কাকচক্ষু দর্শন– কলমে কামারুজ্জামান

ভাষা ভাবনা : ৪

কামারুজ্জামান

সত্য আকাশে থাকে না, মাটিতে থাকে।
কথাটা সক্রেটিসের। যিনি বলেন যে আমি জানি না, জানি না বলেই আমি জানি যে আমি জানি না। এইভাবে শুরু হোয়ে যায় দর্শন ও দর্শনের ভূমিকা, দর্শনের আদ্যপাঠ – না-বলা কথাকে বলার অনলস অভিসার এবং এটাই কথিত দর্শন। এই দর্শন না থাকলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিও থাকত না, তার জলগর্ভ পেটই বিজ্ঞানের সূতিকাগৃহ। কিন্তু দর্শন কিছুটা বায়বীয়। বায়বীয় কিছুকে কি হাতের মুঠোয় ধরা যায়? মস্তিষ্কের কোষে আদপে জবানবন্দী করে রাখা যায়? দর্শন তো সক্রেটিসের জবান, মানে কথা। এই কথাটাই আসলে সবকথার কথা। কথা যে কী তা সবারই জানা কথা। এবং জানা বলেই তা কথা হোয়ে স্বরতন্ত্রী দিয়ে উগরে বের হয়। উগরে বের হয় কারুর বা কিছুর উদ্দেশ্যে, সেটার একটা উদ্দেশ্য থাকেই। সবকিছুর যেমন কিছু উদ্দেশ্য থাকে। উদ্দেশ্যটাই আসলে কথা। উদ্দেশ্যটা কতটা বিধেয়, কতটা তার গ্রাহ্যতা তা নিয়ে কথা বলে কিছু বলতে চাওয়া। শুধু কিছু বলতে চাওয়াই নয়, তাকে অধিগত করতে গিয়ে একইসঙ্গে কিছুর সঙ্কেত দিয়ে যাওয়াও। সঙ্কেত থেকেই সত্যের সন্দর্শন। সক্রেটিস যখন সত্যের কোথায় অবস্থান তা নিজের উপলব্ধি দিয়ে বলতে চান, তখন তিনি শুধু বলতে চান না, একটা সঙ্কেতও দিয়ে যেতে চান। আকাশে সত্য থাকে না তা নয়, তবে যে-ক্ষমতা নিয়ে সত্য মাটিতে থাকে সেই ক্ষমতা নিয়ে সত্য আকাশে থাকে না। আকাশের সত্য মাটিতেই আছড়ে পড়ে। কারণটা আর কিছুই নয়, মানুষের কাছে মাটির নিকট সামীপ্যতা, মাটির সঙ্গে মানুষের নিকট সম্মুখ সম্বন্ধ। জানতে হলে তাই আগে মাটিকে জানতে হয়, তারপর ঊর্ধ্বাকাশ মহাকাশ। মাটিতে পা রাখতে পারলে তবেই না চাঁদে পা রাখা। এই প্রস্থানবিন্দু থেকেই সক্রেটিসের দর্শনের শুরু – আগে নিজেকে জানো, মানুষকে জানো, আরও জানো।

মাটিকে জানা, মানুষকে জানাই দর্শন। জানার মধ্যে জীবন থাকে। বিশ্বদর্শনও থাকে।
প্রকৃতিতে, মানুষের রক্তমাংসে বিশ্বদর্শন তার সন্দেশ খুঁজে পায়। ভাষাতেই তার গর্ভবাস, ভাষাতেই তার নির্বাণ।

কিন্তু কীভাবে জানা যায়? জানাটা এমনিই হয় না। যেমন ভাত খেতে চাইলে কাউকে জানাতে হয়। খেতে না চাইলে তা মুখেও বলা যায়। হাত নেড়েও বলা যায়। যে করেই হোক বলাটা আসল। আর বলা মানেই তো কিছু কথা বলা। মুখে কিছু না বলেও অঙ্গভঙ্গী করেও কিছু বলা যায়। চুপ করে থেকেও কিন্তু কিছু বলা যায়। মুখরতা যেমন নীরব, নীরবতাও তেমন সরব। শুধু মৃতরাই সরব বা নীরব হোতে পারে না, তারা সৃষ্টি বিসৃষ্টির ঊর্ধ্বে। যারা নি®প্রাণ তারাই শুধু কিছু বলতে পারে না। তাদের তা দরকারও হয় না। কাউকে তাদের দরকারও পড়ে না। জীবগত অর্থে তারা স্বাধীন। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা রচনা করতে গেলেই কথা বলার দরকার হোয়ে পড়ে। একান্ত আবেদনের ভিত্তিতেই সমাজের উদ্ভব। সমাজে কথার বিনিময় না হলেই নয়। পণ্যের মতো কথারও বিনিময় হয়, তবে লেনদেন হয় না। হয় না বললে ভুল হবে কেন না কথার দম ও দাম থাকে, ফুরিয়ে গেলে সব শেষ। মানুষকে কথা বেচে/বেছে খেতে হয়। ফেরি করতেও হয়। কথার কীর্তি এটাই। এতে মানুষেরও কৃতিত্ব আছে। আবার মানুষকে কথাদাস বললে খুব একটা ভুল হয় না। চিরজীবন মানুষকে কথার দাসত্ব করেই চলতে হয়, দাসত্বটা তার স্বোপার্জ্জিত, বাঞ্ছিতও। এবং সেটা তার নিজের অধীনস্থও। মানুষ সর্ব্বতঃ পরাধীন হোলেও এই একটা দিক দিয়ে অন্ততঃ সে স্বাধীন, হয়ত’ বা। কথায় তার স্বাধীনতা থাকে থাকে, স্বেচ্ছাচার। তার মাধ্যমে কিছু চাওয়া পাওয়ার স্বাধীনতা ও অভিলাষ। যেন হাতে পাওয়া চাঁদ। চাঁদে পা রেখেই মানুষ তার পশুত্বকে কিছুটা বিসর্জ্জন দিতে পেরেছে। আরণ্যক মানুষ সমাজ পত্তন করতে পেরেছে। পশুরা পারেনি কারণ তাদের পা কারুর বুকে থাকে। তাদের চার পা দুই হাত হোয়ে ওঠেনি। দুই হাত দুই পা শুধু মানুষের।
সমাজ মানে শুধু যূথবদ্ধ হোয়ে থাকা নয়। কথাবদ্ধ হোয়ে থাকাও। কথাবদ্ধ না হোতে পারলে মানুষ যূথবদ্ধ হোয়ে থাকতে পারত না।
কথা কথাটা একটা সামাজিক প্রত্যয়, একটা সামাজিক প্রতিনাদ। একটা ভিতরের কণ্ঠস্বর যা দিয়ে আমি আমার আমিত্বকে সামাজিক করে তুলতে পারি, সমাজে আমি আমার স্বীকৃতির দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতে পারি। বলতে পারি ও বুঝতেও পারি আমি কে, আমি কী। বুঝতে পারি অন্যরাই বা আমার কে, আমার কী। সমাজে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হোলে এই উপলব্ধিটা অত্যন্ত জরুরী। এই উপলব্ধির মাধ্যমেই মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কের দ্বিধাদ্বন্দ্ব গড়ে ওঠে। সেইঅর্থে কথা আর নিছক কথা থাকে না, কথার সঙ্গে কথার মিথস্ক্রিয়া কথা আরও কথার সঙ্গে আরও সম্পর্কের স্ফুরন ঘটায়।

কথা ইতিহাসের প্রতœরূপ। কথা মানুষের ঠিকুজি কুলুজি।
কথা মানুষের জীবনের ভ্রƒণতথ্য। ভ্রƒণটা ভাষার জরায়ুর। এর বন্ধ্যাত্বও থাকে। কিন্তু তার ক্রোমোজমে জিনগুলো রয়েই যায়, তার ক্রমাগত মিউটেসন ঘটে চলার সম্ভাবনা থাকলেও। পাড়া জুড়ে ঘুম এসে নটে গাছটি মুড়িয়ে গেলেও কথা ফুরিয়ে যায় না। ফুরিয়ে গেলে অস্থির জগতও যে স্থির হোয়ে যায়।

কথা দিয়েই কথার শুরু। এটা দর্শন, দর্শনের কথা।
দর্শনকে তার যোগ্য মর্য্যাদা দিতেই হয় – তা না হোলে সত্যের গভীরতায় ডুব দেওয়া যায় না। সেই নিমজ্জনে মণিমুক্তার খোঁজ।
সব কথাতেই কিছু দর্শন থাকে। কিন্তু কথাকে শুধু কথা বললে হয় না, তাতে অনেক ফাঁক থেকে যায়। সবাই এক কথা বলে না। একভাবে বলে না। যা বলে তাতে একই স্বররূপ বা ধ্বনিরূপ (phoneme) থাকে না। এই স্বরধ্বনি এক একটা ধারণা বা ভাবনার সূচক, প্রতিফলক ও প্ররোচক (এর সঙ্গে ভাবনার আরও কিছুকে ধরতে হরে)। ভাবনা বা ধারণা হোল মানুষের সেই জীবগুণ যার জৈবিকতায় মস্তিষ্কে প্রসূত বহু স্বরধ্বনি বা স্বররূপ মিলেমিশে একীভূত হোয়ে যে আশ্চর্য্য কথার ক্ষমতা নির্ম্মান তাতেই ভাষার নিঃশব্দ পদধ্বনি শিঞ্জিনী সৃষ্টি করে চলে (ক্ষেত্র বিশেষে ভাষা শব্দ, এবং নিঃশব্দও)। একটা স্বরধ্বনি একটা কথার প্রতিধ্বনি। কথার ভাব থাকে যার সঙ্কেত বা অর্থ দিয়ে কিছু বলতে চাওয়া হয়, একটা স্বরধ্বনির মাধ্যমে একটা কথা দিয়ে কখনো সখনো কথা বলা গেলেও সবকথা বলতে গেলে বহুকথা লাগে। কথার তখন আর একটা দু’টো বলে কিছু থাকে না। বহু স্বরধ্বনিতে নিহিত থাকে এক বা একাধিক ভাব ও ভাবনা। বহুকথা সমন্বিত নির্দ্দিষ্ট একটা বিন্যাসে যা সৃষ্টি হয় তা-ই হোল ভাষা (তাতে নিয়মনিষ্ঠ ব্যাকরণ থাকে, আবার থাকেও না – থাকুক বা না-থাকুক, ভাষার যা বলার কথা তা বলা হোয়ে যায়)। তখন আমরা কথাকে আর নিছক কথা বলে তাকে আড়ষ্ট করতে পারি না, তার সমসত্ত্ব ভাবনার প্রবাহ তখন হোয়ে ওঠে আমাদের অস্তিত্ব ও সত্তার মূল স্মারক, ধারক – অস্তিত্ব-সত্তার অভিকর্ষ ছাড়া আমরা কেউ কারুর কাছে কিছুই নই – আমিও যেন আমি নই, কেউও কেউ নয়। হাইডেগার বলেন : Language is the house of being, which is propitiated by being and pervaded by being. আমাদের জীবন শুধু প্রাণ নয়, প্রাণের দাম্পত্য দেশ যেখানে ভাষাই আমাদের অধিপতি, তার আধিপত্য স্বীকার করে নিয়েই তবে আমাদের জীবন যাপনার শুরু, ভাষা সমাজের নির্ধ্বারকও যা পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়, আমরা বুঝতে পারি আমাদের অস্তিত্বের সীমা ও সীমানা কতটা, তা কতটা সুস্থিত ও অস্থিত, আমাদের সত্তা কতটা প্রসারিত বা সঙ্কুচিত – তাতেই স্ফুট হোয়ে ওঠে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের আলাদা আলাদা চালচিত্র যা থেকেই বুঝে নেওয়া যায় কার কী প্রকৃত সামাজিক অবস্থা ও অবস্থান, আমরা সমাজের অলিগলি ছুঁয়ে বুঝতে পারি যে আমরা প্রত্যেকেই একান্ত, এবং অনেকান্তও। একান্ত ও অনেকান্ত ভাব ও স্বভাব নিয়েই আমরা মানুষ, পশুর যাপনচিত্র থেকে আমরা অনেক আলাদা, স্বতন্ত্র।
মূলতঃ ধ্বনিরীতি বা ধ্বনিরূপ ও তাদের ভাবগত অর্থের পার্থক্যের কারণেই ভাষা এক নয়, একাধিক। শুধু ধ্বনিরীতিই নয়, তার ভাব ও সঙ্কেতের মধ্যে লক্ষ্যণীয় পার্থক্যও থাকে। পার্থক্যটা হয় মূলতঃ মানুষের খ- খ- ভূখ-ে বসবাস করার সূত্রে যা বহু প্রত্যন্ত অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত যেখান থেকে এক নির্দ্দিষ্ট ভূখ-ের অন্তর্গত স্বরধ্বনি অন্য কোথাও সহজে অন্য মানুষের কানে এসে পৌঁছোতে পারে না এবং ফলে নানা যোগসূত্রে নানা অঞ্চলে মানুষ পৃথক পৃথক সঙ্কেতের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে নির্দ্দিষ্ট কোনো ভাব বিনিময় করতে অভ্যস্থ হোয়ে ওঠে – এই স্থান-কালিক দূরত্বতা মূলতঃ একাধিক ভাষা সৃষ্টির কারণ এবং এই একই কারণে একই ভূখ-ের অঞ্চল বিশেষেও একই ভাষার মধ্যে এক বা একাধিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে, এটাও লক্ষ্য করা যায় যে পৃথক পৃথক ভূখ-ের মানুষের প্রকৃতিগত সমস্যা ও চাহিদা সবসময় একইরকম না হওয়ার সূত্রে তাদের ভাবপ্রকাশ ও ভাবপ্রকাশের মাধ্যম একইরকম হয় না, যেমন – কোথাও ঝড়বৃষ্টির প্রকোপের আধিক্য, কোথাও খরা কিম্বা কোথাও শিকারের সুযোগ বেশী তো কোথাও ফলসব্জির – এইভাবে ভাবলে বোঝায় যায় যে আদিম ভাষা-সঙ্কেত কখনো একই হওয়ার কথা নয়। এই প্রসঙ্গে নিৎসে বলেছেন : The various languages placed side by side show that with words it is never a question of truth, never a question of adequate expression; otherwise, there would not be so many languages. নিৎসের বক্তব্যেও মানুষের বস্তুগত চাহিদা ও সমস্যা প্রতিফলিত যেখানে সত্যানুসন্ধান থাকে না বা তার অভিপ্রকাশ ভাষা খুঁজে পায় না – সত্য একই হোলে সত্যানুসন্ধান তার অভিপ্রকাশে সেই একই ভাষা খুঁজে পেত যে-ভাষা পরবর্তী কালে সাড়ম্বর সভ্যতায় বহুভাষা হোয়ে উঠেছে। খ- খ- জনজাতি (আদিবাসি) অধ্যুষিত অঞ্চলে যেখানে প্রাগ্রসর সভ্যতার যথাযথ বিকাশ ও সম্প্রসারণ ঘটেনি সেই এলাকার মানুষের ভাষা অত্যন্ত সীমিত এই অর্থে যে তাদের শব্দভা-ার তাদের বস্তুগত চাহিদার মধ্যে সীমাবদ্ধ – তাদের চাহিদার পুরোপুরি পরিপূর্তি ঘটে না, পরিপূর্তি ঘটলে আরও চাহিদার সৃষ্টি হোত (মানসিক-সাংস্কৃতিক ক্ষুধা যা শারীরিক চাহিদার অনন্তরেই সৃষ্টি হয় ), তাদের শব্দভা-ার পরিমাণে ও গুণগত অর্থে বাড়ন্ত ও সমৃদ্ধ হোয়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি করত। এখন তো অবস্থাটা আরও ভয়ঙ্কর – এখন ভাষার উপরও আধিপত্যের খাঁড়ার ঘা।
কেউ কেউ একের অধিক ভাষায় কথা বলতে পারলেও প্রত্যেকের মূলতঃ একটা নিজস্ব ভাষা থাকে যাকে আমরা মাতৃভাষা বলতে পারি, কিন্তু মাতৃভাষা মূলতঃ মা’য়ের কাছ থেকে শেখা হলেও মা’য়ের পেট থেকে শিখে আসা কিছু নয় – অর্থাৎ এর মধ্যে কোনো জিনধর্ম্ম নাই, মাতৃভাষাও শিখতে হয়, এবং আমরা তা সমাজ ও পরিবেশ থেকে সহজেই শিখে ফেলতে পারি। প্রতিটা ভাষার যেমন নিজস্ব ধ্বনিরীতি থাকে, সেই ধ্বনিরীতি প্রয়োগেও নিজস্ব বিধান বা ব্যাকরণ থাকে – ভাষায় ভাষায় ফারাকটা প্রয়োগ বিধির কারণেই। ভাষাই মানুষের সব। সমাজ সংগঠনের প্রযুক্তিও ভাষা। আর সবকিছুর মতো ভাষাকেও প্রকৃতির অনুকৃতি বলা যায় – মানুষের সব কৃতিই প্রকৃতির অনুকৃতি এবং সেই অনুকৃতির জন্য প্রথমে নবিশিও করতে হয়। মানুষের ভাষা শিক্ষা অনুকৃতির সর্ব্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন। মানুষের আর যা সব সৃষ্টিকৃষ্টি তাদের সৃষ্টির মূলেও ভাষা। ভাবের সৃষ্টি ভাষায়, ভাষারও সৃষ্টি ভাবে – ভাব ও ভাষার সমন্বয়ে মানুষের অস্তিত্ব ও সত্তা গঠিত। ভাষা না জানলে মানুষের সত্তা ও অস্তিত্বের কোনো মানেই হয় না, ভাষাই মানুষের অর্থকারক, সবেরই অস্তিত্ব ও উপস্থিতি ভাষা দিয়েই। ভাবের প্রকাশ ও সম্প্রচার ভাষাতেই – ভাব থেকেই ভাষা, ভাষা গতি পেলে ভাষা নিজের গতিতে ভাবকে ছাড়িয়ে যায়, তখন ভাষাই হোয়ে ওঠে ভাব, ভাবের চলচ্ছবি। এই কারণেই বোধহয় কিয়ের্কেগার্ড বলেন : : Language is partly given, and partly that which develops freely. And just as the individual can never reach the point at which he becomes absolutely he becomes independent. কিন্তু ভাবের প্রকাশকে কেউ অধিগ্রহন করতে চাইলে তাকে ভাব-দীক্ষিত হোতে হয়, ভাবুক হোতে হয় (মানুষের ভাবগুণ থাকাটা খুবই খুবই বাঞ্ছনীয়, এবং স্বভাবতঃ থাকেও), না হোলে সে ভাবকে অনুমান ও অনুভব করতে পারে না। রস না থাকলে কি আর রসিক হওয়া যায়? কবিতার পাঠককেও কবি হোতে হয়, কিন্তু তার জন্য তাকে কবির সঙ্গে সহমত হোতে হবে বা কবির মন দিয়ে কবির কবির কবিতাকে দেখতে হবে এমন কথা নয় কেন না দ্বিমতও প্রকারন্তরে একটা মত – এটা বলতে গেলে ভাষার পুনর্পাঠ। আসলে কিছু শোনা দ্যাখা বা বোঝা সবই নতুন করে পুনর্সৃষ্টির সমান – এই পুনর্সৃষ্টি ছাড়া নতুন কোনো অভিজ্ঞতা অর্জ্জন সম্ভব নয়, অভিজ্ঞতা মানেই নতুন করে পুনর্ভব কেন না ভাষা নাক্ষত্রিক গতিতে আসে, নাক্ষত্রিক গতিতে বেরিয়ে যায়, তাকে ধরে রাখাটাই অভিজ্ঞতা, সব সমস্যার প্রকৃত সমাধান সেখানেই। অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হওয়াটাই ভাষা।
আমাদের ভাবের বাহক ভাষা (অস্তিত্ব ও সত্তার পূর্ণতা), অভাবের বাহকও ভাষা (অস্তিত্ব ও সত্তার অপূর্ণতা)। ভাষা বাসার মতো কুলায় ফিরে আসা।
কুলায় ফিরতেই হয়। না হোলে নতুন করে যাওয়া হয় না আসা হয় না। এটা জীবনের পুনরাবৃত্তি. এবং ভাষারও।

শুধু শাব্দিক কথাই নয়, শুধু কথা বলাই নয়, কথা শোনা, কথা না-বলাও (নীরবতা) ভাষার অপরিহার্য্য অঙ্গ, ভাষার বিকল্প রূপ। কথা বলে আমরা যা বোঝাতে চাই, কথা শুনে আমরা যা বুঝতে পারি নীরবতা তারই পাল্টা জবাব। উক্তিতে বলা-শোনার মধ্যে যে বিদিত শক্তি নিহিত তা-ই অনুক্তিতে বলা ভাষার অবিদিত শক্তি – কবিতার ভাষায় : ’যা তুমি বলে গেলে না, যা তুমি শুনে গেলে না/ তা যে তোমারই অশেষ গঞ্জনা, তোমারই ব্যথিত লাঞ্ছনা।’
প্রতিটা শব্দই একটা ব্যথা। কষ্টে যেমন কেষ্ট মেলে তেমনই। ব্যথার কষ্টে জনিত হয় ভাব। একটা রূপক।
প্রতিটা ভাষার শব্দস্বর বা phoneme ভাষার একটা সঙ্কেত হোয়ে আসে (স্টোয়িকরা যাকে বলেছেন lekton), সঙ্কেত মানুষের মনে সাড়া জাগিয়ে যায়, কিন্তু তা নিজে এবং তা যাকে নির্দ্দেশ করে তার থেকে স্পষ্টতঃই আলাদা কিছু, আসলে তা একটা কিছুর অর্থ বা অর্থবোধক (ideophone) যা সত্য বা সত্যতার বাহক, এইরকম বহু সঙ্কেত সমন্বয়ে যে-বাক্য গড়ে ওঠে তা একটা ভাব বা অভিব্যক্তির দ্যোতক (কিছুটা পূর্ণ, কিছুটা শূন্য, কিছুতেই সম্পূর্ণ হোতে চায় না)। অর্থাৎ শব্দ থেকে বাক্য, বাক্য থেকে ভাবের দ্যোতনা। এই দ্যোতনার অভিব্যক্তি নির্দ্দিষ্ট কোনো অভিমুখে ধাবিত হয় না, ডাইনে-বাঁয়ে ঊর্ধ্বে-অধেঃ তার পরিক্রমা, তাতে দার্শনিক পক্ষপাতও থাকতে পারে, থাকতে পারে শুধু নয়, থাকেও এই অর্থে যে তার পরিক্রমায় সত্য অসত্যে পর্য্যগামী হয়, অসত্য নির্মোক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার অবকাশ পায় – সত্য ও অসত্যের নিজেদের মধ্যে এই যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই তাতে জীবনও সামিল হোয়ে পড়ে, মানুষ কার পক্ষে যাবে বা কার বিপক্ষে থাকবে তার হদিশ খুঁজে পায় না। সত্য বদলে যায়, সত্যের পরিসর সঙ্কুচিত হোয়ে আসে, জগতটা চোখের সামনে দুলতে দুলতে বিগ ব্যাং করে বিস্ফোরিত হোয়ে পড়ার উপক্রম হয়। সংঘাত অনিবার্য্য হোয়ে ওঠে। কিন্তু জীবন পুরোপুরি পুনরাবৃত্তি কাটিয়ে উঠতে পারে না কেন না পুনরাবৃত্তি জগতের নিয়ম, পৃথিবীর স্টোইক ভাষা। ভাষা চতর্ভূজ বহর্ভূজ। চার পা’য়ে বহুযুগ-যুগান্ত হেঁটে গেলেও দুই হাত উদ্বাহু হোয়ে থাকে যার কারণে এক থেকে বহুর সৃষ্টি, বহুত্বের সৃষ্টি। তাই, এক ভাষা হোলেও তার মধ্যেই বহু ভাষার স্বাদ পাওয়া যায়, আন্দাজে বান্দারা তাকে আপন করে নিতে পারে। আন্দাজটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়, আন্দাজ করেই যাওয়া আসার খেলা, একটা পূর্ণতার সম্পূর্ণতা অর্জ্জন করতে চাওয়ার খেলা। এটা তেমন অনায়াস নয় যে ’ঝটদি বিমার, পটদি খতম’ বলে ছাপ মেরে দেওয়া যায়। সময়েরও তো সময় লেগে যায়।

ভাষারও সময় লাগে। বুঝতে ও বোঝাতে। রূপ হোলে তবুও কথা ছিল। সবই যে রূপক।

মানুষ মাতৃভক্ত – মা’য়ের ভক্ত, মা’য়ের ভাষায় অনুরক্ত। তার মধ্যে অনুপ্রাস ছন্দও থাকে। ঘুম-পাড়ানি গানের মতো ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যায়। টহলদারি ডাকে জেগে উঠতে হয়। সেই পুনরাবৃত্ত চোখরাঙানি। ভাষাকে মেনে চলতে হয়, সয়ে চলতে হয়। অন্যথায় গারদের গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
ভাষাকে উপেক্ষা করবে কে? উপেক্ষা করবে যে নিজেই উপেক্ষিত হবে সে।

আমরা ভাষাকে ভাবের গ্রাহক বা বাহক বলেছি, আবার আধারও বলা যায় (আধারের আধারও ভাষা)। ভাষার সঙ্গে ভাবের যে সনির্ব্বন্ধ সম্বন্ধ সেই ভাব কী? এটা একটা দার্শনিক সওয়াল যার জবাব বহুধা বিভক্ত যা নিয়ে কখনো সহমতে আসা যায় না, ভাবতে গেলে ভাবনাটা নিজের খুশীমত ছড়িয়ে পড়ে, এককাট্টা করাটা খুবই মুস্কিল ব্যাপার। তবুও বলা যায় যে ভাব ভারতীয় দর্শনের নবরস বা গ্রিক পুরাকথার নয় জ্ঞানদেবী (জ্ঞানও এক ধরনের ভাব), তাতে সবকিছু থেকেও তবু মনে হয় যেন কোথাও কিছু ফাঁক রয়ে গিয়েছে। ভাববস্তু বস্তু নয়, তাহলে কী? সেটাও বলা সহজ নয়। জ্ঞান বললেও পার পাওয়া যায় না কেন না জ্ঞান ঠিক ভাব নয়, তবে তাতে কিছুটা ভাবও থাকে (রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ভাব হোত বলে আমরা জানি, ভাবে জ্ঞান না থাকলেও চলে)। তাহলে উত্তর-বস্তু জাতীয় কিছু কি? হ্যাঁ, এইপর্য্যন্ত কিছু বলা যায় হয়ত’ বা। আবার এটাও একটা সমস্যা যে ভাবকে ঠিক ভাবনা বা চিন্তা বলা ঠিক নয়। আমরা যখন ভাবি তখন আমরা প্রথমতঃ বাহ্যিক সমস্যা নিয়েই ভাবি কারণ আমরা সবসময় ওই সমস্যায় পীড়িত থাকি। সুতরাং পীড়নই সব ভাবনার মূল সূত্র। কিন্তু বস্তুগত চিন্তাই এক ও একমাত্র ভাবনা নয়, তার সঙ্গে মনোগত ভাবনাও থাকে। বস্তুগত ভাবনা আমাদের অসন্তোষ। অন্যদিকে, মনোগত ভাবনা আমাদের প্রিয়তোষ। এই দুই ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবনা নিয়েই আমাদের বিশ্বসংসার, আমাদের ভাষার জগতের প্রতিনিয়ত সংশ্লেষণ।
’আমি খাবো’ কথাটা বস্তুগত চিন্তা, ’আমি তেপান্তরে যাবো’ মনোগত চিন্তা। আবার কেউ যখন বলে ’আমি মরে যাবো’ তখন কথাটায় যেমন বস্তুগত চিন্তা থাকে, তার সঙ্গে তেমনই থাকে মনোগত চিন্তা। সামাজিক বিভাজনের প্রেক্ষিতে বললে কথাটার মর্ম্মার্থ হয় আর পাঁচটা চাহিদা ও অভাবের মতো বস্তুগত, নিছকই বস্তুগত এই অর্থে যে গতর খাটিয়ে খাওয়া মানুষরা হাতে ভাত না পাওয়ার কারণে মরে যাওয়ার ভয়ে মরে থাকে। অন্যদিকে, সামাজিক বিভাজনের ওপারে থাকা সুবিধাভোগী সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে যারা ’বুদ্ধিজীবি’ বলে পরিচিত (বাকিদের অনেকেই নিছক ’গবেট’) তারা ’মরে যাবো’ কথাটার বিমূর্তায়ন ঘটিয়ে তার স্টোয়িক ব্যাখ্যায় অনেক সাধুবোধ করতে পারে (মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা বিমূর্ত চিন্তা করতে পারে), তারা নান্দনিক ভাবনার পরাকাষ্ঠা, তারাই সৃজন করে এবং বিসৃজন করে – খেটে খাওয়া মানুষরা তাদের ভাবনার শরিক হোতে পারে না, খুব বেশী হোলে তারা কখনো সখনো সুন্দরী কমলার নাচ দেখে গৌড়ীয় আনন্দে আফিম খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার মতো একটু সুখে ঘুমিয়ে যাওয়ার অবকাশ পায় (এখানে মার্কসের ধর্ম্ম ও আফিমের মধ্যে সম্পর্কটা একটু তলিয়ে ভাবার দরকার আছে, অনেকে এটাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে)। এটা প্রমাণিত সিদ্ধান্ত যে উচ্চকোটি ভাবনা উচ্চকোটি মানুষদের. এবং তাদের উদ্দেশ্যেই সংরচিত। সুতরাং ভাবনা বা ভাবকে যে অর্থেই ভাবা হোক না কেন তার উপর সামাজিক বিভাজনের একটা প্রত্যক্ষ প্রস্তাব থাকেই। যারা যেভাবে থাকে তারা সেভাবে ভাবে। থাকার সঙ্গে ভাবার সাপেক্ষে সেটাই ভাবনার প্রারম্ভিক উংৎস।
ভাবনা মানুষের সন্ধিহীন (seamless) বিপাকীয় ক্রিয়ার মতো যা মনের মধ্যে অখ- ধারায় বয়ে চলে, ধারাটা প্যারেটো গ্রাফের (Pareto Chart) মতো যাতে চ্যুতি-বিচ্যুতি থাকে বলেই তা জ্যামিতিক সরলতা অবলম্বন করে চলে না, ফলে এক একজনের ভাবনা এক একরকম, এবং এইরকম ভাবনা নিয়েই একজন মানুষের বাস্তব জগৎ। কিন্তু বাস্তব জগৎ সমষ্ঠি মানুষের জগৎ (collective world)। বস্তুগত ও মনোগত ভাবনা নিয়েই নির্ম্মিত বাস্তব জগৎ বা সামাজিক বাস্তবতা। সেই বাস্তবতাকে সম্মুখপটে উঠিয়ে নিয়ে আসতে চায় ভাষা। বাস্তবতার ব্যাপ্তি বিশাল, ভাবের ব্যাপ্তি বহুমুখী ও বহুরূপী। সেই বিশালত্ব ও বহত্বকে উপস্থাপিত করার মতো বিশালত্ব ও বহুত্ব কি ভাষার আছে? ভাষার আধারত্বই বা কতটা যে তা কানায় কানায় উপছে পড়বে না? উপছে পড়ে যা মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে তা কি মাটিতে অঙ্কুরিত হোয়ে ওঠার সৃষ্টি সম্ভাবনা ধারণ করে? এটা একটা অপ্রতর্ক্য বিষয়। ভাষার ক্ষমতা যে প্রবল তা নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ নাই, কিন্তু ক্ষমতা প্রবল হোলেও তা সীমাহীন হোতে পারে না, সীমার একটা সীমানা থাকেই। একটা আধারের আধেয় রাখার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ, তার বেশী হোলে আধেয় উপছে পড়বেই : ’তোমার রস কানায় কানায় পূর্ণ হোলে, কেন গো সখি তুমি যাও চলে, বলে না-বলে।’ এখানেই ভাষার সঙ্কট। জোর করে বাস্তবকে ধরার চেষ্টা, চেনার চেষ্টা। সাধ্য না হোলেও ভাষার সাধটা তার ক্ষমতার দম্ভ হোয়ে ওঠে। তার ক্ষমতার দম্ভ তাকে তাই পাশবিক করে তোলে, বাস্তবের এককে একশো করে কিম্বা একশোকে এক করে মানুষের সামনে তুলে ধরতে চায় (Those he commands more only in command,/ Nothing in love. Now does he feel his title/ Hang loose about him, like a giant’s robe/ Upon a dwarfish thief. – ম্যাকবেথ)। সফিস্ট জর্জ্জিয়াস বলেন, বাস্তবে মানুষের প্রত্যক্ষ উপলব্ধিকে (perceptibles) কথায় বা ভাষায় স্ফুটন করা সম্ভব নয়। প্রতিটা উপলব্ধি পৃথক প্রকৃতির, ব্যক্তি বিশেষে তার বিভেদও লক্ষ্যণীয়, এক ইন্দ্রিয় যা অনুভব করে তা অন্য কোনো ইন্দ্রিয়ে অনুভূত হয় না, এবং কথায় তার অভিপ্রকাশ এক বা সমান হয় না বা হোতে পারে না কেন না কথা বা ভাষার ন্যারেটিভ প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। বিধৃত বাস্তবতার এই পরোক্ষ ন্যারেটিভে যা বিবৃত হয় তা বাস্তবতার পরিবর্তিত বা বিকৃত রূপ। ভাষা বাস্তবতার ন্যারেটিভ হওয়ার শর্তে বাস্তব কখনই যুক্তিশর্ত মেনে চলে না, ফলে তা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। শিল্প-সাহিত্যের ন্যারেটিভের ক্ষেত্রেও সেই একই সমস্যা।
দেখতে হোলে আয়না লাগে। আয়নাকে দেখতে হোলেও আয়না লাগে। আয়না যেমন, ভাষাও তেমন। আয়নায় যা দেখতে পাওয়া যায় তা মূলের প্রতিরূপ, মূল নয়। ভাষায় প্রতিফলিত বাস্তবও বাস্তবের প্রতিরূপ, অনুরূপ নয়। বোধে ফুটে ওঠা বাস্তব যে-ভাষায় ফুটে ওঠে তার ভাষা একই ভাষা হয় না, তার জন্য একটা অধি-ভাষার (meta-language) দরকার হয়। অধি-ভাষার বাস্তবতা বাস্তব নয়, অধি-বাস্তব। সুতরাং বাস্তবতাকে ধরা যায় না। ব্যথায় কথা ডুবে থাকার মতো। বাস্তব ডুবে থাকে অধি-বাস্তবে। বাস্তবের ব্যথা অধি-বাস্তবে ক্লিষ্ট হয় না। এ যে কী ব্যথা তা শুধু ব্যথাই বুঝতে পারে!
ভাষার মাধ্যমে আমরা শুধু কিস্যা শুনি। কিস্যাকে যে যেভাবে শোনে তার চেতনার আয়নায় সেইভাবে দাগ কাটে।

কিস্যা বাস্তবতার কিস্যা।
আর তার জন্যই ভাষা। বাস্তবতার প্রতিরূপ ভাষা। বাস্তবতাও ভাষার প্রতিরূপ। প্রতিরূপকে নিছক প্রতিরূপ বললে অবশ্য ভুল হয়, রূপক বললেও ক্ষতি হয় না, যা আসলে কিছুর সত্যমিথ্যা ব্যাখ্যান। এই ক্রিয়া বা প্রক্রিয়া অন্তহীন উদ্দেশ্যে মানুষকে সজীব করে রাখে, থেমে গেলেই মানুষ নির্জীব হোয়ে পড়ে। তার বিকাশ ও প্রকাশ একমুখী নয় কেন না মানুষের জীবন একটি একক সত্তা হোলেও তার সমস্যা বহুমুখী, করণ উপকরণের অর্ন্তজালিকা। এই ম্যট্রিক্স থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে সত্তার সঙ্কট অন্যরূপে প্রকাশ পায়, তার মধ্যে নিরুক্ত বিবিক্তি-বোধ উক্ত হোয়ে পড়ে তাকে ন্যাঙটো করে ছাড়ে – নিজের উলঙ্গতা দেখে সে নিজেই আতঙ্কে পড়ে যায়, এতে তার নির্ভাষ সত্তা কোনো শব্দ খুঁজে পায় না। এটা তার আচরণগত সমস্যা একসময় যা দিয়ে তার সামাজিক অভ্যাস গড়ে উঠেছিল এবং যার মধ্যে তার অস্তিত্ব ও সত্তা একটা আপাতঃ স্থির বাসা বেঁধেছিল, কিন্তু শব্দের প্রয়োগে যে-অর্থ সৃষ্টি হয় তার অভাবে তার চর্চ্চিত সামাজিক নিযুক্তির বিযুক্তি ঘটে যায় – তার অস্থিরতায় কেউ তার উদ্দেশ্যে Help! বলে চিৎকার করলেও সে তার দিকে ছুটে যায় না, Fire! বললেও সে ছুটে পালায় না, No! বললেও তার নিষেধ মানার সাধ্য থাকে না। (দৃষ্টান্তগুলো শব্দের কঠোর অভিঘাত বোঝানোর জন্য যা দিয়ে মানুষের সামাজিক আদত ও আদব গড়ে ওঠে)। বাস্তবতার বিপর্য্যয়ে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। ভাষা বাস্তবকে নিয়ে মুখর, কিন্তু বাস্তবতা কোনো স্থির প্রত্যয় নয়, ক্রমিক অবসাদে তার ভঙ্গুর চেহারাটা ফুটে ওঠে। এটা কি ভাষারও বিপর্য্যয় নয়? কই, ভাষা তো স্থিত বাস্তবকে নিজের শাসনে ধরে রাখতে পারল না। বা, ভাষাকেও না। এমনই হয়। আসলে যা কঠোর তা আপাতঃ কঠোর, শেষাবধি তাকে ভঙ্গুরতার শিকার হোতেই হয়। এটাই বাস্তবতা।
বাস্তবতার কেত্তন গাইতে গিয়ে অর্থের অর্থটা হারিয়ে যায়।
আসলে অর্থের কোনো অর্থ হয় না। আর অর্থ কোনো ধ্রুবপদ নয়। বাস্তবতার সাপেক্ষে অর্থের অর্থ উদ্ভব হয় বা তার অর্থ করে নিতে হয়।
মানুষ যখন কিছু করতে যায় বলতে চায় তখন তাকে শব্দের উপযোগ করতেই হয়, নিজের কাছে কিম্বা অন্যের কাছে। শব্দের সঠিক কোনো অর্থ থাকুক বা না-থাকুক, তা দিয়ে একটা উদ্দেশ্য ব্যক্ত হয়, এই উদ্দেশ্যটা একটা অর্থ হোতে পারে – অর্থের উদ্দেশ্য উদ্দেশ্যই, কিন্তু অর্থের অর্থে অর্থ নয় – একটা অনুজ্ঞা, অনুমান, উপমান বা তাদের আপেক্ষিক অনুরূপ মাত্র। শব্দের অর্থ খুঁজতে গেলে শব্দই আড়ালে চলে যায়। সার্ব্বিক ভাষার ক্ষেত্রেও কথাটা সমান সত্য। ’তোমার হচ্ছে’, ’যাচ্চলে’, ’এই মরেছে’ ইত্যাকার কথা খুবই সাধারণ কথা, কিন্তু এদের অভিব্যক্তি খুব সাধারণ নয়, শুধু কথার কথা নয় এইসব বলে এমন কিছু বলতে চাওয়া হয় যা ভাষা ছাড়িয়ে যায়, এমন কি তারা বিমূর্ত কবিকথাও নয়, কথাগুলোর মধ্যে এমন মূর্ত বাস্তবতা আছে এমন সব মূর্ত ব্যঞ্জনা আছে যা শুধু বক্তার মনেই সীমাবদ্ধ হোয়ে থাকে, বক্তার কাজেই তাদের বিবৃত উপমানের প্রকাশ ঘটে, যার উদ্দেশ্যে ব্যক্ত হয় বলে মনে হয় তার কাছে প্রায় অবোধ্য থেকে যায় – এর বাস্তবতা বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া বাস্তবতা কিন্তু পরা-বাস্তব নয়। আবার যখন বলা হয় ’তিন বছরের মধ্যে পঁয়ত্রিশ লক্ষ মানুষকে (খবরেরর কাগজ পড়ে আমি যদি না ভুল করি, পরে পাঁচ লক্ষও লক্ষ্য করেছি) কাজ দেওয়া হবে’ বা ’বন্দুকের নলে কি নিরোধ ভরা থাকে?’ ÕParliament is not mortar & stones. It envisions democracy’, ’কিষান আন্দোলনের পিছনে মাওমাদী মদত আছে’ ইত্যাকার ভাষা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি বা কাগজে পড়ে থাকি – এইসব ভাষা কিসের ভাষা, কাদের প্রচলিত ভাষা, কী উদ্দেশ্যে এইসব ভাষা? গণতন্ত্র ধর্ষণের যুগে এদের গূঢ়ার্থ বুঝতে অসুবিধা হয় না, কিন্তু বুঝতে হয়। যারা এইসব কথা বলে তারা অল্পকথা বহুকথায বলে মানুষকে ধোঁকা দেয়, বহুকথা এককথায় বলে আসল সত্যকে মানুষের কাছে চেপে রাখে। রলাঁ বার্ত হোলে বলতেন শাসকের ভাষা হোল ’মিথ’ – মানে, মিথ্যাচার বা নষ্টামি যার ক্ষমতা অসীম, যা আসলে লোক-ঠকানো ভাষা। শাসিতদেরও পাল্টা ভাষা আছে, ভাত-কাপড়ের দাবির ভাষা যা শুধু দাবি নয় অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ভাষা। ফুকো ভাষা নিয়ে আলাদা করে কিছু না বললেও জ্ঞান আহরণ ও ছড়ানোর মাধ্যম হিসাবে ভাষাও তাঁর ক্ষমতাতত্ত্বের বিশেষ অনুষঙ্গ হোয়ে উঠেছে। ক্ষমতা ক্ষমতাকে ধরে রাখতে চায় শালীনতা-বিব্বর্জিত ভাষায়, ভাষাটা তার ক্ষমতার বন্দুক হোয়ে কাজ করে চলে।
আক্রামক ও আক্রান্তের ভাষা শুধু সামাজিক বিভাজনের কথা বুঝিয়ে দেয় না স্মরণ করিয়েও দেয়। আমরা বুঝতে পারি ভাষা কীভাবে ক্ষমতার শাসনের প্রতিনিধিত্ব করে, কীভাবে তার কর্তৃত্ব ফলিয়ে চলে। আবার এটাও সত্য যে সুবিধাভোগী মধ্যবিত্তরা তাদের সব কথায় ও আচরণে কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করে রাখে – তারা মুখে সামাজিক দায়ের কথা স্বীকার করলেও তাদের কথার ও কাজের স্ববিরোধী ও দ্বিচারী চরিত্র প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধ শক্তি হোয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়, চূড়ান্ত বিশ্লেণে তারা প্রতিষ্ঠানের প্রতিহারী কথক ঠাকুর ছাড়া কিছু নয়। ভাষার কর্তৃত্বশক্তি তাদেরই হাতে যাদের হাতে ক্ষমতার লাগাম থাকে, মূলতঃ তাদেরই লাগামের বেতো ঘোড়ার মতো কাজ করে যায় বুদ্ধিজীবিরা, সবাই না হোলেও অন্ততঃ অধিকাংশ তো বটেই। ভাষা এমনই দ্বিচারী।
বুদ্ধিজীবিদের ক্ষমতাকে ভয় পায় ক্ষমতার শাসন। ক্ষমতা তাই তাদেরকে তোষণ করে রাখে। পুষে রাখে তার সমর্থনে। বরাবরই এটা হোয়ে আসছে। হিটলারের ফ্যাসিস্ত শাসনেও এমন ঘটেছিল, সব শাসনেই এমন ঘটে থাকে – কখনো সেটা স্পষ্ট ও পরিপুষ্ট, কখনো নিছকই জনদরদি ধোঁকাবাজি।

সামাজিক ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাষার ক্ষমতা ক্রমশঃই একটা প্রবল শক্তি হোয়ে উঠেছে, তার মধ্যেই যূথবদ্ধ হোয়ে বাস করতে শিখে নিয়েছে মানুষ, কিন্তু মানুষের জীবন যেন অন্যকিছু, তাকে যূথের ভাষা থেকে কিছুতেই মুক্ত করা যায় না,তারা সেই ভাষাতেই ভাবে ও কাজ করে। ভিটগেনস্টাইন বলেন : [T]his language grew up as it did because human beings had – and have – the tendency to think in this way. So you can succeed in extricating people who live in an instinctive rebellion against language; you cannot help those whose entire instinct is to live in the herd which created this language as its proper mode of expression. ভাষা কি মানুষের প্রবৃত্তিগত প্রকাশ? কিছুটা তা হোলেও ভাষা কিন্তু মানুষের বৃত্তিগত অভ্যাস, তারই কারণে এত কিছু, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে বলা, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে শোনা, এবং এইভাবে ক্রমাগত জীবনকে বাড়িয়ে চলা। কারণ ইতিমধ্যে মানুষ ভাষার সামাজিকতার অবিচ্ছেদ্য মাত্রা অর্জ্জন করে ফেলেছে, পরিণামটা ইতিবাচক হোলেও মানুষের সেটা নিজের সম্পদ করে তোলাটা জরুরী। শুধু জীবনকে বাড়িয়ে চলা নয়, নিজেও যুগপৎ বেড়ে ওঠা। কতটা বেড়ে ওঠা যায় সেটা নির্ভর করে সামাজিক পরিস্থিতি থেকে পাওয়া সুযোগের উপর, পরিস্থিতি অনুকূল না হোলে এবং সুযোগের অভাব ঘটলে শুধুমাত্র ভাষার করার কিছু থাকে না, জীবনকে অল্পেই সুখে থাকতে হয়, অল্প জীবনের সংস্কৃতি স্বল্পেই সীমাবদ্ধ, তাতে সুখ থাকলেও সমৃদ্ধি থাকে না। সমৃদ্ধি না ঘটুক, স্বল্পকথা না-বলা কথাটা ঘটিয়ে দিয়ে যায়। এমিলি ডিকিনসন তাঁর বন্ধুকে এক চিঠিতে লেখেন : : If you were here … we need not talk at all, our eyes would whisper for us and your hand fast in mine, we would not ask for language. এইভাবে কথা বললে ভাষা তখন নেপথ্যে থাকলেও কথার চেয়ে বেশী কথা বলা হোয়ে যায় : ভাষার অসীম শক্তি সত্ত্বেও উন্মুখ দুই চোখের মিলনে ফিসফিস কথার ফাঁস জড়ানো দুই হাতের নিষ্পেষণে ভাষার আধিপত্য ক্রমশঃ নিমীলিত দমিত হোয়ে আসে।

ক্ষমতার আধিপত্যকে খারিজ করার জন্য ভাষার আধিপত্যকেও খারিজ করার দরকার হয়।
ক্ষমতা প্রযুক্তি শুধু মানুষের উপর আরও শাসন করে না, তারই স্বার্থে ভাষাও এক ক্রমিকতায় বিবর্তিত হয়ে চলে।
আরও একটা কথা যে ভাষা শুধু বলা হয় না, কাগজে কলমে লেখাও হয় যাকে বলে গ্রন্থনা, যে লেখে সে গ্রন্থধকার। একবার কথা ছুঁড়ে দিলে বা লিখে ফেললে ডাকবাক্সে চিঠি ফ্যালার মতো তা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না – সেটা তখন আর কারুর স্বত্বে থাকে না, সেটা সবার জন্য ও সবার কথা হোয়ে যায়, সবার চর্চ্চার বিষয় হোয়ে যায়। ভাষার এই সামাজিক স্বত্বটা মাথায় রেখেই রঁলা বার্ত নিজেই ফাঁসুড়ে সেজে গ্রন্থকারের মৃত্যু ঘোষণা করেছেন।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *