সহজ মানুষ-সহজপাঠ

 

পরম হংস শ্রীরামকৃষ্ণ,স্বামীজি ও মা সারদাময়ী-র মতাদর্শ ও দর্শনের অন্য আলো নিয়ে লিখছেন–নিমাই বন্দোপাধ্যায় “ঈশ্বর প্রসঙ্গে “— বিভিন্ন গ্রন্থে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, -মুনি-ঋষিদের কথায়, বাণীতে,প্রনম্য বহু অবতারদের, লেখক -সাহিত্যকদের লেখায় ও কথায় যা পড়েছি এ যাবৎ– সে গুলিই সহজ সরল ভাবে এখানে একত্র করেছি মাত্র। এর কোনোটিই এ অধমের পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি নয়।বলা যেতে পারে ” ছায়া অবলম্বনে “। আমার মতো একজন অর্বাচীনের এ স্পর্ধা কেন ঘটল ঈশ্বরই জানেন।আমি জানিনা।” ঠাকুর -মা-স্বামীজী মহারাজের শ্রীচরণ স্মরণ করে এ লেখায় উৎসাহিত হয়েছি,একথা স্বীকার করতে আমার কোনো বাধা নেই। আমি নিমাই বন্দোপাধ্যায়, দূর্গাপুর থেকে বাইফোকালিজম্ ওয়েব পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে এবং উৎসাহে প্রতিদিন কিছু কিছু লেখা নিয়েই – এই তৎপরতা

সত্যরূপে সনাতনী (দুই)

নি মা ই   ব ন্দো পা ধ্যা য়

” আর খাবো না। বা একবার গাড়ু- গামছা নিয়ে ঝাউতলার দিকে যাবো ” — যদি বলে
ফেলেছেন, – মুখের কথার সেই সত্যতা রাখতে
গিয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পেটে খিদে থাকলেও
আর খেতেন না। যদি খাই তাহলে সত্যের অপমান
হবে। শৌচের প্রয়োজন নেই, তবু যেহেতু মুখে
একবার বলে ফেলেছেন – সেইজন্য গাড়ু-গামছা
নিয়ে ঝাউতলার দিকটা ঘুরে আসতেন। লোকে
ভাবতো পাগল, কিন্তু আসলে তিনি সচেতন ভাবেই এসব করতেন – জগতবাসীকে শিক্ষা দেবার জন্যে। শুধুমাত্র সত্য রক্ষার্থে। যাতে করে আমরা বুঝতে পারি ” সত্য” ব্যাপারটা আমদের জীবনের কতটা গভীরকে স্পর্শ করে আছে। এবং এর মূল্যবোধ কতটা জরুরি একটা মানুষের জীবনে। ঠাকুরের জীবনে এমন অনেক ঘটনা, অনেক মূহুর্ত উজ্জ্বল হয়ে আছে যা আলোচনা করলে বোঝা যায় তিনি কতটা সত্যের ধারক এবং বাহকও।
প্রথমদিকে গিরিশ ঘোষ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কে
অনেক তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। ঠাকুরের গৃহী ভক্তরা এতে চটে ছিলো, উত্তেজিত ছিলো মনে মনে। তাঁরা চাইতেন না ঠাকুর গিরিশকে প্রশয় দিন। বা গিরিশের সঙ্গে কোনো সংযোগ রাখুন।
একদিন দক্ষিনেশ্বরে গৃহীভক্ত দের সাথে ধর্মালোচনা সাঙ্গ হলে ঠাকুর বললেন,” যাই ; আজ একবার কোলকাতায়, গিরিশের বাড়ি। তাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। ” রাম দত্ত, মনমোহন প্রভৃতি ঠাকুরের অন্য ভক্তরা বললেন, “না না, কক্ষনো যাবেন না, ও একটা পাষন্ড, মাতাল। আপনি নিজে থেকে কেন যাবেন তার কাছে
অপমানিত হতে? “
ঠাকুর স্মিত হেসে বললেন, ” মুখ দিয়ে যে বেরিয়ে গ্যাছে গো! যেতে তো হবেই। যাও যাও রাগ কোরোনি। কেউ একজন গিয়ে একটা গাড়ি ডেকে
আনো। ” — এই হলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। বলেছি যখন যাব। রাখব আমার কথা। সত্যের সম্মান আগে। চললেন পতিতপাবন জীবোদ্ধারে। এখানে তাঁর অহংকার নেই। ভেদাভেদ নেই। আগে সত্যরক্ষা, পরে অন্য অনুভব। আগে সূর্য পরে ভিন্ন পটভূমি।আগে মন পরে মনন। আগে নভমন্ডল পরে জ্যোতিষ্কালোক। আগে আকুলতা পরে কান্না… 
       ঠাকুর বলতেন; “পিঁপড়ের মত সংসারে থাকো।
বালিতে – চিনিতে মাখামাখি। নিত্যে – অনিত্যে মিশেল হয়ে আছে। বালি ছেড়ে চিনিটুকু নাও। অর্থাৎ সত্যটা ধরো আর মিথ্যেটাকে ছাড়ো।
ঠাকুর বোঝালেন — কী অসামান্য উপমায়!
বললেন – “আমরা যখন পা ফেলি, অর্থাৎ হাঁটি, তখন একপায়ে মৃত্তিকাকে ধরি, আর অন্য পা টা যখন তুলি তখন মৃত্তিকাকে ছাড়ি। একবার ধরা আর একবার ছাড়া। চলাচলের এটিই নিয়ম। ধরা আর ছাড়ার মধ্যেই পথ চলার নামতাপাঠ। এখন বোঝো কী ধরবে আর কীই বা ছাড়বে? ধর্মকে ধরো আর অধর্মকে ছাড়ো। ন্যায়কে ধরো আর অন্যায়কে ছাড়ো। সত্যকে ধরে অসত্যকে বিসর্জ্জন দাও। এমনি করেই তোমাকে এগতে হবে। সব পথে। ধর্ম পথে। কর্ম পথে। জীবনের নানান পথে। এটিই সচল পথ। সনাতন পথ।
একমাত্র পথ। আর বাকি যা কিছু সব ভাঁওতা।”

” অষ্টপাশে বদ্ধ হয়ে আছে জীব, এ সংসারে।
মহামায়া একটা চিকের আড়ালে আমাদেরকে
রেখে দিয়েছেন। যেমন বড়লোক বাড়িতে, জমিদার বাড়িতে, চিকের আড়াল থাকে। নাট মন্দিরের উঠানে যাত্রাপালা হচ্ছে, কবিগান হচ্ছে,কালিকীর্তণ হচ্ছে – বাড়ির মেয়েরা বসেছে চিকের ওপারে। তারা অনুষ্ঠান দেখতে পাচ্ছে। পাত্রপাত্রি সকলকে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু তাদের কে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। তেম্নি। “ঈশ্বর নিজে চিকের ওধার থেকে আমাদের দেখছেন,কিন্তু আমরা এই ভুলভুলাইয়াতে পড়ে
তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না। অষ্টপাশ মুক্ত হলেই তিনি প্রকাশিত হবেন। এই বন্ধন বড় শক্ত। “পাশ” শব্দের অর্থ দড়ি।অষ্টপাশ হল আটটি ধাপ যা শক্ত করে সংসারে জীবকে বেঁধে রেখেছে। লজ্জা ঘৃনা ভয় কুল শীল জাতি মান আর অভিমান। — এই হল অষ্টপাশ।


ঈশ্বরই একমাত্র বন্দনীয় কীর্তনীয় বরনীয় এবং কথনীয়। তাই তাঁর নামগুনগান সর্বাগ্রে প্রয়োজন। তাঁকে বন্দনা করা আর তাঁর নাম করা পরমার্থ সমান। তাঁর নামগুন কীর্তন তাঁরই শ্রীমূর্তীকে মনের মধ্যে উদ্ভাসিত করে। সকলে মিলে এক জায়গায় একমনে তাঁর নাম গুন কীর্তন করলে লজ্জা ঘৃনা ভয় মান অভিমান এসব থাকে না। আমি ব্রাহ্মণ ও শূদ্র হরিনামে রামনামে এসব মনে আসে না। নামের জোয়ারে সব ভেসে যায়। তাই হরিনাম করো। কৃষ্ণনাম করো। রামনাম করো। একমনে একসাথে একজায়গায় শুরু করলেই মনে বল পাবে। বুকে জোর পাবে। সবাই মিলে আছি – একটা নিশ্চিত আশ্রয় পাবে। আমি অমুক কুলের বৌ, আমি অমুক গাঁয়ের তর্কালঙ্কার বাড়ির ছেলে – হরিনামে এসব ভেসে যায়। সবাই সমান। হরিসভা সব্বার। সবার মান অভিমান ধুয়ে যায়। অন্য যাগযজ্ঞ আচার অনুষ্ঠানে মন্ত্রতন্ত্রে অনেক ভুল ত্রুটি ঘটে যেতে পারে। তাতে ঈশ্বরের তুষ্ট হবার বদলে রুষ্ট হবার সম্ভাবনা ও থাকে। হরিনামে সেই ভয় থাকে না। মুখে বলছি, কানে শুনছি হৃদয়ে অনুভব করছি। সব হরিময়। ভগবান নামের গুনে বশীভূত হন।
যখন নবানুরাগের বর্ষা আসে, যখন প্রথম কাল-বোশেখির ঝড় ওঠে, তখন সেই ঝড়ে কোনটা আমগাছ আর কোনটা তেঁতুলগাছ বোঝা যায় না। নবানুরাগে মান- অপমান থাকে না। তুচ্ছ- উচ্চ
থাকে না। ছায়া- কায়া থাকে না। ছোট- বড় থাকে
না। সব একাকার। সব তুমিময়। সব ঈশ্বরময়।
সব কৃপাময়। সব মঙ্গলময়।
এই আত্মদর্শনই ঈশ্বর দর্শন। এই অনুভূতিই
ঈশ্বরের চৈতন্য প্রকাশ।

শেষ

আগামী বৃহস্পতিবার অন্যকিছু অন্য অনুভবে…

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *