যে জন থাকে প্রানের মাঝে

পরিচিতিঃ সনৎকুমার বটব্যাল ও হরিপদ কেরানী ছদ্মনামে ২০১৫ সাল থেকে সম্পাদনা করে চলেছেন একটি মননশীল  সাহিত্য পত্রিকা ‘পৃথ্বী’। থাকেন তমলুকে। জন্মসুত্রে পুর্বমেদিনীপুরের মানুষ। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। হরিপদ কেরানী ছদ্মনামে দীর্ঘকাল লেখালিখি করে আসছেন। ২১/১১ তেঘরিয়া, নন্দনকানন, কলিকাতা-৭০০১৫৭। বাইফোকালিজম্-এ আজ একটু অন্য স্বাদের লেখা।

স ন ৎ কু মা র  ব ট ব্যা ল-র জীবনীচর্চায়

যে জন থাকে প্রানের মাঝে

আপনারা শিক্ষিত মানুষ, সভ্য সমাজের প্রতিনিধি।আপনাদের আমি বলব আর আপনারা শুনবেন, তাকি হয় নাকি।বরং স্মরণ করিয়ে দিই।আপনাদের কারো প্রত্যক্ষ শিক্ষক বা কারো পরোক্ষ ।আমার
মতো হাড়- হাভাতে ছেলেকে ইনি পাঠদান করেন নি।তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পা ছুঁয়ে প্রনাম করে আশীর্বাদ নিয়েছি।তাঁর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বইটি কখনো কখনো পাতা উল্টেছি।শতবর্ষ পেরিয়ে গেল, কোথাও তেমন করে তাঁকে স্মরণ করতে দেখলাম না ।

অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

ভূমি স্পর্শঃ ৩ রা জুন,১৯২০ সাল।
গ্রামঃ নকফুল
বনগাঁ মহকুমা
উত্তর চব্বিশ পরগনা ।

অমৃতলোকে যাত্রাঃ- ২১শে মার্চ,২০০৩ সাল।

বাবা– অক্ষয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
মা– চারুবালা দেবী ।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার, বিশিষ্ট অধ্যাপক, গবেষক ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাদেমির ভূতপূর্ব সভাপতি। নয় খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত একটি হিমালয়-প্রতিম কীর্তি এবং এই গ্রন্থখানির জন্য তিনি সারস্বত সমাজে বিশেষ শ্রদ্ধার আসন অধিকার করেন।

অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমার নকফুলে মামাবাড়িতে ।
১৯২৫ সাল থেকে অসিত বাবুর বাবা হাওড়ায় বসবাস করতে থাকেন। ১৯৩৮ সালে হাওড়া জিলা স্কুল থেকে বাংলায় ৭৭% নম্বর সহ জেলায় এই বিষয়ে প্রথম হয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
এরপর রিপন কলেজ (এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ,শিয়ালদহ) থেকে আই এ পরীক্ষায় বাংলা ও আসামের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন।তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে বিএ ও এমএ পরীক্ষায় (১৯৪৫ খ্রীস্টাব্দে) প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন।

কলেজ জীবনেই ১৯৪১-৪২ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বক্তৃতাগুলো বঙ্গানুবাদ করে’ ফরোয়ার্ড’ পত্রিকায় ছাপতে থাকেন।ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর গল্প দেশ ও অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৫ সালে এমএ পাশ করে সেই বছরেই নবদ্বীপের বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরে রিপন কলেজে ও ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অধ্যাপক ‘হয়েছিলেন।
শরৎ অধ্যাপক বলতে লোকে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বুঝতেন বা জানতেন । ১৯৮৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন অসিত বাবু ২০০২ সালে অন্নদাশঙ্কর রায়ের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সভাপতির পদে ব্রত হন ও আমৃত্যু সেই পদে বহাল থাকেন।
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, নয় খণ্ডে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের বিস্তারিত ইতিহাসগ্রন্থ। এই গ্রন্থের দুটি সহজপাঠ্য সংস্করণ বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত ও বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও তাঁর রচনা। তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থগুলি বাংলার নবজাগরণ বিষয়ে রচিত। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য –


★ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ ও বাংলা সাহিত্য,
★ বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর,
★ সাহিত্য জিজ্ঞাসায় রবীন্দ্রনাথ
★ হাওড়া শহরের ইতিহাস (২ খণ্ড) ইত্যাদি।
তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থগুলির মধ্যে
★ শ্রেষ্ঠ গল্প শ্রেষ্ঠ লেখক,
★ জীবনের গল্প গল্পের জীবন, @সত্যেন্দ্র রচনাবলী,
★ বিদ্যাসাগর রচনাবলী,
★ সঞ্জীব রচনাবলী উল্লেখযোগ্য।

★ ‘স্মৃতি বিস্মৃতির দর্পনে’ নামে তাঁর একটি আত্মকথাও রয়েছে।

★ এছাড়া ভারতীয় পণ্ডিত বেদ প্রকাশ উপাধ্যায় রচিত কল্কি অবতার ও মোহাম্মদ সাহেব বইটি গবেষণা পূর্বক হিন্দুধর্মগ্রন্থ বেদ ও পুরাণে মুহাম্মদ নামে অনুবাদ ও সম্প্রসারণ করেন তিনি।

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাদেমির সভাপতিত্ব করা ছাড়াও তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গবেষক ছিলেন। একাধিকবার সম্মেলন উপলক্ষে ও অতিথি-অধ্যাপনার জন্য বিদেশেও গিয়েছেন। ১৯৮১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক বুদ্ধমহাভাব মহাসম্মেলনে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসাবে ভাষণ দেন। চিন্তাবিদ ও গবেষক হিসাবে একাধিক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন অসিতকুমার। তাঁর স্ত্রী হাওড়া গার্লস কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপিকা বিনীতা গঙ্গোপাধ্যায় (২৯/০১/১৯২৫ – ১৫/০৪/২০০৬) ঐতিহাসিক উপন্যাস,গল্প ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন সুকন্যা ছদ্মনামে।

শিল্প-সাহিত্য বলুন, বা খেলা, বাংলায় প্রতিভার অভাব কোনোকালেই ছিল না। কেউ কেউ বেঁচে থাকার সময়ই প্রবল সম্মান পেয়ে গেছেন, কেউ বা মৃত্যুর পর। কাজেই শতবর্ষ, সার্ধশতবর্ষের ছড়াছড়ি এখানে। অবশ্য ঠিকমতো দেখতে গেলে, ওই মানুষগুলোর কীর্তির কাছে আমরা সবাই ঋণী। যেমন ধরুন বাংলা সাহিত্য। এমনিতেই কবিতা-প্রবণ জাত বলে বাঙালিদের খানিক ‘বদনাম’ আছে। সেই কবে থেকে এত বিশাল সংখ্যক সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে এই বাংলাদেশ । এখনও হয়েই চলেছে। সেসবকে একসঙ্গে আনাও তো চাট্টিখানি কথা না! সেই কাজটাই বিংশ শতকে করে গিয়েছিলেন যিনি, সেই অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের শতবর্ষ চলে গেল বাংলায়; খানিক নীরবেই………..তেমন করে কেউ স্মরণে ও মননে আনেনি ।

১৯২০ সালে চব্বিশ পরগণার বনগাঁয় জন্মালেও, পাঁচ বছর বয়স থেকে তাঁর বাস হাওড়ায়। ছোটো থেকেই তুখোড় ছিলেন পড়াশোনায়। বেশিরভাগ জায়গাতেই প্রথম স্থানটি ছিল বাঁধা। যেমন ছিল মেধা, তেমনই তাঁর স্মৃতিশক্তি। গবেষণার নিরলস খিদে। জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত এই দুটোই ছিল তাঁর দুই স্তম্ভ। নিজের সময় আইএ পরীক্ষায় কেবল বাংলা নয়, আসামের পরীক্ষার্থীদের মধ্যেও প্রথম হন তিনি। এমন ছাত্ররা সাধারণত প্রবল রাশভারী, গম্ভীর গোছের একজন হন, প্রচলিত ধারণা এটাই। তবে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই পথের পথিক ছিলেন না।ঠিক ছিলেন উল্টো । বাস্তব জীবনে যেমন ছিলেন ছাত্রদরদী, তেমনই ছিলেন রসিক।
সূক্ষ্ম রসবোধ ছিল ভীষণ প্রগাঢ় ।
অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় আর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ দুজন দুজনের পরিপূরক ।নয় খণ্ডে প্রকাশিত এই বিশাল কাজ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। গবেষণার কাজে এতটুকুও ফাঁকি দেননি কখনো । অধ্যাপনার কাজ সামলে বারবার ছুটেছেন লাইব্রেরিতে। আজও যে কোনো গবেষক এবং পড়ুয়াদের কাছে এই বইগুলি অমূল্য সম্পদ। তবে অসিতবাবুর সাহিত্যকীর্তির নমুনা এখানেই শেষ হয় না। কলেজের ছাত্র থাকার সময় থেকেই অনুবাদের কাজ শুরু করেন তিনি। তাঁর লেখা দেশ, নবশক্তি-সহ নানা পত্রিকাতেও প্রকাশ করা হত। তবে বাংলা সাহিত্য ও তার ইতিহাস নিয়েই তাঁর যাবতীয় কাজ।

লেখা, গবেষণার পাশাপাশি অধ্যাপনার ভূমিকাতেও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় চিরস্মরণীয়। হাওড়া গার্লস কলেজ, নবদ্বীপের বিদ্যাসাগর কলেজ ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়— যেখানেই গেছেন নিজের পরিচয় রেখে গেছেন। হাওড়া গার্লস কলেজে থাকাকালীন তাঁর সহকর্মী ছিলেন স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ। সেই সময় বেশ কাছ থেকে দেখেছেন কবিকে। আজও তাঁর সুযোগ্য ছাত্ররা স্মরণ করেন তাঁদের প্রিয় অধ্যাপককে। আর করবেন নাই বা কেন! যেমন ছিলেন নিজের পড়াশোনায় সিরিয়াস, তেমনই ছিলেন ছাত্রদরদী। কারোর যদি খরচের অসুবিধা হত, এগিয়ে আসতেন তিনি। নিজের বাড়ি থেকে বই দিয়ে দিতেন পড়ার জন্য। ছাত্ররাই যে তাঁর ‘অ্যাসেট’, সে কথা বারবার বলতেন।

সারাজীবন হাওড়ায় থেকেছেন। তা নিয়ে গর্বও ছিল প্রচণ্ড। কলকাতা, হাওড়ার দূষণ নিয়ে চলত অহরহ রসিকতা। বাঙালিদের শতবর্ষ উদযাপন নিয়েও রসিকতা করতে ছাড়েননি। সব মিলিয়ে জীবনটাকে উপভোগ করেছেন প্রাণভরে। বাংলা ভাষার গন্ধ, শব্দ ধারণ করেছিলেন নিজের ভেতর। শেষ বয়সে এসে নানা সম্মান পেয়েছিলেন। তার থেকেও বড়ো ছিল অগুনতি ছাত্রছাত্রীরা, যারা সর্বক্ষণ আঁকড়ে থাকতেন তাঁদের প্রিয় অধ্যাপককে।
কালই চলে গেল বাংলাদেশের এই কৃতি সন্তানের জন্মদিন। তাঁর এই জন্মদিনে জানাই আমাদর অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা ও আভূমি প্রনাম ।

অনুলিপি ও সহযোগিতায়– বন্ধু্বর শ্রী হিমাদ্রি বর্মণ।

তথ্যঋণ:
১) আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘জীবনানন্দ দাশ’/ মহীতোষ বিশ্বাস (প্রহর)

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *