কাকচক্ষু দর্শন

বিনা স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা?

কা মা রু জ্জা মা ন

প্রথমে স্বদেশীর স্বদেশ সম্বন্ধীয় রাজসিক ধারণার ছাঁদটা একটু অন্যভাবে ভেবে নিতে পারলে মন্দ হয় না। প্রথমতঃ বলে নেওয়া ভালো যে দেশের দৈশিক ধারণাটা অত্যন্ত আধুনিক, তার আগে দেশ বলে কিছু ছিল না, যা ছিল তা হল সাম্রাজ্য বা বড়োজোর নগররাষ্ট্র (প্লেটোর গ্রন্থে রাষ্ট্রের কথা পাওয়া যায়)। সাম্রাজ্য যে কী বস্তু তা জানার জন্য সাম্রাজ্যবাদ কী তা জানাই যথেষ্ট, সাম্রাজ্য হারিয়ে সম্রাট বলে এখন কেউ না থাকলেও (তবে এখনও কিছু রাজা-রাণী বহাল তবিয়তে আছে) সাম্রাজ্যবাদ এখন আরও আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত হোয়ে সারা দুনিয়াকে শাসিয়ে ও দাপিয়ে বেড়ায়, তার নখদন্তের ধার কমেনি তো বটেই, বরং আরও বেশী হিংসাত্মক হয়ে উঠেছে। এখন সবই দেশ, সাম্রাজ্যের পারম্পর্য্যে যাদের সৃষ্টি, দুনিয়াটা ভেঙ্গে আরও টুকরো টুকরো হয়ে এক একটা দেশ, বলতে গেলে শাহনামার ক্ষমতানামায় বিবর্তন – সাম্রাজ্যের ক্ষমতার হাত-বদল হোয়েছে মাত্র কেন না ক্ষমতা ক্ষমতার হাতেই থাকে, সাম্রাজ্যবাদী ম্যাজিকানার জোরে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড দুই-ই থাকে। সেইঅর্থে এখন প্রায় প্রতিটা দেশই সাম্রাজ্যবাদী দেশ, যার যেমন ক্ষমতা।
প্রায় প্রতিটি দেশে যখন তখন দেশ দেশ করে চতুর্দিকে কলরব/হিংসার জয়ধ্বনি উঠতে শোনা যায়। ’এটা আমার/আমাদের দেশ, ওরা পরদেশী – ওদের এখানে কোনো ঠাঁই নাই।’ ওরা উদ্বাস্তু, ওরা পরদেশী। মানে, আমরা/ওরা নিয়েই একটা দেশ, এক একটা দেশ। যার দেশ, তার দেশ – আর কারুর নয়।”বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।” তা, দেশটা এল কোথা থেকে তার দেশ হোয়ে? তার নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস আছে যার সারকথা ক্ষমতা ও শক্তি। জোর যার মূলুক তার, তার জোরের উপর জোর খাটানো যায় না। জোর খাটিয়ে মানুষের দেশোদ্ধার হয় না। আর জোর যে খাটাবে মানুষের সেই ক্ষমতা কোথায়। মানুষের ক্ষমতা বা দেশ নাই (এবং মানুষের কোনো শাশ্বত মূর্তিমান সত্তাও নাই, ব্যাষ্টি ও সমষ্ঠি মিলিয়ে তার পুরাসত্তা খণ্ডিত ও বিকৃত, দেশহীন ও দিশাহীন বিমূর্ত মানব হয়েই সে বাঁচে, এবং বেঁচে থাকতে চায় – এটাই তার কালানুক্রমিক ইতিহাস)। দেশহীন আরও মানুষ আরও দিশাহীন, এই অবস্থায় তাদের জোর করে ধরে রেখে তাদের দিয়ে দেশের হোয়ে জোর খাটিয়ে নেওয়া হয়, দেশের মধ্যেই দেশবন্দী করে রাখা হয়। বলাই যায়, মানুষের আবার দেশ কোথায়, দেশ তাদেরই যারা তাদের অধিগত ক্ষমতায় মানুষের উপর শাসন চালায় – দেশ ক্ষমতার, ক্ষমতার দেশ।
জীবিকার সন্ধানে মানুষ চিরকাল এই মূলুক থেকে সেই মূলুক করে বেড়িয়েছে, (এবং এখনও বেড়ায়)। আর পাঁচটা জীবের মতোই মানুষ পরিযায়ী প্রাণী। মানুষের, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের যথায় স্ববাস তথায় তার পরবাস, তার স্বদেশ বিদেশ বলে কিছু থাকে না – তার যখন যেখানে, তখন সেখানে। আপাত অর্থে যেখানে সে থাকে সেটাকে তার স্বদেশ বলা হলেও কিন্তু নিজের দেশ নয়, স্বভূমি – নিজের যাপিত জীবনের স্থানিক পরিধি, জীবনের সীমায়িত পরিসর যার স্থান-কালিক স্থিতি পরিস্থিতি ভেদে ভেঙ্গেও পড়ে, তখন মানুষকে বাস্তুহীন হোয়ে পড়তে হয়। ক্ষমতা তার স্বভূমিকে কায়েম করে তাকে তার ’দেশ’ করে নেয় কেন না ক্ষমতার লক্ষ্যই হল আধিপত্য ও বিস্তার, সর্ব্বব্যাপী আধিপত্য। সেইঅর্থে, দেশ হোল ক্ষমতার বিমূর্তায়িত রূপ – আধিপত্য কায়েম করার গূঢ় অভিসন্ধি। তাই থাকে বলে বলা হোলেও মানুষের দেশ বলে কিছু থাকে না, যা থাকে তা হল তার স্বভূম, মাথা গুঁজে পড়ে থাকার একপ্রস্থ মৃত্তিক ঠাঁই – যখন যেখানে, তখন সেখানে। দেশ বলে যা বলা হয় তা তাদেরই যাদের হাতে ক্ষমতা থাকে। ক্ষমতা সব মানুষের থাকলেও থাকে না, থাকলে ক্ষমতা আর ক্ষমতা থাকত না, সবার মধ্যে বা সবার জন্য থাকলে তা আলাদা কিছু হয়ে উঠত না – অনেকটা কারুর সম্পদ বা আয়মা তালুকের মতো যার হাত-ফিরতিও ঘটে যাদের ক্ষমতা থাকে তাদের নিজেদের মধ্যে। যার সম্পদ, তার সম্পদ, ব্যক্তি-সম্পদ, সর্ব্বজনীন বলে কিছু নাই। শুধু পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতে নয়, পূর্ব্বতন আর সব ব্যবস্থাতেই এই একই রকম ব্যবস্থাবিধি : ক্ষমতা থেকে সম্পদ বা সম্পদ থেকে ক্ষমতার সমীকরণটা কখনই পাল্টিয়ে যাওয়ার নয় যার আদি উৎস ছিল অবশ্যই শারীরিক বল যা অন্যের উপর আধিপত্য কায়েম করে তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে চলেছিল।
যার সম্পদ থাকে না, তার ক্ষমতা থাকে না, দেশও থাকে না : যথা নাস্তি অধনস্ততা – যার ধন নাই, সে নিজেও যেন নাই। মানুষর যে দেশ হয় না বা দেশের মানুষ যে মানুষ বলে গণ্য হয় না তা কিছু আর্থনীতিক তথ্য দিয়ে বোঝানো যেতে পারে : আমেরিকার মতো অতিধনী দেশে দশ শতাংশ মানুষের হাতে মোট জাতীয় সম্পদের পঞ্চাশ শতাংশ গচ্ছিত, বাকি পঞ্চাশ শতাংশের জন্য মাত্র ১.৬ শতাংশ, মজুরদের আয়ও ক্রমশঃ অধোগামী। ভারতের পরিসংখ্যান আরও করুণ – এক শতাংশ অতি-ধনীদের হাতে যদি ৪২.৫ শতাংশ থাকতে পারে, তবে দশ শতাংশ ধনী ও অতিধনীদের হাতে মোট জাতীয় আয়ের কত অংশ থাকতে পারে? অধঃস্তন শ্রেণীর ৫০ শতাংশের হাতে মোট জাতীয় সম্পদের মাত্র ২.৮ শতাংশ। এইটুকু তথ্যই আমাদের চোখ ঘুরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট, এর থেকেও আরও বেশী ভয়ঙ্কর অনেক সত্য তুলে আনা যায়। সম্পদ বন্টনে অসমতা যে মানুষকে ক্ষমতার জিঞ্জিরে বেঁধে রাখে – এই বেঁধে রাখাটা যে অন্যায় ও অনাচার তা বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু বলতে হয়। গোটা দেশ-দুনিয়ার সর্ব্বত্র এই একই অবস্থা। অভাব অনাচারের বিরুদ্ধে অনেক লড়াইও হয়, কিন্তু তেমন কিছু হয় না (লড়াইটা নিছক অভাবের বিরুদ্ধে ভাবলে ভাবলে ভুল হবে, কেন না অভাবের কোনো মাপকাঠি থাকে না, এটা আসলে সার্বিক অসমতার বিরুদ্ধে লড়াই, কেন না সার্বিক অসমতাই অভাবের কারণ ও ফল। অভাবকে বুঝতে গেলে সার্বিক অসমতার নিরিখেই বুঝতে হবে)। অভাবের বিচার চাইবে মানুষ? কার কাছে? যার কাছে বিচার চাইবে তার বিচারের রায় তো সবার জানা অঙ্ক কষা সুদ – শুভঙ্করী বিচার। অভাবী অবস্থায় মানুষ দেশকে স্বদেশ বা নিজের দেশ বলে ভাববে কী করে? তবুও ভাবে, ভুলভাবে ভাবে, নিজের দেশ বলেই ভাবে, তাকে ভাবানো হয়। ভাবানোটা আসলে শাসনতন্ত্রের ধ্র“বপদ। এর দুস্তর বিস্তার : ওহি রাম ঘট ঘট মে লেটা। এইভাবে মানুষ দেশপৃক্ত দেশপৃষ্ট হয়ে পড়ে।
ভাবা ও ভাবানোটা ঘটে মানুষের ভাষায় – মানে যে-মানুষ যে-ভাষায় কথা বলে।
ভাষায় ভাষানিষ্ঠ হয়ে অভাবের বিরুদ্ধে মানুষের দাবি হবে : আমার স্বদেশ চাই! আমার অভাবের ভাষা চাই!


স্থাবর অস্থাবর সম্পদের মতো না হলেও ভাষা মানুষের অন্ততঃ একটা সম্পদ, জন্মগত সম্পদ (এবং একদিক দিয়ে ক্ষমতাও), ক্ষমতার ছাড় পাওয়া ও ছাড় না-পাওয়া সম্পদ (ও ক্ষমতা), যা ছাড়া তার অন্যসব সম্পদ অর্থহীন, বিনিময় প্রথায় অর্থের দস্তুরের মতোই ভাষার ভূমিকা (an ideal of the marketplace – টমাস হবস) – ভাষা দিয়েই তার যাবতীয় জাগতিক বিনিময় চলে, জগতের সঙ্গে জাগতিক সম্পর্ক স্থাপিত থাকে, এই সম্পর্ক দিয়েই নির্ম্মিত মানুষের ভাব-সঙ্গীত, আবার এই ভাব-সঙ্গীতই হল মানুষের সংস্কৃতি (এবং ধর্ম্মও) বলতে যা বোঝায় তা। ভাষা ও ভাবনার উদ্বায়ু বন্ধনে তারা উভয়ে উভয়ের অর্ধ্বেক আত্মা স্বরপ, তাদের সত্তা ও অস্তিত্ব এই বন্ধনে সমর্পিত থেকে কেউ কাউকে ছেড়ে থাকে না, ছেড়ে থাকলে মানুষকে চিরকাল নির্ভাব হয়ে থাকতে হত, নির্ভাব হয়ে থাকতে হলে মানুষের মুখ দিয়ে কথা ফুটত না – ভাব না থাকলে ভাষার স্ফুরণ ঘটে না, এবং বিপরীতক্রমে ভাষাকে মাধ্যম হিসাবে না পেলে ভাব বা ভাবনার বিনিময় ঘটে না, নিজের সঙ্গে নিজের এবং নিজের সঙ্গে অন্যের ও বহির্বিশ্বের (আসলে গোটা জগতটাই ভাব করার জন্য, তাকে নিয়ে ভাবনা করার জন্য – এটাই মানুষের জীবনসংস্কৃতি : মৃত্যুক্ষণ পর্যন্তও মানুষের ভাব থাকে, ততক্ষণ পর্য়্যন্তই ভাষা তার শিঙা ফুঁকে যায় – আদমের দম শেষ তো ইসরাফিলের দামও শেষ)। সংস্কৃতি যেমন মানুষের ব্যষ্টি ও সমষ্ঠি জীবনের অভিপ্রকাশ, ভাষাও তেমন মানুষের জীবন সংস্কৃতির অন্তরঙ্গ ভাষ্য ও ভাষক – সেই প্রেক্ষিতে মানুষের জীবন একটা বিশাল (সামাজিক) সংস্কৃতি যার উপর ভিত্তি করেই বলতে গেলে সমাজের সাংস্কৃতিক উপসৌধ (super-structure) নির্ম্মিত, তাতেই মানুষের ভাঙ্গা ও গড়ার অন্তহীন খেলা চলে, এবং মানুষ একইসঙ্গে তার শিকার ও শিকারী।
সম্পদ হিসাবে ভাষাও মানুষের একটা অধীত ও চর্চিত ক্ষমতা আসলে যা ক্ষমতার পরিসরের বাইরে থেকে তার বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধ্বী হোয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে, যাপিত জীবনের পরম্পরায় এই সম্পদকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইলেও সহজে কেড়ে নিতে পারে না, দমন করতে চাইলেও তা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে চরাচরে। পারলে মানুষ ভাষাকে ধরে থাকে, আঁকড়ে রাখে। দেশও একটা নয়, ভাষাও অগুণতি : মোট দেশের সংখ্যার চেয়েও অসংখ্য। শুধু তাই নয়, একটা দেশ ও প্রদেশের মধ্যেই অসংখ্য ভাষার বিচিত্র সহাবস্থান, কারুর চালচিত্রের সঙ্গে কারুর মিল থাকে না – থাকার কথাও নয়। অবশ্য স্থানিক সামীপ্যের কারণে ধ্বনিগত ও অর্থগত কিছু মিল থাকলেও থাকে, তবে ওইটুকুই। প্রকার প্রকরণের দিক দিয়ে প্রতিটা ভাষাই আলাদা ও স্বতন্ত্র, অন্য কারুর ভাষা বুঝতে গিয়ে তাই হোঁচট খেতে হয়ই। তবে কিছুটা হয়তো বোঝাও যায়, আবার বোঝাও যায় না – যখন বোঝানো যায় না, অথচ বোঝানোটা জরুরী হয়ে ওঠে, ভাষা তখন মানুষের শরীরের রূপ নিয়ে হাত-পা নাড়তে শুরু করে, চোখে ইশারার ঝিলিকও ওঠে কেন না সবেতই কিছু না কিছু বলতে চাওয়ার ইঙ্গিত ও অভীপ্সা – সেটা বোঝাতে গিয়ে ও বুঝতে গিয়ে স্বয়ংসিদ্ধ ভাষা হয়ে ওঠে, যা বলতে বা বোঝাতে চাওয়ার তার কিছুটা হোলেও ঘটে যায়, কাজের কাজটা হয়ে যায় বটে তবে তা নিয়ে খুব বেশীদূর যাওয়া যায় না, এবং অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির মতো বহুকিছুর ন্যারেটিভ ইশারা ইঙ্গিতে প্রকাশ করা যায় না কেন না ইশারা ইঙ্গিতের শব্দকোষ স্বভাবতঃই খুব সীমিত : ’এমন একটা পৃথিবী চাই/ মায়ের আঁচলের মতো/ আর যেন ওই আঁচল জুড়ে/ গান থাকে/ যখন শিশুদের ঘুম পায়।’ (বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) – (প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসার সংবৃত ও সংগুপ্ত উচ্ছ্বাস নিটোল চোখের ভাষা দিয়ে স্পর্শের ভাষা দিয়ে উপলদ্ধি করা গেলেও) কবির ওই অন্তর্গূঢ় ভাব ও ভাবনাটা কি ইশারা ইঙ্গিতের ভাষা দিযে কখনও বোঝানো সম্ভব? না, সম্ভব নয়?
তবুও বলা ভালো যে চোখের ভাষা দিয়ে স্পর্শের ভাষা দিয়েও কবিতা হয়। চোখের ভাষায় আগুনও থাকে, ফাগুনের হাওয়াও থাকে।
আগুন ও ফাগুনের হাওয়ায় কবিতাও থাকে। যা রয়ে যায় অন্তর্মনে। কবিতা অন্তর্মনের সৃষ্টি। তবুও তাকে বহির্মনে উঠিয়ে আনার জন্য অন্য আরও একটা ভাষার সামিল হওয়ার দরকার হয়ে পড়ে। বলার কথা এটাই যে ইঙ্গিত ও ইশারায় ভাব থাকলেও অন্য আরও একটা ভাষায় তার ভাবোপলব্ধি ঘটে – এটা ছাড়া মানুষের অনুভূতি বা বোধশক্তি কাজ করতে পারে না (পশুদেরও ভাব থাকে, সেটা তারা উপলব্ধি করতে পারে তাদের প্রবৃত্তি দিয়ে)। অন্ধ হস্তিদর্শন করতে পারে না বটে কিন্তু তার গা’য়ে হাত ছুঁইয়ে তার বিশালত্ব অনুভব করতে পারে, ফুল বা ফুলের রঙ দেখতে না পেলেও নাক দিয়ে তার গন্ধের স্পর্শ পায় এবং বুঝতে পারে ফুলের পাপরিতে গন্ধ থাকটা তার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এমন কি এই গন্ধ ও স্পর্শের অনুভূতি তার স্মৃতিতে রয়ে যায়, সহজে মুছে যায় না, স্মৃতি তো নিজেই একটি ভাষা, ভাষা না হলেও অন্ততঃ ভাষার অনুসৃতি, তাকে ধরে রাখে, সময় বিশেষে জাগিয়ে তোলে।
মানুষের ইন্দ্রিয় সমূহের নিজস্ব ভাষা আছে, ভাষার সমর্থনে তারা অনুভূত বা উপলব্ধ হয়ে ওঠে। চোখের বা হাত-পা’য়ের ইশারায়ও কথা ফুটে ওঠে।
এই ভাষা হল মানুষের মুখের ভাষা, মানুষের জন্মের পর প্রথম বলতে শেখা ভাষা, নিজম্ব ভাষা যা কখনও পরস্ব হওয়ার নয় (একটা কেন, জন্মের আরও পরে মানুষ একাধিক ভাষাও শিখতে বলতে পারে – তবে প্রথম বলতে শেখা ভাষাটাই তার মুখ্য ভাষা, নিজের স্বাধীত ভাষা, এবং পরিস্থিতি সাপেক্ষে সেই ভাষা অমুখ্য হয়েও উঠতে পারে অন্য কোথাও বসবাস করতে গিয়ে, যখন তাকে সেখানে সেই জায়গার ভাষায় কথা বলতে ও শুনতে হয়, ব্যবহারিক প্রয়োজনে তা শিখে নিতেও হয়, তখন সেই ভাষাটাই ক্রমশঃ তার পরিবর্ত ভাষা হয়ে ওঠে, অনেক ক্ষেত্রে অভ্যাসের অভাবে বা একাদিক্রমে প্রয়োগ করতে পারার সুযোগের অভাবে তার মুখ্য ভাষাটা স্মৃতিতে বিস্মৃত হোয়ে উঠতে পারে, ওঠেও, বুঝতে পারলেও বলার ক্ষেত্রে অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যেতে পারে এবং উচ্চারণে সঠিক স্বরভঙ্গী থাকে না – ভাষাটা স্মৃতিতে ধরা থাকলেও, স্বরভঙ্গী অসংবৃত হোয়ে পড়ে)। মানুষের প্রথম শেখা মুখের ভাষা বা যে-ভাষা পরিবেশে মানুষ গড়েপিটে ওঠে তাই তার মাতৃভাষা (lingua materna) বলে পরিচিত, কিন্তু তা প্রথমতঃ মা’য়ের শেখানো ভাষা বলে মনে হলেও মা’য়ের পেট থেকে শিখে আসা ভাষা নয়, প্রধানতঃ মা’য়ের কাছ থেকে ও পরিপার্শ্বের নানাজনের কাছ থেকে নানা শব্দ ও ধ্বনি শুনে শুনে শেখা (শিশু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রথমে মা বলতে শেখে, এবং পৃথিবীর সব দেশেই ’মা’ শব্দের শব্দধ্বনি প্রায় একই) এবং মা’য়ের সঙ্গে তার ভাষার নাড়ি-বন্ধন থাকলেও সেটা কিন্তু খুব সামান্যই। এমন কি বিদেশে গিয়ে জন্মালে সেই দেশের ভাষিক পরিবেশে শিশু তার মা’য়ের ভাষা অধীত নাও করতে পারে।


মানুষের সমস্ত কিছু শেখার মধ্যে একটা জেনেটিক ব্যাপার থাকেই। আসলে মানুষের প্রায় সবকিছু জেনেটিক সঙ্কেত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত – তার শারীরিক গঠন ও মানসিক বৃত্তিসহ আরও বহুকিছু। মানুষের শরীরটা যেমন জিনের, মানুষের মন ও বুদ্ধির ক্ষমতা বা অবধারণ ক্ষমতার (cognitive power) মূলেও জিন। তবুও জিনই সবকিছু নয়, মানুষের জিনগুণই সবকিছু নয় – তার উপর পরিবেশ প্রভাব পড়ে তা পাল্টিয়ে যেতে পারে, এবং যায়ও। মানুষের জিনগুণ ও পরিবেশের প্রভাব মিলিযে মানুষের জীবগুণ গড়ে ওঠে, এই জীবগুণও কিন্তু পরিবেশ ও সামাজিক অবস্থার চাপে কোনো নির্দ্দিষ্ট স্থানাঙ্কে স্থিত থাকে না, পরিস্থিতি ভেদে বদলেও যায়। বহুকিছু ভুলে গেলেও মানুষ তার শেখা ভাষা খুব সহজে ভোলে না, বিশেষ করে তার নিজের ভাষা, তার শব্দ বাক্য বিন্যাস তার স্মৃতিতে রয়ে যায় চিরাচরিত অভ্যাস বা অভিজ্ঞতার মতো : The fox knows many things but the hedgehog knows one big thing. মানুষের ক্ষেত্রে সেটা হোল তার ভাষা, বিশেষতঃ তার নিজের ভাষা। যা নিয়ে এক একটা গোষ্ঠী জাতি সম্প্রদায় জনপদ গড়ে ওঠে। প্রতিটা জাতি গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা থাকে যা তাদের জাতিত্বের স্মারক এবং এই জাতিত্বের স্মারকেই মানুষ তার সংস্কৃতি বহন করে চলে। এবং প্রথমে যে-মানুষ যে-ভাষা শিখে কথা বলে, নিজের ভাব ও ভাবনা ব্যক্ত করে এবং অন্যের সঙ্গে (এবং নিজের সঙ্গেও) বিনিময় করে সেটাই তার নিজের ভাষা বা স্বদেশী ভাষা। ভাষাই হল মানুষের আসল বাসা, মানুষ ভাষায় থাকে – ভাষায় খায় ও পরে, ভাষায় বলে ও শোনে, এবং সেই ভাষাতেই স্বপ্ন দ্যাখে, এমন কি এই ভাষা ছাড়া তার আরও ভাষা জানা থাকলেও সে ওই একই ভাষাতেই ভাবে ও স্বপ্ন দ্যাখে (মানুষের স্বপ্নের ন্যারেটিভ কখনই অন্য ভাষায় হয় না, স্বপ্ন দেখলে তার রঙও রঙীন হয় না, মানুষের দ্যাখা স্বপ্নের ভাষাছবির রঙও সাদা-কালো – কখনও এর ব্যতিক্রম ঘটলে বুঝে নিতে হবে সেটা একটা বিরল ব্যতিক্রম)। মানুষের অবধারণ ক্ষমতা সহজাত হলেও তার ভাষা শেখাটা কিন্তু সহজাত নয় (চমস্কি যেমন বলেন), যখন যা কানে আসে শিশুকে তা শুনে শুনে শিখতে হয়, তারপর বুঝতে হয় এবং বুঝেই তার শেখাটা সম্পূর্ণ হয় যখন সে নিজেই কথা বলার ক্ষমতা অর্জ্জন করে। মানুষ যখন অন্য ভাষায় কথা বলে ও অন্য ভাষার কথা শোনে তখন তার অবচেতনে একটা অব্যবহিত অনুবাদ ক্রিয়া ঘটে চলে, তাৎক্ষণিক এই অনুবাদ-ক্রিয়া না ঘটলে মানুষের মুখ্য ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার সমন্বয় সাধন সম্ভব হত না, এমন কি স্বভাষার ক্ষেত্রেও সেটা সত্য কেন না ভাবনা ও ভাষার পারস্পরিক অনুবাদায়নের মাধ্যমেই তাদের অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন ঘটে চলে (কোনো দৃশ্য দেখে বা কোনো শব্দ শুনে সেটা ভাষার মাধ্যমে অনুধাবন করাটাও অন্য আর এক ধরনের অনুবাদ-ক্রিয়া, ভাব-বিনিময় করার ক্ষেত্রেও এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে, বলতে গেলে ভাষার যাবতীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বক্তা-শ্রোতার মধ্যে ভাব ও ভাবনার বাদ ও অনুবাদ, এই অনুবাদায়ন ব্যতিরেকে ভাবনা ভাষায় মূর্তায়িত হতে পারে না বা ভাষাও ভাবনায় বিমূর্তায়িত হতে পারে না)। মার্কস প্রসঙ্গতঃ মন্তব্য করেছেন যে যে অনুবাদ ক্রিয়া ছাড়াই অন্যভাষা বলতে ও বুঝতে পারে সে-ই অন্যভাষা অন্তরস্থ করে ফেলেছে বলা যায়। কিন্তু অনুবাদ ক্রিয়াটা হয়ই। মনে রাখতে হবে যে একভাষা ও অন্যভাষার মধ্যে অনুবাদায়ন কিন্তু একই ভাষার মধ্যে অনুবাদ-ক্রিয়া এক নয়।
পরন্তু, একটা ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করা প্রায় অসম্ভব। প্রতিটা ভাষার নিজস্ব ভাব ও ভাবধারা (অনেক চলতি কথাও) থাকে যা অন্য ভাষায় সঠিক ভাষায় উঠিয়ে আনা যায় না। বাঙলায় যখন বলা হয় ’তোমার হচ্ছে’ কিম্বা ’বেশ হয়েছে’ বা যখন ইংরাজিতে বলা হয় my way, or the high high way (আমি যা বলছি করো, নতুবা ভাগো) কিম্বা যখন বলা হয় my foot! তখন তার মানেটা কী দাঁড়ায়? এইসব কথা কি অন্য ভাষায় ঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব? তবে মনে রাখতে হবে এগুলো অত্যন্ত চলিত বা কথ্যভাষা যা অনেক সময় সেই ভাষার মানুষও বুঝতে পারে না। এইসব চলতি কথা কোন অজান্তে শিল্পে-সাহিত্যেও ঢুকে পড়েছে, এতে না কি শিল্প-সাহিত্য ’আধুনিক’ হয়ে উঠেছে – তা হোক, প্রকৃতির সবকিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাষাও বিবর্তিত হোয়ে উঠেছে, মানুষের পড়ে থাকলে চলে না, কিন্তু আধুনিক হওয়াটা কি এতই জরুরী? অতীত মধ্যযুগীয় অন্ধকার, সন্দেহ নাই, কিন্তু অন্ধকার থেকে আলোয় আসতে গিয়ে মানুষ একটা নতুন শরীর পেয়েছে ঠিকই, আধুনিক মন তো পড়ে আছে সেই সংস্কার শোষণে যারই কারণে অতীতে একটু-আধটু যা মূল্যবোধ ও নীতিনিষ্ঠা ছিল (নীতিনিষ্ঠার ব্যাপারে কান্ট অতটা কঠোর না হোলেও পারতেন), এখন তাকে সূঁচ খোঁজার মতো করে খুঁজতে হয়। আধুনিক বলতে যা বোঝায় তা শুধু গতির কারণে নয়, বিপ্র-গতির কারণেও। অতীতের অনেককিছু অন্যায় অবিচার হোলেও, মানুষকে বহুভাবে পিছিয়ে রাখলেও তার সবকিছু বর্জ্জনীয় কাম্য হোতে পারে না, আধুনিক সমাজেও বহু আবর্জ্জনা এসে জমেছে যাদের বর্জ্জনা আরও বেশী কাম্য – আধুনিক সমাজ তো আবর্জ্জনার নিউক্লিয়ার ¯তূপ। ভাষাকে আধুনিক করতে গিয়ে ভাষা নামতে নামতে তার প্যান্ট কোমর পর্য্যন্ত উঠে এসেছে, তার সেই আর স্বগরিমা নাই। ভাষাকে লাটিন-সংস্কৃত যুগে পড়ে থাকতে হবে এমন কোনো মানে নাই, কিন্ত সহজ ও সহজবোধ্য করে তোলার মধ্যে ফাঁকি থেকে যায়।
ভাষা চর্চার বিষয়। চর্চা না করলে স্থবির হয়ে পড়ে। পরিশীলিত হয় না। সাধারণ মানুষের অভিষ্ট উপলব্ধিকে ছুঁতে পারে না। ভারতের সব প্রাচীন শাস্ত্র-সাহিত্য সংস্কৃত ভাষায়, সাধারণ মানুষ সংস্কৃত ভাষায় কথা বলত না এবং বুঝতও না – সেটাই ছিল রচয়িতাদের ধূর্ত উদ্দেশ্য : সাধারণ মানুষকে শাস্ত্র বুঝতে না দেওয়া, সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর সমাজ ও সংস্কৃত থেকে তাদের ব্রাত্য করে রাখা এবং ব্রাহ্মণদের মন-কা-বাতে মানুষকে বেঁধে রাখা (বিদ্যাসাগরকে বিধবা-বিবাহ প্রচলন করতে গিয়ে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি)। বোঝাই যায় ভাষা নিয়ে মানুষের বিরদ্ধে হীন ষড়যন্ত্র/স্বেচাচ্ছাচার চালিয়ে যাওয়া যায়। এবং কারচুপি করে ভাষা দিয়ে মানুষকে ঠকানোও যায়। যারা ঠকে তারা ঠকে। বিশেষ করে যখন ’মন-কি-বাত’ হয়।
ভাব থেকেই ভাষা। বা, বলা যায় যে ভাবই ভাষা। মনকে কৃষিকার্য্য করতে হয়। তার আবাদে সোনা ফলে। মানে, ভাবেরও চর্চ্চা করতে হয়, সেটা একটা মানুষের স্থির বৌদ্ধিক বৃত্তি, চর্চ্চা করলে ভাবের সমৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ হয় যা সম্প্রসারিত হোয়ে শেষপর্য্যন্ত ভাষায় গিয়ে মেশে, ভাষা সেটাকে ধারণ করে রাখে আপন করে। ভাবের অভাব থাকলে ভাষার ভাষা জোটে না এবং ভাষা না মিললে ভাবের স্বতঃপ্রকাশ ঘটে না, ভাবের ভাবসঙ্গী হিসাবে ভাষা তার যৌনসঙ্গী – বাইনারি বলে মনে হোলেও তারা পরস্পরের পরিপূরক। তবে ভাব স্থিতিশীল হয় না, তার অস্থিরতা নদীর মতো বহমান, এক নদীতে দু’বার হাঁটে না – তা হোলেও পরিস্থিতি সাপেক্ষে কিছুটা রয়ে যায়, কিছুটা উবে যায়, কিছুটার অস্তিত্ব ও সত্তাগত কালানুক্রমিক সংক্রমণে বিবর্তন ঘটে চলে। আবার এটাও ঠিক যে সব ভাব ও ভাবনার সব কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কোথাও একটা তলীয় টান রয়ে যায়, বিচ্ছেদ ব্যবচ্ছেদ ঘটেও যায়।
ভিটগেনস্টাইন বলেন- যা কিছু আদপে ভাবা যেতে পারে, তা প্রাঞ্জলভাবে ভাবা যেতে পারে এবং যা কিছু বলা যেতে পারে তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যেতে পারে। কিন্তু তা হয় কি? আমাদের ভাবার ভাবনা অন্তহীন এবং তা অন্তহীন ধারায় বয়ে চলে। একটা ভাবনা ভাবতে গিয়ে তার সঙ্গে একটার পর একটা পরিবর্ত বা আত্মিক ভাবনা উঠে আসে, তাকে সহজে সীমাবন্ধ করে রাখা যায় না, রাখতে চাইলে আদি ভাবনাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায় – যা অন্তহীন তাতে বাঁক থাকবেই, তাকে সহজে সহজ করা যায় না, আর যায় না বলেই কথা অত সহজ ভাষায় বলা যায় না – যা বাহ্যতঃ সহজ বলে মনে হয়, কার্য্যতঃ তা জটিল। বা, বলা যায় যে যা যত সরল, তা তত জটীল (সহজ কথা সহজে যায় না বলার মতে) – বরং যা জটীল তা সরলের থেকেও আরও বেশী সরল।
ভাষাতাত্ত্বিক চমস্কি পৃথিবীর সব ভাষার মধ্যে একটা ’বিশ্বজনীন ব্যাকরণ’ (Universal Grammar) লক্ষ্য করেছেন, সেটা কিন্তু তেমন অমূলক বলা যায় না। সব ভাষার সঙ্গে সব ভাষার কাঠামোগত কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় (সংস্কৃত ভাষা ইন্দো-আমেরিকান ভাষার আদিরূপ বলে কথিত), কাল (tense) তো বটেই, ভাষার বাক্যবিন্যাস শব্দবিন্যাসে খুব একটা রকমফেরও থাকে না। তবুও পার্থক্য থাকেই যার কারণে একভাষা অন্যভাষা হয় না।


কথা বলতে আগে ভাবতে হয় – সবাই একইরকম কেতা ও প্রথায় না ভাবলেও, সবার ভাবনার দর্শনও সমান না হলেও যে-ভাষাতেই তার প্রকাশ ঘটুক না সব মিলিয়ে ভাষার মাধ্যমে যে-ভাব ও ভাবনার প্রকাশ ও বিনিময় ঘটে তার ব্যঞ্জনাটা বলতে গেলে প্রায়-সমার্থক (সব কথা সমার্থক নয়, একটা কথার একাধিক অর্থও থাকে, পরিস্থিতি বিশেষে ও বলার ভঙ্গীতেও অর্থ বদলে যায়), বলতে চাওয়া ভাবনার কথাটা অন্য ভাষায় ঠিক যথাযথ না হলেও অনেকটা বুঝে নেওয়া যায়। তবুও বলা যায় যে সব ভাষার নিজস্ব বিশিষ্টতা আছে, ওই বিশিষ্টতাটাই পার্থক্য নির্ণয় করে দেয় – সব ভাষায় সব কথা সমানে সমানে প্রকাশ করা যায় না, বিশেষ করে সাহিত্য ও দর্শনের ভাব ও ভাবনা। সেই কারণে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় সার্থক আক্ষরিক রূপান্তর সম্ভব হয় না।
যে-ভাষা যতবেশী চর্চিত হয়, সেই ভাষা ততবেশী সমৃদ্ধ হয়ে চলে -চর্চ্চাটা চলে মূলতঃ শিল্প-সাহিত্য ও দর্শন চর্চার ক্রমিক প্রচার ও প্রসারের মধ্যে এবং তারই অনুক্রমে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে, শুরুটা হয় দেশীয় ভাষার মাধ্যমেই, তাতে উপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রভাব থাকলেও।
এখন উপনিবেশ নাই, তার প্রভাব আছে। প্রভাবটা ইতিবাচকও। উপনিবেশের সংস্কৃতি দুর্বল বলেই তো উপনিবেশিক সংস্কৃতি থাবা বসাতে পারে।
মানুষের এখন আর একভাষা হলে চলে না। পুঁজির স্বয়ম্বর সভায় যোগদানের স্বার্থে মানুষ এক বা একাধিক ভাষা শিখতে বাধ্য হয়। পুঁজির হাত খুব লম্বা। দেশ থেকে বিদেশে তার পুঁজি-সংস্কৃতি ছড়িয়ে বেড়ায়। পুঁজির ভাষাও থাকে, সেই ভাষা এখন বিশ্বায়িত যা দিয়ে তা সব মানুষকে পুঁজির বাঁধনে জড়িয়ে রাখতে চায়, মানুষ অভিসারিকার মতো তাকে গোপনে কামনা করে, পুঁজি ধরবে বলেই তারা অন্যভাষা শিখতে চায়, শেখার আনন্দে নয় – মোটা ব্যবসা বা মোটা শিক্ষা, এবং তার দৌলতে মোটা পদের চাকরি – তবে দেশে নয়, বিদেশে। সবার এখন রাতারাতি পুঁজিবাদী ও পুঁজিপতি হওয়ার লক্ষ্য।
ভাষা শেখাটা একটা অন্তহীন অনুশীলন ও চর্চা, বিশেষ করে ভাষা শেখা। এবং সেটা ঘটে মাতৃভাষার মাধ্যমে, মাতৃভাষা ব্যতিরেকে মানুষ কিছুই শিখতে পারে না। অন্যভাষা শিখতে হলেও তার মাধ্যম হয় মাতৃভাষা, ইংরাজি দিয়ে ইংরাজি শেখা যায় না – তা দিয়ে বড়োজোর বাবুগিরি দেখিয়ে দু’চারটে ছেঁদো কথা বলা যায়, ভাষার গভীরতা, ব্যাপ্তিকে অর্জন করা যায় না। চেতন ভগত পড়লেই কি ইংরাজি জানা হয়ে যায়? এটা মাতৃভাষার প্রতি বিদ্বেষ।
মাতৃভাষা শেখাটাও যে কতটা জরুরী সংস্কৃত পণ্ডিত বিদ্যাসারই এটা সর্বপ্রথম অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
তিনি যে গরীব ছিলেন, গরীবের মানুষ ছিলেন! চাইলে তিনি ইংরেজদের মুৎসুদ্দি হতে পারতেন।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *