স ন ৎ কু মা র ব ট ব্যা ল-র জীবনীচর্চায়
যে জন থাকে প্রানের মাঝে
আজ ভারতবর্ষের এক কৃতি সন্তানের কথা আপনাদের বোলবো। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী, চিকিৎসক, আইনজীবী, পদার্থবিদ,দার্শনিক, উদ্ভিদবিদ,গবেষক,বৈজ্ঞানিক,
সমাজসংস্কারক,সুলেখক, সুবক্তা
বহুমাত্রিক চরিত্রের একটা আধার।ব্যক্তিটি আর কেউ নন
ডাঃ ইন্দুমাধব মল্লিক (৪ ডিসেম্বর, ১৮৬৯ – ৮ মে, ১৯১৭)
তিনি একাধারে একজন দেশপ্রেমিক, ডাক্তার। যিনি অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকের ঠাকুরদা। “ইন্দুমাধব মল্লিক শুধু কুকারের আবিষ্কর্তা নন, তিনি চিকিৎসক, আইনজ্ঞ, দেশপ্রেমিক, সুলেখক, সমাজ সংস্কারক ও অনেক কিছুই। উনিশ শতকের বিস্মৃত এক বহুমুখী প্রতিভা। সাথে বিপ্লবীদের ডাক্তারি, সবেতেই নজির রেখেছেন এই বাঙালী। ১৯১০ সাল। ‘ইকমিক কুকার’ প্রথমে বড় একটি হাঁড়ি, তার পর ক্রমশ ছোট থেকে আরও ছোট, এই ভাবে পর পর ছ’টা হাঁড়ি বসানো। সময়, জ্বালানি, দুয়েরই সাশ্রয় এবং খাদ্যগুণ বজায় রাখাও সম্ভব। শুরু হল ভাবনাচিন্তা। কয়েক মাসের পরিশ্রমে আবিষ্কার হল ‘ইকমিক কুকার’। আবিষ্কার করলেন আজকের প্রজন্মের কাছে প্রায় বিস্মৃত বাঙালী ইন্দুমাধব মল্লিক।
‘হাইজিনিক’-এর ‘ইক’, ‘ইকনমিক’-এর ‘মিক’, তার সঙ্গে ‘কুকার’- সব মিলিয়ে ইকমিক কুকার।আজকের প্রেশার কুকারের পূর্বপুরুষ।”ইকমিক কুকারের জন্মকথা নিয়ে অনেক ভ্রান্তি উঠে আসে।কেউ কেউ মনে করতেন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে এইধরনের কুকার সর্বপ্রথম দেখা যায়। আবার এ কথাও বলা হত যে, চীনে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার ফুটপাতে হরেক বাটি সাজিয়ে খাবার তৈরি দেখেই ইন্দুমাধবের মাথায় আসে ইকমিক কুকারের আইডিয়া। এক সংবাদপত্রের সাংবাদিককে তাঁর নাতি অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক জানিয়েছিলেন, তাঁরাও ছোটবেলায় পুরীর মন্দিরের ঘটনাটাই শুনেছিলেন। সে যুগে বাঙালী চীনে বিশেষ বেড়াতে যেত না। ইন্দুমাধব মল্লিক গিয়েছিলেন এবং ‘চীন ভ্রমণ’ নামে একটি বইও লিখেছিলেন। সেখান থেকেই হয়তো চিনের ওই মিথটা ছড়িয়েছে। সাত বছর বয়সে কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন তিনি সেখান থেকে পাশ করে এফএ পড়তে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিষয় ছিল দর্শন। ১৮৯১ সালে এমএ পাস করলেন। তার পরই মোড় ঘুরল। প্রতিভাবান ইন্দুমাধবের মনে হল, এবার জানতে হবে আধুনিক বিজ্ঞান। পরের বছর পদার্থবিদ্যায় এমএ পাস করলেন। পাশাপাশি ভর্তি হলেন মেডিক্যাল কলেজে, উদ্দেশ্য ডাক্তারি পড়া। তাতে অনেক বেশি মানুষের সেবা করতে পারবেন। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানই শেষ নয়। ডাক্তারি পড়তে পড়তে, অসহায় মানুষদের সুবিচার দেওয়ার জন্য ভর্তি হলেন আইন কলেজে। তবে আইন পাশ করলেও তিনি ওকালতি প্র্যাকটিস করেননি। ১৮৯৮ সালে ডাক্তারি পাশ করেন ইন্দুমাধব। সেই সময় এমএ পড়ানো হত বঙ্গবাসী কলেজে। ছোটবেলা থেকে গাছপালার প্রতি ইন্দুমাধবের স্বাভাবিক আগ্রহ ছিল। স্থির করলেন, বটানিতে এমএ পরীক্ষা দেবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ছাত্রদের পড়াচ্ছেন, ফাঁকে ফাঁকে নিজেও পড়ছেন। পরের বছর পরীক্ষা দিলেন। পাশও করে গেলেন। কিন্তু ইন্দুমাধব তো শুধু ডিগ্রি জোগাড়ের জন্য পড়াশোনা করেন নি। তাঁর উদ্দেশ্য, মানুষের সেবায় অধীত জ্ঞানের প্রয়োগ। অবসর সময়ে রোগী দেখা আরম্ভ করলেন। রোগী দেখছেন, পড়ছেন, পড়াচ্ছেন। ডিগ্রি তো কম নেওয়া হল না। হঠাৎ খেয়াল হল, বঙ্গবাসী কলেজে যে-ক’টা বিষয়ে এম এ পড়ানো হয়, একটি ছাড়া সব বিষয়ে তাঁর ডিগ্রি নেওয়া হয়ে গিয়েছে। বিষয়টি হল ‘ফিজ়িয়োলজি অ্যান্ড জ়ুলজি’। মনে হল, এটাই বা বাদ থাকে কেন! কয়েক মাস পড়াশোনা করে পরীক্ষায় বসে গেলেন। আশ্চর্যের বিষয়, এই পরীক্ষাতেও পাশ করে যা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ত্রিগুণা সেনের স্মৃতিকথায় আছে, ‘ইন্দুমাধব ছিলেন সর্ব জ্ঞানের আধার। বহুমুখী ছিল তাঁর চিন্তাধারা। ছাত্রদের মুখ দেখে বুঝতে পারতেন তাদের দুঃখ-কষ্ট। কেউ টাকা দিতে না পারলে তিনি নিজেই পড়ার খরচ দিয়ে দিতেন। যেমন বিশাল হৃদয় তেমনি মমতা। আশৈশব বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। চেষ্টা করতেন তাঁর আদর্শে নিজেকে গড়ে তুলতে। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন বিদ্যাসাগরের যোগ্য উত্তরসূরী। ৪৬ বছর বয়সে তাঁর মনে হয়, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন। কিন্তু শেষ অবধি অসুস্থতার কারণে এই ইচ্ছে পূরণ হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র, বিধানচন্দ্র প্রমুখ আসতেন তাঁকে দেখতে। এক রোগী সংক্রামক রোগে ভুগছিলেন, জরুরি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন, অথচ কোনও ডাক্তার তা করতে রাজি নন। সেই সময়েও এগিয়ে এলেন ইন্দুমাধব। তাঁর শরীরে ক্ষত ছিল, সেখান থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে।
১৯১৭ সালের ৮ই মে, মাত্র ৪৭ বছর বয়সে চলে যান বাংলার এই অতুলনীয় কৃতী সন্তান। আজ ভারতবর্ষের এক কৃতি সন্তানের মৃত্যু দিন ।আসুন সবাই মিলে এই ক্ষনজণ্মা মানুষটিকে স্মরণ করি ।
গভীর শ্রদ্ধা ও আভূমি প্রনাম জানাই সাংস্কৃতিক প্রণাম।
তথ্য সংগ্রহ ও অনুলিখনঃ- হিমাদ্রি বর্মন
তথ্যসূত্র: মৌনী মন্ডল
আগের পর্বগুলি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকগুলোতে