ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস “চোরাবালি”(পর্ব-৭)

পরিচিতিঃ ইন্দ্রনীল বক্সী,জন্ম – নকশাল পিরিয়ডে ..৭৩ এ দুর্গাপুরে , উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ মাজা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল টাইপ। লিখছি সেই কিশোরবেলা থেকে, দুর্গাপুর বেলা থেকে বর্তমান নিবাস – বর্ধমান। কি লিখছি ছাই নিজে তো জানিই না অন্যরাও জানে বলে মনে হয় না। হাবিজাবি করে চারটি বই প্রকাশিত।” বাইফোকালিজম্-এ তাঁর আজ ধারাবাহিক উপন্যাস ‘চোরাবালি‘-র সপ্তম পর্ব

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সীর ধারাবাহিক উপন্যাস

চোরাবালি(পর্ব-৭)

সাড়ে সাতটা –আটটা নাগাদ মাস্টারের দোকানে হাজির হয়ে গেল দেবু আর রজত। এমন নয় যে জীবনে প্রথমবার দেবু একা বাড়ির বাইরে রাত কাটাচ্ছে, তবে এরকম উপলক্ষ্য এই প্রথম। একটু ভিতরে ভিতরে নার্ভাস রয়েছে দেবু, রজতের এসব জলভাত, ও সপ্তাহে অন্তত দুবার গলা ভেজায় এবং প্রতিদিনই বেশ রাতে বাড়ি ফেরে। কৈফিয়ত দেওয়ার তেমন রেওয়াজ ওদের বাড়িতে নেই। এমনও অনেকদিন গেছে , রজত বাড়ি ফেরার পর বাবা ফিরেছে, মা কিছুই বলেন না বা বলা ছেড়ে দিয়েছে বলা যায়।

“মাস্টার ওও মাস্টার…” একটু আওয়াজ দিয়ে যাওয়াই ভালো ভেবে নিয়ে রজত হাঁক পারে। দোকানের সামনের ঝাঁপ ফেলা, ওদের ‘প্রোগ্রাম’ দোকানের পিছনে মাস্টারের একাফালি আস্তানায়।
“এই যে … এদিকে চলে এসো গো …” ফালি ঘরের ভেতর থেকে মাস্টারের গলা ভেসে আসে। দেবু আর রজত গিয়ে দাঁড়ায় মাস্টারের ঘরের নিচু দরজার সামনে।
“আরে ওয়াহ! বেশ গন্ধ ছাড়িয়েছো তো মাস্টার… ”
“তা না হলে চলবে! … মাস্টার যে শুধুই কাপড়ে কাঁচি চালাতেই জানে না সেটা বুঝবে কি করে … তার ওপর আজ নতুন গেস্ট রয়েছে … আমাদের দেবু বাবু …হা হা হা …”
এল পি জি স্টোভের উপর কড়াইয়ের সামনে বসে এক হাতে কাপড় দিয়ে কড়াই ধরে অন্যহাতে হাতা দিয়ে কড়াইয়ে ভিতরে মশলা তেলে মাখামাখি মুরগীর পিস গুলো কষতে কষতে মাস্টার বলে ওঠে। তেলের ঝাঁজসহ ধোঁয়ায় ছোট্ট ঘরটা ভরে গেছে, উনুনটা ঘরের একমাত্র ছোট্ট জানালার সামনেই রাখা হলেও তা ধোঁয়া বেরোনোর জন্য যথেষ্ট নয়। কিছুটা ধোঁয়া ছড়িয়ে বেরিয়ে আসছে দরজার দিকেও। দেবু ঝাঁজে খক খক করে একচোট কেশে উঠলো।
-“দেবু –রজত এক কাজ করো ওই মোড়াদুটো নিয়ে তোমরা বরং বাইরে বসো, এখানে ঝাঁজে বসতে পারবে না, আমি কষে নিয়ে চাপা দিয়ে যাচ্ছি একটু পরে।”
দেবু আর রজত বাইরে বসলো মোড়া নিয়ে। রান্নার সুন্দর গন্ধ ছড়িয়েছে বেশ এলাকাটাতে। দোকানের পিছনে কিছু ঝোপঝাড়, একটু দূরে একটা বড় ডোবা রয়েছে। আরামবাগ রোডটা এখান থেকে দেখাই যায় না প্রায়, অথচ দোকানের ওপাশেই রয়েছে। মাস্টারের দোকানের ছাই আর চারকোল ফেলে ফেলে একটা ছোটখাটো ঢিবি মতো তৈরী হয়েছে দোকানের পিছনে।

একটু পরেই মাস্টার বেরিয়ে আসে। ওদের দিকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দেয়।
-“সেকি গুরু! …আজ তোমার ব্রাণ্ডের খাঁকি নেই!” রজত বেশ রগুড়ে গলায় বলে ওঠে
-“না আজ স্পেসাল দিন আজ তাই সাদা …” সিগারেট ধরাতে লাইটার জ্বেলে বলে ওঠে মাস্টার। মাস্টার একটা বস্তা পেতে বসে পড়ে ওদের পাশেই।
– “আর একজন গেস্ট কই ? তার পাত্তা নেই যে!” এতক্ষনে দেবু কথা বলে ওঠে।
-“কে! খোকন? …আসবে আসবে …সে মাল ঠিক আসবে সময় মতো, দাঁড়াও একবার ব্যাটাকে একটা মিস-কল মেরে দি …কি বলো! বুঝবে বাকি মেম্বরারা হাজির. ..”

মাস্টার ঘরের ভিতর ঢুকে যায় ফোন আনতে। মাস্টারের হাতে রজত একটা বড় প্যাকেট ধরিয়ে দেয় যেটা এতক্ষন ও ধরে বসে ছিলো। আসার সময় ধাবা থেকে গোটা কুড়ি রুমালি আর বড় এক প্যাকেট চিপস নিয়ে এসছে ও আর দেবু। মাস্টার একটু কপট রাগ দেখায়
-“এসব পাকামি করতে গেলে কেন রজতবাবু? আমার বাসায় প্রোগ্রাম , সব ব্যবস্থা আমার …”
-“আরে সেতো বটেই …ও কিছু না মাস্টার , আসার সময়ে চোখ গেলো ধাবার লোকটা রুমালি ছুঁড়ছে …তাই …ও তুমি চাপ নিও না …” রজত মাস্টারের হাত চেপে বলে ওঠে।

রাত খুব হয়েছে এমন নয়। কিন্তু আরামবাগ রোডের শেষ বাস চলে যাওয়ার পর রাস্তা বেশ শুনশান হয়ে আসে। এবার মাঝে মধ্যে শুধু ট্রাক আর ট্রলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আর মাঝে মধ্যে তীব্র গতিতে চলে যাওয়া বাইকের আওয়াজ। একটা বাইকের আওয়াজ এসে দোকানের সামনে থামলো মনে হলো , আবার চলেও গেল!
হাতে একটা ঝোলা নিয়ে চার নম্বর মেম্বার খোকন এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে হাসতে হাসতে …-কি? দেরী করে ফেলিনি তো! আরে একটু রাত না হলে জমে! … এই নাও মাস্টার …” বলেই ঝোলার ভেতর থেকে একটা বেশ বড় সোনালী তরল ভর্তি বোতল বের করে মাস্টারের হাতে ধরায়।
– “নাঃ একদম ঠিক টাইমিং … আরে এটা লিটার মনে হচ্ছে !”
– “বলেছিলাম জলের দায়ীত্ব আমার , লিটার আনলাম …হয়ে যাবে তো? …নাহলে কোই বাত নেহি, কাছেই শিবকালী ধাবা…” বলেই হলুদ দাঁতগুলো বের করে হেসে ওঠে খোকন। দেবু ,রজত দুজনাই বোতলটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে আবার মাস্টারের হাতে ধরিয়ে দেয়।
– “আবার কি ! চল শুরু করে দি, দু রাউণ্ড মেরে তারপর ডিনার …” বলে ওঠে রজত

রাত কিছুটা গড়িয়েছে। রঙিন তরলের প্রভাবে চারজনেই অল্প বিস্তর প্রগলভ। তিনজনের মধ্যে ট্রাক ড্রাইভার খোকন চুপ করে রয়েছে, চোখ ছোট করে মিটিমিটি হাসছে আর বাকিদের সংলাপ শুনছে আর মৃদু মাথা নাড়ছে। সবথেকে বেশী কথা বলে চলেছে মাস্টার , ওর জীবনের দুঃখের কথা, কচি ছেলে রেখে বউয়ের অকালে মরে যাওয়ার কথা…
এ ক বছরে শুকিয়ে গেলাম বুঝলে ভায়েরা …একদম ড্রাই  …সারাদিন কাঁচি চালাই, ইস্ত্রি ঠেলি শুধু ছেলেটার কথা মনে করে। ওকে একটা বড় কিছু বানাতেই হবে … ছেলেটার মাথাটা বড় ভাল জানো …”
“ও ঠিক হয়ে যাবে মাস্টার …চিন্তা কোরোনা … তোমার ছেলে ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে…” প্রয়োজনের থেকে একটু জোরেই বলে ওঠে রজত।
“হুম …বড় হতেই হবে… অনেক বড় …প্রচুর মাল কামাতে হবে, নাহলে লাইফ শালা নুন ছাড়া রান্নার মতো …” দেবু আস্তে আস্তে বলে ওঠে।
“সে আর বলতে … পকেট ভারী তো দুনিয়া হাতের মুঠোয় …” রজত সঙ্গত দেয় …
“কিন্তু একথাটা আমার বাপটা বুঝলে তো! … নিজে ছাপোষা মাস্টার …আমাকেও সেরকমই দেখতে চায় … আমার চলবে না …আমার চলবে না…” হঠাৎ একটু যেন ফোঁস ফোঁস করতে থাকে দেবু , নাকের পাটা ফুলতে থাকে…
“এই …এই দেবু …তুই একটু হাল্কা নে …ঝিম খাচ্ছিস … ” রজত দেবুর পিঠে হাত রাখে।
“ধুর শালা …জানিস শালা রোজ সকালে ওই একই খ্যাটন খেয়ে আমায় বেরোতে হয় … মাসে একদিন মাংস হয় কিনা সন্দেহ । এই এই … কমা মোবাইলটাও নিজের পয়সা জমিয়ে কেনা ! …”
“হয়ে যাবে …হয়ে যাবে দেবুবাবু …অধৈর্য হয়েও না …” মাস্টার বলে ওঠে ।
“বাল হবে … কিস্যু হবে না … গ্র্যাজুয়েট হয়ে কি ছিঁড়বো ! …চাকরি করতেও মাল লাগে …পাঁচ লাখ…ছয় লাখ…বুঝলে মাস্টারদা… ”

“এই চলো এবার খেয়ে নি …নইলে এরপর আর খাওয়া যাবে না …” এতক্ষনে খোকন কথা বলে ওঠে।

“হ্যাঁ …সেই ভালো, রাত গড়িয়েছে …আমি রেডি করছি” একথা বলে মাস্টার কিঞ্চিৎ এলোমেলো পা ফেলে ওর ঘুপচি ঘরের মধ্যে উঠে গেল।

মুরগীর মাখা মাখা ঝোল আর রুমালি রুটি, কাঁচা পিঁয়াজ নিয়ে ওরা চারজন বসে পড়ল খেতে। মাস্টার রান্নাটা মন্দ করে করেনি। সবাই একযোগে মাস্টারের রান্নার প্রশংসা করতে লাগল।
-“বউ মরে এই একটা জিনিস তোমার খুব কাজে লেগেছে মাস্টার… রান্নার হাত খুলে গেছে …হা হা হা” খোকন বলে ওঠে মস্করার ঢঙে।
-“হ্যাঁ তা যা বলেছো… হাত পুড়িয়ে রেঁধে রেঁধে পাকা রাধুনি হয়ে গেছি একেবারে… একটা ক্যাটারার খুললে কেমন হয় ওস্তাদ! হা হা হা …” মাস্টার সঙ্গত দেয়।
দেবু চুপচাপ খেয়ে চলেছে। বেশ ঝাল হয়েছে ওর পক্ষে, দু গ্লাস জল ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলে…
-“কি রে ! ঝাল লাগছে ?…তুই একেবারে বাবিন রয়ে গেলি …এবার একটু ঝাল খেতে শেখো চাঁদু…” রজত ফোড়ন কাটে।
নানাবিধ মস্করা করতে করতে একসময় ওদের খাওয়া শেষ হলো। রজত দামী সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে ধরলো সবার সামনে। চারজনেই আবার বাইরে একটা মাদুর পেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলো। আরামবাগ রোড এখন নিস্তব্ধ। খোলা আকাশের দিকে অকারণ তাকিয়ে ছিল দেবু, এক টুকরো মেঘ মাঝে মাঝে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে, আবার চাঁদ বেরিয়ে পড়ছে। মাস্টারের ঘরের একফালি আলো লম্বা হয়ে পড়েছে বাইরে ঠিক যেখানে ওরা বসে রয়েছে। বাড়ির চিন্তা মাথায় আসছে এবার দেবুর। বরযাত্রী বলে আসলেও মা অনেক প্রশ্ন করেছে যাচাই করার জন্য, তবে শেষ পর্যন্ত রাজী করিয়েছে বাবাকে। নিজের ছেলের উপর মায়ের যে অনেক ভরসা… দেবু আপন মনে হেসে ফেলে।

“তা দেবু বাবুর কি প্রোগ্রাম!…কলেজ পাশ করে কি করবে?” সিগারেটে একটা ছোট্ট টান দিয়ে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে ধীর কন্ঠে বলে ওঠে খোকন।
“কে জানে … চাকরি ফাকরি চেষ্টা ছাড়া আর কি … পাবোনা জানি …”
“পয়সা উড়ছে … শুধু ধরতে শিখতে হবে …তবে তোমরা গিয়ে হলে ভদ্দরলোকের ছেলে …”
“ওসব ভদ্দরলোক মারিয়ে কি হবে শালা…! …পকেটে মাল না থাকলে কেউ পোঁদেও পুছবে না খোকনদা …”
খোকন চুপ করে থাকে। রজত ওদিকে বোতলের তলানি থেকে সবার গ্লাসে একপ্রস্থ রঙীন তরল ঢেলে দেয়।
“এটা ঠিক বলেছিস দেবু …সবই মালের জোরে , এত্থির জোরে … ওর কাছে সবাই কুত্তার মতো লেজ নাড়ে, আক্কা দুনিয়া …” ঢালতে ঢলতেই বলে ওঠে রজত। রজতের হাতের সোনার ব্রেসলেটটা এই আধো অন্ধকারেও চিকচিক করে ওঠে, কে জানে ক ভরির!
একসময় সবারই গ্লাস খালি হয়ে যায়। রাত কটা কেউ খেয়াল রাখেনা, নেশা করতে বসলে এসব সময়ের হিসেব রাখতে নেই। সেই জন্যই বোধহয় বারে ঘড়ি থাকে না! দেবুর মাত্রা একটু বেশী হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। চারজনের মধ্যে দেবুই একমাত্র অভ্যস্ত মদ্যপায়ী নয়। একটা অসোয়াস্তি ঘুরপাক খাচ্ছে বুকের কাছে, কি যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠতে চাইছে…
আচমকা দেবু লাফিয়ে উঠে টলমল পায়ে কাছের ঝোপের দিকে এগিয়ে যায় …পেট বুক মোচড় দিয়ে হড়হড় করে বমি করতে থাকে … মাস্টারের সম্ভবত চোখ একটু লেগেই গেছিল, বমির বিকট শব্দ শুনে লাফিয়ে উঠে বসে।
“আরে দেবু! কি হলো … এই রে! হ্যাবিট নেই তো … একটু বেশীই নিয়ে নিয়েছে…দাঁড়াও” জলের বোটল টা নিয়ে দ্রুত দেবুর কাছে চলে যায় মাস্টার
“মুখে চোখে দাও …কুলকুচি করো … কোই বাত নেহি … চাপ নিও না …মাল খেয়েছে অথচ উগড়ায়নি এমন কেউ নেই…”
দেবুর ভিষন লজ্জা লাগতে লাগে। শরীরের অসোয়াস্তিটা একটু কমেছে, সেটাকে ছাপিয়ে ওর নিজেকে ভিষণ অর্বাচীন মনে হতে থাকে …ইস …সবাই সমান খেলো ,অথচ শুধু ওই !…

মাস্টার দেবুকে নিয়ে গিয়ে জোর করে ঘরে শুইয়ে দিয়ে মাথার কাছে টেবল পাখাটা চালিয়ে দিল, সকালে ঠিক সময়ে ডেকে দেবে জানিয়ে দেবুকে নিশ্চিন্তে একটু শুতে বললো।
দেবু একটা ঘোরের মধ্যে শুয়ে থাকলো, শরীরটা ঠান্ডা হয়ে আসছে। অসোয়াস্তিটা অনেক কম। দেবু চোখ বুজলো, হিজিবিজি ভেসে উঠতে লাগল অন্ধকারে, তারপর অন্ধকার ঠেলে একটা মুখ ভেসে উঠল …নন্দিতার!

ঘুম ভেঙে উঠতেই চোখটা কড়কড় করে উঠল দেবুর। নিজেকে মাস্টারের আস্তানায় খুঁজে পেয়ে কয়েক মুহুর্ত সময় নিল গতরাতের ঘটনাবলী মনে করতে। ইস! একেবারে বেহুঁস হয়ে ঘুমিয়েছে কয়েকঘন্টা! এখন কটা বাজে মনে পড়তেই মোবাইলতা হাতড়ালো দেবু পকেটে। দুটো মিসড কল ! বাড়িথেকে …সাড়ে ছটা বাজে। এখনি ফোন করা দরকার, ফোন না ধরায় মা কি ভাববে কে জানে! বেকার টেনশান করবে।

“হ্যাঁ …হ্যালো …কে মা! …হ্যাঁ আরে সবাই এতো জোরে কথা বলছিলো, এদিকে ফোনটাও ছাই কখন পকেটে চাপ পড়ে সাইলেন্ট হয়ে গেছিলো… আমরা ফিরছি…বাবা বেরিয়েছ?…” কোনরকমে মা কে ম্যনেজ করে দেবু। ঠিক এই সময়ে মাস্টার এসে ঢোকে ঘরে।
“কি! দেবু বাবু …উঠে পড়েছ দেখছি নিজেই …আমি ভাবলাম একেবারে চা করে এনে ডাকব। এই নাও …” একটা স্টিলে গেলাসে চা বাড়িয়ে দেয় মাস্টার।
“হ্যাঁ … বেশ বেলা হয়ে গেছে …চা খেয়েই বেড়িয়ে যাবো” হাতের গ্লাসটা রেখে ঘরের কোণে রাখা জলের বোতলটা নিয়ে বাইরে গিয়ে ভালো করে মুখে চোখে জল দেয় দেবু। ঘরে ঢুকে দেওয়ালে টাঙানো ছোট্ট আয়নায় নিজেকে দেখে। চোখের কোলগুলো একটু ফুলে ঊঠেছে, মুখটাও ভারি লাগছে। চায়ে চুমুক দেয় দেবু…
“মাস্টার কাল দারুন প্রোগ্রাম হল কি বল?…শুধু আমি একটু কেঁচিয়ে দিলাম… রজত ,খোকনদা কখন গেল? ”
“আরে না না ওসব কোনো ব্যাপার নয় …। হতেই পারে …তুমি কি এখানে প্রথম লোক নাকি যে উগরালো! …অনেকেই করেছে …ছাড়তো …রজত আর খোকন জেগেই ছিলো, ভোর ভোর চলে গেছে”
“আমাকে ডাকলে না কেন ? আমিও চলে যেতাম!”
“তুমি অঘোরে ঘুমচ্ছিলে …তাছাড়া ফ্রেস হয়ে বাড়ি যাবে এটাই ভালো হল…”
“ নাঃ… মাস্টার এবার উঠি…” দেবু ঊঠে পড়ে জামা –প্যান্ট ঠিক করে চুলটা আঁচরে নেয়। চোখগুলো এখনও একটু লাল হয়ে রয়েছে…
“ঠিক আছে …তুমি রওনা হও … আমিও একটু পরে ঝাঁপ তুলবো, সাবধানে যেও, বাড়িতে ম্যানেজ করে নিতে পারবে তো!” দেবু নিঃশব্দে হেসে মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসে মাস্টারের আস্তানা থেকে। বাইরে এখন রোদ উঠে গেছে বেশ, সকালের রোদ ঝাঁপিয়ে এসে পড়ে দেবুর মুখে, দেবুর মাথাটা টনটন করে ওঠে। একটু সময় নেয় ভালো করে তাকাতে। আরামবাগের দিকের যেকোন একটা বাস ধরলেই হবে। দেবু বেরিয়ে এসে নামে রাস্তায়।

বাড়ির কাছাকাছি এসে দেবুর কাল রাতের কথাবার্তা, দৃশ্য রিপ্লে হতে থাকে মাথার ভিতর। সারারাত কিসব উদ্ভট স্বপ্নই না দেখেছে ও! সবটা মনেও করতে পারে না। শুধু বার বার বমির ব্যাপারটা মনে পড়তেই নিজের কাছেই নিজেকে লজ্জায় পড়তে হচ্ছিল ওকে। মোড়ের মাথায় নেমে হাঁটা লাগায়। একটু হাঁটার পরেই পিছন থেকে বাইকের হর্ন শুনতে পায়, ..রজত!…
“নাও চাঁদু উঠে পড়ো… তোর বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম, তুই ফিরেছিস কিনা দেখার জন্য, যা খেল দেখালি! একটু চাপ ছিল…”
“ আমার বাড়ি তুই গেলে আমি ফিরিনি কেন তার কৈফিয়ত দিতে হতো! তখন কি করতিস!” বাইকের পিছনে চাপতে চাপতে বলে ওঠে দেবু।
“খেপেছিস! …সামনে দিয়ে একটা জাস্ট রাউন্ড মেরে পালাতাম …”
দেবুর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই ওরা দেখল মণি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দিকে তাকিয়েই …
“এই যে …তোমার ভালো দাদাকে দিয়ে গেলাম …কাকিমা কে বলে দিও …” রজত হাসতে হাসতে বলে বাইক ঘুড়িয়ে চলে গেল।
গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে দেবু খেয়াল করল মণি এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছে চুপ করে। দেবু পাত্তা দিল না, সোজা ঘরে ঢুকে গেল …
“মা… মা … এক কাপ চা দাও” আর এক কাপ চা জরুরী নইলে মাথাতা ছাড়বে না …মা কোথায় আছে দেখতে পাচ্ছে না দেবু, আছে এদিক ওদিক। বেশ জোরে বলায় ঠিক শুনতে পাবে, ও যে ফিরেছে এটাও বোঝানো দরকার।
-“কার বিয়ে ছিলো যেন!” মণি কখন এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। দেবু চমকে পিছনে ঘুরে তাকায়।
– “সৌমেনের দাদার …কেন? এখন তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি! …ভাগ এখান থেকে বেশি পাকামি করিস না…”
-“আহা! জিজ্ঞেস করলাম তো অত মেজাজ দেখাচ্ছিস কেন? জিজ্ঞেস করতে পারিনা বুঝি!”- “জেনে কি করবি?… বললাম তো …তুই চিনিস? যা মা কোথায় আছে বল এক কাপ চা দিতে… যা বাওয়াল হয়েছে সারারাত, এসে আবার একজনের দিদিমণিগিরি…”
মণি ঠোঁট বেঁকিয়ে ভেঙচি কেটে চলে গেল ঘরের দরজা থেকে। দেবু জানে মণি নির্ঘাত কিছু একটা সন্দেহ করেছে! দিন দিন ওকে সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে , ভিষণ সেয়ানা… !

মানুষের কোনটা আগে চোখে পড়ে? শিক্ষা, সততার প্রচ্ছন্ন অহংকার, ‘আমি লোভী নই, আমি অল্পে সন্তষ্ট’ এই মনোভাবের ঝোলানো সাইনবোর্ড! নাকি পাঁচ ভরির ব্রেসলেট ঠিকড়ানো বৈভবের প্রদর্শন! সত্যিই কি কেউ অল্পে সন্তুষ্ট হয়! নাকি এসবই অক্ষমতা ঢেকে রাখার অজুহাত! প্রচুর অর্থ উপার্জন কেন খারাপ কাজ হবে? কেনই বা নিম্নমধ্যবিত্ততা গর্ব করার বিষয় হতে যাবে!… অন্তত ওর বাবার কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, ছাপোষা থাকা রীতিমতো গর্বের ব্যাপার। তাছাড়া প্রতিটা মানুষই তো আলাদা আলাদা!… বাবা যেরকম দেবুও সেরকমই হবে এমনটা হবেই বা কেন! দুপুরের ভাত খেয়ে নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে হিজিবিজি চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে দেবুর। জানালা দিয়ে মৃদুমন্দ হাওয়া আসছে ,দেবুর চোখ ঘুম ভেঙে আসে ক্রমে।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *