জ্যোতির্ময় হালদারের “প্রস্তর যুগের জ্যোৎস্না“-র সমালোচনা করলেন- সু কা ন্ত দে
চন্দ্রদোষের জ্যোৎস্না
হে মহামান্য বিচারক
কোনও কোনও কবি রবীন্দ্রনাথের ছবির হুক থেকে নিজেকে ঝুলিয়ে রাখেন। কবি না হলেও তাদের গা থেকে কবিতার এরোটিক পারফিউম টের পাওয়া যায়। রবিঠাকুরের টিআরপি হাই বলে ওনার নাম নিলাম। ওখানে অন্য কারও নামও বসাতে পারেন। আমার লেখা আসা, না আসা, বাঁশঝাড়ের ওপর নির্ভরশীল। তাই কিছু লেখার সময় তার সাথে সম্পর্ক হয় হেটেরোসেক্সুয়াল। সেক্সের কথায় মনে পড়লো —
“ট্রেন শব্দে মনে আসে হাস্যকর তোমাকে হার্ট ক্রেনের সাথে মেলানো
আসলে তো দুটো লাইনই দূরত্ব বজায় রেখে ছুটে যাবে দিগন্তের পরপারে…
আমাদের বসন্ত নেই, আমি হার্ট ক্রেন পড়িনি কোনদিন
আমাদের হাসপাতাল আছে
…
আমাদের গান নেই, আছে আর্তনাদ — চারিভিতে” – আমাদের গান নেই, কাজেই চান করতে না চাওয়া একটা মানুষের সাথে আমার মতো দেশের মাটির বিলিতি বেগুনের ফারাক থাকবেই। Herold Hart Crane আমেরিকার কবি। বাবা-মা এর বিস্ত্রস্ত হয়ে থাকা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে জীবন গোছাতে চেয়ে মদ্যপ হয়ে গেছিলেন। সমকামী সম্পর্ক এবং ইত্যাদি ইত্যাদির পর গাল্ফ অফ মেক্সিকোয় ঝুপ্পুস। বিদায় বন্ধুগণ বলতে বলতে। কাজেই — ভাস্করের “আমাদের মনখারাপ নেই, স্যারিডন আছে” লাইনটা আমার মনে পড়তেই পারে। ভাস্কর একবার আত্মহত্যা করতে গিয়ে বহুক্ষণ লরির চাকার কাছাকাছি থেকে ভোরে ফিরে আসেন। কেউ কেউ সারাজীবন ধরে আত্মহত্যা করেন। জ্যোতির্ময় হালদার ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন শক্তি চাটুজ্যের বই হাতে ( সত্যিমিথ্যের দায় স্বপ্নকমল সরকারের। আমি শুধু চিপকে দেওয়ার দায় নিতে পারি) অথচ জীবনে তাঁর একটাই বই প্রকাশ হল, পরে আর লিখলেনই না সেটা তো আত্মহত্যাই।
ওকালতনামা
বইটা নিয়ে লেখার কথা যখন হচ্ছিলো শ্যামলদা(বরণ সাহা) তাঁর গোল ফ্রেমের চশমার ভেতর থেকে ফস করে চোখ জ্বেলে বললেন — জানো, রূপক(মিত্র, পদবি সার্থক) যখন মণীন্দ্র রায় এর কাছে যায়, আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। রূপককে দেখিয়ে উনি বলেন — “এই ছেলেটিই জ্যোতির্ময় হালদার, নিজের কবিতার বই ছাপতে এসেছে কিন্তু সেটা স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছে, তাই বলছে বন্ধুর বই“। তখন আমি বলি যে রূপককে আমি ভালো করে চিনি, ও জ্যোতির্ময় নয়। আসলে একটা ছেলে বর্ধমান থেকে কলকাতায় হাজির হয়েছে বন্ধুর বই ছাপানোর তদ্বির করতে এটা ভাবতে পারছিলেন না। উনি নতুন লেখকদের বই ছাপতেন।
আর্জ কিয়া যায়ে
“কোলকাতাকে” নিয়ে প্রচুর কবিতা হয়েছে। পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’এ লেখা ছিল — “কোলকাতাকে এক খাবলায় চিবিয়ে খেতে পারি আমি”
এই কবি লিখলেন, “কোলকাতা আজ আর কেউ নেই… আমি তোকে গিলে খাব, অথবা তুই আমাকে“। প্রায় এক? তাহলে এই তুমুল কবিতার আরও কয়েক লাইন পেশ করি হুজুরে আলা
” কোলকাতা তোর মুখোমুখি আমার নিজেকে বড় বোকা লাগে
…
প্রতিষ্ঠানের পেট থেকে বেরিয়ে আসা প্রতিষ্ঠান বিরোধী কাগজ
…
কোলকাতা আমি শুধু তোর ময়দান থেকে ন্যুব্জ মানুষকে দ্রুত হাতে
কুড়িয়ে নিতে দেখেছি পরমানু বিস্ফোরণের খবর ও শ্রীমতী প্রধানমন্ত্রীর হাসি
…
কোলকাতা তোর রুক্ষ বাতাসে আমার শুকনো জিভ চিরে গেছে
কোলকাতা, আমার গলা টিপে ধরা হলে আমি ক্রুদ্ধ চোখ তুলে
চিনে নিয়েছি সেইসব ভাঁড়দের, যারা
খুব দ্রুত, এক জুতোর সুকতলা থেকে জিভ সরিয়ে নিয়ে গেছে অন্য সুকতলায়”
বক্তব্য ঋজু। উপর দিকে সামান্য বাঁকা। একটা উদমা তলোয়ারের মাফিক। বিপ্লবের মতো তার ধার। চমকাইতলার বীজ ছিল এই বর্ধমানের রামটহল লেনের একটা বাড়িতে। ভাবতে ভালো লাগে। পড়ি, সত্তরের সেইসব দিনের কথা। বরানগরের হত্যার পর তিনদিন দরজা বন্ধ করে বসে আছেন ভাষ্কর। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কবিতা দিয়েই লড়ে যাওয়ার কথা বলছেন। আমাদের কবি স্যাবোটাজের কথাও বলছেন। কলকাতামুখীনতাকে নস্যাৎ করতে চাইছেন। যখন শুনলাম কবির ছিল উগ্র ঝাঁঝ, মনে হল কবিতায় আত্মস্থ থাকার সেটা সাইড এফেক্ট। বর্ধমানে তখন কবি সুব্রত চক্রবর্তী জানাচ্ছেন সেইসব কথা যা “বালক জানে না“। জ্যোতির্ময় লিখছেন-
” হৃদয়ের ক্ষতচিহ্ন দেখে, মানুষ কবিতা বলে ভুল করে
তুমুল তালির শব্দে, মূর্খ উচ্ছ্বাস তার ফেটে পড়ে ঘরময়,
ক্রমশঃ বিস্তৃত হয় কোলকাতায়, বিপুল বাংলাদেশে, কবিসম্মেলনে…”
সত্যিই কি এই মফঃস্বলের বালকেরা জানতো না। দু-একজন যে জানতো তার প্রমাণ এই কাব্যগ্রন্থ। বড় বড় নখ রাখতেন শুনলাম। নিজেই নিজেকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে সুবিধা হতো তাতে? খোদায় মালুম। কবি এখন বই থেকে নখযুক্ত আঙুল তুলে আমাকে কবিতা চেনাচ্ছেন। কানের কাছে চিৎকার — জাগতে রহো!
কবি পড়েছিলেন ইকনমিক্স। বন্ধুদের পড়াতেন। প্রচুর পড়াশোনার বাই ছিল। বইতে ‘মহারাজপুর’ নামের দুটো কবিতা। জায়গাটা দিকশূন্যপুর টাইপ ছিল কিনা জানিনা তবে সুনীলের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সিনেমা হয়ে গেছে ১৯৭০ এ। জ্যোতির্ময় এর এই কবিতা লেখার অনেক আগেই সশক্তি তিনি ডালটনগঞ্জ নেতারহাটের ন্যাতা মেরে দিয়েছেন বলেই অনুমান।
সাঁওতাল রমণীর গায়ে সারল্যের সূর্য ওঠে আর অস্ত যায়। বাঙালি জনতা জেনে গেছে। “গার্হস্থ ফুল” কবিতায় যেসব সাঁঝলাগা আক্ষেপ আছে
“কড়ি ও সিঁদুরের কূট সজ্জার মধ্য থেকে লাফিয়ে উঠবে
সুখী দিনের সূর্য্য
…
দূরে গৃহস্থের সুখী ও যুবতী বউ একা
ভেসে যায় গন্ধের প্রবাহে
চোরাস্রোত; তাকে আজ চিনিয়েছে, কাকে বলে আত্মপ্রতারণা
আর কাকে বলে সুখ
গৃহস্থ তো পূজা দ্যায় নিজস্ব কল্যাণকামনায় দেবতার প্রসাদ ভিক্ষুক”
সেসব কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য সাহেবগঞ্জের দু-স্টেশন আগের মহারাজপুর আবিস্কার করেন নিজেই। কিন্তু সেই অন্তর্নিহিত ১ টাকা যে মানুষকে দেখায় তার সমস্ত সম্পর্কগুলো আসলে ১ পয়সা ২ পয়সা থেকে বড়জোর আধুলি অথচ সবগুলো একসাথে করেও কিছুতেই ১ টাকার সমান হয়না। সে কাউকে ছাড়ে না। একমাত্র লেখার সময় কবি ১ টাকা। তার চাহিদা, “মহারাজপুরের ভেতরে যে ঝর্ণা তার জল পান করে মনে হয়, /যদি কোনও গম্ভীর রমণী এর তলে/মেলে দ্যায় আবরণহীন তার দীর্ঘ ও সুদীর্ঘ দৈহিক সম্ভার–/ ভালো হয়…“। অথচ সে যা করে সেটা ১ টাকার চোখে অন্যকিছু। পায়রার কাছে অন্যকিছু। “ঝাউবীথি স্তব্ধ হয়ে দ্যাখে একজন যুবক পদ্যকার / তরল আগুনের মধ্যে দিয়ে সাঁতরে গ্যালো সাঁওতালী/ সারল্যের দিকে… / খসে পড়লো তার অন্তর্বাস, জামাপ্যাণ্ট; আজীবন প্রতারণা”
সেই ১ টাকাই বলে দেয় এসব দ্বিচারিতার কথা। লেখার সময় দেখতে পাই কিভাবে প্রশংসা চাইছে একটা আধুলি, কিভাবে শ্রাগ করছে একটা ১০ পয়সা, দারুণ কিছু লিখেছি ভেবে নিজেরই বুক চওড়া করছি, গোলের পর গোল দিচ্ছি, গোলকিপার নেই। কবিতার বই ভালো কিনা বোঝার একটা উপায় আবিষ্কার করেছি। ম্যাগনেটিক ফিল্ড। যদিও বিজ্ঞান বলছে আকর্ষণের থেকে বিকর্ষণই বিশ্বাসযোগ্য কিন্তু আমি নেহাতই “ফেলবেননা” ওলার ভ্যানে চিতিয়ে থাকা সামান্য লোহা, আমার ওই আকর্ষণই সম্বল। অবশ্য এরকম লোকও দেখেছি যাঁদের আকর্ষণ না থাকলেও আকর্ষ আছে। ক্লোরোফিল নেই অথবা সালোকসংশ্লেষ জানেন না বলে মহীরুহ হয়ে উঠতে পারলেন না। তা না পারুন। আমি নেতি থেকে ইতির দিকে ফোল্ড হই।
ষাট ও সত্তরের দশকে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। খিদে টের পেয়েছে বাংলা কবিতা।
“তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্য বিছানায়
হে ঘোড়া, কোলকাতায় তিন গেলাস স্বাস্থ্যসুধাপান
পরিত্রাণহীনতা হাসে পুরুতের নামাবলীগীতা
ধাতুধর্ম সাতবার গড়াগড়ি খায়”
১৯৬৪ সাল, ২ সেপ্টেম্বর টালার শ্যামাচরণ স্ট্রিট থেকে শৈলেশ্বর আর সুভাষ ঘোষকে তুলেছে পুলিশ। সত্তরের তাস তো আগেই নামিয়ে বসে আছি। এই বইতে অধিকাংশ কবিতা ছন্দের নামাবলী খুলে ফেললেও, কয়েকটার গায়ে নামাবলী আছে। জীবনানন্দীয় গন্ধ আছে। একাধিক হেমন্তকাল, একটা বসন্ত, একটা শীতকাল এমনকি এপ্রিল মাস আছে। প্রেম আছে। চিঠি আছে। যৌনতা আছে। যব যব ফুল খিলে তব তব প্রেম চিকনা হয়ে ওঠে। একজন কবির প্রথম বইতে এসব তো থাকারই কথা। তখন ফেসবুক নেই, ইন্সটাগ্রাম নেই, হোয়াটসঅ্যাপ নেই। তবু প্রেম এলে তো বাহার আসবেই। কিন্তু বইটার কবিতাগুলো আজ থেকে ৪২ বছর আগে লেখা। সেটা নিয়ে এখন লিখতে বসা কেন? সেটা বলার জন্যই এত ধানাইপানাই। তুলোর মতো পঙক্তি উড়িয়ে দেওয়া। ‘প্রেম’ কবিতায় আছে প্রকৃত খামারের কথা। হেমন্তে এক মহিলার নাম পাই। ঋতা। কি বলছেন? বনলতা, সুরঞ্জনা, নীরা, সুপর্ণা তো ছিলই। নতুন কিছু তো নয়, নামমাত্র। প্রেম, চিঠি, শীতকাল কি ব্যাঙের মতো লাফাতে পারতো, পাশ কাটাতে পারতো? এসব নিয়ে ভাববো বলেই কবির ভাব সরিয়ে রেখেছি। নখ কাটিনি এমনকি চোখ ধুইনি। চোখে চারদিনের পিচুটি। এ ছাড়া কবিতাকে মর্গের টেবিলে কিকরে শোওয়াই বলুন। না স্যার বিষয়ে তেমন নতুনত্ব থাকার তো কথা নয়। শৈলী নিয়ে কথা বলি। আগের লাইনগুলো ধরে রেখেছেন তো। ধরে রাখার জন্য পাত্র চাই। কবিতার ধারাপাতের মধ্যে নতুনতরকে সম্মান জানাতে হয়। একেকজন কবি আসেন যাঁর কবিতা পড়ে মনে হয় পূর্বসূরীদের ভেতরে নিয়ে পুষ্ট হয়ে নিজের মতো বেরিয়ে এলেন। বাকিরা ঝিলিক দিয়ে যান কিছু কিছু কবিতায় বা লাইনে। বিশেষ অবস্থা, বিশেষত দূরবস্থার সময়ে কবিতা একটা বড় কাজ করে। মানুষের বক্তব্য তুলে আনে। দায়বদ্ধতা মাটির নিচে জলের মতো বয়ে যায়। আঙ্গিক, ভোকাবুলারি, চিত্রময়তা, ভেতরটান, এরকম কয়েনেজ দিয়েই কবিতাকে বুঝতে চান পাঠক। কিন্তু কবিতা তার থেকেও বেশি শক্তিশালী হয় যখন সে ব্যাখ্যাতীতের কাছাকাছি থাকে। রঙের টেক্কাটা নামানোর আগে একটু হেঁটে আসি গোলাপবাগ থেকে। বাংলা কবিতায় কোন কোন গাছ পোঁতা হয়ে গেছে সেসব বেড়েওছে সেটা দেখি। মানে কা আ তরুবরের পাঁচটা ডালে উত্তাল ঝাঁকুনি দেওয়া হয়ে গেছে। কবিতার থেকে আধ্যাত্মিকতার আর ইতিবাচকতার মোহ গেছে, শিউলি ফুলের মতো ভোর হতেই ঝরে যাচ্ছে ছন্দ, যদিও আলোকরঞ্জন এই সেদিনও নানান তরঙ্গভঙ্গের হদ্দমুদ্দ করেছেন। পরেরদিকের কথা বলবো না। সময়ের কবিতা আর কবিতার জাঙ্কফুডে আমরা আশি সালের একটা দ্যাবা পাথরের ওপর দাঁড়াবো। কবিতার দূর্বোধ্যতা না দূর্বোধ্যতাই কবিতা এর মাঝে একটা ক্যামেরা রোল হচ্ছে। কৃত্তিবাসীরা হুইস্কি থেকে মহুয়া, গাঁজা, নিয়ে ঢুকে একদিকে সাঁওতাল রমণী আর অন্যদিকে বাংলা কবিতার আভরণ আর আবরণ দুটোই খুলে ফেলার একটা একটা শট দিচ্ছেন। ১৯৬৩ তেই “সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত” সম্পাদনা করেছেন শঙখবাবু আর অলোকরঞ্জন। অর্থাৎ বিদেশের কবিতার পড়ার একটা ঝোঁক তৈরী হয়ে গেছে। কবিতার জন্যই কবিতা বলতে বলতে তাকে বিষয়হীন উদোম করার প্রক্রিয়া পুরোমাত্রায়। এরপর কবিতার সেই ধারাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা তাগিদ তো থাকবেই। বিশেষতঃ যে কবি চারপাশ (অগ্রজদের তো বটেই) নিংড়ে ফেলতে চান তার দায়বদ্ধতার অনুভূতি হবে গরম লাগার মতো। নন্দনতত্ত্বের জামা খোলার জন্য ছটফটানি — “অবিনাশী কবিত্বের পোঁদে আমি লাথি মারি” বলে চেঁচিয়ে উঠবেন। কমবয়সের ছেলেগুলোকে নকশাল ব’লে মেরে ফেলার পর কবিতাকে মনে হবে শুধু শব্দের হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়। আবার নকশাল আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার হতাশাও থাকতে পারে। তাই এসব লাইনকে হাংরির শব্দব্যাম্বুর থেকে আলাদা রাখতে হবে। সেই লোক যিনি ইন্টারভিউতে বলেছিলেন কবিতা লেখার জন্যই আমার চাকরি চাই। ওপরতলার সাথে বনিবনা না হলে সে মানুষ ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে চলে যেতেই পারেন। আর সুখী মানুষ কখনও কবি হয় না। তাঁর জন্য ঠিক ছিল অবসাদ আর বিচ্ছিন্ন মনস্তত্ত্বের দিকে চলে যাওয়া। তাই গেছিলেন। ব্যক্তিগত দিনলিপি বলে যা লিখে গেছেন সেটা দেখলে বেশি করে মনে পড়ে ভাষ্করের কথা। জয় গোস্বামীর “ক্রিসমাস ও শীতের সনেট গুচ্ছ” আর “প্রত্নজীব” প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৭৭ আর ৭৮ সালে। তাঁর ভাব ভাষা ও আনুষঙ্গিক মিলেমিশে একটা আলাদা কোয়ালিটি হয়ে উঠছে। এই হয়ে ওঠাটিই সার। বিজ্ঞান দিয়ে বোঝা সহজ। একাধিক মৌলিক পদার্থ যেমন হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মিশে তৈরী করে জল। হাইড্রোজেন জ্বলে ওঠে, অক্সিজেন জ্বলতে সাহায্য করে। জলের গুণ, এর বিপরীত। তাই ভাস্কর, শক্তি, জীবনানন্দ যে সব মৌলিক তত্ত্বই মিশুক না কেন একটি ভিন্নধর্মী যৌগ উৎপন্ন হল কিনা সেটাই দেখার। ১৯৭২ থেকে ৭৬ এই পাঁচ বছর ধরে প্রতি বছর এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা সম্পাদনা করেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত এবং রঞ্জিত সিংহ। সেখানে পাশাপাশি দুজনের কবিতা ছিল জয় এবং প্রস্তর যুগের জ্যোৎস্নার কবি জ্যোতির্ময় হালদার এর৷ এ গল্পও স্বপ্নকমল সরকারের কাছে শোনা। ২০২১ এ এটা ইতিহাস। যেমন চলে গেছেন কবি নিজেই।
দাখিলে সবুদ অওর সওয়াল কা মুকদ্দর
ওকালতির তজুর্বা অনেক হল, নেওয়া যাক দু-একটা সবুত এবার, যখন অন্ধকারে পেঁচা নামে আর দেখে এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়।
১) “এলোচুল ছড়িয়েছো কেন তুমি সমুদ্র বাতাসে–
অভিমানে মাথা হয় নিচু
প্রিয়, বলো অপরাধ করেছি কি কিছু?”
২) “কবিতায় মায়া রাখি
রাখি কিছু বিষ
তুই এসে পড়ে পড়ে
নিঃস্ব করে দিস”
৩) “তরল আগুনের ছলে আমি যাচ্ ঞা করেছি প্রেম কখনো বা পদ্যের ছলে।
তুমি জানো?”
৪) “গুনেগেঁথে রাখিনি সখ্যতা
তবু ফুটেছে কিছু অর্কিডের ফুল
না ফেরা মুহুর্ত যদি শিউলি প্রপাত
সযত্নে থাক আমাদের কটা ভুল”
৫) “সিঁড়ির একান্ত নিচে পড়ে আছে উৎকীর্ণ ফুল ভিতরের ভুলিভ্রান্তি নিয়ে… একা, একা একা। অন্তরালে ওঠে চাঁদ, চলে যায় মেঘের আড়ালে।”
কয়েকটি লিখেছেন জ্যোতির্ময় হালদার, কোনওটা বিভাস রায়চৌধুরী, কোনওটা আমি। আলাদা করে চেনা বা বোঝার উপায় নেই। এর পরও কি বলতে হবে এই লেখাগুলো আসলে কবির নিজের লেখার প্রতি মায়া ছাড়া আর কিছু নয়।
কিছু শব্দ ব্যবহারের প্রতি কবির তুলতুলে কোণ দেখা যায়। এগুলো বিশেষ নয় আবার কবিকে ড্রাইটেস্টে ধরার একটা উপায়ও। হালদারবাবুর যেমন ‘হাবা’, “যাচ্ ঞা”। বইতে লেখা আছে — ‘কবিতার রচনাকাল ১৯৭৪-৭৯, রচনা সন্নিবেশে কোনও কালানুক্রম মান্য করা হয়নি’। থাকলে বুঝতে পারতাম আমার আনুমান ঠিক কিনা। কবি ট্রানজিশনের একটা টানেল বেয়ে যাওয়ার সময় এই বইটা প্রকাশিত হয়। এই আলো-আঁধারির পরই এক প্রবল সম্ভাবনাময় কবির লেখার ধারাকে খানিকটা স্পষ্ট চেহারায় পাওয়ার কথা ছিল আমাদের।
“আবার আমি চিঠি লিখতে শুরু করলাম তোমাকে।
-সেদিন, যখন চারিদিকে সন্ধে,
তোমার চিঠি আমি বিছানায় ছড়িয়ে পড়তে-পড়তে দেখি, আমার
ঘুম নামছে তোমার চিঠিপত্রের ওপর-
আমার ঘুমের ভেতরে
তুমি ঘুমিয়ে আছ, তোমার দিদিও ঘুমিয়ে আছে দেখি,
দেখি, আমার সমস্ত লেখালেখির ভেতর মৃত্যু তার ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে”
কবিতা ১৩৪/ ভাষ্কর চক্রবর্তী
“এখন হোটেলের বারান্দায় বসে চিঠি লিখছি তোমাকে
…
গতকাল ১ জন রূপসী বেশ্যার বাড়িতে কাটিয়েছি রাত
সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, রবীন্দ্রনাথের গান আপনার
কেমন লাগে?
তারপর শুনিয়েছে ৩ খানি ব্রহ্ম সংগীত
চোখ বন্ধ করেও আমি তাকে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে
ভুল করিনি
এখন পুরানো কেল্লার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে হাঁস
আমি এখন সিগারেট খেতে চাইনা।
শুধু জ্বর গায়ে লেপের মধ্যে শুয়ে–
হেঁটে যাবো বালক বয়সের উজ্জ্বল রৌদ্রের ভিতর”
চিঠি/ জ্যোতির্ময় হালদার
“এক সরাইখানা থেকে আরেক সরাইখানায় হেঁটে যাবার পথে
আমার সঙ্গে আলাপ হল বেশ্যাদের
ক্লান্ত ঘুম জড়ানো তাদের চোখ, চোখ কচলে হাই তুলে
সায়া ও ব্লাউজ পরা মেয়েরা বেরিয়ে এলো আমার গলা শুনে”
— অরুণেশ ঘোষ
ইয়োর অনার খেয়াল করুন, যেখানে ভাস্করের চিঠি সন্ধ্যের সূর্যের মতো ঢলে পড়তে চাইছে সুইসাইড এটেম্পটের কারন দর্শানোর দিকে, যেখানে অরুণেশ যৌনতার ঝান্ডা তুলে ধরে, চাইছেন সমাজের কোঁচার ভেতরে লুকিয়ে থাকা ম্যাও বেরিয়ে আসুক, সেখানে জ্যোতির্ময় চাইছেন বেশ্যা ধারনাটার পরিবর্তন। বালকের দৃষ্টিতে সবসময় ভুল থাকে না। অদ্বৈত বেদান্ত বলে স্বরূপত কোথাও কোনও ভেদ নেই। সেই যে খেতরির রাজার বাড়িতে মুজরো করতে আসা তবায়েফের গান শুনে, সরে থাকা বিবেকানন্দ নিজেকে বললেন — সন্ন্যাসীর তো ভেদজ্ঞান থাকা উচিত নয়। বুকভরা গান নিয়ে অবতীর্ণ হলেন আসরে। এই তো জ্যোতির্ময়ের নিজস্বতার আলো।
“ক্রমশঃ অন্ধকার(গুঁড়ি মেরে) নেমে আসছে তোমার উঠোনে
তুমি সরু হ’য়ে ঢুকে পড়ছো শোবার ঘরে
হাঁ করে বসে আছে তোমার বউ
তোমাকে অণ্ডকোষ সমেত গিলে খাবে বলে
…
তোমার মনে পড়ে যাচ্ছে বারবার ঘোর শৈশবের কথা
অন্ধকারের ভয়ে তুমি একইরকম বারবার
হিসি করে ভাসিয়ে দিতে মায়ের পুরোনো কোল আর
তোমার বাবার দেওয়া যৌন আমন্ত্রণ, নতুন শান্তিপুরি শাড়ি”
ব্যক্তিগত দিনলিপি ৮ / জ্যোতির্ময় হালদার
কেয়াবাৎ বলে হাতুড়ি ঠুকুন। অণ্ডকোষের জোর কি করে প্রমাণ হয়? ধর্ষণে না সংযমে। শরীরে না দর্শনে? ক্ষুধায় কি ষড়রিপুর ষষ্ঠসুর ‘ধা’ এর অবস্থান? সভ্যতার গড়ানো চাকায় লুব্রিকেন্টের উপস্থিতি। ফ্রয়েড। লিবিডো। সঙ্গে সমর্পন চাওয়ার বিনীত ভঙ্গিমা? “গত শীতে একজন লুটেরা তোমার কাছে/কি রকম বিনীত ভঙ্গিমায় ভিক্ষা করেছিল তার/ কাঙখিত ব্যালট“–ব্যক্তিগত দিনলিপি-১৪
সত্য আপনার সামনে ইয়োর অনার। বাত এখানেই খতম নয়–
“হাঁটুর উপরে পাজামা তুলে ঘরে
এবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে ডানহাতে লিখতে বসবে
লিটল ম্যাগাজিনের জন্য পদ্য”
ব্যক্তিগত দিনলিপি -২০
আগের সবুদের সাথে আরেকখানা পেশ করছি জনাব। কবির বাচন আর বক্তব্যের ভেতর একটা চোখ দেখছে বাহির আরেকটা ভেতরে। কবি সত্যদ্রষ্টা। বলা সহজ। হওয়া সহজ নয়। জানা সহজ, করে দেখানো বেহদ মুশকিল। আর এই যে নিজস্ব বাচনভঙ্গী যেখান থেকে খুশি কবিতা শুরু হতে পারার যে কথা ভাস্কর বলেছিলেন তা করে দেখিয়েছেন আমাদের কবি।
“আজ ২১ বছর ধরে আমি প্রতীক্ষারত আছি তোমাদের
ক্রমশ চোখের পাতা ভারী হয়ে নেমে আসছে আমার চোখের উপর
…
আমার মা সমস্ত রাত প্রতিক্ষায় থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েন
ঠান্ডা ভাতের থালা সামনে রেখে।
আজ ১৯৭৭ এর শেষাশেষি
আমার ঠোঁট নাড়া বুঝতে পারছে না কেউ…
আজ ২১ বছর ধরে আমি প্রতীক্ষারত আছি মুক্তির
ক্রমশ চোখের পাতা ভারী হয়ে নেমে আসছে আমার জিভের উপর”
ব্যক্তিগত দিনলিপি–২২
“আপনারা যখন কলকাতা শহর জুড়ে সাতটা নয় পাঁচটা নয়
অন্তত একটা সমুদ্র কাঁপিয়ে লক্ষ হাতে নিশান উড়িয়ে কবিতা লিখছেন
তখন আমি এইখানে, এই কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে
চাঁদের লাবণ্যকে খুঁজে খুঁজে না পেয়ে অবশেষে
শুধু হাতেই আমার মায়ের মুখে হাত বোলাই;
আমার মা অসুস্থ, রুগ্ন গায়ে জ্বর
আমি মে দিবসের কবিতা লিখতে পারিনি বীরেনদা”
–-সমীর রায়
দুধ কা দুধ পানি কা পানি এতক্ষণে হয়েই গেছে। কথা বলতে বলতে বলার একটা জাড্যবল তৈরী হয়ে যায়। থামার জন্য আলাদা ব্রেক লাগে। অথবা কবিতাকে একটা খোলা দরজার দিকে শেষ করতে হয় যেখান থেকে পাঠক গড়িয়ে যেতে পারে নিজস্ব রচনার দিকে। সমীর রায় যেখানে সিদ্ধান্ত দিয়ে কবিতাটির নিচে ‘সমাপ্ত‘ লেখা স্টিকার চিটিয়ে দিচ্ছেন সেখানে জ্যোতির্ময় চাইছেন আরেকটা জন্মের দিকে চলে যেতে। এইখান থেকে জয় এসে শুরু করবেন চোখের পাতা লিখিত কবিতা। লাঠি লিখিত কবিতা অথবা নৈশব্দের ডান্ডি অভিযান। শৈলী আর সক্ষমতার সঙ্গে চাই ইমোশনের কাফিলা। মহাকালের ব্ল্যাকহোলের ভেতর আছে সিঙ্গুলারিটি। মাইক্রোওয়েভ ছড়িয়ে আছে বাংলা কবিতার মহাকাশে। আত্মপ্রকাশের লোভ পুড়িয়ে ফেলতে পারলে দেখা যায় তার জ্যোতির্ময় রূপ।
প্রস্তর যুগের জ্যোৎস্না
জ্যোতির্ময় হালদার
প্রকাশকঃ রূপক মিত্র
কালঃ ১৯৮২