ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস (২-য় পর্ব)

পরিচিতিঃ ইন্দ্রনীল বক্সী, “জন্ম – নকশাল পিরিয়ডে ..৭৩ এ দুর্গাপুরে , উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ মাজা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল টাইপ। লিখছি সেই কিশোরবেলা থেকে, দুর্গাপুর বেলা থেকে বর্তমান নিবাস – বর্ধমান। কি লিখছি ছাই নিজে তো জানিই না অন্যরাও জানে বলে মনে হয় না। হাবিজাবি করে চারটি বই প্রকাশিত।” বাইফোকালিজম্-এ তাঁর আজ ধারাবাহিক উপন্যাস  ‘চোরাবালি‘-র দ্বিতীয় পর্ব

 

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস (২-য় পর্ব)

 

চোরাবালি

(★★সতর্কবার্তাঃ এই উপন্যাস একটি কাল্পনিক কাহিনী। এর চরিত্ররাও কাল্পনিক। শুধু কিছু ভৌগলিক স্থান, কাল ও প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে কাহিনীর প্রয়োজনে। যদি কোনো চরিত্র, ঘটনা বা স্থানের সামঞ্জস্য পাওয়া যায় তা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত ও কাকতালীয়।★★)

পর্ব-দুই

“নামটা একটু বলবে ভাই …”
“দেবব্রত সানা”
“ঝুল কত দেবো ?”
“ ঐ…যতটা লাগে … যাতে জুতোর তলায় না যায় দেখবেন …”
ভাইফোঁটায় পাওয়া প্যান্টের ছিটটা এতদিনে প্যান্ট বানাতে দিলো দেবু । এমনিতে রেডিমেড পছন্দ করে , কিন্তু এটা পড়েই ছিলো ,তাছাড়া মায়ের তাড়া । রজত , মইদুলরা এখানেই বানাতে দেয় , বর্ধমান –তেলিপুকুর মোড়ের ‘স্টাইল’ টেলরে । ওদের কলেজের অনেকেই এখানে বানায় প্যান্ট-জামা । দোকানের মালিক খোকন কর্মকার নিজেই মেন কাটার , সঙ্গে দুটো অল্প বয়সী মেশিন ম্যান রেখেছে । এরা মাঝে মধ্যেই বদলে যায় । সবাই খোকন কর্মকারকে ‘মাস্টার’ নামেই ডাকতে অভ্যস্থ। মাস্টার চিরকাল যে বর্ধমানের বাসিন্দা এমন কিন্তু নয় ! দেশের বাড়ি দক্ষিন দামোদরের গোতানে, বছর পঁচিশেক আগে বড় বাজারে এক টেলরে ঢুকে পড়ে কাজ শিখতে, তারপর ধীরে ধীরে একদিন পাকা দর্জি হয়ে দেশের কিছু জমিজমা বেচে এখানে দোকান শুরু করে। তখনও এখানে এত জমজমাট হয়ে ওঠেনি। যাতায়াত করতো প্রতিদিন গোতান থেকেই, কিন্তু ধীরে ধীরে কাজের চাপ বাড়তে লাগলো , পুজোর সময় বিশেষ করে সারারাত প্রায় কাজ করতে হয় । এখন সপ্তায় একবার বাড়ি যায়।
বিয়ে হয়েছিলো মাস্টারের, বছর পনেরো আগে। চার বছরের ছেলে রেখে বউটা মরে গেলো বছর ছয় আগে, সদর হাসপাতালে এনেও কিছু করা যায়নি । ডাক্তার বলেছিলো এত অল্প বয়সে নাকি জরায়ুর ক্যান্সার বিশেষ দেখা যায়না! নাঃ মাস্টার আর বিয়ে থা করে নি। ছেলেটার বছর দশেকের হোলো , গ্রামের স্কুলেই পড়াশুনা করে । ছেলে মাস্টারের বেশ ভালো পড়াশুনায়। ইস্কুলের মাস্টার –দিদিমনিরা বলে “একে একটু নজর দিও খোকন , ছেলেটার মাথা আছে …” মাস্টার ভেবে রেখেছে এখন ওখানেই পড়াশুনা করুক , আর একটু বড় হলে এখানে আনবে। কম বয়সে আনলে শহুরে হাওয়া লেগে ছেলে বিগড়ে যেতে পারে।
“মাস্টার… কবে দেবে ?” দেবুর এমনিতে কোনো তাড়া নেই , তবুও নিয়ম মেনে জিজ্ঞেস করে।
“ দশদিন পর নিয়ে যাবে গো …ইমার্জেন্সি নেইতো! ”
“নাঃ…”
“তোমার বাড়ি বাদুলিয়া না! ” দেবুকে জিজ্ঞেস করে মাস্টার …
“ হ্যাঁ…কেন !”
“কাল বাদুলিয়া মোড়ে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে না রাতের দিকে? দুজন স্পট হয়েছে!”
“হ্যাঁ…ওই একটা লোড লরি উড়িয়ে দিয়েছে একটা বাইককে …” খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে বলে কথাগুলো দেবু। ও শুনেছে সকালেই বাড়ি থেকে বেরোনো মুখেই। সারা বছরে কটা যে এরকম হয় আরামবাগ রোডে! এসব আর তেমন নাড়ায়না দেবুকে। ছোটোবেলায় প্রথম প্রথম খুব উত্তেজিত হয়ে উঠতো এক্সিডেন্টের খবর শুনলে, দেখতে যেতে চাইতো । বাবা খুব বকতেন ,বলতেন“ দেখার বস্তু নাকি! একটা লোক থেঁতলে মরে পড়ে আছে … সেটা যে লোকে ভিড় করে কি দেখে বাপু কে জানে!…” এখন সয়ে গেছে এসব দেবুর।
“ হু…লোড লরি …কিসে লোড জানো …! বালি …বালি…”
“তাই হবে …ওই রুটে প্রচুর বালির লরি যায় বটে দিনভোর …তা তুমি জানলে কি করে এত ! ” একটু কৌতুক মিশ্রিত কৌতুহল নিয়েই জিজ্ঞেস করে দেবু।
মাস্টার কোনো উত্তর দেয়না ,মুচকি হাসে।
“তোমার চেনা লরি!”
এবার মাথা নাড়ে হ্যাঁ সূচক মাস্টার। একটু এদিক ওদিক দেখে অকারনে ফিস ফিস করে বলে ওঠে “আরে ওটা চালাচ্ছিলোতো আর এক খোকন ! মণিরুলের লরি …!!”
“আর এক খোকন মানে?”
“ …আরে আমিও খোকন কিনা …হা হা হা হা হা…” হেসে ওঠে মাস্টার “ও ব্যাটা ইন্দাসের …ও চালায় লরি আমি চালাই কাঁচি …” এটুকু বলেই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে ওঠে “কাউকে গল্প কোরোনা কিন্তু… ব্যাটা মেরে দিয়ে ভাগলবা , সোজা ইন্দাস। কদিন আর এমুখো হবেনা …বউয়ের আদর খাবে বাড়িতে বসে হা হা হা হা…”
এসব কথায় বিশেষ উৎসাহ পায়না দেবু। সেকন্ড ইয়ারের বেশ চাপ রয়েছে পড়ার , এর মধ্যে আবার ওর কিচ্ছু ভালো না লাগার রোগটা মাথা চাড়া দিয়েছে কদিন। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। একদিন বন্ধুরা মিলে আইনক্সে সিনেমা দেখতে যাওয়ার প্ল্যান রয়েছে এরমধ্যে। ও , রজত , রজতের গার্লফ্রেন্ড , মানব , নৌসাদ …নন্দিতাও যেতে পারে …নিশ্চয়তা নেই। পাড়ায় ভোলার মোবাইলের দোকানে ওর মোবাইলের চিপটা দিয়ে রেখেছে কাল , কিছু লেটেস্ট গান আর সলিড কিছু পানু লোড করে দেওয়ার জন্য, ভোলার ভালো কালেকশান আছে। এরকম সময় গুলো যখন চলতে থাকে দেবু দেখছে ,পানু দেখতে আর গান শুনতেই বেশী ভালো লাগে ওর … প্রতিবার স্বমেহনের পর ওর অবসাদ কমে আসে , ঝিমিয়ে পড়া শরীরে ঘুম নামে । সকালে মণির প্রবল ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে থেকে আজ কেন জানি মনে হচ্ছে আজ দিনটা কেমন ম্যাড় ম্যাড়ে । কলতলায় ব্রাশ করতে করতে চোখে পড়লো পাশের বাড়ির বছর তিরিশের বাসবী বৌদি সকাল সকাল স্নান করে তুলশিগাছে জল দিলো , ঘরে গেলো ,ফিরে এলো একটা বালতিতে ভিজে জামাকাপড় নিয়ে …শাড়ি মেললো …নীল রঙের শায়া মেললো… একটা গোলাপি রঙের ব্রেসিয়ার মেললো..এটা নিশ্চয়ই হারুদা এনে দিয়েছে বৌদিকে ! কিংবা….দেবুর কেমন গা টা শির শির করতে লাগলো । মনের মধ্যে একটা দ্রুত চলৎচিত্র খেলে গেলো কয়েক মুহুর্তের …… বাসবী বোউদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে…ব্রা পরে !…ঘরের চারদিকে আয়না… সব আয়নায় শুধু বাসবী বৌদির প্রতিবিম্ব …
এই ঘোরে ঘোরে দেবু স্নান করলো , ভাত খেলো । বাসে উঠলো… কলেজে অবধি পৌঁছে কিছুটা ধাতস্থ হলো । শুধু কলেজে ঢুকে থেকে সামনে মেয়ে দেখলেই ওর দৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠছে , শুধু খোঁজার চেষ্টা করছে তাদের গহনে অন্তর্বাসের আভাস , বিপদজনক আগ্রহে ওর মন পরিমাপ করতে চাইছে তাদের স্তন্যমান ! …দেবু সতর্ক হয়ে ওঠে । নিজেকে সংযত করতে মোবাইলে মনোনিবেশ করে অকারনে। কোনোরকমে ক্লাসগুলো শেষ করে ক্যান্টিনে গিয়ে বসে থাকে অনেকক্ষন মাস্টারের দোকানে আসার আগে পর্যন্ত।
স্টাইল টেলরের বাঁধানো বারান্দা থেকে এবার নেমে আসে দেবু। এসব ভাটের গল্প ওর ভালো লাগছে না। ওরকম কত চিটছে রোজ বাইপাসে ,আরামবাগ রোডে …বালির ট্রাক না বালের ট্রাক আমার ভেবে কি হবে ভাবতে ভাবতে তেলিপুকুর ফ্লাইওভারের দিকে এগোতে থাকে ।ওপাড় থেকে বাস ধরবে , সময় আছে এখনও অনেক । একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে থাকে।
দেবুর মাথায় ঘুরতে থাকে অন্য চিন্তা। বেশ কদিন নন্দিতার পাত্তা নেই। ‘আকাশ ফাউন্ডেশান’এ ও গেছিলো ,খোঁজ খবরও এনেছে। ওরা একটা প্রসপেক্টাস দিয়েছে যেখানে বিভিন্ন কম্পিটেটিভ চাকরির পরীক্ষা ও জয়েন্ট এন্ট্রান্স, বিসিএস সহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ক্রাশ কোর্সের লম্বা লিস্ট। সঙ্গে সময়কাল ও তার বাবদ টিউশান ফির তালিকা, ৩০ হাজার থেকে লক্ষের উপর। অনেক সফল স্টুডেন্টের ছবি যারা নাকি ওদের কোচিং পেয়ে বিভিন্ন পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছে। দেবুর কাছেই রয়ে গেছে প্রসপেক্টাস, নন্দিতা আসেনি, একদিন ফোন করেছিলো দেবু রিং হয়ে হয়ে কেটে গেছে। কে জানে ! শরীরটরির খারাপ হলো নাকি! …কিংবা ওর বাবা হয়তো বিয়ে ফাইনাল করে দিয়েছে! এটা মনে হতেই ওর মনে মনে হাসি পেলো । মনে পড়ে গেলো নন্দিতার সেদিনের হুংকার। যদি তাই হয় আচ্ছা ফাঁসবে বেচারী! পড়াশোনায় ভালো মেয়েটার অনেক স্বপ্ন। কি হবে দুম করে বিয়ে ফিয়ে হয়ে গেলে! বছর দুয়েকের মধ্যে মা হবে ,ঝলমলে শাড়ি পড়ে কপালে একগাদা সিঁদুর লাগিয়ে গদগদ হয়ে শ্বশুরবাড়ির গল্প করবে এসে ! নাঃ নন্দিতার সঙ্গে ব্যাপারটা একদম মেলাতে পারছেনা ও। একদিন ওদের শ্যামলালের বাড়িতে যাবে , গিয়ে দেখে আসবে কি কেস! দেবু মনে মনে ঠিক করে।
মানুষ কেন বিয়ে করে? আর একটা মানুষের সঙ্গ পাবে বলে! শরীর পাবে বলে! একটা নিরাপত্তার নিজস্ব বলয়! তাইকি! কই তাইবা কতজনের হয়! এইতো ফার্স্টইয়ারে পড়তে পড়তেই ওদের পাড়ার মৌসুমীর বিয়ে হয়ে গেলো মিল মালিকের ছেলের সঙ্গে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মৌসুমী বাপের বাড়িতে পাকাপাকি ভাবে ফিরে এলো, ওর বর নাকি পাঁড় মাতাল, বেদম পেটায়, সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয় ওকে! শুনছে ডিভোর্স হবে, মামলা চলছে … বউকে সিগারেটের ছ্যাঁকা! দেবু ভাবার চেষ্টা করে … ওদের ছেলেদের আড্ডায় অনেকেই বলে বিয়ে করা বউকে ‘কন্ট্রোলে’ রাখতে হয় ,নাহলে মাথায় উঠে যাবে। আহা কন্ট্রোলের কি ছিরি ! ওর বোন মিনুরও একদিন বিয়ে হবে , ওকেও ওর বর যদি মারে ! ছ্যাঁকা দেয়!… দেবুর হাতপা শক্ত হয়ে ওঠে , জানে মেরে দেবে শালাকে …হোক বোন বিধবা!
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটাই চলে এসেছে দেবু। ব্রীজে ওঠবার ঢালটায় ঘুপচি গুমটি গুলোর সামনে দাঁড়ায় । এই আধো অন্ধকার গুমটিগুলোয় রয়েছে এক আশ্চর্য্ জগত। মোমবাতির আলোয়, কিংবা চার্জার ব্যাটারির আলোয় একটা ছোট্ট টেবলে রয়েছে শুধু একটা খাতা আর পেন , গুমটিতে কেউ নেই । নেই অথচ আছে কাছে পিঠেই, মাঝে মাঝে একদুজন করে আসছে খাতায় কিছু লিখছে তারপর চলে যাচ্ছে। দেবু জানে ওটা সাট্টার কাউন্টার। এরকম একটাই, পাশের আর একটা গুমটিতে রয়েছে ছোটো ছোটো টিকিটের বান্ডিল সাজানো ,ওটা বারোসেম লটারী কাউণ্টার ,ওটায় বেশ ভিড় লেগে থাকে মাঝে মাঝে বিশেষ করে সন্ধ্যার সময়। সবাই একটা বোর্ডে আটকানো সেদিনের রেজাল্ট দেখে হুমড়ি খেয়ে …প্রতিদিন এরা বেশ কিছু টাকার টিকিট কেনে , মাঝে মধ্যে কেউ কেউ পায় টাকা। সেদিন সে দ্বিগুন উৎসাহে প্রাইজের অর্ধেকের বেশী টাকার টিকিট কেনে, আরও কিছু টাকায় গলা ভেজায়। ঢালের একটু নিচের দিকে আরও একটা গুমটি আছে, সেটা এমনিতে নিরীহ বিড়ি–সিগারেটের, কিন্তু চেনামুখ দেখলে, বা গলা নামিয়ে বিশেষ চাহিদার কথা বললে পিছনের ঝোপে রাখা বড় চায়ের পেটির ভেতর থেকে এনে দেবে চোলাইয়ের ‘পাউচ’, আর একটু দূরে পরিতক্ত্য টোল অফিসে আলো জ্বলছে। একটা ট্রাকটার ট্রলিসহ এসে দাঁড়িয়েছে, টোল অফিস থেকে একজন বেড়িয়ে হাত বাড়ালো ট্রাকটরের ড্রাইভার কিছু দিলো তার হাতে। দেবু জানে ট্রলি নিয়ে যেতে পয়াসা দেওয়া দস্তুর। নাঃ এ পয়সা সরকারের খাতায় জমা পড়েনা। তেলিপুকুরের দিকথেকে আসা একটা বাসের তীব্র হর্নে দেবুর চিন্তার তার ছিঁড়ে যায় ,ও সতর্ক হয় বাসে ওঠার প্রস্তুতি নেয়।

‘তোর কলেজের কি খবর?” বারান্দায় পেপার নিয়ে বসে থাকা বাবা পেপার থেকে মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করে দেবুকে।
“ ঠিক আছে, চলছে…”
“ চলছে ! …ঠিক কি করে বললি! এই তো গত সপ্তাহেই তো ঝামেলা হয়েছে খবর পেলাম! ”
“হুঁ … সে টুক টাক তো লেগেই আছে…”
“ওতে একদম জড়াবি না … দিনকাল খারাপ …ফালতু ফেঁসে যাবি”
দেবু কোনো উত্তর দেয়না। বাবাও জানে ওসবে ও থাকে না , আর দিনকাল আর কবে ভালো ছিলো বাবাদের কাছে! বাবাকেও দাদু বোধহয় একই কথা বলতেন!
“তা মিনুকে সন্ধ্যাবেলা একটু আধটু পড়া-টড়া দেখিয়ে দিতে পারিস তো ! ওরও ভালো হয় ,তোরও প্র্যাকটিস হবে …”
“…হবে না”
“কেন হবে না? আর্শ্চয!” বাবা এবার পেপার থেকে মুখ তুলে কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে তাকায় দেবুর দিকে।
“মিনু আমার কাছে পড়বে! তাহলেই হয়েছে …প্রতি পাঁচ মিনিটে উঠবে, কিছু বললেই মাকে নালিশ করবে”
“ তোরও ধৈর্য কম … শুধু ওর জন্য নয়, তোরও দরকার। গ্র্যাজুয়েশানের পর চাকরির পরীক্ষাগুলো বসতে গেলে তোরও কিছু প্রিপারেসান দরকার …”
“ এভাবে হবেনা , কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে হবে , কথা বলে এসছি …”
“ কোচিং সেন্টার ! চাকরির পরীক্ষার জন্য? তাজ্জ্বব ! আমরা তো টিউশানি পড়াতাম, তাতেই প্রিপারেসান হত !”
দেবু জানতো এটাই বলবে বাবা। কি করে বোঝাবে তখনকার চাকরির পরীক্ষা আর এখনকার পরীক্ষায় অনেক তফাত। বাবা জানেনা এমন নয় ,তবু বলবেই এরকম কথা। ওদের প্রজন্ম যে কত অযোগ্য সেটা বোঝাতে একটুও সুযোগ ছাড়ে না এরা! কি জানি দেবুর তো তাই মনে হয় …
“ তা কত খরচাপাতি বলেছে কিছু? …গ্যারান্টি দেবে! ”

এবার দেবু সরাসরি বাবার দিকে তাকায়। চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দেয়…
“কম করে ৩০ হাজার”
“কি! যত্তসব …বেকারির বাজারে খালি পয়সা লুটবার তাল সব! আর গ্যারান্টি!…”
“এসবের আবার গ্যারান্টি হয় নাকি! ”
“সেই তো! তা আর কটা টাকা ঘুষ দিলে তো এমনিতেই চাকরি…”
দেবু হেসে ফেলে এবার। বাবার চাকরির বাজার সম্পর্কে কোনো আইডিয়াই নেই…এইতো জেলা পরিষদের গ্রাম সেবক পোস্টের জন্য এবার আড়াই রেট উঠেছে। রেল, প্রাইমারির তো কোনো বাপ মা নেই ! তিন চাইলে লোকে চার সাড়ে চার দিয়ে দিচ্ছে! …
মিনু এসে পড়ায় ওদের বাপ-ছেলের আলোচনায় ভাটা পড়ে। মিনু বেশ মাথাচাড়া দিয়েছে। এখনই দেবুর কাঁধে পড়ে। একটু মোটার দিকে বলে দেবু ওকে ‘ঢিপসি’ বলে, মিনুও রেগে যথেচ্ছ কিল চড় লাগায় ওর পিঠে। বড্ড বাপ আদুরে মেয়েটা, এই বয়েসে যেমন হয় মেয়েরা আর কি। ওর স্নিগ্ধ ঢলঢলে মুখটার দিকে তাকালে দেবুর মাঝে মাঝে ভিতরটা কেমন করে। এই মেয়েটাও একদিন আরও বড় হবে, বর্ধমানে পড়তে যাবে …অনেক দুর পড়বে। মিনু পড়শুনায় ভালোই, ওকে নিশ্চয়ই বাবা পড়াবে! না পড়াতে চাইলে দেবু পড়াবে … এসব দাদাসুলভ চিন্তা দেবুকে ঘিরে ধরে মাঝেসাঝেই। কিন্তু তার আগে ওকে একটা কিছু করতে হবে! অস্থির হয়ে ওঠে দেবু। এই অস্থিরতাই ওকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় রোজ। দেবু উঠে পড়ে বারান্দা থেকে, ওকে এবার একটু সিগারেট খেতেই হবে …সোজা সিঁড়ি দিয়ে ওদের একতলা বাড়ির ছাদে উঠে যায়।
মাথার উপর উন্মুক্ত আকাশ। মেঘহীন রাতের আকাশে অজস্র তারা দেবুর মাথার উপর চাঁদোয়ার মতো ছাউনি দিয়ে আছে। এলোমেলো বাতাসে দেবুর মনটা হালকা হয়ে আসে। হঠাৎ ওর মনে পড়ে ও অনেকক্ষন ধরে পেচ্ছাপ চেপে রয়েছে। নাঃ এখন নিচে নামতে ওর ভালো লাগছে না। মা রাতের খাওয়ার জন্য একটু পরেই ডাকবে, তখন একেবারে নামবে। অন্ধকার ছাদের একটা নির্দিষ্ট কোনের দিকে এগিয়ে যায় ও। রাত বিরেতে ছাদে এলে প্রয়োজনে ওই দিকটাতেই ও কাজ সারে, ওদিকে একটা রেনওয়াটার পাইপ রয়েছে। হাল্কা হতে হতে আড় চোখে ছাদের কোমর পাঁচিল পেরিয়ে নিচে তাকায়, পাশের বাড়ির জানালা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। দেবু জানে ওটাই হারুদা আর বাসবী বৌদির শোবার ঘর। টিউব জ্বলছে। একটা ঘটিহাতা নাইটি পড়ে বাসবী বৌদি বিছানা ঝাড়ছে, ওদের একমাত্র সন্তান টুবাই মেঝেতে বসে কিছু একটা ঘসছে। হারুদা একবার ঘরে ঢুকে আবার বেরিয়ে গেলো। এবার ওরা শুয়ে পড়বে, ওরা দেবুদের থেকে তাড়াতড়ি শোয়। দেবু জানে একটু পরেই খালি গায়ে হারুদা একটা বারমুডা পরে এসে বসবে বিছানায়। বাসবী বৌদি কিছুক্ষন ড্রেসিং টেবলের সামনে কি সব মাখবে। তারপর বিছানায় মশারি ফেলবে, চারধার গুঁজবে। তারপর আলো নিভিয়ে দিয়ে একটা নীল রাত-আলো জ্বালিয়ে দেবে।
ওদের এই নিত্য যাপনের চিত্র দেবুর মুখস্থ, তবু অপার কৌতুহলে মাঝে মাঝেই ও এখানে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে, ঐ নীল আলোটা না জ্বলা অবধি। নীল আলোয় ঘটে চলা বা না ঘটে চলা বাদ বাকি ঘটনাক্রম ও কল্পনা করে রোমাঞ্চিত হতে থাকে–নেশাগ্রস্থের মতো।

লেখা পাঠাতে পারেন

 

আগের পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকটিতে

ই ন্দ্র নী ল ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস চোরাবালি(প্রথমপর্ব)

 

 

 

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *