রথযাত্রা উপলক্ষে জিলিপি ও পাঁপড়

সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

রথ যাত্রায় জিলাপি – পাঁপড় ভাজা

আজ রথযাত্রা। এই রথযাত্রা কে কেন্দ্র করে সারা ভারতবর্ষের নানান স্থানে ধূমধাম করে উৎসব উৎযাপিত হয়। ভারতের বৃহৎ রথযাত্রায় ওড়িশার পুরীর নাম অগ্রগন্য। পশ্চিম বাংলার মায়াপুরের ইসকনের রথ, মাহেশের রথ, গুপ্তিপাড়ার রথ,মহিষাদলের রথ ও রাজবল হাটের রথ বাঙালির ধর্মীয় আবেগের সাথে মিশে আছে। শৈশবের দোরগোড়ায় থাকা শিশুদের কাছে  রথযাত্রা হলো কাঠের ছোটো রথে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে বসিয়ে নকুলদানা এবং ফুলের অর্ঘ্য নিবেদন করে বাড়ীর পথের সামনে রথ টানা। ঘন্টাধ্বনিতে আকৃষ্ট গুরুজনেরা ভালোবেসে এক – দুই টাকা দিলে সেই অর্জনের  আনন্দ ও বিরাট। একটু বেশী পয়সা থাকলে নকুলদানার বদলে গুজিয়া জগন্নাথের পাতে চলে আসে।  এই বয়সে ধর্মীয় বিশ্বাসের বদলে  উৎসবের আমেজ হলো প্রধান।
তবে পুরীর রথ যাত্রা বিশ্বের দরবারে সমাদৃত। উৎসবের দিন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার কাঠের মূর্তি বড় দেউলের গর্ভগৃহ থেকে বের করে কাষ্ঠ নির্মিত বিরাট তিনটি রথে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে গন্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই তিনটি রথের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। প্রথম যাত্রা শুরু করেন বলরাম।  তালধ্বজ রথে চেপে বলরামের যাত্রা শুরু হয়। এই রথের উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট, চোদ্দটি চাকা বিশিষ্ট এবং রথের আবরণের  রঙ নীল। দ্বিতীয় রথের নাম দর্পদলন। এই রথে চড়ে বোন সুভদ্রা বলরামের অনুসারী হন।বারোটি চাকা বিশিষ্ট, তেতাল্লিশ ফুট উচ্চ এই রথের আবরণ লাল বর্ণের। রথের ধ্বজায় পদ্ম চিহ্ন আঁকা থাকায় এর অপর নাম পদ্মধ্বজ। তৃতীয় রথে স্বয়ং জগন্নাথ যাত্রা করেন। হলুদ আবরণের এই রথের চাকার সংখ্যা ষোলটি এবং উচ্চতায় পয়তাল্লিশ ফুট। এই রথের নাম নন্দীঘোষ তবে রথের পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি অঙ্কিত থাকায় রথের অপর নাম কপিধ্বজ।  আষাঢ় মাসের শুক্লা তৃতীয়া  তিথিতে পালিত রথ যাত্রার আগের  পনেরো দিন হলো জগন্নাথের স্নানযাত্রা। এই পনোরো দিন জগন্নাথ অসুস্থ থাকায় ছাপান্ন ভোগের পরিবর্তে মন্দির দ্বার রুদ্ধ করে আয়ুর্বেদিক ভোগ পথ্য রূপে নিবেদন করা হয়। পলতা পাতার রস, মিছরি, ছোলার নৈবেদ্য নিবেদনের মাধ্যমে জগন্নাথ দেবের দ্রুত আরোগ্য কামনা করা হয়। তাই পনোরো দিন পর রুচি ফেরানোর জন্য বাঙালি রথযাত্রায় জিলাপি এবং পাঁপরের সংযোজন ঘটিয়েছে। বাঙালির কাছে রথযাত্রা মানেই বৃষ্টি, রথের মেলায় জিলাপি আর পাঁপর ভাজা খাওয়ার ঔৎসুক্য।

এবার আসি জিলাপির ইতিহাসে।জৈন সাধু জিনসূর রচিত ” প্রিয়ংকর রূপকথা ” গ্রন্থে ধনী বণিকদের নিয়ে আয়োজিত নৈশভোজের বর্ণনায় জিলাপির কথা আছে। সেখানে  মিষ্টি রসে ডোবানো ময়দার তৈরী গোলাকৃতি, চক্রাকার,প্যাঁচানো ভাজা সুস্বাদু একটি খাদ্যের কথা বলা হয়েছে। আবার ১৫ শ শতকে সংস্কৃত ভাষার পুথিতে ‘ কুন্ডলিকা’ ও ‘ জালাভালিকা’ নামে দুটো মিষ্টির কথা জানা যায়। গবেষকদের মতে, এগুলোই হলো জিলাপি। তবে বাঙালির জিলাপি অবাঙালিদের কাছে ‘ জালেবি ‘, ইরানে ‘ জালাবিয়া’, মালদ্বীপে ‘ জিলিপি’, লিবিয়া- আলজেরিয়ায় ‘ জিলিবিয়া’ এবং নেপালে ‘ জেলি’ নামে পরিচিত। ভোজন রসিক জাহাঙ্গীর এই জিলাপির রসে, স্বাদে বশ হয়েছিলেন। মুঘল খানসামার তৈরী প্যাঁচালো মিষ্টি খেয়ে তিনি সেই পদের নাম রাখেন ” জাহাঙ্গিয়া”। এই জাহাঙ্গিয়া বা জিলাপি মুঘল রান্নাঘরে পাকাপোক্ত জায়গা করে নেয়।তবে “অক্সফোর্ড কম্প্যানিয়ন টু ফুড” অনুযায়ী জিলাপির প্রাচীন বর্ণনা রয়েছে মুহাম্মদ হাসান আল বাগদাদীর লিখিত ত্রয়োদশ শতকের রান্নার বইয়ে।মধ্যপ্রাচ্যের খাদ্য বিষয়ের  গবেষক ক্লডিয়া রডেনের দাবি ত্রয়োদশ শতকের পূর্বে ইহুদীরা হানুক্কাহ উৎসব  পালনের জন্য ” জালবিয়া” তৈরী করতো। ঐতিহাসিক অ্যাংলো শব্দকোষ ” হবসন- জবসন” এ উল্লেখ করা হয়েছে যে,  ভারতীয় শব্দ ” জালেবি” এসেছে আরবী ” জুলিবিয়া ” কিংবা ফারসি ” ” জুলবিয়া” শব্দ থেকে। ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ  পরশুরাম কৃষ্ণ পোড়ের লেখা ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত ” দ্য নিউ ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকুয়ারি ” জার্নাল থেকে যায়, ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বেই সংস্কৃত ভাষায় রচিত ” গুণ্যগুণবোধনী” পুথিতে জিলাপির উল্লেখ আছে। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে রানী দীপাবাঈ এর সভাকবি  রঘুনাথ দক্ষিণ ভারতের খাবার নিয়ে ” ভোজন কুতূহল” নামের  রন্ধন গ্রন্থে জিলাপি তৈরীর পদ্ধতির বিবরণ দিয়েছেন। বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর দামোদর শেঠের মহা সমারোহে ভোজনের জন্য ঝড়িয়াতে জিলাপির রেটের খোঁজ নিতে বলেছিলেন। রবি ঠাকুর স্বয়ং মান কচুর জিলাপি খেতে ভালোবাসতেন।  কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ স্মৃতিচারণায় লিখেছেন,
” একদিন বাবা যখন মা কে মান কচুর জিলাপি করতে বললেন মা হেসে খুব আপত্তি করলেন কিন্তু তৈরি করে দেখেন এটাও উৎরে গেলো।”
বর্ধমান রাজ মহারাজাধিরাজ মহতাবচন্দ বাহাদুরের আদেশানুসারে  লিখিত ” পাকরাজেশ্বরঃ” বইয়ে মানকচু দিয়ে জিলাপি তৈরীর উল্লেখ আগে থেকেই পাওয়া যায়। রমজান মাসে পারস্যে  গরীবদের এই মিষ্টি দান করা হতো। এখন ও ইফতারের সাথে জিলাপির গাটছড়া বাঁধা রয়েছে।

এবার আসি পাঁপড়ের কথায়। পুরীর জগন্নাথের খাবার তালিকায় পাঁপড় ব্রাত্য হলে ও বাঙালির রথের মেলা পাঁপড় ছাড়া অচল। শোনা যায় পাঁপড় উত্তর ভারত মূলত পাঞ্জাবের খাবার। তবে কবি কৃত্তিবাস তার কাব্যে ভরদ্বাজ মুণির আশ্রমে শ্রীরামচন্দ্র ও তাঁর সত্তর অক্ষৌহিনী সেনার জন্য যে বাঙালী ভোজনের আয়োজন করেছিলেন, সেখানে তিনি লিখেছেন,
” কলাবড়া তালবড়া আর ছানাবড়া
ছানাভাজা খাজা গজা জিলাপি আর পাঁপড়া
সুগন্ধি কোমল অন্ন পায়স পিষ্টক
ভোজন করিল সুখে রামের কটক।”
রথের মেলা কবিতায় লেখা হয়েছে,
” ওই আমার সাথে আজ রথের মেলায় যাবি?
ফুচকা পাঁপড় জিলাপি আর বাদাম ভাজা খাবি?”
আসলে বাঙালির পাতে যাই পড়ুক, তাদের সমাদরে বাঙালি গ্রহণ করে। তাই খাবারের ইতিহাস যাই হোক না কেন,  রথের মেলায় পাঁপড় আর জিলাপির লোভে দোকানে লাইন পড়ে যায়। কড়াইয়ের গরম তেলে ভাজা জিলাপি আর মচমচে পাঁপড় না হলে রথযাত্রা যেন ঠিক জমে না।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *