সংসার
মো হ না ম জু ম দা র
সেদিন বজবজ লোকালে ফিরছিলাম,আমি সাধারণত লেডিস কমপার্টমেন্টেই উঠি।তো ফোনে নেট সার্ফিং করতে করতে কানে এলো আমার পাশে বসা এক মহিলা, এ্যাপ্রোক্স আমার মায়েদের বয়সী হবে ,ফোনে কাউকে ,শুনে মনে হলো সম্ভবত তার মেয়েকেই হবে ,বলছেন “এত টাকা খরচা করে বিয়ে দিয়েছি,বিয়ে যখন হয়ে গেছে , কান্নাকাটি করে,ভেবে তো লাভ নেই,তোকে ওখানেই মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে হবে…. জামাই যা চায় তেমন টাই করার চেষ্টা কর,ওর মন যুগিয়ে চল ,মন দিয়ে সংসার কর।” অনেকেই হয়তো বলবেন এ আর এমন কি …ভীষণ স্বাভাবিক কথা..সত্যিই হয়তো তাই..আমাদের সমাজের নব্বই শতাংশ বাবা-মা ই চান মেয়ে সন্তান কে পন্যরূপে কারোর ঘাড়ে গছিয়ে দায় মেটাতে ।মেয়ে সন্তান মানেই একটা বয়সের পর মা-বাবার কাছে বোঝা। মেয়েটি কি চায়,কেমন চায়, এসব বিচার করার সময় বা অবকাশ কোনো টাই দেওয়া হয়না,মেয়েদের ও যে একটা চাওয়া বা পছন্দ করার অধিকার থাকতে পারে,মেয়েদের মনস্তত্ব বলে যে কিছু হয়,তাই আর্ধেক মানুষ বোঝেন না ।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়,দুটো মানুষ সারাজীবন এক ছাদের তলায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে বাধা পড়ে থেকেও কেউ কারোর মন ছুতে পারে না..একটা নারীর শরীর ছোঁয়া যতটা সহজ ,মনের কাছাকাছি যেতে পারা ততটাই কঠিন।সমাজের চোখে বিবাহিত সম্পর্কে থেকেও সেই একাকীত্বটা বড়ই ভয়ংকর ।সেই একাকীত্বে সঙ্গী পেতে চাওয়া টাও যে সমাজের চোখে অবৈধ, মহাপাপ। এ ধারনাই যুগ যুগ ধরে মানুষ বহন করে আসছে ।আর বহন করে আসছে মানিয়ে নেওয়ার ধারনা ,এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে একজন নারী ই হয়তো মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছেন মেয়ে হয়ে জন্মানো মানেই হলো প্রত্যেক পদক্ষেপ এ মানিয়ে নেওয়া আর মেনে নেওয়ার সখ্যতায় জীবন অতিবাহিত করা,যে যত মানিয়ে নিতে পারবে সে তত বুদ্ধিমতী,সংসারী।স্বামীকে খুশি করা, সন্তান মানুষ করা এই দুটোই হলো মেয়েদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, তাদের আর অন্য কোনো চাওয়া পাওয়া থাকতে নেই।নিজের ভালো লাগার জায়গায় পা মাড়াতে নেই,পূরোনো আঁকার খাতায় তুলি বোলাতে নেই কিংবা ফেলে আসা আবেগ কে ছুয়ে দেখতে নেই ।নিজের মনকে এক শেকলে বন্দী রেখে তিলে তিলে মারতে পারার নামই সংসার। এরকম হাজার হাজার নারী আমাদেরই চারপাশে হাসিমুখে বেচে আছে জীবন্ত লাস হয়ে ।কিংবা মানুষিক নিপীড়ন তীব্র থেকে তীব্রতর হলে কেউ বেছে নেয় আত্মহননের পথ। সেখানেও তাদের নিস্তার নেই ।তাতেও শুনতে হয় “কেমন মেয়ে একবার সন্তান এর কথা,বাবা-মা র কথা ভাবলো না”।অথচ এই সেই বাবা-মা যারা ” লোকে কি বলবে ” এই ভেবে বিবাহিত মেয়েকে আশ্রয়টুকু দেয়নি,ক্রমশ ঠেলে দিয়েছে অন্ধকার লড়াই এর ময়দানে।তাদের কাছে ডিভোর্সী মেয়ের প্রানের থেকেও বেশী মূল্যবান “লোকে কি বলবে”। আবার কোথাও দেখি ছোট্ট তিন বছরের শিশুকে তার ঠাকুমা বলতে শেখাচ্ছেন বাবার নাম,মার নাম নয়।একজন নারী হয়ে যদি আর একজন নারীকে সম্মান করতে না পারা যায়,এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিজেদের আরও শক্তিশালী আসনে প্রতিষ্ঠা করবে আর নারী নিজেকে ছোট করতে করতে আরও অন্ধকারে ডুবিয়ে দেবে,উত্তরন ঘটবে না।বলা যায়, নারীদের জীবন একটা রঙ্গমঞ্চ,এ খেলায় নিজেকেই পুতুল সাজিয়ে নাট্যমন্চে দাঁড় করিয়ে দিতে হয় ,এ খেলায় আমিই খেলোয়াড়,আমিই দর্শক।