মাছে ভাতে বাঙালি(দ্বিতীয় পর্ব)
লিখছেন— সুকন্যা দত্ত
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
” খেঁদুবাবুর এঁধো পুকুর, মাছ উঠেছে ভেসে
পদ্মমণি চচ্চড়িতে লঙ্কা দিল ঠেসে”।
বাঙালি বাড়ী বলতে তখন ঘাট বাঁধানো পুকুর আর পুকুর ভরা মাছ। বাঙালি বিয়েতে মাছের একটা কদর আছে। তত্ত্বে নোলক ও শাড়ী পড়ানো মাছ, গায়ে হলুদের সাথে মাছ, আইবুড়ো ভাতে , বিয়ে বাড়ীর পাতে, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, সাধ- ভক্ষন এমনকি মৎসমুখীতে ও মাছ। কিছু উৎসবে মাংসকে একচুল জায়গা ছাড়েনি মৎস প্রিয়া। এখন তো অলংকারের কারুকাজে,আলপনায় কিংবা পোশাকের ডিজাইনে মাছের নকশা জমিয়ে বসেছে। পশ্চিমবঙ্গের চন্দ্রকেতুগড়ে কিংবা বাংলাদেশের পাহাড়পুর বা ময়নামতিতে পোড়ামাটির ফলকের বেশ কয়েকটিতে মাছের ছবি ও দেখতে পাওয়া যায়। মাছ নিয়ে অ্যাখ্যানের শেষ নেই। মহাভারতের যুগে নরপতি তাম্ররাজ এক ধীবরপত্নীর কাছ থেকে অলৌকিক গল্প শুনেছিলেন। সেই ধীবর পত্নী রোজ দূর থেকে মরা মাছ নিয়ে আসেন আর বনের ভিতর এক মন্দিরের পুকুরে সেই মাছ ডুবিয়ে জ্যান্ত করে নেয়। তারপর যায় রাজবাটীতে। এই কাহিনি শুনে ধীবরীর সাথে সেই মন্দিরে গিয়ে বর্গীভীমার মূর্তি স্থাপন করেন। “পদ্মানদীর মাঝি” উপন্যাসে জেল মাঝিরা পদ্মার ইলিশের মরসুমের দিকে চেয়ে থাকতো। কখন ও প্রশ্ন করতো,
” যদু হে, মাছ কিবা”।
ইলিশের কথায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন,
” নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লন্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিস্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ্ব নীলাভ মণির মতো দেখায়”। বাঙালি এক কথায় ইলিশের ভক্ত। সরষে হোক বা ইলিশ পাতুরী কিংবা কালো জিরে কাঁচা লঙ্কার ঝোল ইলিশ পাতে পড়লে বাঙালি র জিভে জল আসবেই। পূর্ববঙ্গে বেড়াতে গিয়ে পদ্মার টাটকা ইলিশ দেখে স্বামী বিবেকানন্দ সঙ্গী কানাইকে ইলিশ কিনতে বলেছিলেন। তখন ষোলটি ইলিশের এক একটি চার পয়সায় কেনা হয়েছিলো। আর একদুনের কথা। স্বামীজী উপোস করে তিন ঘন্টা ধ্যান করার পর ঠিক করলেন, সেদিন তিনি ভাত, মাছ, তরকারী সব খাবেন। তখন গঙ্গার ইলিশ ধরা হলো। প্রেমানন্দ স্বামী টাটকা ইলিশ কেনার পর বেলুড় মঠে ইলিশের নানান পদ রান্না হলো। সেদিন স্বামীজী খেলেন ইলিশ মাছের তেল দিয়ে ভাত, ডাল দিয়ে ইলিশ ভাজা, লংকা ডলে ঝাল ঝাল করে মাছের ঝোল খেলেন আর শেষে খেলেন মাছের টক। কোনো কোনো দেশে লক্ষ্মী পুজোয়, সরস্বতী পুজোয় জোড়া ইলিশ খাওয়ার নিয়ম আছে। আবার নববধূ কে ধরতে দেওয়া হয় জ্যান্ত ল্যাটা মাছ। নদীয়ার তৎকালীন মহারাজ ক্ষীতীশচন্দ্রের বাড়ীতে একবার নববর্ষের আসর বসেছিলো। রবীন্দ্রনাথ ও সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। নববর্ষের খাবার তালিকায় ক্ষীরের মালপোয়া ও চিংড়ির মালাইকারি ছিলো প্রধান। খাবারের তালিকায় রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছিলো পাঠার মাংস, আম দিয়ে শোল, কাঁচা ইলিশের ঝোল,নারকেল চিংড়ি,চিতল মাছ,চালতা দিয়ে মুগ ডাল।
“বাঙালীর ইতিহাস ” গ্রন্থে নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন,
” বারিবহুল, নদনদী, খালবিল বহুল প্রশান্ত সভ্যতা প্রভাবিত এবং আদি- অস্ট্রেলীয়মূল বাঙলায় মৎস অন্যতম প্রধান খাদ্যবস্তু রূপে পরিগনিত হইবে,ইহা আশ্চর্য কিছু নয়”। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ মতে, রোহিত, শফর( পুঁটি), সকুল( শোল) আর সাদা বর্ণের ও আঁশযুক্ত মাছ ব্রাহ্মণরা খেতে পারেন। বাঙালদের মধ্যে কোনো কোনো দেশে শুঁটকি মাছ খাওয়ার চল রয়েছে। ফরাসী পর্যটক ফ্রাসোঁয়া বোর্নিয়ে তার বাংলার ভ্রমণ বৃত্তান্তে লেখেন,
” মিষ্টি জলের মাছ হোক বা নোনা জলের, সব রকম মাছই বাংলায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।”।কামিনী কুমার রায়ের ” লৌকিক শব্দকোষ” এ প্রায় একশোর বেশি মাছের নাম পাওয়া যায়। গয়না বা শাড়ি নয় একটি ইলিশ মাছ যে দম্পতির মিলন ঘটাতে পারে হোসেনউদ্দীন হোসেন তার ” ইলিশ ” গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন। শৈবাল মিত্রের ” ইলিশের রাত” গল্পে দারিদ্র্যতা আর ইলিশ খাওয়ার কথা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। কীর্ত্তনী সুরে একটি গান একবার আমার মন কেড়েছিলো।
“তুমি আমার ঘরকন্না উনকুটি চৌষট্টি
ধান ভানাতে ঢেঁকি তুমি মাছ বানাতে বঁট্টি।”
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার কবিতার ছন্দে মাছ কে বরণ করে এনেছেন,
” ইলশেগুঁড়ি! ইলশেগুঁড়ি!
ইলিশ মাছের ডিম।
ইলশেগুঁড়ি ইলশেগুঁড়ি
দিনের বেলায় হিম।”
সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ’র একটি গল্প সঙ্কলন আছে- ‘ইলিশ’। আবার কবি বুদ্ধদেব বসু ইলিশকে বলেছেন ‘জলের রূপালি শস্য’। বুদ্ধদেব বসুর ‘ইলিশ’ কবিতায় পাই-
“নদীর নিবিড়তম উল্লাসের মৃত্যুর পাহাড়
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ, কেরাণির গিনি্নর ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁঝ। এলো বর্ষা ইলিশ-উৎসব।”
ইলিশকে কবি, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক আব্দুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন ‘জলজোছনা’।
“নৌকাডুবি ” উপন্যাসে রমেশ স্টিমারের খালাসিদের কাছ থেকে রুই মাছ কেনার পর কমলাকে দিলে কমলা মাছের মুড়ো রমেশকে খাওয়ায়। রমেশ তখন বলেছিলো,
” এ তো স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রম নয়, এ যে সত্যিই মুড়ো- যাহাকে বলে রোহিত মৎস তাহারই উত্তমাঙ্গ।”
মাছ বললেই ছোটোবেলার সেই ছড়াটা মনে পড়ে যায়,
” আয় আয় চাঁদ মামা
আয় আয় আয়
খোকার কপালে এসে টিপ দিয়ে যা
ধান ভানালে কুঁড়ো দেবো,
মাছ কাটলে মুড়ো দেবো।
“চোখের বালি” উপন্যাসে বিহারী তার মাসিমা রাজলক্ষ্মীর রাঁধা মাছের ঝোলের প্রশংসা করেছে।
” যোগাযোগ ” উপন্যাসে মধুসূদন অর্থ উপার্জন করে ধনী হয়ে রূপার বাসনে খেলে ও মোটা চালের ভাত,মাছ আর সাধারণ তরকারি ছাড়া তাঁর মুখে রুচত না।