মন্দির মিথ2ঃ রহস্য ও মিথের চাদরে জহরা কালী

 

দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি পেশায় ইংরেজীর অধ্যাপিকা তবে তাঁর ভালোলাগা ও ভালোবাসায় গাঁথা হয়ে আছে দেশ বিদেশের পুরাণে। ইদানিং দেবলীনা সেই পুরাণ সাহিত্য ও প্রতীকীবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। প্রধানত, আন্তর্জাতিক জার্নালে লেখালেখি ও বিভিন্ন সেমিনারে উপস্থাপন। একটি ইংরেজী ও একটি বাংলা কবিতার বইয়ের পর,সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে “Into the Myths” নামে দেশ-বিদেশের পুরাণ নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন। Myth Muhurto নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলরও কর্ণধার। দেবলীনাও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

জহরা কালী মন্দির

লেখা ও ছবিঃ

দে ব লী না    রা য় চৌ ধু রী    ব্যা না র্জি

আমবনের ঘন ছায়ায় পথ হেটে, শহর থেকে বেশ কিছুটা ভিতরে, বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তে, রায়পুর গ্রামে এই মন্দির অবস্থিত। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার পূজা হয়ে থেকে। মালদার ইতিহাসে আছে সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন এই মন্দির তৈরী করেন পঞ্চদশ শতাব্দীতে পুরোহিত সালওয়ারা তেওয়ারির সহায়তায়। এক সময়ে নাকি ইনি ডাকাতদের দ্বারা পূজিতও ছিলেন।

মন্দিরটা অপূর্ব সুন্দর। না, কারুকাজের দিক দিয়ে বলছি না। আসলে এখনও কেতাদুরস্ত হয়ে পরেনি জায়গাটা। শহুরে চাকচিক্য থেকে বেশ কয়েক গজ দূরেই আছে এখনো।প্রকৃতি যেন মুঠো ভরে সবুজ এনে সাজিয়েছে এই মন্দিরটির চারপাশ। ঘন সবুজের ছায়া ঘেরা এই শান্ত, লালচে মন্দিরটি দর্শনার্থীদের মনে গভীর স্নিগ্ধতার সৃষ্টি করে। তবে বিগ্রহটি কিছুটা উগ্ররূপা। ভক্তরা তাকে মানেন অতীব জাগ্রত দেবী বলেই। জহরা কালী মানে “বিষের কালী”- তা নামের সাথে সাযুজ্য থাকতে হবে না!

অনেকগুলি কিংবদন্তি আছে এই মন্দির নিয়ে। গৌড়ের প্রতিপত্তি কমতে থাকলে পুরোহিত তেওয়ারিজি সকলের মঙ্গলার্থে তৈরি করেন এক বেদি যাকে চণ্ডীজ্ঞানে পুজো করতে এগিয়ে আসেন সবাই। এই বেদিতেই আসল পুজো হয় কারণ, এতেই দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠিত। আফগানদের আক্রমণ ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওখানকার মানুষ ওই বেদীর ভিতরে প্রচুর ধনরত্ন লুকিয়ে রেখেছিলেন। খবর পেয়ে আফগান দস্যুরা এই মন্দির লুঠ করতে আসেন। কিন্তু মন্দির প্রাঙ্গণে ঢুকতে বাঁধা পান। সর্দার “জহর হ্যায় য়াহা তো জহর হ্যায়” বলতে বলতে ছুটতে ছুটতে পালিয়ে যান এই মন্দির ছেড়ে। তিনি নাকি ওই বেদী থেকে উঠে আসতে দেখেন এক ভয়ংকর, ক্রুদ্ধ ও বিষময় নারীমূর্তিকে। তীব্র বিষের অবস্থিতি থেকেই এই মন্দিরের নাম রাখা হয় জহরা মন্দির।

যাই হোক, এই মন্দিরটিতে বেদী পুজোর শুরু হওয়ার এক শতকের মধ্যেই বেদীর সাথে দেখা যায় তিনটি মুখোশ। মুখোশপুজো কিন্তু বঙ্গে নতুন বিষয় নয়। অবশ্য ভারতের বিভিন্ন স্থানেও এর চল আছে। তবে এই মুখোশের পিছনেও আছে আরেকটি কাহিনী, আরেকটা মিথ। কথিত আছে, সালওয়ারা তেওয়ারির নাতি হীরারাম জহরা মায়ের দর্শন পেয়ে মাটি দিয়ে এই মুখোশ গড়েন তার দেখা দেবীর আদলে। বরাহদন্তবিশিষ্ট রক্তবর্ণা ত্রিনেত্রা রূপ তার। চণ্ডী মূলত অনার্যদের মধ্যেই পূজিতা ছিলেন, যেমন ছিলেন মনসা, শীতলা বা ষষ্ঠী। পরবর্তীকালে আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির মিলনে এক বৃহত্তর দেবতা গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়, তা আমরা জানি। চণ্ডী কালক্রমে কালীর চামুণ্ডা রূপের সাথে একাকার হয়ে যান। জহরা চণ্ডী বিগ্রহটি ওই বেদী ও তিনটি একই রকমের মুখোশ নিয়ে সৃষ্ট। বেদীটিকে কেন্দ্র করে তিনটি মুখোশ তিন নেত্রের মতো ক্রমে অবস্থিত। তা যেমন ত্রিগুণ অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ তমঃ গুণের প্রতীক, তেমনই এই তিনটি মুখোশ জহরা দেবীর তিনটি চোখের ন্যায় যেন অতন্দ্র প্রহরা দিয়ে চলেছে তার ভক্তদের শতাব্দীর পর শতাব্দী

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *