যু গা ন্ত র   মি ত্র-র ছোটগল্প “মৃত্যুপরবর্তী সংবাদ”

 পরিচিতিঃ দীর্ঘদিন ধরে জেলা ও জেলার বাইরের বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখালিখি। থাকেন নদীয়া জেলার কাটাগঞ্জের গোকুলপুরে। গদ্য নিয়েই তাঁর উড়ান। আজ বাইফোকালিজম্-র পাতায় তাই রইল তাঁরই একটি ছোটগল্প।

 

যু গা ন্ত র   মি ত্র-র ছোটগল্প

 

মৃত্যুপরবর্তী সংবাদ

লাশ বৃত্তান্ত ও মৃত্যুপরবর্তী চর্চা

মাত্রই ত্রিশ-বত্রিশ ঘণ্টা আগে শ্যামদীপ্ত রায় সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েছিলেন। সাদা পায়জামা আর আকাশনীল হাফ-হাতা পাঞ্জাবি পরা দেহটা ঝুলছিল। মাঝে মাঝে হালকা হাওয়ায় দুলে উঠছিল লাশটা। তাঁর দু’চোখ ছিল অনেকটা ক্যালেন্ডারের শিবের ছবির মতো অল্প ফাঁক করা। সেই আধখোলা চোখ দিয়ে যেন তিনি তাঁর আশেপাশের অবস্থা ও অবস্থান দেখে নিচ্ছিলেন। সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকেছিল শ্যামের দু’পায়ের পাতা, যেন আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন শেষবারের মতো কোনও অবলম্বন ছোঁয়ার। যদিও না-ছুঁতে পারার ব্যর্থতা তাঁর চোখেমুখে ফুটে ওঠেনি।
মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই বহু মানুষ দেখতে এসেছিল। শ্যামদীপ্ত কেন আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটাই বেশি করে ভাবাচ্ছিল উপস্থিত লোকজনকে। শুধু এটুকুতেই থেমে থাকেনি তারা, কার কার সঙ্গে সম্প্রতি শ্যামের দেখা হয়েছে, কাদের পরিচিতজন, কবে, কীভাবে ঝুলে পড়েছিল, তাদের কী কী মানসিক বা শারীরিক সমস্যা ছিল, তাও আলোচনায় উঠে এসেছিল। কেউ কেউ এসব শুনে চুকচুক করে মুখে শব্দ করেছে। এমনকি ঝুলন্ত লোকটার পরিবার-পরিজনের কী কী করা উচিত, পুলিশ এসে ঠিক কী কী করবে, তাও ছিল আলোচ্য বিষয়।
পুলিশ এসে লাশটা দড়ি কেটে নামানোর আগে কয়েকশো লোক দেখে গেছে। তারা যে সবাই শ্যামের পাড়াপ্রতিবেশী তা নয়, অচেনা লোকও সেখানে ছিল। আর তাঁর লাশ নামানোর পরে দেখে গেছে আরও বেশকিছু জন। স্বাভাবিকভাবেই তারাও কেউ পরিচিত, কেউ-বা অপরিচিত। যতক্ষণ তাঁর লাশটা উঠোনে শোয়ানো ছিল, বিছানার চাদর দিয়ে ঢাকার আগে যেমন অনেক লোক দেখেছে, আবার ঢেকে দেওয়ার পরেও কম লোক দেখেনি। মর্গে কাটাছেঁড়ার পর সাদা কাপড়ে মুড়ে আবার তাঁর নিজস্ব আস্তানায় আনা হয়েছিল তাঁকে, যা এতদিন তাঁর নিজের বাড়ি ছিল বলে তিনি নিজেও মনে করতেন, এবং আপাতত তাঁর আর বাড়ি নয় তা, কেননা মৃত মানুষের এই বিশ্বচরাচরে নিজের বলে কিছুই থাকে না; সেই আস্তানায় আনার পরও শয়ে শয়ে মানুষ এসে তাঁর মৃতদেহ দেখে গেছে।
শ্যামদীপ্ত রায় ছিলেন একজন জনপ্রিয় শিক্ষক। স্কুলে যেমন তাঁর নাম ছিল ভালো শিক্ষক হিসাবে, বাড়িতেও প্রাইভেট টিউশনে তাঁর নাম ছিল বিস্তর। (তার একটি কারণ যদি হয় খুব ভালো অঙ্ক করানো, অন্য একটি কারণ প্রাইভেট পড়ানোর জন্য কোনও সাম্মানিক দক্ষিণা নিতেন না তিনি।) শিক্ষকদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা যেমন থাকে, তেমনি তাঁদের অন্যরকম যাপনেও কৌতূহল থাকে অনেক বেশি। আর সেই মানুষ-গড়ার কারিগর যদি নিজেই নিজের হন্তারক হন, তাহলে স্বাভাবিক কারণেই সেদিকে মানুষের কৌতূহল বেশি থাকবেই।
তাছাড়া শ্যামদীপ্ত কবিতা লিখতেন। ফলে একজন কবির আত্মহত্যা করা যথাযথ কিনা বা কোন পরিস্থিতিতে কবি আত্মহত্যা করলেন, সে বিষয়েও আগ্রহ থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়, সামাজিক নানা কাজে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শ্যাম এলাকায় মহা উৎসাহে অংশ নিতেন। সেই সঙ্গে এক ছেলে, এক মেয়ে, ব্যাঙ্ক কর্মী স্ত্রী এবং বিধবা মাকে নিয়ে তাঁর আপাত সুখী সংসারের কথা অনেকেই জানে। সেই লোক আত্মহত্যা করায় মানুষের স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসা তাঁর লাশ দেখার জন্য এতশত মানুষকে টেনে এনেছে। আর কে না জানে, মৃত্যুসংবাদ বাতাসের ডানায় ভর দিয়ে হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে আনাচকানাচ পর্যন্ত।
শ্যামদীপ্তর নাম ছোট করে তার সঙ্গে দাদা, কাকা, মামা ইত্যাদি জুড়ে দিয়ে ডাকত অনেকেই। কেউ আবার ডাকত শ্যাম নামেও। আবার অনেকেই শ্যামদীপ্ত স্যার বা শ্যাম স্যারও ডাকত। একজনই শুধু বলত শ্যামসাহেব।
শ্যামদীপ্তর সহশিক্ষকরাও স্বীকার করেন তিনি খুব ভালো অঙ্ক জানতেন। অঙ্কের অনেক কঠিন কঠিন সমস্যাও তিনি অনায়াস দক্ষতায় সমাধান করে দিতেন। তাঁর স্ত্রী মধুরিমার ভাষ্যে, ‘শ্যামের প্রথম প্রেমিকা অঙ্ক এবং দ্বিতীয় প্রেমিকা কবিতা’।
বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় শ্যামের বহু কবিতা ছাপা হয়েছে। সেই সুবাদে তাঁর কবিখ্যাতিও নেহাত কম ছিল না। সাহিত্যসভায় পারতপক্ষে যেতেন না ঠিকই, তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
যে-কোনো মৃত্যু নিয়েই মানুষের অবাধ ও অগাধ কৌতূহল থাকে, চর্চা হয়। স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে যেরকম চর্চা হয়, অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে চর্চা হয় অনেক বেশি। আর একাধারে কবি, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে শ্যামের অকাল ও আত্মমৃত্যু বেছে নেওয়া স্বাভাবিকভাবেই অনেকের আলোচনার বিষয়। প্রেমঘটিত কারণে শ্যামের আত্মহত্যা বলে খুব কম লোক হলেও কেউ কেউ মনে করেছে। যদিও তা তারা নিজেরাও বিশ্বাস করে কিনা বোঝা যায়নি। আবার গতবছর শ্যামদীপ্ত রায় তাঁর ফেসবুকের ওয়ালে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন আত্মহননের পক্ষে। তিনি লিখেছিলেন, ‘আত্মহনন মানুষের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষিত গম্যস্থান। প্রতিটি মানুষই কোনও-না-কোনও সময় আত্মহননের কথা ভাবে। সকলেই এই গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না, জীবনের অনপনেয় চোরাটানের কারণে কিংবা দুঃসহ সাহসের অভাবে।’ এই স্ট্যাটাস কে বা কারা ঠিক খুঁজে বের করে এনেছে। ফলে শ্যামের আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত একবছর আগেই নেওয়া, এমনও কেউ কেউ বলেছে। এই স্ট্যাটাসই যে তার গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ সাক্ষ্য, এ বিষয়ে তাদের কোনও সন্দেহ নেই। তাঁর স্কুলের দু-একজন সহশিক্ষক মনে করেছেন, শ্যাম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল বরাবরই। কিন্তু কেন বিপর্যস্ত ছিল, তার ব্যাখ্যা তাঁরা দিতে পারেননি। শ্যাম স্যারের খুব ঘনিষ্ঠ বাংলার সহশিক্ষক অতনুবাবু জীবনানন্দ দাশের ‘মরিবার হল তার সাধ’ উচ্চারণ করেছেন গভীর আবেগে। প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানিয়েছে, সেইসময় অতনুবাবুর চোখ ছিল ছলছলে। আর সর্বশেষ খবর হল, তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেছেন, ‘শ্যাম ছিল পারিবারিক ভাবে অত্যন্ত সুখী। আর এই সুখই সে সহ্য করতে পারেনি।’ যদিও প্রতিটি মতেরই কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ বা গ্রাহ্য যুক্তি নেই। তবু অস্বাভাবিক মৃত্যু যখন চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে, সেইসময় নানা প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক তথ্য ও কথাকলি ভেসে ওঠে। এক্ষেত্রেও ভেসে উঠেছে।

রেহানার কথা
শ্যামদীপ্তর স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক রেজ্জাক মণ্ডল। কবিতা লেখার সূত্রে তাঁর সঙ্গে শ্যামের ঘনিষ্ঠতা ছিল খুব। রেজ্জাক মাঝে মাঝে কবিতা লেখেন। সেই কবিতা যে খুব-একটা উঁচু মানের তা নয়। তবে রেজ্জাকের দেশি-বিদেশি নানা কবিতাপাঠের অভ্যেস আছে। সেসব নিয়েও দুজনের আলোচনা হত। সেই সুবাদে রেজ্জাকের বাড়ি মাঝেমধ্যে আসতেন শ্যাম। তবে শ্যামের বাড়ি রেজ্জাক এযাবৎ যাননি।
রেজ্জাকের এক মেয়ে আর এক ছেলে। মেয়ে রেহানা বড় আর ছেলে ইমান ছোট। রেহানা ছোটবেলা থেকেই শ্যামের ভক্ত। শ্যামের প্রতি তার দুর্বলতা গড়ে উঠেছিল প্রবল। বলব না বলব না করেও একদিন শ্যামকে ভালোবাসার কথা বলে দিয়েছিল সে। তখন রেহানা মাত্রই চোদ্দ বছরের কিশোরী আর শ্যাম বত্রিশ বছরের টগবগে যুবক। বাবারই স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। বাবার স্কুলে রেহানা বা ইমান কেউই পড়ত না। তারা স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়ত। তাই শ্যামকে স্যার ডাকত না কেউই। রেহানা ডাকত শ্যামসাহেব আর তার ভাই ডাকত শ্যাম আঙ্কেল।
তুই কি পাগল হয়ে গেলি? জানিস আমার বয়স কত? রেহানার ভালোবাসার কথা শোনার পরে শ্যাম ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তার দাবি।
জানি। তুমি আমার ডবল বয়সের।
ডবলেরও বেশি রে পাগলি! আর তোর বাবাকে আমি দাদা ডাকি, মাকে ডাকি ভাবী।
তাও জানি। যতই শ্যামসাহেব ডাকি, তুমি তো আমার সম্পর্কে চাচু হও। কিন্তু প্রেম কি কোনও বাধা মানে? তুমিই বলো!
মানে না ঠিকই, কিন্তু সবদিক ভেবে দেখ। যে প্রেমের সামাজিক স্বীকৃতি নেই, সেই প্রেম মনে পুষে রাখবি কেন?
স্বীকৃতি থাকবে না কেন বলো? তুমি যদি স্বীকৃতি দাও, তাহলে বাধা কোথায়?
মাত্রই চোদ্দ বছরের মেয়ের ম্যাচুউরিটি দেখে শ্যাম বিস্মিত হয়েছিলেন। এমন কথার পৃষ্ঠে কথা বলতে পারে মেয়েটা! এই বয়সেই? শ্যাম বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, অসম বয়স, এতে প্রেম ঠিক হয় না রে। তুই একটু বোঝার চেষ্টা কর।
আমি কিচ্ছু বুঝতে চাই না শ্যামসাহেব। আমি কিচ্ছু জানি না, জানি না, জানি না…
রেহানার মুখজুড়ে বিষণ্ন আবেদন। চোখ টলটলে। সেই চোখে ভেজা দৃষ্টি নিয়ে শ্যামের দিকে তাকিয়েছিল নির্নিমেষ। শ্যামও দেখছিলেন তাকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন, তুই কি জানিস মাস দুয়েক বাদে আমার বিয়ে?
থমকে গিয়েছিল রেহানা। শ্যামের দিকে দৃষ্টি ভাসিয়ে রেখেছিল অবিশ্বাসী চোখে। মুখের উপর বিস্ময় ঝুলিয়ে রেখে বলেছিল, বিয়ে? তোমার? শুনিনি তো!
কী করে শুনবি? আমি তো কাউকেই বলিনি এখনও। শুধু আমি আর মধু জানি।
মধু কে?
মধুরিমা। যাকে আমি বিয়ে করব।
প্রেম? তার মানে তুমি প্রেম করছ? তাকেই বিয়ে করবে? রেহানার অবাক চোখে খেলে বেড়াচ্ছিল ম্রিয়মাণ আলো। তার শ্যামসাহেব অন্য কারও হতে পারে, বিশ্বাস করতে পারেনি। এমনকি তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে, তাও তার ভাবনার অতীত।
হ্যাঁ রে, মধুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেই ইউনিভার্সিটি থেকে।
তুমি পারো না। কিছুতেই আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারো না শ্যামসাহেব!
তা হয় না রেহানা। এসব ভুলভাল চিন্তা মাথা থেকে তাড়া আগে। মাথা ঠান্ডা কর।
ঘনঘন মাথা নাড়ছিল রেহানা। এলোমেলো চুল ছড়িয়ে পড়ছিল মুখের উপর। ঝুপঝুপে কান্না নেমে এসেছিল রেহানার সারা শরীরজুড়ে। অতর্কিতে শ্যামের কাঁধ আঁকড়ে ধরেছিল সে। শ্যামের উচ্চতার থেকে খানিকটা কম উচ্চতার রেহানা শ্যামের বুকে অবিরাম মুখ ঘষে চলেছিল।
রেহানার অঝোর শ্রাবণধারা কিছুটা থেমে যাওয়ার পরে ধীরে ধীরে রেহানার থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলেছিলেন, এবার আমাকে যেতে হবে। তুই এমন করলে আর কোনওদিন তোদের বাড়িতে আসা হবে না পাগলি। চোখ মোছ। তোর আব্বু-আম্মার আসার সময় হয়ে এল।
রেহানা দেওয়াল ঘড়িতে দেখেছিল সত্যিই আব্বু-আম্মা আসার সময় হয়ে গেছে। ইদের বাজার করতে গিয়েছিলেন শ্যামকে বাড়িতে রেখেই। রেহানার ভাই ইমান ঘুমোচ্ছে তখন। শ্যাম আচমকাই এসে পড়েছিল এ বাড়িতে। (কেন এসেছিল, নানা ঘটনাপ্রবাহে শ্যামের আর তা মনেই ছিল না।) যাবার সময় শ্যামকে রেজ্জাক বলে গেছেন, ‘তুই একটু বোস। আমরা আধঘণ্টার মধ্যেই চলে আসব। ছেলেমেয়ে তোর জিম্মায় রেখে গেলাম। হা হা হা…।’
রেজ্জাকদের বাড়ি থেকে শপিং মল খুব দূরে নয়। তাছাড়া এই অঞ্চলটায় মল ছাড়াও আরও নানা জামাকাপড় ও অন্যান্য দোকানপাট আছে। রেজ্জাক অবশ্য শপিং মলেই কেনাকাটা পছন্দ করেন। রেজ্জাকের বলে যাওয়া আধঘণ্টার সময়সীমা শেষ হয়ে এসেছিল প্রায়। শ্যাম সেকথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এই যে রেজ্জাকদা বিশ্বাস করে তোদের আমার কাছে রেখে গেছে, সেই বিশ্বাস রাখব না আমি?
শুধু বিশ্বাস রাখাটাই তোমার কাছে বড় শ্যামসাহেব? আমার ভালোবাসার কোনও মূল্য নেই?
বিশ্বাস সবথেকে বড় রে রেহানা। একে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। আরও বড় হলে বুঝবি।
আমি কিচ্ছু বুঝতে চাই না। শুধু তোমাকে চাই শ্যামসাহেব। শুধু তোমাকে। আর কিচ্ছু চাই না!
শ্যামের বুকের মধ্যে একটা কালো চকচকে সাপ হিসহিস শব্দ করে উঠেছিল। রেহানার এই পাগলামি যদি টের পান রেজ্জাকদা আর ভাবী, যদি মনে করেন এতে শ্যামেরও প্রশ্রয় আছে, তখন কী হবে! যদি রেজ্জাকদারা অন্য অনেককে বলে দেন, তখন কোথায় মুখ লুকোবে সে? যদিও রেজ্জাকদা এসব করবেন না বলেই শ্যামের বিশ্বাস। তবু ভয় হয়, বড্ড ভয়!
রেহানা, পাগলি মা আমার, এসব মাথা থেকে সরিয়ে দে। মধু তো কোনও দোষ করেনি, বল! কেন তাকে ঠকাব? তাছাড়া আমি দু-তিন বছর ধরে তোদের বাড়িতে আসি। কই, কোনওদিন তো সেই চোখে তোকে দেখিনি! কেন এমন করছিস? একটু বোঝার চেষ্টা কর, প্লিজ। মরিয়া হয়ে রেহানাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন শ্যাম।
রেহানা তার নীচের ঠোঁট দিয়ে কামড়ে ধরেছিল উপরের ঠোঁট। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে নিতে চাইছিল তার আব্বু-আম্মা আসছে কিনা। সেদিকে চোখ রেখেই বলেছিল, জানি আমি তোমাকে আর কোনওদিনই পাবো না। জানি না তোমাকে ছাড়া আমি কীভাবে বাঁচব। যদি পারো, সবকিছু ভুলে গিয়ে আমাকে একদিন অনেক অনেক আদর করবে শ্যামসাহেব? করবে তো? কথাগুলো বলেই দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছিল শ্যামের দিকে। শ্যামের সম্মতি আদায় করেই ছাড়বে, এমনভাবে তাকিয়েছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে।
‘আমি চেষ্টা করব। খুব চেষ্টা করব।’ এই বাক্যবন্ধ ছুঁড়ে দিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিলেন শ্যাম। সেখানে পাতা কাঠের চেয়ারে বসে সিগারেট টানতে টানতে দেখে যাচ্ছিলেন পথচলতি মানুষের যাতায়াত আর যানবাহনের চলাচল। একসময় রেহানার আব্বু-আম্মা বাড়ি ফিরে এলে শ্যাম বেরিয়ে আসেন সেই বাড়ি থেকে। যেমন আচমকা এসেছিলেন, তেমনই চলে গিয়েছিলেন সংক্ষিপ্ত বাক্য বিনিময়ের পরে। আর কোনওদিন যাননি সেখানে। রেজ্জাকদার হাতে স্কুলেই বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র তুলে দিয়েছিলেন।
এর কয়েকবছর পরে রেহানার বিয়ের সময়ও শ্যাম আসেননি এ বাড়ি। সেদিনই তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তার দেখানোর দিন ঠিক করে রেখেছিলেন শ্যাম। বিয়ের নানা আয়োজনের ক্ষেত্রে অবশ্য বাইরে থেকে পরামর্শ দিয়েছেন, কেনাকাটা ও অন্যান্য যোগাযোগের ব্যাপারে সাহায্য করেছেন। কিন্তু রেজ্জাক তাঁকে তাঁদের বাড়িতে যাওয়ার কথা বললেও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এড়িয়ে গেছেন শ্যাম।
রেহানা দূর থেকে শ্যামের স্ত্রীকে দেখেছে আর ঈর্ষায় জ্বলে গেছে। বিয়ের কিছুদিন পর অত্যন্ত সাজগোজ করে বিনা আমন্ত্রণেই একা এসেছিল শ্যামের বাড়ি। রেহানার পোশাক আর আচরণে ‘শ্যামসাহেব, দেখো আমি কত সুখে আছি, ভালো আছি’ এই বিজ্ঞাপন দেখেও নির্বিকার ছিলেন শ্যাম। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন রেহানাকে। আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন মধুরিমার সঙ্গে। মাথায় আলতো হাতের ছোঁয়া দিয়ে শ্যাম বলেছিলেন, ‘তোকে খুব সুন্দর লাগছে রে। বোস একটু। মিষ্টি নিয়ে আসি। বিয়ের পরে এই প্রথম এলি আমাদের বাড়ি।’
দাউদাউ আগুনে পুড়তে পুড়তে রেহানাকে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হয়েছিল অবিরাম।

মধুরিমা ও অন্যদের কথা
শ্যামদীপ্তর স্ত্রী মধুরিমা ভাবছিলেন তাঁর স্বামীর বিবাহোত্তর জীবনযাপন আর আচরণ নিয়ে। লোকটাকে কিছুতেই চিনে উঠতে পারেননি, বুঝে উঠতে পারেননি মধু। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় কবিতাপাগল এবং প্রেমিকপুরুষ যে শ্যামকে তিনি দেখেছিলেন, বিয়ের পরে কয়েক বছর সেই মানুষটাকে তিনি কাছে পেয়েছেন। কিন্তু ধীরে ধীরে শ্যাম বদলে যেতে লাগলেন। মধুরিমা সেই শ্যামের সঙ্গে মাঝেমাঝেই এই শ্যামের মিল খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে গেছেন। কিছুতেই অঙ্ক মেলেনি। ইদানিং শ্যাম নীচতলার ঘরে একা ঘুমোতেন। ছেলের পড়ার ঘর সেটা। একটা সিঙ্গেল খাট পেতে সেখানেই থাকা শুরু করেছিলেন। কোনও বাধাই তিনি মানতে চাননি। বিয়ের পনেরো বছর না-কাটতেই শ্যাম নিজের জগতে একা হয়ে তাঁদের সবাইকে সরিয়ে দিলেন কেন, বুঝতে পারেন না মধুরিমা। তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছিল শ্বশুর মারা যাওয়ার দিনের কথা। ভোর থেকেই প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হল। ডাক্তার আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাই বাড়ির সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুতই ছিল। অবশেষে সকাল আটটা নাগাদ মারা গেলেন শ্বশুরমশাই। বারোটা বাজার কিছু সময় পরে ডাক্তার এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে চলে গেলেন। এ ব্যাপারে যা-যা করার ছিল সব করেছিল শ্যামের ভাই। কিন্তু শ্যামের সেদিনের আচরণ ছিল অন্যরকম। তিনি নির্বিকার বসেছিলেন দোতলার ব্যালকনিতে। ছোট ভাই অনুযোগ করেছিল, ‘কী রে দাদা, সবাইকে জানালাম আমি। তুই কিছুই করলি না! একে একে সবাই এসে পড়ল, আর তুই এখানে বসে আছিস?’ কথাটা বলেই বিরক্ত ভাই চলে গিয়েছিল নীচতলায়।
প্রথমে সবাই ভেবেছিল শ্যাম বোধহয় মানসিক যন্ত্রণায় ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে গেছেন। তাই এমন চুপচাপ বসে আছেন দোতলার ঘরে। কিন্তু যখন বললেন, ‘মধু একটু চা করো তো’, মধুরিমা অবাক হয়েছিলেন খুব।
চা খাবে এখন?
হ্যাঁ। কেন, কী হয়েছে?
না, এমনিই…
হয়তো মাথা ধরেছে, এই ভেবে মধু চা করে এগিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর দিকে। চা শেষ করে সিগারেট ধরিয়ে বলেছিলেন, যাই, একটু পরোটা খেয়ে আসি। বড্ড খিদে পেয়েছে।
কী বলছ এসব?
কিছু না তো, খুব স্বাভাবিক কথা বলেছি। খিদে পেয়েছে। খাব। তুমি তো শোকের বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে রেখেছ মুখে। তোমাকে বললেও পরোটা বানাবে না জানি। অগত্যা…
তুমি এখন খাবে? বাবা মারা গেলেন?
খুব অস্বাভাবিক লাগছে নাকি আমার কথা?
হ্যাঁ লাগছে। মধুরিমা বেশ জোরেই বাক্যটা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
তাহলে তুমি স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিকের দ্বন্দ্ব নিয়ে গবেষণা করো। আমি আসছি।
হনহন করে চলে গিয়েছিলেন শ্যাম। নীচে গিয়ে ভাইকে বলেছিলেন, শোন দিলু, সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে তুই শ্মশানে যাবি। যা কাজকর্ম করার করিস। টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করিস না। সব মিটিয়ে দেবো। আমি আর যাচ্ছি না।
ভাই দিলু বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থেকেছিল দাদার দিকে। দাদা ততক্ষণে বেরিয়ে যাচ্ছেন বাইরে, পরোটার দোকানের দিকে। কোথায় যাচ্ছে বা কেন শ্মশানে যাবে না, সেই প্রশ্ন তার গলার কাছে আটকে ছিল।
দাদার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে দিলুর মনেও ভেসে উঠেছিল নানা কথা। বাবা মারা যাওয়ার পরে দাদা পারলৌকিক কাজের কিছুই করেননি। গায়ে ছিল নিত্যদিনের পোশাক। ‘এসব শোকের বিজ্ঞাপন গায়ে রাখার কোনও মানে নেই’। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন। তবে নানা কাজ তদারকি করেছেন। টাকাপয়সা যা লাগে সব তুলে দিয়েছেন। টি-টোয়েন্টি খেলা দেখার সময় দাদার উত্তেজনা আর প্রিয় দল জিতলে হইহই করাও মনে পড়ছিল তার।
শ্যামের ছেলে প্রদীপ্তর মনেও বাবার এলোমেলো আচরণের নানা প্রবাহ উঠে এসেছিল একে একে। বাবার সঙ্গে বাজারে গেছে কিছু কেনাকাটা করতে। জিনিসপত্র হয়তো পছন্দও হয়েছে। আচমকা কেনা থামিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন দোকান থেকে। ‘পরে কিনিস বাবু, এখন চল বাড়ি ফিরে যাই’ বলেই বাড়ির পথ ধরেছিলেন কোনও ভূমিকা ছাড়াই। জন্মকাল থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক নানা আচরণ ভেবে চলেছিলেন শ্যামের মাও। আজকাল তিনি অনেক কিছুই মনে রাখতে পারেন না। তবু তিনি মনে করার চেষ্টা করেন ছেলের নানা কথা ও ঘটনা।

শ্যামের কথা
আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম? কেউ আমাকে বিশ্বাস করত না কেন? আমি দেখতে পেতাম প্রতিদিন এই শহরটা একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে। চারিদিকে আলোর রোশনাই। নিজস্ব আস্তানা মুছে গিয়ে উঠে যাচ্ছে হাইরাইজ বিল্ডিং। পুকুর বুজিয়ে ফেলছে অনেকেই। মাঠ হারিয়ে যাচ্ছে। নদীজলে মিশে যাচ্ছে আবর্জনা। আর সেসবকে ছাপিয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে আলোর গুঁড়ো। আমার কেমন যেন গুলিয়ে যেত সবকিছু।
একদিন মধুরিমাকে বলেছিলাম, দেখো দেখো, কেমন আলোর গুঁড়ো ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে। ও অবিশ্বাসের চোখে দেখছিল আমাকে। চোখ সরু করে আমার মুখের ভাঁজে ভাঁজে কিছু একটা খুঁজতে চাইছিল মনে হয়। তারপর কী মনে করে চলে গিয়েছিল নিজের কাজে। যেন আমার কথার কোনও মূল্য দেওয়ার প্রয়োজন নেই, কিংবা এইসব অর্থহীন কথা শুনে সে হয়তো অন্যকিছু ভেবেছে। কিন্তু কী সেই ভাবনা, বুঝতে পারিনি আমি। বুঝতে পারিনি আমিই-বা কেন অন্য সকলের মতো ভাবতে পারছি না! কেন সবার মতো ভালোলাগা মন্দলাগা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারছি না! আমি কি সবার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি? বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি সমাজ সংসার থেকে? নিজের থেকেও?
প্রায় প্রতিদিনই মধ্যারাতে জানালা দিয়ে দেখতে পেতাম কোনও এক সম্রাট ঘোড়ার পিঠে চড়ে টগবগ করে ছুটে যাচ্ছে। আমি দ্রুত দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতাম। ‘ছোটোদের ইতিহাস’ বইতে দেখা বখতিয়ার খলজি যেন ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যাচ্ছেন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে। সঙ্গে বেশ কয়েকজন অশ্বারোহী সৈনিক। মধুরিমা আমার কথা বিশ্বাস করেনি। ছেলেও না। আর কাউকে কোনওদিন বলিনি। কেননা আমি জানতাম, আমার কথা বিশ্বাস করবে না কেউই।
মধ্যরাতে ঘোড়ার টগবগ শুনলেই আমি চঞ্চল হয়ে উঠতাম। ছিটকে বেরিয়ে আসতাম বাইরে। যেতামও ছুটে। ততক্ষণে ঘোড়া বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে। আমাকে পরের দিকে মধু আর বিছানা থেকে নামতে দিত না। হাত টেনে ধরে রাখত। আমি চেষ্টা করেও কেন যেন তার হাত ছাড়াতে পারতাম না।

শেষের কথা
মৃত্যুর পরেও কি জীবন থাকে! ধর্মীয় ব্যাখ্যায় অবশ্য থাকে। এবং তার থেকে জন্ম নেওয়া বিশ্বাসেও থাকে। কিন্তু সবকিছু কি সবাই মানে বা বিশ্বাস করে? বিশ্বাস করার যুক্তিও কি থাকে?
মাঝে মাঝে ম্যাজিক রিয়েলিটি আমাদের আচ্ছন্ন করে, অনেকটাই বাস্তবের মতো মনে হয়। যেমন শ্যামদীপ্ত রায়। দড়িতে ফাঁস দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তার মানে মৃত্যু হল তাঁর। তিনি আর ফিরে আসবেন না কোনওদিন। কিন্তু কী আশ্চর্য! শ্যাম ফিরে এলেন। তাঁর সৎকার হয়ে গেছে কয়েকঘণ্টা আগেই। ‘ছিল’ থেকে তিনি ‘নেই’ হয়ে গেছেন। এখন তিনি শুধুই স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনাসম্পাতে শ্যাম ফিরে এলেন তাঁর নিজের ঘর বলে জীবৎকালে যা ছিল, সেখানে। গত পরশু সকালে তাঁর দেহ নামিয়ে নিয়ে গেছে পুলিশ। তবু তিনি দেখতে পেলেন তাঁর ঝুলন্ত দেহ। অদৃশ্য দড়িতে ঝুলতে-থাকা সেই অদৃশ্য শরীর শুধুমাত্র তাঁরই দৃষ্টিতে ধরা দিল। তিনি নির্বিকারভাবে খাটের উপর একটা প্লাস্টিকের চেয়ার পাতলেন এবং নিজের মৃতদেহ নামিয়ে আনলেন। তারপর টানতে টানতে নিয়ে চললেন অদূরের নদীপাড়ে। প্রথমে ধারালো ছুরির ফলায় ক্ষতবিক্ষত করলেন দেহটা। এরপর একে একে টুকরো টুকরো করলেন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। এবং সবশেষে টুকরোগুলোর কিছুটা ভাসিয়ে দিলেন নদীজলে। বাকি দেহাংশ ছড়িয়ে দিলেন আনাচকানাচে, ড্রেনের জলে, পথের ধুলোয়। সেসব মাড়িয়ে মাড়িয়ে সবাই চলে যাবে, কেউ টেরও পাবে না, তিনি নিশ্চিত।
এই ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী ছিল শেষরাতের মরা চাঁদ আর বাতাস। মাটির উপরে জেগে থাকা ঘাস। আকাশের তারা, আর নির্বাক বিশ্বচরাচর।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *