একটি সাক্ষাৎকারঃ পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল

 

পরিচিতিঃ জন্মঃ ২৩/১২/১৯৪৯ মৃত্যুঃ ২৯/০৯/২০২০ ★প্রথম লেখেন- ইমন পত্রিকায়(১৯৬৫ খ্রীঃ) কাব্যগ্রন্থঃ দেবী [১৯৭০ খ্রীঃ] রাত্রি চতুর্দশী [১৯৮৩ খ্রীঃ] টেবিল, দূরের সন্ধ্যা[১৯৮৪ খ্রীঃ] পাঠকের সঙ্গে, ব্যক্তিগত [২০০১ খ্রীঃ] ধর্মপুত্র, এখানে আগুন [২০০৭ খ্রীঃ] বহিরাগত [২০০৮ খ্রীঃ]

চলিত ক্রিয়াপদের বাংলা আর লিখতে ইচ্ছা হয় না

                           -পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল

[ সত্তরের, মতান্তরে বিলম্বিত ষাটের, বিশিষ্ট কবিজন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল সেই ঊনসত্তর সালে কৃত্তিবাস-পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সবিনয়ে। এইভাবে, প্রথমাবধিই, বাংলা কবিতা চর্চার প্রবাহে তাঁর অন্যান্য কৃতিত্ব বহুবিধ। ‘দেবী’, ‘রাত্রি-চতুর্দশী’, ‘টেবিল’, ‘দূরের সন্ধ্যা’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে ও পুস্তিকায় যেমন, তেমনই গদ্য-রচনায় তাঁর সেই কীর্তি-চিহ্ন স্পষ্ট প্রতীয়মান। তরুণতর কবিদের প্রতি তাঁর অনাবিল আগ্রহের, ঔৎসুক্যের কথাও আমরা অনেকেই জানি। ঠিক সেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক দাক্ষিণ্য না-পেলেও, বাংলা কবিতায়, একক প্রাবল্যে, তাঁর অস্তিত্ব অনস্বীকার্য এবং অপরিহার্য।

বহুকাল তিনি কবিতা-দূরবর্তী বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করলেও তাঁর প্রতি আমাদের আগ্রহ এখনও সম-জাগরুক। এ-সংখ্যায় আমাদের লিখিত প্রশ্নের লিখিত জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি। কবিতা, রাজনীতি এবং নিজের সম্পর্কে তাঁর এই নগ্ন উন্মোচন আক্ষরিক অর্থেই বিস্ফোরক ও অস্বস্তিকর মনে হতেই পারে। রক্তমাংস-র পক্ষে তাঁকে প্রশ্ন করেছেন উজ্জ্বল সিংহ এবং সমোক দাস। শেষ চারটি প্রশ্ন সোমক এর, বাকি-সব প্রশ্ন উজ্জ্বল। কৃত। সম্পাদক-রক্তমাংস ]

প্রশ্ন : বহু বছর আগে একটি গদ্য-রচনায় আপনি লিখেছিলেন – ‘সাহিত্যের ইতিহাস ব্যর্থতারই, সফলতা কেবলমাত্র ফলশ্রুতি-অনুগ্রহ করে ব্যাখ্যা করবেন ?

উত্তর : এই প্রশ্নের প্রসঙ্গে, কোনও উত্তর-আধুনিক জবাব নয়, বরং এক দাক্ষিণ্য-প্রাচীন লেখক কে ডাকছি – “সংসারে প্রকৃত কবি বড় বিরল, তাই কবিকে দেখিয়া মানুষ বিস্মিত হইয়া যায়। কবি বড় বিরল, তাই কবিকে দেখিয়া মানুষ বিস্মিত হইয়া যায়। কবি বড় আশ্চর্য মানুষ। যৌবনে যে যৌনধর্মকে কেন্দ্র করিয়া লয় না, যৌবনান্তে বিষয় ধর্মে তাহার রুচি নাই, ধর্মকর্মেও সমান অরুচি। তাই সংসারী তাহাকে অকর্মণ্য বলিয়া গালি দেয়, ধার্মিক গালি দেয় দুষ্ট বলিয়া।…সে কোন্ সংসারের সমুদ্রতীরে নুড়ি কুড়াইতেছে, আর দেখিতেছে, উহা পরশপাথর কি না।
বেশির ভাগ কবির জীবন নিস্ফল অন্বেষণেই শেষ হয়, কিন্তু তাই বলিয়া তাহাদের জীবন নিস্ফল নয়। তাহাদের খোঁজার ইতিহাসই কাব্য।” -শরদিন্দু অমনিবাস, ১২-খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৩৮।
যে-অফিসার-সাহিত্য বা যে-প্রফেসার-সাহিত্য সাফল্য চায়, তার চিড়ে এতে ভিজবে না, আমি জানি। তবু, এইটুকু বলার, ব্যর্থতা আর বিফলতা এক জিনিস নয়।

প্রশ্ন : অন্যত্র আপনি ‘বিষয় নিয়ে কবিতা লেখা হয় না’-সুব্রত চক্রবর্তীর এই উক্তিটির সশ্রদ্ধ উল্লেখ করেছিলেন একবার। তাহলে কবিতা কী হবে?

উত্তর : ‘বিষয় নিয়ে কবিতা হয় না’-এই রুচির তারিফ করি, যিনি । বলবেন, ‘বিষয় নিয়েই কবিতা হয়’-তাঁরও জেদের তারিখ করি। কবিতা কী হবে-এ-প্রশ্ন কেন? কবিতা কি কোন মেধাবী ছাত্রের উত্তরপত্র? কোনও সংবিধান? কবিতা কেউ লেখেনা, কবিতা হয়। কোনও-কোনও লেখার মুসাবিদাকে স্থান-কাল-পাত্র কবিতা করে তোলে।

প্রশ্ন : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার একটি আলোচনায় সনেটকে ‘অবসোলিট ফর্ম’ বলেছিলেন। রণজিৎ দাশও এক সাক্ষাৎকারে সনেট সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন তা ‘সময়োপযোগী ফর্ম নয়’। উক্ত সাক্ষাৎকারে রণজিৎ দাশ আবার আপনার ‘রাত্রি-চতুর্দশী’-কে সনেট-ফর্মের সার্থক উদাহরণ হিসেবে গণ্য করেছিলেন। আপনি কী বলেন?

উত্তর : সুনীল, ভাগ্যিস বলেছিলেন। না-হলে সনেট নিজে লিখতাম না। বিজ্ঞজন যখনই কোনও কিছুকে অবসোলিট, ক্লীশে, ডেটেড প্রভৃতি বলেন, পড়ি-কি-মরি করে আমি সেদিকে দৌড়াই। ‘কবিতা হয়ে এ-লাইনে এসেছিলাম। এখন দেখছি, না, হচ্ছে, কিছু-কিছু হচ্ছে! এইজন্যেই আর লেখার উৎসাহ পাই না। …আর, একটা কথা, সনেট কোনও ফর্ম নয়, একটা ডেকর। ফর্ম কথাটাকে অত হালকা করে দেখতে চান তো দেখুন।

প্রশ্ন : রণজিৎ বলেছিলেন, ছন্দের ব্যবহার নাকি কবিতায় একটা রেডিমেড কাব্যিক উচ্চারণ এনে দেয়, যা একটা সময়ে ক্লান্তিকর ও ফাঁকা মনে হয়, গদ্য-কবিতারও সেই সমস্যা রয়েছে-আপনার কী মনে হয়?
উত্তর : বাঁধা-অবাধা দুই ছন্দেই যদি সেই সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে সমস্যাটা ছন্দে নেই, অন্য কোথাও রয়েছে। বাংলা লেখালেখির জগৎটা আমি অল্পসল্প জানি। বেশ কেরানি আবহাওয়ায় লিখে যেতে হয় প্রায় আপিস করার মত। প্রমোশন হয়। বন্ধুবান্ধবরা ফেয়ারওয়েল দেয়। কন্ডোলেন্স হয়! তো, যদি লিখে যেতেই হয় কাউকে, ওই ক্লান্তিকর ও ফাঁকা উচ্চারণটা বেরিয়ে পড়বে।

প্রশ্ন : ‘চলিত ক্রিয়াপদের বাংলা আর লিখিতে ইচ্ছা হয় না’ -আপনার একটি কবিতা শুরু হয় এই বাক্যে তাহলে কেমন বাংলা লিখতে ইচ্ছে করে আপনার?

উত্তর : বাংলা বাজারের বাংলা।

প্রশ্ন : আপনার ওই পর্যায়ের অসাধারণ গদ্য কবিতাগুলো লেখার আগে নিশ্চয়ই একধরনের উদ্দেশ্য বা চিন্তা-ভাবনা কাজ করেছে-সেই মানসিক প্রেক্ষিতটি জানতে ইচ্ছা হয়।

উত্তর : যদি এইভাবে বলেন ‘অসাধারণ -খারাপ লাগে, নিজেকে পড়াশুনোয় ভাল, গুডবয় মনে হয়।…না, না, মনের কথা বলা যে কাপুরুষতা হবে-শিবরাম চক্রবর্তী সাবধান করে দিয়েছেন।

প্রশ্ন : ছন্দ বিষয়ে আপনি কি গোঁড়া, অ্যাকাডেমিক—প্রবোধচন্দ্র অনুগামী ?

উত্তর : বহু লেখকের ছন্দ লাইসেন্স অর্থাৎ কথা বলার প্রস্বরটুকু কাজে লাগানো বা হলন্তহজম-এনিয়ে বহু ব্যক্তির সঙ্গে আড়াই দশক ধরে অনেক খ্যাচখ্যাচ খচরমচর করার পরও আমি গোঁড়া, অ্যাকাডেমিক? আমাকে অমন বানিয়ে যদি আনন্দ পান তো খারাপ কী! প্রবোধচন্দ্র, মোহিতলাল, রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথ, কি আরও অনেকের অনুগামী হওয়ার কোনও দরকারই তো পড়ছে না; অনেক উদাহরণ এঁরা পাননি। ধরুন, ‘বাঘা যতীন ছিল বাংলাদেশে রাজা শিব্রাম ছিল কোন্ ভ্রমে একদা কী করিয়া মিলন হলো দোঁহে নাতি ও নাতনী মাধ্যমে’ -এর বিশ্লেষণ কি পাওয়া গেল এঁদের আলোচনায়? যাক গে, এসব নিয়ে পরে একটা হিসাবশাস্ত্র আমি লিখে দেব।

প্রশ্ন : সামাজিক রাজনৈতিক বিশ্বাস বিষয়ে কিছু বলুন। বিশেষত, একজন কবির এক্ষেত্রে দায়িত্ব বা ভূমিকা এবং কবিতায় কীভাবে এই আদর্শ প্রতিফলিত হওয়া সম্ভব ?

উত্তর : ‘রাজনীতি’ মানে? নানা উর্দির রাজাদের কুটনীতি? এবং সেই কুটনীতিজ্ঞদের কবি বলে চালানো যায় লোককে ধরে। কিছু পেডগেজি করানো-এই তো কবিদের দায়িত্ব ও ভূমিকা? একটা ফরমান, একটা রাজরুচিকে পদ্য করা ? সাফ বলে রাখি যে, আমি বিশ্বাস করি, ‘পোয়েটস্‌ আর দি আনঅ্যাকনলেজড্‌ লেজিস লেইচার অফ দা ওয়ার্ল্ড! লোকযাত্রানির্বাহীদেরই উচিত কবিদের বোঝার চেষ্টা করা, কবিদের এ-প্রসঙ্গে কোনও আমপ্লিফায়ার বা পাব্লিক অ্যাড্রেস সিস্টেম হওয়ার দায় নেই।

প্রশ্ন : মায়াকোভস্কি, নেরুদা বা সুকান্ত এ-ক্ষেত্রে কতখানি সফল। অসফল ?

উত্তর : বিদেশি দু-জন সম্পর্কে কিছু বলব না, সুকান্ত কোনও কবি নন, পদ্যকার।
যাই মনে করুন, মূল কথাটা এই যে কবিরা ভালই খেয়াল করেছেন যে, আরে ব্রেক বলুন পাবলিসিটি বলুন, সবই পোলিটিক্যাল ক্যাম্প দিচ্ছে; এবং নন-কমিউনিস্ট ক্যাম্পের থেকে কমিউনিস্ট ক্যাম্পগুলি এ-প্রসঙ্গে আরও বেশি মুখর হবেই-কম্যুনিস্টরা র্যা গপিকার থেকে রিচেস এর দিকে আসছেন তো! …তাইলে তো দাদাদেরও কিছু দেওয়া দরকার। শুরু হল কবির দায়িত্ব বা ভূমিকা নিয়ে অন্তত প্রশ্ন করা, এবং উত্তর দেওয়া। কবির দায়িত্ব কী কোর্টপোয়েট হওয়া? ‘রাজনৈতিক বিশ্বাস’ কথাটার মানে? রাজনীতি একটা প্রয়োগ এবং ধারণাগুচ্ছ ঠিক, কিন্তু এর সঙ্গে বিশ্বাস টিশ্বাসের কোনও দৃঢ় সম্পর্কই নেই। যে রাজা দেশ চালাতে জানে না, তার নানা আড়ম্বর দরকার পড়ে, কবিদেরও ওই দেখনশোভা হিসেবে দরকার পড়ে। ইমার্জেন্স জারি করলেই মিসেস গান্ধীরা কলকাতার বুদ্ধিজীবিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। দেশ চালাতে পারলে, বসতে হত না। রাজনীতিকদের বক্তব্য আমি বুঝি এই যে কবিমশায়, মদন আমার, পাব্লিককে থোড়া গ্যাস খাওয়াও তো! খাওয়াতে পারলে, নানা প্রাপ্তির পাশাপাশি ‘উপরে বসিবার সুবন্দোবস্ত আছে’। নিজেকে অতটা কুক্কুট কলিজা, আমি, এখনও মনে করিনা; রাজদাদা ধরে পাব্লিসিটি পেয়ে লাইফ সাথথোক করতে হবে-পেছনে যদি এতই কম দম, দিলে যদি এতই কম কলিজা, তে এ-লাইনে আসো কেন গুরু! ধন্যবাদহীন কাজে থ্রিল পাননা, তো লিখলেন না কবিতা। রাজনৈতিক বিশ্বাস দায়িত্ব ভূমিকা সম্পর্কে গোটাকতেক ভণ্ড শব্দের ওই আড়-দরজা খোলা রেখে লাভ কি? এই ছামাজিক ঝাঁজনৈতিক প্রসঙ্গটা এখন কবিদের নাইনথ পেপার হয়ে দাঁড়িয়েছে; যদিও বলা হচ্ছে, না গো, এটা তোমার অপশনাল-তবু দেখো, এটাতেও না ফাসক্লাশ পাওয়া চাই! যদি প্রশ্নকারীকে বলা যায় যে, সমাজ কী ভাই, ডিফাইন করে দিন-কোন খেলায় তাঁরা পড়বেন, সে-খেয়াল আছে? এবং রাজনীতি বলতে নিশ্চই বি চৌধুরী-মার্কা গুড ওয়ার্ডস বোঝাচ্ছে না?
সামাজিক বিশ্বাস, পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট-এইসব হার্নিয়া ও হাইড্রোসিল ওয়ালা শব্দগুলোকে ছেড়ে দিলে, প্রকৃত তথ্য এই: কিছু কবি থাকতেই পারেন যারা সত্যিই ভালবাসেন এই দিকগুলিকে। কিছু কবি ভালবাসেন না। কোনও প্রশ্নালাপ নয়, লেখাই বলে সেই ভালবাসার কথা-কারণ, ভালবাসা সত্যিই সেই বিনিসুতোর মালা, স্বীকার করলে যা থাকে, স্বীকার না করলে যা থাকে না। এখানে কপট হওয়া চলবে না-কবির দায়িত্ব শুধু এইটুকু, খাঁটি মানুষ হিসেবে। খাঁটি মানুষ সমাজকে ভালোবাসে, হৃদয়বান রাজনীতিকেও, নিজেদের কাঁধকে বিস্তর শক্ত বোধ করলে কোনও-একটা আংশিক দায়িত্ব নেয়, না-পারলে নেয় না, কিন্তু পত্র-পত্রিকা করে মার্কসবাদ ছিটিয়ে কপচায় না। কিছু কবি কিছু মানুষ কিছু পরস্পর সত্যি সমাজকে ভালবাসতে পারে- সমাজের মহৎ এইখানে যে, সমাজ তাঁদেরও ভালবেসেছে। এবং রাজা এমনি এক লোক যিনি নিজে অন্যের বিশ্বাস উৎপাদন করেন, কিন্তু অন্য কাউকেই বিশ্বাস করা তাঁর পক্ষে মৃত্যুতুল্য, সুতরাং তাকে বেশি ভজা করে মনোবেদনা বাড়িয়ে লাভ নেই।

প্রশ্ন : আপনি কি মার্কসবাদের মূল সূত্রগুলিতে বিশ্বাস করেন? যদি না করেন, তাহলে কী ধরনের দর্শণ চিন্তার আপনি অনুসারী?

উত্তর : ‘ফিলোজফি-র তর্জমা ‘দর্শণ’ নয়; ফিলোজফি আমি প্রায় কিছুই পড়িনি। মার্কসবাদের স্পেশাল মজা হচ্ছে-চান্স অ্যান্ড অ্যাকসিডেন্টের সূত্র মানা। ‘অব্যর্থ গণনা, অব্যর্থ রত্ন বিধান’ প্রভৃতির পর ‘দৈব-দুর্ঘটনার জন্য দায়ী থাকব না’-ছাপা জ্যোতিষীর প্যাডের কথা মনে পড়ে যায়।

প্রশ্ন : আপনার কবিতায়, বিশেষত রাত্রি-চতুর্দশী-তে শক্তি সাধনার একটি পরিপ্রেক্ষিত স্পষ্ট লক্ষ্য করি। তান্ত্রিক-সাধনার ওই যে জীবাত্মা থেকে দিব্যস্তরে উন্নীত হওয়ার পর্যায়, তা কি আপনি কবিতায় প্রয়োগ করতে চেয়েছেন? ঠিক ধরতে পারি না। তন্ত্রের কথাই যদি ধরি, সে-ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্তরের যে কথা বলা হয়, যেখানে দক্ষিণাচার ও বামাচারের প্রসঙ্গ আছে-আপনি কোন পন্থী?

উত্তর : ধরে নেওয়া যাক যে, সত্যিই ও-রকম জৈব-দিব্য স্তর আছে, থাকল। উন্নীত হওয়া-টওয়ার দিকে আমি নেই। স্তর পরম্পরাগুলির সত্য বা মায়া কিছু কিছু পরিবেশনযোগ্য বলে মনে হয়-হয়েছিল। তন্ত্রে নানা কবিতা চূর্ণ আছে-অধিকাংশ ধর্ম-সাধনা আসলে একধরনের কাব্যচর্চা।….আর, আপনি কেন ব্যাপারটা ধরবেন, ব্যাপারটাই আপনাকে ধরবে।

প্রশ্ন : দেবীর কবিতা আমরা অনেকেই পড়িনি, সেই সব কবিতার আবহ ও অনুষঙ্গ বিষয়ে কিছু বলুন?

উত্তর : কিছু বলব না।

প্রশ্ন : আপনার পূর্ববর্তী সমকালীন বা পরবর্তী কবিদের বিষয়ে, পাঠক হিসেবে, আপনার কী দৃষ্টিভঙ্গি – বিশেষত সুনীল শক্তি-অলোক-রঞ্জন-আলোক-শঙ্খ, বুদ্ধদেব-দেবাশিস- ভাস্কর-রাসেশ্বর-পবিত্র, রণজিৎ অমিতাভ-জয়-মৃদুল-সুবোধ অনন্য-তুষার, মল্লিকা-অনুরাধা-জয়দেব-প্রমুখ ?

উত্তর : অনন্য প্রয়াত। অননার লেখা আমার কখনওই ভাল লাগেনি। আলোক সরকার ও অনুরাধা মহাপাত্র সম্পর্কে আমার বক্তব্য, এঁরা কবি নন, পদ্যকারও নন, জাল কবি। জয়দেব বসুর উদ্দেশ্য সভা-লেখন। অনেকের সম্পর্কেই কিছু বলছি এই কারণে, আমার এক বিচিত্র ভাগ্য এই যে, কাগজে-কলমে যদি কাউকে নিন্দে করি অমনি তিনি ভাল লিখতে থাকেন, প্রশংসা করলেই মাল ছড়াতে থাকেন। রেফ : মহুয়া চৌধুরী। ৮৮-তে গাল দিই ওঁকে এক লেখায় সেই থেকে শি হ্যাজ বিন ভেরি মাচ ইন প্রেজেন্ট। বুদ্ধদেব-দেবাশিসের লেখা পড়ি না, রাজেশ্বর বিষয়ে আমার কথা না-বলাই ভাল। ভাস্কর বিষয়ে অভিযোগ বহু, কিন্তু ওঁর লেখা পড়ি ও পড়বই – কালীকৃষ্ণেরও। শামসের, পবিত্র, সামসুল – কোথাও একটা অসহিষ্ণুতা কি এঁদের লেখার প্রথম থেকেই শুরু হয় – এঁদের বিষয়ে আমি পরিষ্কার নই। যেমন নই গৌতম চৌধুরীর বিষয়ে।

প্রশ্ন : সুনীল ও শক্তির মধ্যে কবি হিসেবে কাকে বেশি ইম্পরট্যান্ট মনে হয় ? আপনার একটি গদ্য পড়ে মনে হয়েছিল, শক্তি সম্পর্কে আপনার দুর্বলতা আছে, আপনার কবিতা যে-রকম থিমেটিক, স্কিমেটিক, সংহত ও লিরিক-বর্জিত, শক্তি তো একেবারে তার বিপরীত – তাহলে ?

উত্তর : শক্তি, ১৯৫৫ থেকে ৬৬ পর্যন্ত এই বারো বছর – আমার কিছু করার নেই। ৬৭ থেকে ফাংশন জমান। ৬৭ থেকে যে একেবারেই গেছেন সে-কথা নয় – কাঠের রেণুতে ছাল, শুধু তারই পরাগে আপ্লুত এ ধরনের জিনিস পাওয়া গেছে। কখনও কখনও – যা হোক –
আপনার এই প্রশ্ন দুটি দেখে আমার জিজ্ঞাসা, শ্যামলকান্তি দাশ, বীতশোক ভট্টাচার্য, হেমন্ত আঢ্য, স্বরাজ সিংহ – এমন অনেকেই এই তালিকায় নেই কেন? করুণাসিন্ধু দে, শঙ্কর দে, চিন্ময় গুহঠাকুরতা? মানছি এঁরা অল্পায়ু, কিন্তু এমন অনেক দীর্ঘজীবী আছেন যাঁরা all-পায়ু। কালীকৃষ্ণেরও নাম নেই। অথচ, ভাস্কর, কালীকৃষ্ণ ও ফাল্গুনী রায় – ভাস্কর ও ফাল্গুনী উত্তর কলকাতার সৌন্দর্য পরিবেশন করেছেন, মোমিনপুর বেহালা হীরেবন্দরের দিকটা কালীকৃষ্ণ। যেমন ৮৪-তে গোপনে নদীয়া গিয়ে দেখেছিলাম নদীয়ার রাগ হিস্টিরিয়া খুনাখুনির বহ্নিচক্রের দিকটা – নদীয়ায় মল্লিকা, অরুণ বসু ও আরও অনেকেই তখন – কিন্তু ওঁরা দেখছেন না – ওই জয়ই দেখছেন – না না, প্রত্যক্ষভাবে লেখার মোটা গদ্যে নয়। এসে পড়ছে। আমি সৌন্দর্যের বদলে আত্মা বলতে পারতাম, কিন্তু ‘আত্মা’ বললেই আপনাদের ওই রণজিৎ দাশ, অহমরুপসী যিনি বাংলা কবিতার, ভূতের ভয় পান। মেদিনীপুরের স্থানিকতার সৌন্দর্য শ্যামলকান্তি একসময় যথেষ্ট সাপ্লাই করেছিলেন – ওয়েলিংটন থেকে প্রায় ওই মোমিনপুর পর্যন্ত – রয়েড স্ট্রিট, মল্লিকবাজারের সৌন্দর্য উৎপল কুমার বসু – এখনও ও-সব জায়গায় তাদের সমুৎকণ্ঠিত রচনামনীষা অচেতচেতন লেগে আছে। আমি যে ভুলভাল বকছি না, তার প্রমাণ দিই। উৎপলের লেখার মূল মজা হচ্ছে একই সঙ্গে বিতর্ক ও সমাহিতিতে পাঠককে জড়িয়ে দেওয়া। তা দেখুন, বাগবাজার থেকে যুগান্তর পত্রিকাটাই উৎপলের খপ্পড়ে পড়ে, বহু বিতর্ক তুলে, সমাহিত হয়ে গেল!
অবশ্য, এ-সব কথা আপনাদের বলা ? আপনাদের এই তালিকায় অরুণ কুমার সরকারই নেই।… শক্তি কেন, সমস্ত কবির প্রতি আমার দুর্বলতা আছে – সমান সেই দুর্বলতা; ওঁর কবিত্ব তিন-পো, এর কবিতা দেড়-সের এমন বাটখারা নিয়ে বসিনি আমি – কারটা কত বড় এ-সব মাপতে যাই না। প্রশ্ন দেখে মনে হচ্ছে, বিজয়াগীতা অর্চনা সংযুক্তা সুতপার মারূপা অপাবৃতা প্রভৃতি মাহিল্য গোত্র ও তারাপদ, বীরেন্দ্রনাথ রক্ষি্‌ দেবকুমার, গৌতম বসু, গৌতম মুখোপাধ্যায়, অনির্বাণ লাহিড়ী- আরও অনেকের নামই বোধ করি শুনে ওঠেননি -ছেলে সুনীল ও ছক্তি । হ্যা, আমি জানি যে সুনীলকে অনেকদিন থেকেই কবি মনে করা হয় না এত পয়সা করিলি তুই আবার কীসের কবি রে – ইত্যাদি। সুনীলশক্তি শঙ্খ অলোকরঞ্জন – এঁরা চারজনই নিজেদের প্রতি অকল্পনীয় রকমে সাংঘাতিক অপরাধ করেছেন, শ্রীহীন সেই অপরাধগুলি হয়তো চির-অমার্জনীয়, কিন্তু চারজনই কবি। সুনীল ব্যতীত আর কেউ লিখতে পারেন না রাত্রির বর্ণনা, নীরার জন্য কবিতার ভূমিকা; যেমন যুগান্তর চক্রবর্তী ব্যতীত কে লিখবেন স্মৃতি বিস্মৃতির চেয়ে কিছু বেশী; তুমি নগ্ন করো নীল পান্থশালা – এ-পঙক্তি শক্তি পারবেন না – হাওয়া খোলে মাটি নীহার অরব পুকুরে শব্দ যুগান্তর পারবেন না। আরও ডিটেলে বলি, খুতখুতানি; পরিত্রাণ, তুমি শ্বেত, একটুও ধূসর নও – এই যে ‘শ্বেত’ এটা কি ভুলেও সাদা হবার উপায় আছে? এইসব ন্যুয়ান্সেস ধ্রুবক শব্দ ব্যবহার থেকে বোঝা যায়, কে কবি আর কে কবি না। অক্ষরের ভাঁজের ব্যাপার আছে – শঙ্খ লেখেন, ‘শরীর ভরে ঢেলে দিয়েছি আগুন, প্রবণতা। কখনওই ‘দিয়েছি ঢেলে’ নয়। ‘ঢেলে দিয়েছি’-র মধ্যে যে লুকোনো স্ল্যাং, লিঙ্গ ব্যবহাররত নরপুরুষের শ্রেণী চিত্র এবং তৎসুত্রে নিষ্প্রণয়ের সংশক্তি উপস্থিত করা – ‘দিয়েছি ঢেলে’ বললেই তা আর পাওয়া যায় না।
আপনারা কেমন লোক আমি জানি না, কমল কুমার মজুমদার কবিতার নামও করেননি।… মনীকন্যার যে-লঘুদংশন, পুচ্ছের ঝাপটা মল্লিকার লেখায় ছড়ানো, সুতপা তা পারবেননা , পারতে চানওনি; সুতপার লেখার নভোবর্ণার যে- নখজ্যোতি, সেটা পরিবেশন করা মল্লিকার পক্ষে সম্ভব নয়। এ বড় মজার খেলা এর মধ্যে কেউ-কেউ এসেছেন ‘ওই যে উনি এখনও লিখিতেছেন’, ‘ওই যেওনার নাম কত না শুনা যাইতেছে’ – এ-সব নিয়ে। নাম-ফাটানো নিয়ে ব্যস্ত আছেন। এদিকে, একজন লিখে বসে আছেন, ‘একদিন নীল ডিম করেছ বুনন – কী করে এঁর নাম ফাটবে?
শক্তির কবিতা নাকি নন-থিমেটিক, স্কিমেটিক নয়, অসংহত, লিরিসিজমে ভর্তি-কোত্থেকে পেলেন এ-সব? ও-সব লোক দেখানো। কবিতা স্কিমেটিক হয় এ-ও নয়, স্কিমেটিক হয় না এ-ও নয়। ভাইড চোখের বালি। কতক জেনে কতক না জেনে কবিতার কেলেঙ্কারিতে হাত দেওয়া হয়। কবিতা পড়া হচ্ছে, না ফিচার পড়া হচ্ছে? দেখুন,আমার ধারনা অনুযায়ী যিনি দুটিও কবিতা লিখেছেন, আর যিনি ২০০০ একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। যিনি ২০০০ তিনি কিছু বেশি সৌভাগ্যবান।… প্রণবেন্দু মোহিত দীপক কবিতা এমন অনেকেই নেই এই প্রশ্নের তালিকায়। কোন? এঁরা কেউ ছোটখাটো কবিদল নিমন্ত্রণ করেন না বলে ? রমেন্দ্রকুমার কেন নেই ? কবিতা নয়, জাল কবিখ্যাতি আমাদের অনেককেই শাসন করে। ওতে কিছু হয় না। জাল বানানো খ্যাতির মুখে পিছনে লাথি না মারতে শিখলে একজন, কবি পাঠক কিছুই হতে পারেন না। এ-লাইনে ওইটে প্রাথমিক কাজ প্রচারের আলো দেখলে তবে ভিড় করে এমন মৎস্য মস্তিষ্কের উচিত বিজ্ঞাপন-বিভাগে যাওয়া, জমবে। শঙ্খের কৃতিত্ব মাপহ, সুনীলের কৃতিত্ব মাপহ – এসব কানুনগো পেতে চান তো অন্য লোক ধরুন। এবং কবিতা কোনও কৃতিত্বের ব্যাপার নয়। পদ্য কৃতিত্বের। পদ্য-কৃতিত্ব ওই গ্যাং অব ফোর শক্তিসুনীলশঙ্খ অলোকদের আছে, আংশিকভাবে ভাস্কর রণজিৎ জয় মৃদুল মল্লিকার আছে। দেবারতির নেই, কিন্তু দেবারতিকে কবি হিসেবে একচুল নড়ানো সম্ভব নয়। পদ্যের মূল জিনিস মসৃণতা ও তারল্য। পদ্য জিনিসটা এক পার্ক ; ঠিক এর উল্টোদিকে কবিতা – যে কবিতা লিখেছে, পড়েছে, সে জানে – কবি খ্যাতি এক বেঁড়ে কৌতুক মাত্র – এক গাড়োয়ানি রসিকতা বিশেষ। কবিদের আবার কী গুরুত্ব ! কবিরা অতীব লঘু, বজ্রমণি যেমন লঘু হয়। গুরুত্ব ফুরুত্ব এসব অফিসার ও প্রফেসারদের জন্যে। কবিতা নির্বাসিত যুধিষ্ঠির ও ব্যোমকেশ : যুধিষ্ঠিরের পক্ষে লঘু না-হলে ভ্রমণ সম্ভব নয়, ব্যোমকেশ যশস্বী হলে গোয়েন্দার কাজটাই তার পক্ষে অসম্ভব হয়।

[এই বিস্তৃত ভৎসনা প্রশ্নকারীকে সহ্য করতেই হয়, কেননা, উত্তর লেখনকালে তিনি পার্থপ্রতিম বাবুর সমীপে ছিলেন না থাকলে অভিযোগের প্রত্যুত্তর হয়তো অসম্ভব ছিল না। – সম্পাদক।]

প্রশ্ন : আবৃত্তি-উৎসব, কবিতা-উৎসব – এ-সব ব্যাপারে আপনার বরাবর একধরণের বিরাগ লক্ষ্য করেছি, এসবে কিছু হয় না?

উত্তর : খুব বিরাগ কই, পড়েছি তো এসব জায়গায়। ফর্মুলা আছে। একটু খোলা ধরনের লেখা বা পদ্য শ্রোতারা নিতে পারেন। আগে, ছয়ের দশকে, ওভারটুন হলে শ্রোতারা ‘রাত্রির বর্ণনা’ সুনীলের গলায় নিতে পারতেন, কিন্তু এখন তাকে শিয়ালদায় গরিব বুড়ির গল্প বলে জমাতে হয়। শক্তি তো অবনী স্বেচ্ছাচারী ও আমি বাড়ি আছে।… তাছাড়া, উৎসব কীসের? তাহলে তো ‘আবৃত্তি শ্রাদ্ধ’, ‘কবিতাশ্রাদ্ধ’-ও হয়।

প্রশ্ন ; কবিতা, কৃত্তিবাস, শতভিষা থেকে এ-সময়ের ছোট পত্র পত্রিকাগুলি বিষয়ে আপনার বক্তব্য?

উত্তর ; কিছু নেই।

প্রশ্ন : ‘অন্ধযুগ’ সম্পর্কেও আমরা প্রায়-কিছুই জানি না, বিস্তৃত বলবেন?

উত্তর : না।

প্রশ্ন : আপনাদের সময়, পরিবেশ, বন্ধুতা, শত্রুতা ইত্যাদি বিষয়ে আলােকপাত করেন?

উত্তর : না। কারণ, আমাদের সময়টাই এখনও চলছে। ভয় হয় যে, আপনি পটল তোলার পরও চলবে।

প্রশ্ন : আপনি বহু তরুণ কবিকে প্রমোট করেছেন। এটা কি দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন? যাঁদের আপনি পাদপ্রদীপে এনেছিলেন, তারা সকলেই আপনাকে স্যাটিসফাই করেছেন কবি হিসেবে?

উত্তর : ‘প্রমোট’ কথাটা মিথ্যে ও কুৎসিত। যা করেছি নিজের স্বার্থেই করেছি – অর্থাৎ তাদের লেখাটা আর একটু ছড়িয়ে বুঝবার জন্য। সকলেই, অনুরাধা মহাপাত্র ছাড়া।

প্রশ্ন : কবিতার সঙ্গে আরবানাইজেশন-এর এক অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ককে আপনি স্বীকার করেন? শহর, বিশেষত একটি মেট্রোপলিটান শহর একজন কবিকে প্রকৃতই উর্বর করে তুলতে সক্ষম কি?

উত্তর : শহরবাসের সঙ্গে নাগরিকতার কোনও যোগ নেই। গদ্যে বলতে পারছি না আমি প্রোজ পাইনা, শক্তি-লেখা দিয়ে বলি, নাগরিকতা বলতে এই বোঝায় – ‘তলায় মনসার কাঁটা, উপরে উন্নত কোঠাবদ্ধ’।

প্রশ্ন : আপনার কবিতা পাঠ করে অনেক শিক্ষালাভ করে থাকি। একটা প্রশ্ন প্রসঙ্গত মনে হয়, কবিতা রচনা কি শেষ অবধি মেধা বৃদ্ধি বিজ্ঞান বা অকাল্টেশন নির্ভর শিল্পে পর্ষবসতি হবে? বিষাদ, আবেগ, ভালবাসার ব্যাপার থাকবে না আর?

উত্তর : আমার লেখা পড়ে শিক্ষা? হাঃ! এইবার বুঝতে পারলাম কেন আমি লেখা থামিয়ে দিয়েছে! আছে, আছে, সব আছে। মেধা, নির্মেধা, বুদ্ধি, নির্বুদ্ধিতা, বিজ্ঞান, অবৈজ্ঞানিকতা, নিবিষাদ, বিষাদ, আবেগ, আবেগ – সবই কাজে লাগে ও লাগবে – সবই জীবনের ধন, জীবনানন্দেরও, কিস্যু ফেলা যাবে না, দেখবেন।
রাঁধুনী হিসেবে আপনার এই প্রশ্নের উদ্বেগ আমি বুঝি – তবে কি সুক্তো আর আর রাঁধা হবে না (বিষাদ), পোস্ত (ভালবাসা) ইত্যাদি। নির্ঘাৎ হবে! না-হলে রাঁধুনীর বদনাম হবে, জানো, ওরা না ভ্যারাইটি পারে না। কবিতা এক দশকর্ম ভান্ডার বিশেষ।

প্রশ্ন : আপনার কবিতায় তীব্র যৌন-অবসেশন ও রিপ্রেশান-এর ইঙ্গিত সর্বদা লক্ষ্য করি – কী তার প্রকৃত তাৎপর্য?

উত্তর : ইস্কুলে বিরাট পেকে গিয়েছিলাম – তার জন্য; তাৎপর্য কিস্যু নেই।

প্রশ্ন : তরুণ প্রজন্মের কবিদের কেউ যদি আপনার কাছে কোনও পরামর্শ চান – আপনি কী বলবেন?

উত্তর : তরুণ প্রজন্মের কাছে আমিই পরামর্শ চাইব। কারণ শরদিন্দু বন্দ্যোর ‘উপদেশ’ পদ্য (দ্বাদশ খন্ড) – ‘ওগো প্রাচীন, আসবে যবে মৃত্যু দেবের রথ/খসিয়ে যবে আসবে মোহাবেশ মিনতি মোর পড়ো নাকো শ্রীমদ্ভাগবত/নিও তখন যুবার উপদেশ’। নিতান্ত তরুণ কবির কাছে সকলকেই রসে জব্দ হতে হয়। শক্তি এ-কথা লিখেছিলেন, কিন্তু, হাঃ হাঃ, তার নিজেরই সে-সব মনে ছিল না।

প্রশ্ন : বিদেশি কবি-লেখকদের মধ্যে আপনি কাকে পড়তে ভালবাসেন – কার লেখা খুব টানে? একটি গদ্যে জঁ জেনে-র উক্তি আপনি ব্যবহার করেছিলেন – ফরাসি সাহিত্য কি আপনার খুব প্রিয় ?

উত্তর : দুই মশাই, আমি আপনাদের মত লেখাপড়া-লাইনের লোক নই – স্টুজ পাবলিক-ফরাসি ভাষা, ফিলোজফি! সাহিত্য আমাকে টানে না। কতকগুলি মাল পোড় খেয়েছিল এইটুকু যা টানে, বিদেশি-স্বদেশিও ভালমত জানি না। শুনেছি, ফরাসি-সাহিত্য নাকি শুরু হয় একটা সংস্কৃত নাটকে, ভারতবর্ষে। পুরুরবা ও উর্বশীর সমাচারে, যেখানে উর্বশী পুরুরবাকে ত্যাগ করার সময় মানুষের সেই আশ্চর্য একাকীত্বের কথা বলে যাচ্ছেন।

প্রশ্ন : নিজের বিষয়ে কিছু বলুন – কোন তাড়না বা প্রেরণায় কবিতা রচনায় এলেন?

উত্তর : প্রেরণা – আগেই বলেছি – লিখে কিস্যু হয় না – ওই বাণীই আমার প্রেরণা। তাড়না বলতে এই যে, লিখতে বসলেই নিজেকে – এমনিতে খুবই পেঁচোয় পাওয়া বডি আমার কিন্তু লিখতে বসলেই নিজেকে এমন-এক হারকিউলিস মনে হত, যে লিখতাম। একধরণের মেল শভিনিজম আর কী?

প্রশ্ন : কৃত্তিবাস-পুরস্কারের বিষয়টি কেন প্রত্যাখ্যান ?

উত্তর : কৃত্তিবাস পুরস্কার-কৃত্তিবাস মানে শিব-ও হ্যা, গাঁজা বেলপাতা, সিদ্ধি-সে-বিষয়ে তো সকলেই জানেন। হয়েছিল কী, তখন সার্ত্রে নোবেল প্রত্যাখ্যান আমাকে খুব ইয়ে… তাছাড়া, আমার আগে (আসলে সে বছর যুগ্মভাবে আমি আর অমিতাভ গুপ্ত) যারা-যারা ওই পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাদের সকলকেই আমারখুব ইনসিগ্নিফিকেন্ট মনে হয়েছিল, হ্যাঁ দেবারতিও তখন পর্যন্ত তাই – তো মনে হল, ওই তালিকা আমি কেন আরও লম্বা করি! পরের বছর থেকে পুরস্কার তো বন্ধ হয়ে গেল। বাঁচা গেল!

প্রশ্ন : বেশ কয়েক বছর যাবৎ কবিতা দূরবর্তী আপনি – কেন এই নির্বাসিত মনোভাব? 

উত্তর : জানি, বলব না।

প্রশ্ন : জীবনানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু বলুন। একটি গদ্যে আপনি লিখেছিলেন, সন্দীপন নাকি সত্তর সালে জীবনানন্দ সম্পর্কে ‘প্রকৃত বামপন্থী’ এমত উক্তি করেছিলেন। আপনার কী মনে হয়?

উত্তর : সন্দীপন লিখেছিলেন। ‘বামপন্থী’ শব্দটি সম্পর্কে অহেতুক শ্রদ্ধা, বাঙালি-বামালিদের থাকে -ওঁরও ছিল, আমি ও-সব ভাবতে যাইনি কস্মিনকালে। সন্দীপন যখন লিখেছেন – সুতারং জীবনানন্দ বামপন্থী, অতএব জীবনানন্দ বামপন্থী, এবং জীবনানন্দ বামপন্থী ও তা বই কী, জীবনানন্দ বামপন্থী!
রবীন্দ্রনাথ এবং উনি-দুজনেই আপাতত বিশ্রামে আছেন কিছুদিন পর হয়তো কাজ নামবেন।

প্রশ্ন : তিরিশের বাংলা কবি ও কবিতার মূল্যায়ন করবেন কীভাবে – বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু…

উত্তর : বুঝেছি ! জীবনানন্দ-ছাড়া বাকি যাঁরা! সব ড্রেসিং গাউন ও চুরুট ওয়ালা ব্যক্তিত্ব – বাংলোচারী কমল মিত্র সব – সুধীন্দ্রের দুটি পদ্য ও একটি অনুবাদ-পদ্য ভাল; কবি হিসেবে এঁদের অণুমাত্র সমীহ করার কিছুই পাইনি আমি। এঁরা আসলে সাহিত্যকে একটি সামাজিক শ্রদ্ধেয় কাজটাজ-গাউন পরে ডিগ্রি নেবার মত মহিমময় কিছু ভেবে লেখার চেষ্টা করেছিলেন।

প্রশ্ন : জ্যোতিষ-চর্চায়, কবিতা-রচনার ফাঁকে ফাঁকে, আপনি আগ্রহ পান কেন- কবিতার সঙ্গে জ্যোতিষের যোগাযোগ কী?

উত্তর : কথাটা জ্যোতিষ নয়, ফলিত জ্যোতিষ, ওর সঙ্গে লেখার কোনও সূত্র নেই। তবু শনি, রাহু, কেতু শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে এ-সব কথায় রহস্য আছে – কিন্তু সে-সব বলার জিনিস না।

প্রশ্ন : কবিতা-সম্পর্কিত গদ্য ছাড়া, গল্প-উপন্যাস লিখেছেন ? কটি ? না।

উত্তর : ৫টা লম্বা উপন্যাস লিখেছি, প্রত্যক-কটি বাজে; সব বিসর্জন দিয়ে উঠতে ১৯৯০ হয়ে গেল।

প্রশ্ন : বর্তমান রাজনৈতিক আবহাওয়ায় কবিদের ভূমিকা কী?

উত্তর : সংযত, শুদ্ধ ভাষায় বলছি, বর্তমান রাজনৈতিক আবহাওয়ার তাম্বুগুলিতে বাম্বু লাগানো।

প্রশ্ন : মানুষের, রাষ্ট্রের নিয়তি শেষ-অবধি কে নিয়ন্ত্রণ করে – ধর্ম, না রাজনীতি?

উত্তর : ধর্ম বা ‘রাজনীতি সবই অস্পষ্ট শব্দ – ‘রাষ্ট্র’, ‘নিয়তি – এসবও তাই। এই শব্দগুলির মহায়ন কেড়ে নিলেই দেখা যাবে, এগুলো থুত্থুড়ে ঠাকুন্দার ঠাকুন্দা, বর্ষারাতের ভূত সব – শ্রাদ্ধ-শান্তির অপেক্ষায় বসে আছে। ‘নিয়ন্ত্রণ শব্দটি ক্ষমতালোভীরা পছন্দ করেন, শব্দটি আসলে এক টাই-পরা আমলা। ধর্ম-রাজনীতি এগুলো যেমন প্রফেসার-শব্দ, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ-নিয়তি এগুলো তেমন অফিসার-শব্দ। এত সারবান আমি নই যে, এই মহাগুরুনিপাতী গাম্ভীর্য বুঝতে পারব-হমে ছোড়ি দে রে সৈয়াঁ ছোড়ি দে রে ম্যায় নেহি জানে দুনিয়াদারি।

        ★একটি ফিরে ফিরে পড়া সাক্ষাৎকার  

                         (পত্রিকা-রক্তমাংস শরৎ ১৯৯১)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *