছে বলে অনুমিত যদিও এটি বিতর্ক তৈরি করে। কারও মতে ক্যানিবলিজম চিকিৎসার জন্য শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ব্যবহার হয় আবার কার ও মতে এটি Pica নামের মানসিক রোগ। বন্ধ্যাভূমিতে সবুজের সমারোহ মাতৃত্ব, সৃষ্টিকে ইঙ্গিত করে
গল্পদুটিতে কেবল নারীকেই দানবীর রূপ দেখান হয়েছে। কিন্তু কেন? সোমালিয়ায় ধেগধীরের জন্মের পিছনে রয়েছে সমাজে নারীদের সামাজিক অবস্থানের কথা। ডাইনি কিংবা দানবী সন্দেহে পুড়িয়ে মারা সমাজে নতুন কিছু নয়। ধেগধীরের গল্পে মিশে আছে শুভ- অশুভের লড়াই এবং শুভ শক্তির জয়।
সোমালিয়ার মানুষের সহাবস্থান বন্য পশু এবং গবাদি পশুর সাথে। পশুরা মানুষের চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী। তাই সকল বিরূপতা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য পশুদের লোক গল্পের মধ্য দিয়ে চিত্রকল্প তৈরি করতো। হায়না হিংস্র প্রাণী। সোমালিয়ার গল্পে সে বোকা হলেও লোভী। তার মধ্যে মানুষের রূপ লাভ ধরার মতো অলৌকিক শক্তি আছে। আসলে লোকগল্পে পশু পাখীর মানবায়নের পিছনে একটি বড়ো ইতিহাস লুকিয়ে আছে। হিংস্র চরিত্রকে কিছুটা প্রশমিত করার জন্য সোমালিয়া লোককাহিনীতে হায়না কে মূর্খ পশু হিসেবে দেখান হয়েছে। তবে আফ্রিকায় হায়নার বাহুল্য থেকে এমন চরিত্রের সৃষ্টি।
তৃতীয় গল্প…
বহুকাল আগের কথা। অটুপা গ্রামে গ্রামবাসীরা ফসল কাটছিল। তারা তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করার জন্য জোরে জোরে হাত চালাচ্ছিলো। যেভাবেই হো সন্ধ্যা নামার আগে তাদের ঘরে ফিরতে হবে। রাতের অন্ধকারে বন্য পশুদের ভয় রয়েছে। অন্যদিকে সেই গ্রামের এক গ্রামবাসীর ঘরে একজন শিশু হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো। শিশুটির বারবার বমি হতে শুরু করল। চোখ উলটে শরীর বেঁকে যেতে লাগলো। শিশুটি এমন ফ্যাকাসে হয়ে যেতে লাগলো যেন কেউ ওর রক্ত শুষে নিচ্ছে।
শিশুটির মা ভয়ে কাঁদতে শুরু করলো। সন্তানের মাথায় হাত মা প্রশ্ন করলো,
” তুই আজ সন্ধ্যায় খেলতে খেলতে কামারের বাড়ির কাছাকাছি গিয়েছিলি?”
শিশুটি চুপ করে রইলো।
মা আবার বললো,
” সত্যি করে বল। আমায় লুকোস না বাছা।”
শিশুটি ভয়ে ভয়ে বললো,
“হ্যাঁ মা। আমি ও পাড়ার কামার বাড়ীর উঠোনে খেলতে গিয়েছিলাম। খেলতে খেলতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। ”
শিশুটির মা বলল–
” সর্বনাশ করেছে। তোকে না কামার পাড়ায় যেতে বারণ করেছিলাম। ওখানে তো বুডা থাকে। তোকে নিশ্চয়ই বুডা ধরেছে।”
কথাগুলো বলেই স্ত্রী লোকটি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। তারপর আবার জিজ্ঞাসা করলো,
” বল বাছা, তুই কী ওদিকে কাউকে দেখেছিস? ভয়ানক কাউকে?”
শিশুটি বললো,
” হ্যাঁ মা, একটা ইয়া লম্বা, মিশমিশে কালো লোক দূর থেকে আমার দিকে চেয়েছিলো। চোখগুলো ভাটার মতো জ্বলজ্বল করছিলো। দাঁত বের করে হাসছিলো। আমি ভয় পেয়ে ছুট্টে চলে এসেছি ।”
মা বললো,
” হায় হায়, এখন কী হবে?”
এমন সময় শিশুটির বাবা ঘরে এলো। সব শুনে তিনি দৌড়ে ওঝার কাছে নিয়ে গেলো।
অবশেষে চিকিৎসা করে সে যাত্রা শিশুটির প্রাণ বাঁচলো।
এই গল্পে রয়েছে Ware Hyena বুডার কথা।
ইউরোপের Ware Wolf এর মতোই ware Hyena বা বুডা ( Bouda) রূপ পরিবর্তন করতে পারে। মানুষের বেশে তারা শিকার করে। সোমালিয়া, তানজানিয়া, ইথিওপিয়ার গল্পে বুডার প্রসঙ্গ ছড়িয়ে রয়েছে। সাধারণত কামার এবং কুমোর শ্রেণির মধ্যে বুডার কাহিনী প্রচলিত। উভয়ের কাজেই আগুন ব্যবহার হয়। স্থানীয় ইহুদীদের বিশ্বাস আগুন গলিত লোহা বা মাটিকে রূপ দিয়ে অস্ত্র, ছুরি, কাঁচি, মাটির বাসনে পরিনত করে। আগুন যেমন গলিত পদার্থের নবরূপ দান করে তেমন বুডা হায়না থেকে মানুষের রূপে পরিবর্তিত হওয়ার অলৌকিক শক্তি ধারণ করে। কার ও মতে Ware Hyena ইহুদিদের ধর্মীয় অনুশীলন।
সোমালিয়া পর্ব এত দ্রুত শেষ করা সম্ভব হলো না। তাই বাইফোকালিজম্-র পাতায় পরবর্তী পর্বে এই দেশের সামাজিক লোক কাহিনী নিয়ে আবার মালা গাঁথতে বসব।