ছোটদের গল্পঃ লক্ষ্মীছেলে সোনাছেলে

                      লক্ষ্মীছেলে সোনাছেলে

                                     মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

                                                    ছবিঃ গৌতম মাহাতো

   বীরেন পড়ছিল। হঠাত্‍ তার মা নীরাদেবী দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বীরেন মাকে দেখে জিজ্ঞেস করল – ‘মা, কিছু বলবে?’
   নীরাদেবী বললেন –‘বাবা, তুই পড়ে উঠে একটা কাজ করে দিতে পারবি?’
বীরেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল – ‘মা, আমার সব পড়া হয়ে গেছে। বলো আমাকে কী করতে হবে?’
  -‘তুই একবার বাজার যা না বাবা। একটু মাছ কিনে আনতে হবে। তোর বাবা একটা বিশেষ কাজে বাইরে গেছে। ফিরতে দেরি হবে। এদিকে তোর মামা আসবে। ঘরে যা সবজি আছে তাতে হয়ে যাবে, শুধু একটু মাছ আনলেই হবে। তাই তুই একবার যা না বাবা বাজারে।’
   বীরেন বই গুছাতে গুছাতে বলল – ‘আমি এক্ষুনি যাচ্ছি মা। এই দু’কিলোমিটার দূরে তো। সাইকেল নিয়ে যাব আর চলে আসব। কই তুমি আমাকে টাকা আর ব্যাগ দাও।’
   মা নীরাদেবী তাড়াতাড়ি করে বাজারের থলিটা বীরেনকে দিলেন। আর সঙ্গে দিলেন দুটো একশো টাকার নোট। বললেন –‘এক কেজি মাছ নিয়ে আসবি।’
  বীরেন মায়ের কাছ থেকে থলি আর টাকা নিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে পা দিল। নীরাদেবী ছেলেকে বলেন –‘সাবধানে যাবি বাবা। রাস্তায় যা গাড়ি-ঘোড়া চলছে।’
   বীরেন বলল –‘তুমি কোনো চিন্তা করো না মা। আমি যাব আর চলে আসব।’ বীরেন রাস্তায় নেমে সাইকেল ছুটিয়ে দিল।
   বীরেনের এবছর ক্লাস নাইন চলছে। পাশের গ্রামের সোনারপুর হাইস্কুলের ছাত্র সে। পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো। ক্লাসে বরাবরই ফার্স্ট হয়। ক্লাস নাইনে ওঠার সুবাদে ক্লাসের অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে সরকারি তরফ থেকে এই বাইসাইকেলটা পেয়েছে সে। এই সাইকেল নিয়েই সে প্রতিদিন স্কুলে যায়। এখন বাজার যাচ্ছে। বীরেন বাজারে এসেই যেখানে মাছ বিক্রি হচ্ছে সেখানে চলে গেল। দেখল তার বাবার থেকে কিছুটা কম বয়সী একজন মাছওয়ালা মাছ বিক্রি করছে। বীরেন তার কাছে গেল। 
   মাছওয়ালা বীরেনকে দেখে জিজ্ঞেস করল – ‘বাবু, কী নেবে তুমি?’
   বীরেন বলল – ‘আমার এক কেজি মাছ দরকার।’
   সঙ্গে সঙ্গে মাছওয়ালা এক কেজি মাছ ওজন করে বীরেনের ব্যাগে ভরে দিল। বলল –‘বাবু, তুমি আমাকে একশো তিরিশ টাকা দাও।’
    বীরেনের কাছে দুটো একশো টাকার নোট ছিল। যা তাকে মা দিয়েছে। সেদুটো মাছওয়ালাকে দিল সে। এদিকে খদ্দেরের ভিড় পড়ে গেছে দোকানে। মাছওয়ালা টাকাটা নিয়ে বাকি টাকাটা ফেরত দিল বীরেনকে। বীরেন আর দেখল না। মাছওয়ালার কাছে ফেরতটা নিয়ে তার জামার পকেটে পুরেই বীরেন সোজা সাইকেল নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। স্কুলের বেলা হয়ে যাবে তাই তাড়াতাড়ি করে সাইকেল চালাল সে। 


   বাড়ি ফিরেই স্নান সেরে নিল বীরেন। মা নীরাদেবী খেতে দিলেন। বীরেন তাড়াতাড়ি করে খেয়ে যে জামাটা পরে বাজারে গিয়েছিল সেটা আবার গলিয়ে নিয়েই স্কুলে চলে এল। প্রথম পিরিয়ডের ক্লাস সেই সবে শুরু হয়েছে। বীরেন কি ভেবে জামার পকেটটাতে হাত দিতেই মাছওয়ালার ফেরত দেওয়া টাকাগুলো হাতে ঠেকল। ভাবল আরে সে তো ভুল করেছে। এই টাকাটা নিয়ে স্কুলে আসাটা ঠিক হয় নি। মাকে দিয়ে আসাটা উচিত ছিল তার। টাকাটা আস্তে করে বের করে গুনল। আর গোনামাত্রই চমকে উঠল। একি! এত বেশি টাকা তার পকেটে কেন? একটা একশো টাকার নোট, একটা পঞ্চাশ টাকার নোট আর দুটো দশ টাকার নোট। না এত টাকা তো তার ফেরত পাবার কথা নয়। তার কাছে দুটো একশো টাকা ছিল। সে তা মাছওয়ালাকে দিয়েছে। তার তো সত্তর টাকা ফেরত পাবার কথা। তাহলে তো মাছওয়ালা তাকে একশো টাকা বেশি দিয়ে ফেলেছে। খদ্দেরের ভিড়ে এই ভুলটা করে ফেলেছে। আর বীরেন নিজেও সেখানে গুণে দেখেনি। তারও ভুল এটা। কি করা যায় এখন? গরীব মানুষের একশোটা টাকা চলে যাবে? না এটা তো ঠিক হবে না। কি করে টাকাটা মাছওয়ালাকে দেওয়া যায়? সে কি বাজারে একবার চলে যাবে? গেলে তো এখনই যেতে হয়। এখনই গেলেই হয়তো মাছওয়ালার দেখা সে পেতে পারে। নইলে আর পাবে না। বাজার শেষ হয়ে যাবে। একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায় বীরেন। ছটপট করতে থাকে, অস্থিরতা ছেয়ে ধরে। পড়ায় মনোযোগী হতে পারে না। ঘন ঘন আনমনা হয়ে পড়ছে সে। ব্যাপারটা ক্লাস টিচার বরেনবাবুর নজরে পড়ে। বরেনবাবু বীরেনের কাছে এগিয়ে আসেন। বীরেনকে জিজ্ঞেস করেন – ‘বীরেন, আমি লক্ষ্য করছি তুমি বেশ আনমনা হয়ে পড়েছ। উসখুস করছো। কি হয়েছে তোমার?’
   বীরেন দাঁড়িয়ে বলে – ‘স্যার, না মানে- স্যার, বলছিলাম কি আমাকে একটিবার ক্লাস থেকে ছাড়বেন। আমি ছুটে একবার বাজারে যাব আর আসবো। খুব জরুরি দরকার পড়ে গেছে।’ বরেনবাবু বলেন –‘এখন তো ক্লাস চলছে। আমি ছাড়লেও হেডমাস্টারমশাই তোমাকে এ সময়ে ছাড়বে কেন? তবু দেখো, হেডমাস্টারমশাইকে একবার বলে।’ 
   ক্লাস টিচার বরেনবাবুর অনুমতি পেয়ে বীরেন সোজা হেডমাস্টারমশাইয়ের রুমে চলে গেল। সেখানে গিয়েও বীরেন একই কথা বলল একবার বাজার যাবার কথা। হেডমাস্টারমশাই প্রথমদিকে বীরেনকে ছাড়তে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে বীরেনের করুন মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হলেন। বললেন –‘বীরেন, স্কুল থেকে এই মুহূর্তে তোমাকে ছাড়াটা আমাদের উচিত না। তবে তুমি ভালো ছেলে। আমি নিশ্চিত তুমি মিথ্যা কথা বলছ না। তোমাকে ছাড়ছি। তবে সময় বেশি নষ্ট করবে না। তুমি যাবে আর আসবে।’ 
   বীরেন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতো সাইকেলটা নিয়ে বাজারের দিকে চলে গেল। 
   বাজারে এসে বীরেন সোজা সেই জায়গাতে গেল যেখানে সে মাছ কিনেছিল। এসে দেখে সেই মাছওয়ালা তাঁর বঁটি, দাঁড়িপালা ইত্যাদি সব গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করছে। বীরেন কথাটা কিভাবে বলবে তাই উসখুস করছিল। মাছওয়ালা জিজ্ঞেস করল – ‘বাবু, তুমি তো সকালবেলা মাছ কিনে নিয়ে গেলে। আবার এসেছো কেন? কিছু বলবে?’
   বীরেন উত্তর দিল – ‘কাকু, সকাল বেলা মাছ কেনার সময় আমাকে যে টাকা ফেরত্‍ দিয়েছিলেন সে সময় আপনি আমাকে একশো টাকা বেশি দিয়ে ফেলেছেন। তাই সেই টাকাটা আমি আপনাকে দিতে এসেছি। এই নিন আপনার টাকা।’ বলে একশো টাকার নোটটা মাছওয়ালার সামনে ধরল বীরেন। 
   মাছওয়ালা কথাটা শুনে তো অবাক। বলল- ‘বাবু, তুমি ঠিক বলছ? তোমার ভুল হচ্ছে না তো?’
  -‘কাকু, আমি ঠিক কথাই বলছি। আসলে নোটগুলো একটু পুরাতন ছিল তো তাই এমন হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি নিন। আমি স্কুল থেক এসেছি। হেডমাস্টারমশাইকে বলে এসেছি দেরি করবো না।’ বলে বীরেন একপ্রকার জোর করেই মাছওয়ালার হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়েই সাইকেলে চড়ে বসল। 
   মাছওয়ালা জিজ্ঞেস করল – ‘তুমি কোন স্কুলে পড় বাবু? তোমার নাম কী? কোন শ্রেণিতে পড়?’
  -‘সোনারপুর হাইস্কুলে। আমার নাম বীরেন। নাইনে পড়ি-’ কোনোক্রমে উত্তর দিয়ে মেইন রাস্তায় উঠে পড়ল বীরেন। 
   মাছওয়ালা বীরেনের চলে যাওয়ার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। এতো সোনার টুকরো ছেলে, যাকে বলে লক্ষ্মীছেলে। এই বয়সের ছেলে এমন সত্‍ হতে পারে এটা মাছওয়ালকে বেশ আনন্দ দিল। না, তাকে একবার স্কুলে যেতেই হচ্ছে, হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতেই হচ্ছে।
   এদিকে মাছওয়ালাকে টাকাটা ফেরত্‍ দিয়েই বিদ্যালয়ে ফিরে এসেছে বীরেন। যথারীতি ক্লাস করছে। বিদ্যালয় ছুটির ঠিক পনেরো মিনিট আগে হঠাত্‍-ই শোনা গেল বিদ্যালয়ের হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘোষণা – সকল ছাত্রছাত্রী এবং বিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা যেন বিদ্যালয় সংলগ্ন মাঠে জড়ো হয়। হেডমাস্টারমশাইয়ের নির্দেশ মতো বিদ্যালয় মাঠে ছাত্রছাত্রীরা জড়ো হয়ে গেল। শিক্ষক-শিক্ষিকারাও সব হাজির হলেন। সবাই সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। কেন 

হঠাত্‍ হেডমাস্টারমশাই এভাবে সবাইকে জড়ো করলেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও ব্যাপক উত্‍সাহ আর ভাবনা কাজ করছে। সবার মনেই কৌতূহল হেডমাস্টারমশাই কী বলেন। সবাই যখন মাঠের মধ্যে হাজির এমন সময় হেডমাস্টারমশাই ঢুকলেন। সঙ্গে বীরেনের বাবা, মা আর বাজারের সেই মাছওয়ালা। বীরেন তার বাবা-মাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। বাবা-মা এখানে এল কেন? আর মাছওয়ালাই বা কেন এসেছেন? সে কিছু অন্যায় করে ফেলেনি তো? বুকটা তার ভয়ে দুরুদুরু করতে লাগল। একই সঙ্গে কৌতূহলও জাগছে তার। মাঠের মধ্যে একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। হেডমাস্টারমশাই কী বলেন তারই শোনার অপেক্ষায়। 
   সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে হেডমাস্টারমশাই গম্ভীর গলায় ডাকলেন – ‘বীরেন, নবম শ্রেণির ছাত্র বীরেন, তুমি কোথায়? আমার সামনে এসো।’
   হেডমাস্টারমশাইয়ের ডাকে বীরেনের বুকে কাঁপন শুরু হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে এল সে। বীরেন এলে হেডমাস্টারমশাই তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন – ‘আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, সকলে শোনো, আর আমার শিক্ষকগণ আপনারাও শুনুন – এই যে বীরেন, হ্যাঁ-আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্র বীরেন আজ একটি বিরাট কাজ করেছে। সততা কী আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এমন একজন ছাত্রের জন্য আমরা সত্যিই যারপনাই গর্ব অনুভব করছি। ভাবছো তো কী করেছে ও? ও আজ সকালবেলা বাজারে গিয়ে এই মাছওয়ালা সতীশবাবুর কাছ থেকে মাছ কিনেছিল। পয়সা ফেরত্‍ দেবার সময় ভুলক্রমে বাড়তি একশো টাকা দিয়ে দেন। স্কুলে এসে তা নজরে পড়ে বীরেনের। স্কুল থেকে গিয়েই ও সেই টাকা সতীশবাবুকে দিয়ে আসে। আমাকে তখন বীরেন ও কথা বলেনি। বলেছিল-তার বাজারে একটা বিশেষ কাজ আছে। এই সতীশবাবু না এলে বুঝতেই পারতাম না। সতীশবাবু বলেন –এমন সোনার টুকরো যাদের ছেলে তার মা-বাবাকে দেখতে চাই। তাই বীরেনের বাবা-মাকে ডেকে পাঠিয়েছি। বিষয়টা জানানোর জন্য তোমাদের সকলকে জড়ো করেছি। তোমরা হয়তো অনেকেই ভাবছো মাত্র তো একশো টাকা। এ আর এমন কী? আমি বলবো না-ও যা করেছে এটা একটা বিরাট কাজ। পয়সার মূল্যে এটা বিচার করা যায় না। ওর এই সততার দাম অমূল্য! তাই ঠিক করেছি আগামী বার্ষিক অনুষ্ঠানে সততার জন্য বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বীরেনকে আমরা বিশেষভাবে পুরস্কৃত করবো।’ 
   হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘোষণায় উপস্থিত সকলেই তুমুল হাততালি দিয়ে উঠল আর বীরেনের নামে জয়ধ্বনি দিল। এদিকে সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। তার শেষ রশ্মিচ্ছটা বীরেনের মুখমণ্ডলকে উজ্জ্বল-রঙিন করে তুলল। 

                               ★★★

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *