পরম হংস শ্রীরামকৃষ্ণ,স্বামীজি ও মা সারদাময়ী-র মতাদর্শ ও দর্শনের অন্য আলো নিয়ে লিখছেন–নিমাই বন্দোপাধ্যায় “ঈশ্বর প্রসঙ্গে “— বিভিন্ন গ্রন্থে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, -মুনি-ঋষিদের কথায়, বাণীতে,প্রনম্য বহু অবতারদের, লেখক -সাহিত্যকদের লেখায় ও কথায় যা পড়েছি এ যাবৎ– সে গুলিই সহজ সরল ভাবে এখানে একত্র করেছি মাত্র। এর কোনোটিই এ অধমের পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি নয়।বলা যেতে পারে ” ছায়া অবলম্বনে “। আমার মতো একজন অর্বাচীনের এ স্পর্ধা কেন ঘটল ঈশ্বরই জানেন।আমি জানিনা।” ঠাকুর -মা-স্বামীজী মহারাজের শ্রীচরণ স্মরণ করে এ লেখায় উৎসাহিত হয়েছি,একথা স্বীকার করতে আমার কোনো বাধা নেই। আমি নিমাই বন্দোপাধ্যায়, দূর্গাপুর থেকে বাইফোকালিজম্ ওয়েব পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে এবং উৎসাহে প্রতিদিন কিছু কিছু লেখা নিয়েই – এই তৎপরতা।
ত্যাগীশ্বর হে নরবর ( তিন)
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের আশা যোগাচ্ছেন। ভরসা দিচ্ছেন। বলছেন, “আমি ছাঁচ তৈরী করেছি, তোরা সেই ছাঁচে কপি করে নে। এটুকু পারবি নে? পথ চলতে চলতেই পথ পেয়ে যাবি। চলা তো শুরু কর। দেখ লক্ষ্য কমে আসবে। যত এগোবি তত পথের ধকল আর গায়ে লাগবে না।
মলয়ের হাওয়া খুব বইছে চারিদিকে।তোরা সেই হাওয়াটুকু চিনে নে। ফুল ফুটলে ভ্রমর আসে, মৌমাছি আসে।কেউ তাদেরকে ডাকে না। কেউ নেমন্তন্ন করে আসে না। তারা নিজে আসে। তেমনই নিজে থেকে একটু এগিয়ে আয়। ঈশ্বর কৃপাময়, করুনাময় তিনি ঠিক পথ বলে দেবেন।” আমাদের মত গৃহীদের জন্য বলেছেনঃ “কেন তোরা ঈশ্বর-পানে চেয়ে দেখিস না জানিস? ওই খেলনা পাতি নিয়ে মেতে আছিস বলে। শিশু যখন খেলনা গাড়ি, খেলনা বাঁদর নিয়ে খুশি হয়ে খেলে- মা সেই সময় তার সংসারের কাজ সেরে নেয়।যখন আর খেলনা ভালো লাগেনা, তখন ‘ মা যাবো, মা যাবো’ বলে কাঁদে।আর তখন মা ও ছুটে আসে।নাম, যশ, গাড়ী, বাড়ি, সম্পদ, সম্পত্তি– এগুলো হল খেলনাসম। যতদিন এগুলো থেকে তোমার মন আসক্তি না হারাচ্ছে, ততদিন তুমি ঈশ্বরমুখী হবে না।” কত গভীর পর্যবেক্ষণ ঠাকুরের! কত সুন্দর তুলনা! গার্হস্থ্যজীবন আর ধর্মজীবনকে পাশাপাশি রেখে বুঝিয়েছেন কোথায় আমাদের ঘাটতি। বুঝিয়েছেন ধন সম্পত্তি সব অস্থায়ী, একমাত্র ঈশ্বেরর আবাসই স্থায়ী। তবে তার জন্য তোমার মনে তীব্র ব্যাকুলতা চাই। মনের মধ্যে গভীর ঝটপটানি চাই।আর চাই ত্যাগ। কী ত্যাগ করতে হবে আমদের? বাসনা ত্যাগ করতে হবে।”নির্বাসনা” হতে হবে। শ্রী শ্রী মা সারদা পরবর্তীকালে বলেছেনঃ “ত্যাগই ছিল ঠাকুরের ভূষণ। অমন ত্যাগ জগত এর আগে দেখেনি”। সেই সময় ঠাকুরের কত ধনী ভক্ত এমনকি রানী রাসমনির সেজ জামাই মথুরবাবু ঠাকুরকে অনেক জমিজমা লিখে দিতে চেয়েছিলেন,যাতে বয়সকালে ঠাকুর মা সারদাকে নিয়ে অসুবিধায় না পড়েন।
মথুরের প্রস্তাবে ঠাকুর ‘না’ করে দিয়েছিলেন।এবং বলে ছিলেন ভবিষ্যতে আমার মনে কখনও কোনওরূপ বাসনার সলতে পাকানোর চেষ্টা কোরো না।
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সৃষ্ট আরাত্রিক ভজনে তাঁকে ‘ ত্যাগীশ্বর হে নরবর’ বলে বন্দনা করেছেন।
ত্যাগের কথা শুনেই আমরা সাধারণ মানুষ অহেতুক ভয় পেয়ে যাই।ওরে বাবা, আমাকে ঘর বাড়ি সংসার পরিবার পরিজন সব ছেড়ে বনে জঙ্গলে যেতে হবে? না। ত্যাগ অর্থাৎ মনে ত্যাগ।সংসার করবে কিন্তু ঈশ্বরকে ধরে। মনে রাখবে তিনিই সব। আমি তদারকি করছি মাত্র।তা হলেই দেখবে কামনা বাসনা লোভ এটা চাই ওটা চাই সব পালাতে শুরু করেছে। আর কোনো গোল নেই।
★★★
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ গল্পকার।অতি সাধারণ গ্রাম্য ভাষায় তিনি আমাদের অনেক অমূল্য” উদাহরন “গল্পের ছলে উপহার দিয়ে গেছেন। কথাতে বলে ” উপমা রামকৃষ্ণস্য”। তেমনই কামনা বাসনা নিয়ে ‘উপমা’ দিয়ে বলেছেন, মাঝির কথা।আমাদের শুনিয়েছেন মাঝির নৌকা বাওয়া আর জীবনপথে এগিয়ে যাওয়ার তুলনা।
মাঝি নদির আঁকবাঁক,জলের গভীরতা কোথায় কেমন ভালো জানে, তেমনই আকাশের ঝড়- তুফানও ভালো বোঝে। সেজন্য সে যখন নদীর এবং প্রকৃতির ভয়ের জায়গা গুলো পার হয় তখন শক্ত হাতে হাল ধরে রাখে। তারপর ঐ অবস্থা পার হয়ে এলে পরে, সে নিশ্চিত মনে তামাক খেতে বসে। তখন আলতো করে হালের ওপর একটা হাত দিয়ে রাখে। তখন নৌকা এমনই তরতরিয়ে চলে…।
ঠাকুর বুঝিয়েছেন আমাদের মতো অর্বাচীনদের, মনের মধ্যে কামনা বাসনার ঝড়- তুফান এলে অত্যন্ত শক্তহাতে তার মোকাবিলা করতে হবে। জীবনের খারাপ সময় দৃঢ়তার সংগে পার করবে মনের জোরে।তারপর আয়াশ করো নিশ্চিন্তে।তখন ঈশ্বরের কৃপাময় বাতাসে তোমারও জীবনতরী তরতর করে এগিয়ে যাবে।
ঠাকুরের সব কথা সত্যে প্রতিষ্ঠিত। তিনি বলেছেন “কলিতে সত্যে টান থাকা চাই।সত্যের ওপর তোমার প্রান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দরকার। তাহলে আর কোনো গোল থাকবে না। মিথ্যে মায়া সব চোঁ চা পালাবে।”
আমাদের দৈনন্দিন জীবনচর্চায় যেন আমরা ঠাকুরের উপদেশাবলি মেনে চলতে পারি। সেটিই হবে আমাদের জীবনের লক্ষ্য। তাঁর দেখানো সুবৃত্তিগুলি (যথাঃ সেবা, ত্যাগ, ক্ষমা,সত্য, বিবেক, বৈরাগ্য, লোভ- বাসনাদি ত্যাগ ইত্যাদি) যেন আমাদের জীবনে ফুটিয়ে তুলতে পারি। তাহলে হয়তো তাঁর শ্রীচরণের রাতুল স্পর্শ অনিবার্য ভাবে পেয়ে যাবো এবং তাঁর শরণে “শরনাগতির” নিশ্চিন্ত কূলে হয়তো পৌঁছে যাবো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
জয় ঠাকুর, জয় মা, জয় স্বামীজী
সমাপ্ত
★আগামীকাল অন্য প্রসঙ্গে কিছু অন্য কথা